Sandip Ghosh

Horror Children

3  

Sandip Ghosh

Horror Children

ভূতের মৃত্যু

ভূতের মৃত্যু

12 mins
327



ভিড়ে ঠাসা বাসটি যত গন্তব্যের দিকে এগোয় ভিড় একটু একটু করে পাতলা হতে শুরু করে | ভূতনাথবাবু ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নেন | ঘড়িতে এখন কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যে পাঁচটা বেজে চল্লিশ মিনিট | ওঁর পাশের সিট্ এখন ফাঁকা | একটু রিলাক্স মুডে বসে দেহের জড়তাগুলো কাটান ভূতনাথবাবু | ও! আজ যা গেল সারাটাদিন, একে লাস্ট বাস তাই তার উপর বাদুড়ঝোলা অবস্থা ! কোনোরকমে ভিড়ের ধাক্কা সামলে কে এক মহানুভব--- 'সরখেলবাবু'র বদান্যতায় সিটে বসার একটু জায়গা হয়েছিল | 'জয় বাবা ভোলনাথ'-'জয় বাবা ভোলানাথ' বলে দুই হাত কপালে ঠেকান | বাস ছুটছে ……| কাচের জানলার ওপারে রাস্তার ধারে থাকা গাছ , ইলেকট্রিক স্তম্ভগুলো একটু একটু করে আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে | কন্ডাক্টর বলেছে জামবনি স্টপেজ এলেই ডেকে দেবে | এখনো কিছুটা পথ বাকী | সাড়ে ছটা বেজে যাবে মনে হয় | ভূতনাথবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রাইভার'স কেবিন সহ বাসের ভেতরের পুরোটাই একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেন | একেবারে পেছনের দেওয়ালের সিটে ডানদিক ঘেঁসে কম্বলমুড়ি দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে একজন চুপচাপ বসে আছে | ভুতনাথবাবু বিস্মিত হলেন ! নেহাত উপায় ছাড়া একেবারে পেছনের সিটে সাধারণত কেউ বসতে চায় না | প্রবল ঝাঁকুনির ভয়ে | অথচ লোকটা সামনের দুটো সিট্ ফাঁকা সত্বেও পেছনে বসার কারণ বোধগম্য হোল না ভুতনাথবাবুর ! কে জানে হয়ত তার ইচ্ছে হয়েছে ! আজকের জার্নিটার কথা ফের মনে হতেই ভেতরে অস্বস্তির সূচক মাত্রা যেন বাড়তে লাগল | ভাগ্নাদের আবদার তাদের একমাত্ৰ মামাকে এবার আসতেই হবে | তার ছোট ভাগ্নার বিয়ে যে ! কি আর করা যাবে ! সেই সকাল সাড়ে নটায় বাসে উঠেছেন এখনো দিদির বাড়িতে পৌঁছতেই পারলেন না | ব্রেকজার্নি মানে বাস-ট্রেন-বাস, আবার এই বাস যা তাকে এখনো নিয়ে চলেছে গন্তব্যে | তারপর আজকের শেষ জার্নিটা হবে বাইকে | অবশ্য এইরকমই কথা হয়েছে ভাগ্নের সঙ্গে | সন্ধ্যে নামতেই ঠান্ডাটা মনে হচ্ছে বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে | ভুতনাথবাবু বাঙ্কার থেকে ব্যাগ নামিয়ে খোলা হাতদুটোতে হ্যান্ডগ্লাভস পরে নিলেন | পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে কম্বলমুড়ি দিয়ে বসা লোকটিকে দেখতে গিয়ে তাজ্জব বনে গেলেন, বেশ ভয়ও পেলেন | আরে একি ! কম্বল চাপা দিয়ে বসে থাকা লোকটা গেল কোথায় ? ঘাড় ঘুরিয়ে সামনের দিকটাও দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন বাসে লোকটা নেই | প্রথমবার দেখার পর এখনও অব্দি বাস কোথাও দাঁড়ায়নি ! তাহলে ! কি হোল ব্যাপারটা ? বছর পঁচিশের কন্ডাক্টর পাশেই একজনের টিকিট করছিল | প্রশ্ন শুনে ও ভূতনাথবাবুর চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখে বলল ; ---------"আজ্ঞে না মশাই , পেছনের সিটে কেউ ছিল না , পাঁচটা স্টপেজ আগে একই জায়গার চারজন বসেছিল,ওরা অনেকক্ষণ আগে নেমে গেছে | তারপর থেকে পেছনের দেওয়ালের সিটে কেউ বসেনি | আপনি কি দেখেছেন জানি না, তবে বাসে পুরো কম্বল ঢাকা নিয়ে কেউ বসেছিল আমার চোখে পড়েনি |" বাসের অন্যান্য যাত্রীরাও কন্ডাক্টরের সঙ্গে সহমত পোষণ করে | কন্ডাক্টর যাইবলুক না কেন, কিন্তু ভূতনাথবাবু নিজের চোখে দেখা লোকটা বেমালুম গায়েব হয়ে গেল কি করে ! ভাবতে ভাবতে তাঁর সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায় | যাইহোক তিনি পকেট থেকে ফোন বের করে ভাগ্নাদের প্রায় পৌঁছে যাওয়ার খবর দেওয়ার জন্য ফোন কাণে ধরেন | কিন্তু একি ! ফোন তো নট রিচেবল্ বলছে ! অনেকবার চেষ্টা করলেন ফোন হোল না | তবে কি নেটওয়ার্ক প্রবলেম্ ! দেখলেন একদম তাই | জামবনি মোড়ে ভাগ্না আসবে বাইক নিয়ে , তারপর তার সঙ্গে চলে যাবে | বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে ফাঁকা সিটে পুরো শরীরটাকে এলিয়ে টান টান করে বসলেন ভূতনাথবাবু |


       সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল, ----"জামবনি-জামবনি কে আছেন ? উঠে আসুন |" কন্ডাক্টরের ডাকে তন্দ্রা কেটে গিয়ে হড়বড়িয়ে উঠে পড়েন | তারপর ব্যাগ কাঁধে সোজা গেটের কাছে | ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন ভূতনাথবাবু , না তিনি ছাড়া আর কেউ জামবনির প্যাসেঞ্জার নেই | ঘড়ি দেখলেন , ছটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গেছে | বাস থামল, ভূতনাথবাবু নামলেন | বাস চলে যেতেই বাসের হেডলাইটের আভা মিলিয়ে গেল | চন্দ্রালোকিত সন্ধ্যে বেলাও যেন নিশিপোকার জোরালো আওয়াজে গভীর রাত্রির গা ছমছমের মুহূর্ত ! না কেউতো নিতে আসেনি | ফোন কাণে নিলেন, না কোন রিং হচ্ছে না ! বার বার চেষ্টা করেও বিফল হলেন | এখন উপায় কি ? মাত্ৰ এক কিমি তো পথ,হেঁটেই যাওয়া যাবে | অনেকদিন এদিকে আসা হয় নি | রাস্তাঘাট যে কোনদিকে ঠিক বুঝে ওঠা মুশকিল ! শেষ আসা হয়েছিল বছর পঁচিশেক আগে, ছোট ভাগ্নার অন্নপ্রাশন্নে |এইসব ভাবতে ভাবতে দেখলেন, ফুট ষাটেক দুরে বোধহয় বেশকিছু রাস্তার ধারের দোকানঘর, চাঁদের আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে , তাতে মনে হচ্ছে টিম টম করে লন্ঠন জ্বলা একটা দোকান খোলা আছে | ভূতনাথবাবু সেদিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে খনখনে হেড়ে গলায় বলে বলে ওঠে; -------"আঁরে ওঁ মঁশাই , উঁদিকে চঁললেন কুঁতা, আঁপনার পঁত্ তঁ ইঁদিকে | গা ছমছমে পরিবেশকে অগ্রাহ্য করেন কি করে ! ভূতনাথবাবু পিছন ফিরে দেখেই ভয়ে শিউরে উঠলেন ! সেই কম্বলে ঢাকা বাসের ভিতরে থাকা লোকটা এখানে কি করে এল ! মাথায় আঁচল টানার মতো কম্বলটা টেনে নামানো , মুখমন্ডল গাঢ় অন্ধকারে পরিপূর্ণ যেন গিলতে আসছে ! ভীষণ ভয় পেয়ে ভূতনাথবাবু হনহন করে খোলা থাকা দোকানটির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন | দোকানের কাছে পৌঁছে পেছনে তাকান | লোকটা নেই | যাঃ বাবা বাঁচা গেল ! দোকানটি চায়ের | দোকানদার জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত | এইসময় হন্তদন্ত হয়ে দোকানের সামনে উপস্থিত আগন্তুককে দেখে ঘাবড়ে গেল দোকানের মালিক | ভয়ে ভয়ে জিঞ্জেস করে; --------"কে-কে আপনি ?" ভূতনাথবাবু বললেন; ------ "আমি ভূতনাথ চক্রবর্তী, এইমাত্ৰ বাস থেকে নামলাম | যাব দিদিরবাড়ী গোলকপুর | ভাগ্নের বিয়ে কিনা, তা রাস্তাটা কোনদিকে বলতে পারেন ?" গোলকপুর শুনে দোকানদার অবাক ! বলে; -------"আপনি এই জামবনিতে নেমেছেন কেন ? গোলকপুর তো এখানে নয় , সে তো আরো দশ কিলোমিটারের পথ, জপবনি থেকে সোজা পূর্বে প্রায় দুই কিলোমিটার যেতে হবে | আপনি জপবনির বদলে জামবনিতে নেমে পড়েছেন |" এবার ভূতনাথবাবুর পা থেকে মাটি যেন সরতে শুরু করেছে | তিনি মাথায় হাত দিয়ে দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চিতে ধপ্ করে বসে পড়লেন | দোকানদার আরো কিছু জিনিস গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে; -------"ও মশাই , ভাগ্নেকে ফোন করেছেন ?" ফ্যাল, ফ্যাল করে চাঁদের আলোমাখা অন্যমনস্ক চোখে তাকান ! ------" বলি ফোনটোন করা হয়েছে ভাগ্নেকে ? এবার কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ভূতনাথবাবু বলেন ; -------- "হ্যা, বড্ড নেটওয়ার্ক প্রবলেম, বুঝলেন | ফোনে কাউকেই পাওয়া গেল না |" ------"তবে আর কি ! ঠ্যালা সামলান | এই ভূতুড়ে জায়গায় আপনি ফেঁসে গেছেন | নিন্ এবার বেঞ্চিটা ছাড়ুনতো , এখানে আর বেশিক্ষণ নয় |" বলে দোকানদার বেঞ্চিটা ঢুকিয়ে ঝপাঝপ দোকানের সাটার নামিয়ে তালা মেরে দ্রুত অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল | ভূতনাথবাবু পিছু পিছু যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু দোকানদারের হাঁটার গতির কাছে হার মানতে বাধ্য হন | অগত্যা-- পুনরায় সেই দোকানের সামনে ফিরে এসে দাঁড়ান | রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ বড় বড় গাছ ছাড়া আশেপাশে তেমন একটা গাছ নেই | জামবনি মোড় থেকে সোজা পূর্ব দিকে মোরাম বিছানো একটা রাস্তা চলে গেছে | এর শেষ কোথায় কে জানে ! শুনশান চাঁদনি রাতের মহিমায় ঝরা আলোয় স্নাত গাছ-গাছালির সৌন্দৰ্য্য ভূতনাথবাবুর বড়ই প্রিয় | কিন্তু আজ তার ব্যাতিক্রমী মুহূৰ্ত | ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক আরো চড়া ও কর্কশ হয়ে নিঝুম নিস্তব্ধ পরিবেশটাকে আরো ভয়ঙ্কর রহস্যময় করে তুলেছে | দুরে কোথাও শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক শুনে তিনি চমকে উঠলেন | ফড় ফড় করে মাথার উপর দিয়ে কি যেন চলে গেল !

      এই নির্জনে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না | ভয়ে কাঁপতে শুরু করলেন | 'জয়বাবা ভোলানাথ'-জয়বাবা ভোলানাথ' মন্ত্র আওড়াতে লাগলেন | যত রাত বাড়ছে এলাকাটা যেন তত দুর্গম হয়ে উঠছে ! মন্ত্রের কৃপায় হোক আর যাই হোক , এই মুহূৰ্তে মনে কিছুটা বল ফিরে পেয়েছেন ভূতনাথবাবু | আরে ওটা আবার কি ! প্রায় পনেরো ফুট দুরে একটা ছায়ামুর্তি দাঁড়িয়ে আছে না ! মনে হচ্ছে এদিকেই এগিয়েই আসছে | দুধসাদা চাদরে ঢাকা পা থেকে মাথা পর্যন্ত | ভূতনাথবাবু বুকভর্তি শ্বাস নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করেন ; -------"কে-কে ওখানে ?" ছায়ামুর্তির ভেতর থেকে খনখনে ভাঙা গলায় জোরালো উত্তর এল ; ---------" কিঁ! এঁতবড় আঁস্পর্দা ! আঁমার এঁলাকায় ডুঁকে আঁমাকেই পঁশ্ন কঁরা হঁচ্চে আমি কেঁ !" ভূতনাথবাবু খানিক থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নেন | ছায়ামুর্তি বলে চলে ; ---------" আঁপনি গোঁকুলপুর যাঁবেন ? তাঁ মঁশায়ের পঁত্ টো কিঁ জাঁনা আঁচে ?" যা-বাবা ! বিয়েবাড়ির পরিবর্তে শেষে কিনা ভূতের আখড়ায় ! চটপট জবাব দেন; --------" না জানা নেই !" তা আপনার পরিচয় জানতে পারি কি?" ছায়ামুর্তির ভেতর থেকে খ্যাঁকখ্যাঁকে বিচ্ছিরি রকমের হাসি বেরিয়ে আসে | বলে; --------" নিঁচ্চই-নিঁচ্চই, আঁমার নাঁম তেঁলোপদ সাঁমন্ত , ভূঁতে-মঁনিষ্যে তেঁলো বঁলেই ডাঁকে | আঁমি তাঁকি গোঁকুলপুর যাঁবার পঁতে তাঁলসাঁরিতে | আঁর তাঁরপরেই গোঁকুলপুর | যাঁবেন নঁকি আঁমার সঁঙ্গে ?" ভূতনাথবাবু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানান | একবার করে শীতের কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে | ভয়ের চোটে ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে পড়েছিলেন | তাই এই ঠান্ডা হাওয়া এখন মন্দ লাগছে না ভূতনাথবাবুর | তিনি যে ভূতের পাল্লায় পড়েছেন, এটা বেশ বুঝতে পারছেন | সন্মতি পেয়ে তেলো ভূতের কি নাচনকোঁদন ! কি খনা গলার বিকট হাসি ! বাঁশের বাতার মতো হাত বের করে মোরাম রাস্তাটা দেখিয়ে বলে ; -------"ইঁদিকে আঁসুন" , ইঁটা হঁল আঁপনার গোঁকুলপুঁর যাঁবার পঁত |" তেলোভূত কখনো আগে যেতে যেতে মিলিয়ে যায় তো আবার পিছনে সেই গা ঘিনঘিন করা বিকট অট্টহাসির রোল তোলে | আবার হঠাত্ চলন্ত ভূতনাথবাবুর ঘাড়ের পাশে রাক্ষুসে দাঁত বের করে খুকখুকে কাশি | এইভাবে কিছুদুর যাওয়ার পর তালসারিতে পৌঁছেই তেলো ভূত হাওয়ায় মিশে যায় |

এদিকে ভূতনাথবাবুর ভাগ্নারা বাসমালিকের সাথে পরিচয় থাকার সুবাদে কন্ডাক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মামার জামবনি মোড়ে নেমে যাওয়ার কথা জানতে পারে | শুনে তাদের মাথায় হাত ! তড়িঘড়ি বাইকে করে চলে আসে জামবনি মোড়ে | চারপাশ ভালো করে খুঁজে না পেয়ে তারা হতাশ ও চিন্তিত হয়ে ফিরে যায় | এলাকাটা যে ভূতবাবাজীদের ডেরা, ভাগ্নাদের অজানা নয় | তাহলে কি মামা ভূতের খপ্পরে পড়ল নাকি ! তাদের আন্দাজ যে মিথ্যে নয় তাদের মামা বেশ টের পাচ্ছেন | মামা ভূতনাথবাবু রাতের অন্ধকারে তালসারির দুর্গম জঙ্গলের সামনে একাকী দাঁড়িয়ে ফোনে রিং হতেই খুব দ্রুত হাত পকেটে চালান করে দেন | কিন্তু কাণে তোলবার আগেই ফোন নিস্তব্ধ হয়ে যায় | একইভাবে তিনবার হওয়ার পর ফোনের আশা ছেড়ে চুপচাপ দুর্গম-নির্জনে মায়াবী জ্যোত্স্নার জালে নিজেকে সঁপে দিয়ে ধপ্ করে বসে পড়েন শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর |

       ভয় যেন কোথায় গায়েব হয়ে গেছে ! খিদেতে পেটে জ্বালা ধরতে শুরু করেছে | সদরে বাসে উঠবার আগে একজন হকার একডজন কলা কিনবার জন্যে অনেক করে বলেছিল | না নেওয়াটা ভুল হয়েছে | খিদে ক্রমশঃ উর্ধ্বগামী………| এবার অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে পেটে | ভূতনাথবাবু ক্রমাগত খিদের উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছেন | না আর পারা যাচ্ছে না | শরীর হঠাত্ কেমন যেন শিথিল হয়ে এল ! শান্ত হয়ে অচেতন হয়ে পড়লেন | কতক্ষণ এরকম কেটে গেছে কে জানে, গায়ের রক্ত জল করা অট্টহাসির তীব্ৰ বিকৃত চিত্কারে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন | চোখ পিট্ পিট্ করে দেখতে থাকেন, তার চারপাশটা কেমন যেন প্রায় এক'শ ফুট দুর অব্দি ঝকঝকে শুভ্র আলোয় আলোকিত ! ভয়টয় ভুলে ভূতনাথবাবু এই দুর্গম অরণ্যে ছেলেমানুষ হয়ে উঠেছেন ! 'আমি খাব গো, আমার খিদে পেয়েছে গো, আমায় খেতে দাও গো' বলে অদ্ভুত আবদারসূচক চিত্কার জুড়ে দিলেন | বিভত্স হাড়হিম করা হাসির মাঝে দাঁড়িয়ে অবিরাম ভূতনাথবাবুর ক্ষুধার্ত শরীর প্রকৃতির সবকিছুকেই লোভনীয় সুস্বাদু আহার দেখছে | চোখ শুধু বাই বাই করে ঘুরছে কোনটা ছেড়ে কোনটা আগে খাবে | ভূতের দল ভূতনাথবাবুকে ঘিরে গোল হয়ে পাক খেতে খেতে উদ্দাম নৃত্যে মশগুল | ভয়ংকর গর্জন আর বজ্রবিদ্যুতের মতো আলোর ঝলকানি ভূতনাথবাবুর একটা চুলকেও ওড়াতে পারেনি | আঁখুভূত মানে ভূতেদের সর্দার তেলোভূতকে বলে ; --------"তেঁলো তুঁই বেঁশ বাঁলো নাঁদুসনুঁদুস মঁনিষ্যি এঁনেচিস বঁটে, অঁনেকদিন মঁনিষ্যির ভুঁড়ি দিঁয়ে পঁটলের ছেঁচকি খাঁইনি, তুঁই রেঁধে আঁমাদের সঁবাইকে খাঁওয়া দিঁকি !" আমতা আমতা করে তেলোভূত বলে; -------- " শিঁকার'ট তো……আঁ- আঁমি এঁনেচি বঁস্ , রাঁন্না'ট অঁন্য কেঁউ কঁরতে পাঁরে | আঁমি কেঁলান্ত হঁয়ে পঁড়েচি |" সর্দার ভূত তার পেকাটিমার্কা ঘাড় একবার এদিক, একবার ওদিক ঘুরিয়ে কি যেন খুঁজতে থাকে | তারপর ভড়ভড়ে খনা গলায় ডাকে ; --------ওঁরে খাঁজু কুঁতায় গেঁলিরে ? আঁয় বাঁপ তুঁই রাঁন্না'ট কঁরে দেঁ |" খেজোভূত ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে বলে; ---------"এঁজ্ঞে গুঁরু …তাঁ আঁমি কঁরতে পাঁরি বঁটে, তঁবে আঁমার হেঁলপার হিঁসাবে তেঁলোকেই চাঁই | কিঁ গুঁরু পাঁব তঁ ?" তেলোভূত রেগে অগ্নিশর্মা , চেঁচিয়ে বাজখাই গলায় বলে; -------" বঁস ইঁটা কিঁন্ত বাঁলো হঁচ্চে নাঁই , আঁমি অঁনেক কাঁজ কঁরেচি, মঁনিষ্যিটা ইঁখানে উঁড়ে আঁসে নাঁই, ইঁটা আঁগে সঁবার ভাঁবা দঁরকার ! "

        কোলোভূত বসে ছিল সর্দার আঁখুভূতের গা ঘেঁসে | কেলোভূত খলখলিয়ে হেসে উঠে বলে; ------"বঁস্ উঁয়াদের টাঁয়ার পাঁচার, তঁবে তুঁমি যঁদি বঁল আঁমি কাঁজ'ট উঁদ্দার কঁরে দিঁতে পাঁরি , কিঁন্ত হ্যাঁ, ছেঁচকির ভাঁগ'ট আঁমার বেঁশি চাঁই | বঁস্ তুঁমি রাঁজি ?" সর্দারের চোখে না পড়তে হয় সেজন্য আমুভূত এতক্ষণ তেলোভূতের পিছনে চুপটি করে বসেছিল | ছেঁচকির ভাগের কথা শুনে আমুভূত ষোল হাত লম্বা লকলকে জিভ বের করে ভূতনাথ বাবুর সারা শরীর চেটে নেয় , তারপর আনন্দে বলে ; --------"গুঁরু আঁমাকে কেঁলোর হিঁল্পার কঁরে দাঁও, আঁমি রাঁন্না'টঁতে কেঁলোকেঁ সাঁহায্যিঁ কঁরতে পাঁরি | তুঁমি তঁ জাঁনই গুঁরু যেঁ, আঁমার মঁনিষ্যি ভুঁড়ির চেঁচকি পিঁয় কাঁদ্য" আখুভূত, আমুভূতকে কেলোভূতের হেল্পার করে দেয় | তারপর ভূতেদের দল মহাভোজের সূচনা পর্বে ভূতনাথবাবুকে ঘিরে নাকি সুরে গান আর উদ্দাম নৃত্য শুরু করে | এদিকে ভূতনাথবাবু 'জয় বাবা ভোলানাথ, জয় বাবা ভোলানাথ' মন্ত্রধ্বনি করতে করতে কখন যে বৃহদাকার দৈব শক্তির আধারে আবির্ভূত হয়েছেন, টেরই পায় নি উল্লাসে মেতে থাকা ভূতেরা | ভূতনাথবাবু হো-হো করে হাসতে শুরু করলেন | হাসির চোটে সারা তালসারির জঙ্গল কাঁপতে শুরু করেছে | গোল গোল লাল চোখ করে আঁখু সর্দার কেলোকে বলে ;----------" ওঁরে কেঁলো মঁনিষ্যিঁটার কিঁ হোঁল রেঁ ?" 'কেলো' শব্দকে কলা শুনে ভূতনাথবাবু তড়াক করে উপরের দিকে এক লাফ মেরে 'কলা খাব, কলা খাব' করে চিত্কার জুড়ে খুঁজতে লাগলেন ; ------"কোথায় কলা……কোথায় কলা……? হ্যাঁ দেখতে পেয়েছি |" কেলোর দিকে আঙ্গুল তুলে বলতে থাকেন ; --------"ঐ যে কলা, এক্ষুণি খাব |" বলেই হিংস্র জন্তুর মতো লাফিয়ে পড়লেন কেলোভূতের উপরে ! কেলোভূত কিছু বুঝে ওঠার আগেই কচি ছাগলের মতো কেলোর গলাটা মট্ করে ভেঙ্গে মাথাটা মুখে পুরে নিলেন | তারপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কেলোভূতের বাকী অংশটাও পেটে চালান করে দিলেন | এইকান্ড দেখে সর্দার আঁখুভূত হকচকিয়ে যায় , মিনমিনে গলায় বলে; --------" ওঁরে ওঁ তেঁলো ঐঁ মঁনিষ্যিটাকে তুঁই কোঁথা থেঁকে এঁনেচিস্ বাঁপ্ ? কেঁলোকেঁ যেঁ সাঁবড়ে দিঁল রেঁ ! এঁবার কিঁ হঁবে ?" তেলোভূত তার তালপাতার মতো এক'শ একাশি ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে নেমে পড়ে ভূতনাথবাবুর সন্মুখে | তারপর খনখনে ভারী গলায় বলে; --------" চিঁন্তা কোঁরো নাঁ বঁস্ , আমি এক্ষুণি মঁনিষ্যি'টর ভুঁড়ি নাঁমিয়ে রাঁন্না সেঁরে ফেঁলচি |" ভূতনাথবাবু শ্বাস টেনে তালের গন্ধের সুবাস নিচ্ছেন ! যেন ঐ গন্ধে ম-ম তে ভরে উঠেছে চারিদিক, তার আনন্দ আর ধরে না !

      কেলোর মতো তেলোরও ঐ অবস্থা দেখে সর্দার আঁখুভূত সহ প্রতেকেই চম্পট দেবার চেষ্টা করে | ভূতনাথবাবু গাছের ডালপাতা দিয়ে সবকটাকে বেঁধে ফেলেন | তারপর 'জয় বাবা ভোলানাথ', জয় বাবা ভোলানাথ'-----ধ্বনি তুলে নাচতে নাচতে জামুভূতের মাথাটা মট্ করে ভেঙে পট্ করে মুখে তুলে নেন | বেগতিক বুঝে ভয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয় আঁখু ভূত , কাঁদতে কাঁদতে বলে; -------" উঁরে বাঁবা রেঁ, আঁমাদের খেঁয়ে ফেঁললে রেঁ , ওঁ-হোঁ-হোঁ-হোঁ, তুঁমি কেঁ গাঁ ? কেঁমন মঁনিষ্যি গাঁ তুঁমি ? আঁমাদের এঁক এঁক কঁরে সাঁবড়ে দিঁচ্চ ? আঁমাদের ছেঁড়ে দাঁও গোঁ ------" বেঁচে থাঁকতে আঁমি ন্যাঁতা (নেতা) হঁব হঁব কঁরে হঁতে পাঁরিনি, কিঁন্ত মঁরার পঁরে ভেঁবেছিঁলম ভূঁতের জেঁবনটাঁ ন্যাঁতাগিঁরি কঁরেই কাঁটাব, কিঁন্ত এঁখন দেঁকচি ইঁটা আঁর হোঁলনি |" না ! ভূতনাথবাবুর কাণে পৌঁছয়নি আঁখু সর্দারের আর্ত চিত্কার | ইক্ষু গাছের ছালের মতো আঁখু সর্দারের গায়ের ছাল ছাড়িয়ে চিবিয়ে চুসে ছিবড়ে করে ছুড়ে ফেলে দেন | ভূতনাথবাবু ছেলেমানুষের মতো দুই হাতে আমু, জামু, খাজু,ঢেঁড়ু মানে যত ভূত ছিল সবাইকে গোগ্রাসে গিলে কিম্বা চিবিয়ে খেয়ে ফেললেন | এখন থেকে তালসারির জঙ্গলে ভূতের রাজত্ব শেষ | খেয়ে দেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন ভূতনাথবাবু | বিশাল এক বৃক্ষ অশ্বত্থের নীচে এসে বসে পড়লেন | কতটা সময় পার হয়ে গেছে জানা নেই, টাওয়ার লোকেশন্ ট্র্যাক করে পুলিশের গাড়ী ভাগ্নাদের নিয়ে যখন তালসারির জঙ্গলে এসে পৌঁছয় তখন ভোরের আলো ফুটতে আর কিছুটা সময় বাকী ! ভূতনাথবাবু ধ্যানেমগ্ন, অশ্বত্থের নীচে একাগ্রচিত্তে তার গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরে ' জয় বাবা ভোলানাথ', 'জয় বাবা ভোলানাথ' উচ্চারিত হয়ে চলেছে


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror