Sandip Ghosh

Inspirational Others

3  

Sandip Ghosh

Inspirational Others

কৈশোরে করোনার থাবা

কৈশোরে করোনার থাবা

7 mins
224



দেখতে দেখতে শীতও এসে গেল | ঠান্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে | এই ঠান্ডাতেও উত্তরের বন্ধ জানালা খুলে একটি চেয়ার নিয়ে বসে পড়ে হিমিকা | হিমেল হাওয়া এসে তার ঝিমিয়ে পড়া প্রাণে খানিকটা শান্তির অনুভূতি উপহার দিয়ে যায় | মনে মনে ধন্যবাদ দেয় আপনছন্দ নিয়ে মেতে ওঠা প্রকৃতির অংশ শৈত্যপ্রবাহিনীকে | তবুও যেন অসাড় মনে হয় তার নিজেকে | অনুতাপের জ্বালায় পুড়ে মরে | সকালের ঘটনাটায় নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকে | কেন যে শুধু শুধু তার ছোটবোন সারিকাকে এতগুলো কথা শোনাতে গেল ! ফোন তো সেও কম ঘাটে না | ফোন চার্জে বসানো নিয়ে ঝামেলা | বোন কেন, ও- তো নিজেই চার্জে বসাতে পারত | আজ দুপুর আড়াইটের সময় ফিজিক্সের অনলাইন ক্লাস আছে লিপিকা ম্যাডামের | আর হিমিকার প্রিয় সাবজেক্ট ঐ ফিজিক্স | একারণেই সে মাথাগরম করে ফেলেছে | ছোট বোনটাকে তিরস্কার সহ চপেটাঘাত করতে ছাড়েনি | প্রচন্ড রাগ তার ঐ করোনা নামক ক্ষুদ্ৰ জীবটার উপর | কেমন যেন সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেল !


  ওরা দুই বোন, হিমিকা ক্লাস নাইনে পড়ে, আর সারিকার ক্লাস সেভেন | যখন তখন ওরা ফোন ঘাটার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, সুযোগ পেলেই হোল, কে আগে ফোনটা নিতে পারবে, যেন শুরু হয়ে যায় একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা | যে নিতে পারে না, শুরু হয়ে যায় তার নানা অভিযোগ-অনুযোগ, কাজ না হলে বচসা ও তার ফলসরূপ হাতাহাতি-মারপিট | অভিযোগের বিষয়টি মা-ই দেখেন | বাবা লক্ষ্মীনাথের সে সুযোগ হয়না | তিনি তো বাজারে স্টেশনারী দোকান সামলান | অবশ্য তাদের বাবার কড়া হুকুম----- পড়াশুনা ও ফোনকল ব্যতীত ফোন নেওয়া যাবে না | কিন্তু তার হুকুম-ই সার | আর মাকে তো থোড়াই কেয়ার !! মেয়েরা মারপিট করছে দেখলে হাতে ছড়ি নিয়ে দৌড়ে আসেন | তারপর হালকার উপর বেত্রাঘাত করে ওদের অভাব-অভিযোগের বন্দোবস্ত করে সমস্যার সাময়িক নিরসন করেন | এর বেশি তিনি আর কি করতে পারেন ! স্কুল বন্ধ, প্রাইভেট টিউশন বন্ধ ! করোনা এসে জীবনের সব ছন্দটুকু শুষে খেয়ে নিয়েছে যে ! স্থানীয় এলাকার লোকজন করোনায় আক্ৰান্ত হচ্ছেন | স্থানীয় সহ রাজ্য তথা দেশের সামগ্ৰিক আক্ৰান্তের সংখ্যা উর্ধগামী-নিম্নগামী পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে | স্কুল বন্ধ, দিনের পরদিন এক নাগাড়ে বইয়ে মুখ গুঁজে কতক্ষণ থাকা যায় ! যদিও মেধাবী মেয়ে দুটো মরিয়া হয়ে সবকিছুর মধ্যে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা করে | স্কুল বন্ধ থাকার সৌজন্যে ফোন-ই যে মেয়েদের একরকম বশে এনে ফেলেছে , একথা তাদের মা বেশ উপলব্ধি করতে পেরেছেন |


বাবা লক্ষ্মীনাথ বাড়িতে থাকলে ফোনের ধারেপাশে কাউকেই দেখা যায় না | তখন লক্ষ্মীমেয়ে হয়ে পড়ার টেবিলে | লক্ষ্মীনাথ সবই বোঝেন, আগে স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে দুইবোনে মাঠে সাইকেল নিয়ে চলে যেত, ওদের বন্ধুদের সঙ্গে লাফ-ঝাপ খেলাধুলা করে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরত | মেতে থাকত হাসি আনন্দে | পড়াশুনার ব্যাপারে ওরা অত্যন্ত সচেতন | এখন একপ্রকার বন্দী অবস্থায় ওদের দিন কাটছে ! উপায় নেই | অগত্যা ওদের ফোনটাই সর্বক্ষণের সঙ্গী | দু'জনের জন্য দুটো স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য নেই লক্ষ্মীনাথের | একটাতেই সময় ভাগাভাগি করে অনলাইন ক্লাস ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা, চ্যাটিং ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে | দু'জন প্রাইভেট টিউটরের সাথে কথা বলেছেন লক্ষ্মীনাথ | আগামী দু'এক দিনের মধ্যেই হয়ত তারা পড়াতে শুরু করবেন | করোনার ঝঞ্ঝাটে সরকার পরীক্ষা ছাড়াই পরের ক্লাসে প্রমোশন দেবে বলেছে | এ আর এক যন্ত্রণা তিলে তিলে ভাবাচ্ছে মেধাবী দুই কিশোরী ছাত্রীকে | চাপাকষ্ট যেন লতার মতো দেহমনে চেপে বসেছে | যদিও অনলাইনে ম্যাডামরা পরীক্ষা নিচ্ছেন তবুও দুধের স্বাদ তো আর ঘোলে মেটে না |যাইহোক আর তো মাত্র একটা মাস তারপর উত্তীর্ণ পরের ক্লাসে |


    বোন বাড়িতে নেই, বাবার সঙ্গে ডাক্তার দেখাতে গেছে | ওর চোখের কি একটা সমস্যা হয়েছে ! পড়াশুনো করতে অসুবিধা হচ্ছে | ইস্ ব্যাচারা ছোট্ট বোনটা তার, তাকে এমন করে বকতে আছে, মারতে আছে ! ভাবতে ভাবতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে হিমিকা | মাথার চারপাশে উষ্ণ জ্বালা বোধ হচ্ছে | হাত দিয়ে দেখল কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম | উত্তুরে হিমশীতল হাওয়াটাকে নেওয়ার জন্য জানলার পাল্লা দুটোকে দেওয়ালের দিকে ঠেলে দেয় | অশ্রুসিক্ত নয়নে বিষন্ন মনে উত্তরের জানলার মধ্য দিয়ে চোখ চলে যায় ভেভলি'দের বাড়ির উঠোনে | চেখের জলে ভিজে যাওয়া স্কার্টের উপর হাত দুটি নাড়াচাড়া করতে করতে একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকে | 

ভেভলিরা তাদের প্রতিবেশি | সে তখন উঠোনের একপাশে বাসনকোসন নিয়ে ধুতে ব্যস্ত | ওদের বাড়িতে মা--বাবা, ভেভলি আর তার ভাই সাবু | হিমিকার সহপাঠী ভেভলি , সাবু পড়ে ক্লাস সিক্সে | ওর বাবা বেশ বড় দুধের কারবারি | ওদের বাড়িতে পড়াশুনার তেমন চল নেই | তাহলেও এই ছেলে-মেয়ে দুটি মেধাবী না হলেও পড়াশুনা নিয়ে অত্যন্ত সজাগ | কিন্তু এই মারণ ভাইরাস করোনা ওদেরও পঠনপাঠনে থাবা বসিয়েছে | এই তো সেদিন ভেভলি দোকানে যাওয়ার সময় ওকে ডেকে হিমিকা কথা বলেছিল | পড়াশুনার কথা বলতেই ভেভলি বলেছিল; ওর মা তাকে ঘরের কাজে লাগিয়েছে | ওর মা নাকি বলেছে স্কুল খুলুক, তখন আবার পড়বি | আর ওর ভাই সাবু তার বাবার সঙ্গে দুধের কারবার নিয়ে বেশ মনোযোগী | অর্থাত্ করোনা যে পরোক্ষভাবে বহু কিশোর কিশোরীর কৈশোরকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে তা বলাইবাহুল্য | জীবনের এই ছন্দপতন বিশেষত: যারা অনুভবে ভাবিত তাদের ফ্যাকাশে অনুজ্জ্বল মুখগুলোর করুণ আর্তি কাণ পেতে শুনলেই হৃদয় মোচড় দিয়ে ওঠে | হিমিকা পরামর্শ দিয়েছিল ভেভলিকে , বলেছিল ; পরিস্থিতি যাই আসুক, যখন যেটুকু সময় পাবি পড়াশুনা চালিয়ে যাবি, বন্ধ করিস্ না | হিমিকার উত্সাহদান ভেভলিকে ভীষণভাবে অনুপ্ৰাণিত করেছে | তাই সে সন্ধ্যাবেলায় একপ্রকার জোর করে মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পড়তে বসে | কেননা তার মা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন | কিন্তু ব্যৰ্থ হয়েছেন ভেভলিকে দেওয়া হিমিকার অনুপ্রেরণা'র শক্তির কাছে |


মা ডাকেন, কি করছিস হিমু ? এদিকে আয় |এতক্ষণ একনাগাড়ে কেঁদে চলায় হিমিকার গলা ধরে এসেছে , সে ধরা গলায় উত্তর দেয় ; বসে আছি মা | মা মেয়েদের যন্ত্রণার কথা বোঝেন | আদুরে গলায় ডাকেন ; আয় মা--- আমার কাছে আয় | হিমিকা কাছে যেতেই মা ওকে বুকে চেপে ধরে আদর করেন | হিমিকা ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে | মা ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন ; জীবনে চলার পথে এরকম হাজারো সমস্যার সন্মুখীন হতে হবে | মনে জোর এনে সেই সব সমস্যার মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে |


ঠিক এই সময়ে হঠাত্ পাশের বাড়ি থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ কাণে আসে | হিমিকা তার মাকে সঙ্গে নিয়ে সদর গেট খুলে বাইরে যায় | তারপর যা শুনল তা সত্যিই বেদনাদায়ক | মা-মেয়ের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ে | পাশের বাড়ির ছয় বছরের অর্ণব নামের ছেলেটা আজ দিনদশেক একনাগাড়ে ঘর বন্দী | ওর দাদু রোজ বাইরে বেরোতেন নাতিকে নিয়ে | আর আজ তিনি গত দশদিন যাবত্ অসুস্থ , প্রায় শয্যাশায়ী | একা একা বেরিয়ে নাজানি কোথায় একটা চলে গিয়েছিল | পরিচিত কেউ পৌঁছে দিয়ে গেছে | তারপর অর্ণবের বাবা-মা ওকে অবিবেচকের মতো প্রহার করে চলেছেন | হিমিকার মা গিয়ে অর্ণবের মা-বাবাকে বোঝান | অর্ণবের চিত্কার থামে |


হিমিকা মাকে নিয়ে ফিরে আসে | এখন শীতটা বেশ অনুভূত হচ্ছে | রোদের তাপও হালকা | ওরা এসে দক্ষিণের ব্যালকনিতে বসে | হিমিকার বাবা ও বোন এখনো ফেরেনি | জেলা শহরে গেছে, বোধহয় ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যাবে ! বোনের চোখে কি হোল কে জানে ! ভাবতে ভাবতে সে আনমনা হয়ে যায় | মায়ের ডাকে হুঁশ ফেরে | মা জিজ্ঞেস করেন ; অনলাইন ক্লাস কখন আছে ? হিমিকা বলে; আড়াইটা, এখন কটা বাজে বলতো ? মা একটু ঝুঁকে ঘরের দেওয়াল ঘড়িটা দেখে বলেন ; এখন দুটো বেজে দশ | হিমিকার মা গালে হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করেন, শুধু তারই না, করোনা নামক এই বিষাক্ত প্রাণীটি সব বাচ্চারই শৈশব-কৈশোরের মানসিক বিকাশে ভয়ানক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে | প্রয়োজনে বাইরে গেলে মুখে মাস্ক আর শারীরিক দূরত্ব মেনটেইন, শৈশব-কৈশোরের ক্ষেত্রে বড়ই কষ্টদায়ক | এরা কতক্ষণ ধৈৰ্য্য রাখতে পারবে সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় | হিমিকার মায়ের মতে, এই মুহূৰ্তে তাদের পাশে থাকা, অর্থাত্ বেশি বেশি করে সময় দেওয়া সব বাবা মায়েরই উচিত | সর্বক্ষণের সঙ্গী যেগুলো তাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, যেমন খেলার মাঠ, লাইব্রেরী , ছোট্ট করে একটা ট্যুর, আর তো উত্সব আছেই, বিশেষ করে এবারের দুর্গাপুজোর আনন্দ বাচ্চাগলো সেভাবে নিতে পারেনি | ক্লাসের সময় হতেই হিমিকা চলে যায় |


কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্মীনাথ বাড়ি ফিরলেন তার ছোট মেয়েকে নিয়ে | বললেন; অতিরিক্ত ফোন ঘাটার প্রভাব পড়েছে সারিকার চোখে | মা চিন্তিত, বললেন; মা সারু, শুনলি তো-- এবার ফোন দেখাটা বন্ধ কর ! বাবা লক্ষ্মীনাথ রাগান্বিত হয়ে বললেন ; আমি বার-বার বলেছি প্রয়োজন ছাড়া ফোনে হাত না দিতে | কিন্তু কে শোনে কার কথা ! সারিকা নিশ্চুপ | যাইহোক, এখন আবার করোনার দৌলতে বাইরে বেরোলেই স্নান সেরে ঘরে ঢুকতে হয় | অগত্যা সারিকাও স্নান-খাওয়ার পর্ব মিটিয়ে নিজেদের রুমে চলে যায় | লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে | হিমিকা ক্লাস শেষ করে বোনের কাছে আসে | মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে; তোকে বকেছি-মেরেছি তোর খুব কষ্ট হয়েছে না রে ? আর বকবনা-মারবনা | ফোন আমিই চার্জে বসাব……সারিকা হাঁপুস নয়নে কাঁদতে থাকে | হিমিকা বোনকে জড়িয়ে ধরে | বোনের কান্না থামিয়ে জেনে নেয় চোখের ডাক্তার কি বলেছে ? তারপর দুই বোন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়---- প্রয়োজন ছাড়া ফোন কেউ ঘাঁটবে না |


     ওরা তো বলছে ফোন ঘাঁটবে না | ফোন থেকে নিজেদের দুরে রাখবে | কিন্তু কৈশোর মন করোনার থাবায় বিভ্রান্ত যে ! 

       



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational