Sandip Ghosh

Children Stories Action Classics

3.1  

Sandip Ghosh

Children Stories Action Classics

লিলিপুট ' দের দেশে

লিলিপুট ' দের দেশে

15 mins
652



সমুদ্রের মাঝে হরবোলা নামে ছিল ছোট্ট একটি দ্বীপ | সেই দ্বীপে বাস করত রাজা রাহানচন্দ্র ও রাণী উর্মিমালা এবং তাদের প্রজারা | সবুজের সবুজাভ প্রকৃতি আরো মোহময়ী করে তুলেছে এই হরবোলা দ্বীপকে | প্রজাদের নিয়ে রাজা ও রাণী'র বেশ সুখেই কাটছিল | মহাপ্রলয়ের সন্মুখীন হতে হবে এরকম কোনো ভাবনা উদয়ের অবস্থা ছিল না | প্রবল ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল হরবোলা দ্বীপ | ভেঙে পড়েছিল সমস্ত বাড়িঘর আর বিশাল বিশাল ঢেউরের ধাক্কায় দ্বীপের রাজা রাহানচন্দ্রের রাজ্যপাট নিমেষে ভেসে গিয়েছিল | ছিল না হরবোলা দ্বীপের আর কোন অস্তিত্ব |


  রাজা রাহানচন্দ্রের যখন জ্ঞান ফিরে তখন সবে দিনের আলো বিদায় নিতে শুরু করেছে | ভাবতে থাকে, এখানে কোথায় সে ! একটু একটু করে তার আগের দিনের ঘটে যাওয়া দুর্যোগের কথা মনে পড়তে থাকে | রাণীর কথা ভাবতে ভাবতে হাঁপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করে | রাজ্য ও রাজ্যপাট খুইয়ে রাজা এখন সর্বসান্ত, কি হবে বেঁচে ! এইসব ভাবতে ভাবতে সমুদ্ৰতটে নিকষ আঁধারে একাকী বিষণ্ণ মনে পরিত্রাণের আশা না করে নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দেয় | এমন সময় পথের দিশারী হয়ে ভাগ্যদেবী এলেন | আলোর বন্যায় প্লাবিত হোল রাজার শরীর | রাজা জানতে চায় তার এই অবস্থা হোল কেন ? সে তো কখনো অন্যায় করেনি | প্রজাদের মঙ্গল চিন্তাই ছিল তার একমাত্ৰ মুখ্য উদ্দেশ্য | তবুও কেন তাকে এই ফল ভুগতে হোল ? ভাগ্যদেবী স্বস্নেহে বলেন; ওরে তুই যে নিয়তির কোপে পড়েছিস্, নিয়তির বিধান কে খন্ডায় বল্ তো | রাজা রাহানচন্দ্র কাঁদতে কাঁদতে বলে; তাহলে আমার বেঁচে থাকা কেন ? সবাই তো এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে | ভাগ্যদেবী বলেন ; তোর যে এখনো অনেক কাজ বাকী এই ধরাধামে| তোকে রক্ষাকর্তা হয়ে চলে যেতে হবে সমুদ্ৰ পেরিয়ে এক সোণালী দেশে | সেখানে রাজা-রানী আর প্রজারা ভালো নেই | তোকে তাদের দেখাশুনো করতে হবে | ওদের ভালোরাখার ব্যবস্থা করতে হবে | রাজা বলে; আমি কি করে যাব সেখানে ? ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হয়ে বলেন; পথ আমি বলে দিচ্ছি---এই বলে তিনি সমুদ্রের জলে হাত স্পর্শ করতেই মুহূৰ্তের মধ্যে একটা সাজানো-গোছানো নৌকার আবির্ভাব হোল |


এই নৌকো তোকে নিয়ে যাবে তোর গন্তব্যে | তবে সাবধান, পথে যাওয়ার সময় অনেক প্রলোভনের মুখোমুখি হতে হবে | আর যত প্রলয়-ই আসুক না কেন নৌকা ছেড়ে যাবি না | সবকিছুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাবি | নয়ত, আর এগোতে পারবি না | এখানেই ফিরে আসতে হবে | তারপর আবার নতুন করে এখান থেকে যাত্ৰা শুরু করতে হবে | এই কথাকটা বলে ভাগ্যদেবী অদৃশ্য হলেন | রাজা রাহানচন্দ্র নৌকায় গিয়ে বসতেই নৌকা চলতে শুরু করল | এই দুর্গম সমুদ্ৰ সৌকতে ভাগ্যদেবীর সান্নিধ্যলাভে নিজের মনে একটা বেশ প্রফুল্ল এসেছে | এখন ভাগ্যদেবীর আদেশ-উপদেশ গুলো আর একবার মনে মনে আওড়ে নিল রাজা | ভাগ্যদেবীর বাণীতে নিশ্চিন্ত সে | নৌকা ক্রমশঃ গভীর অন্ধকারে একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে | তার মধ্যেই দুরে একটা আলোর বিন্দুর দিকে চেয়ে রইল সে | আলোটা যেন ক্রমশ বড় হতে হতে এদিকেই এগিয়ে আসছে | তারপর ঐ আলোর কেন্দ্ৰ থেকে বেরিয়ে এল এক রাজপরী | তারপর কম্পিত স্বরে চিত্কার করে বলতে লাগল; কে কোথায় আছো সবাই সরে যাও ,এই পথে প্রবল ঝড় আসছে, নৌকাডুবি হবে | বাঁচতে চাও যদি চলে এসো আমার পঙ্খীনাওয়ে(উড়ন্ত নৌকা)| সত্যি সত্যি সাঁই সাঁই শব্দে ঝড় উঠল, কেঁপে উঠল ভয়ে রাজার সারা শরীর | প্রবল ঝাঁকুনি, নৌকার ডুবু ডুবু অবস্থা আর সেই সঙ্গে তার নৌকায় উঠে আসার রাজপরীর আবেদন | রাজা নৌকার পাটাতনকে জাপটে ধরে রইল | তারপর মনে করতে লাগল ভাগ্যদেবীর নির্দেশ ও সতর্কবাণী |

      সামুদ্রিক ঝড়ের গতি ক্রমশঃ বাড়ছে | উথাল-পাথাল করা ঢেউ | নৌকার টালমাটাল অসহায় অবস্থা | না ! যাই ঘটে যাক না কেন কোনো অবস্থাতেই নৌকো ছেড়ে যাওয়া যাবে না | রাজা মনে মনে তার সিদ্ধান্তে অনড় রইল | অবশেষে রাজপরীর সেই কাতর আবেদন উপেক্ষিত হোল | অন্ধকারে রাজপরী মিলিয়ে যেতেই ঝোড়ো হাওয়ার দাপট এক লহমায় কমে গেল | শান্ত হয়ে উঠল সমুদ্ৰ | ফের গতি বাড়িয়ে চলতে শুরু করল রাজার নৌকা | এইভাবে আরো অনেকটা পথ চলার পর শুরু হোল আর এক সংকট | হঠাত্ চলন্ত নৌকার দুপাশে বেরিয়ে এল দু'জন জলপরী | তারা আতঙ্কিত হয়ে বলতে থাকে রাজা আর এগিয়ো না | সামনে মরণফাঁদ | ঘুর্ণিতে হারিয়ে যাবে তুমি | নৌকা ছেড়ে আমাদের সঙ্গে এসো, আমরা তোমাকে তোমার গন্তব্যে পৌঁছে দেব | নৌকা ভারসাম্য হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে উঠেছে | রাজা কাঠের পাটাতনকে শক্ত করে ধরে রাখে | ভাগ্যদেবীর স্মরণ নেয় | মনে মনে ভাগ্যদেবীর নির্দেশবাণী আওড়ে নিয়ে ভয়কে জয় করার চেষ্টা চালায়, তাতে সফল হয় | এখন সমুদ্ৰ স্বাভাবিক | নৌকার ভারসাম্য ফিরে আসে | জলপরীরা অদৃশ্য হয়ে যায় | নৌকা স্বাভাবিক ছন্দ পেয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলতে শুরু করে | যাওয়ার পথে নানা প্রকারের যাদুকর মাছেরা মানুষের মাথা ধারণ করে রাজার মনের দখল নেওয়ার চেষ্টা করে | কখনো তারা ডুবে যাওয়ার ভাণ করে বলে ; বাঁচাও-বাঁচাও তো আবার কখনো নরখাদক জলযাদুকরের কথা বলে প্রাণসংকটের ভয় দ্যাখায়| রাজা বেশ বুঝতে পেরেছে , এসবই ক্ষণিকের আবেগ, ক্ষণিকের মায়া !! অতএব নৌকার সংস্পর্শ ত্যাগ মানে মৃত্যুসম অর্থাত্ পুনরায় যাত্ৰা করতে হবে|


এইভাবে চলতে চলতে আরো কিছুদুর যাওয়ার পর রাজার চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে ওঠে, অন্ধকার ভেদ করে দুরের দ্বীপে বিন্দু বিন্দু আলোর দেখা পেয়ে | নৌকা দ্বীপের কাছাকাছি আসতেই অসহনীয় মিশ্ৰ আর্ত চিত্কার রাজার কাণে এসে বাজে | রাজার মন অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে | নৌকা একেবারে দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পেনের আকৃতির ছোট ছোট মানুষেরা রাজাকে আর্তস্বরে ডাকতে থাকে ; আমাদের বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও----, আমাদের দেশে অভিশাপ লেগেছে ----- সব ভেসে গেল গো------বলতে বলতেই কোথা থেকে একবিশাল উচ্চতার ঢেউ ওদের অনেককেই ভাসিয়ে নিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল ! রাজার আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে | তার দুচোখ বেয়ে অশ্রধারা নেমে আসে | রাজা ভাবে সে তার গন্তব্যে এসে পড়েছে বোধহয়, ঘুরে নৌকোর সামনের দিকটায় চোখ পড়তেই নৌকোটা গতি বাড়িয়ে চলতে শুরু করে ! এতক্ষণে রাজার হুঁশ ফেরে | সে এতক্ষণ যা ভেবেছিল তা মিথ্যে ! পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে রাজা দেখল, দ্বীপটা নেই, হঠাত্ কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে ! সবই মায়া!! রাজা নিশ্চিন্ত হোল----- তারপর আরো কিছুটা যাওয়ার পর নৌকাটা এসে দাঁড়িয়ে পড়ল একটা দ্বীপের সৈকতে | রাজা বুঝতে পারল নৌকার এখানে দাঁড়িয়ে পড়ার কারণ | অবশেষে সে পৌঁছল ভাগ্যদেবীর বলে দেওয়া সেই দেশে | না ! এই দেশে তেমন আলো নেই, আলো ঝলমলে শোভা নেই | কালোর মাঝে গুটিকয় নিভু নিভু বাতি টিম্ টিম্ করে জ্বলছে | নিশ্চই এখানের লোকেদের খুব কষ্ট ! রাজার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল | এখনো ভোরের আলো ফোটেনি | ফের আবির্ভূতা হলেন ভাগ্যদেবী | বললেন ; রাজা রাহানচন্দ্র তোর অপার করুণা-দয়া-ভালোবাসা-ধৈর্য্য-নিষ্ঠা-দায়িত্ব ও বুদ্ধি আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছে | আমি জানি একমাত্ৰ তুই-ই পারবি এই ছোট্ট ছোট্ট মানুষ গুলোর দুঃখ-দুর্দশা দুর করতে | তুই এখন থেকে যে দ্বীপের বাসিন্দা হয়েছিস, সেটি হোল একটি লিলিপুটদের দেশ | ভাগ্যদেবী চোখ বন্ধ করলেন, একটু পরে চোখ খুলতেই তার সামনে অজস্ৰ ছোটবড় নানান আকৃতির বাঁশি উপস্থিত হোল | ভাগ্যদেবী রাজাকে জিজ্ঞেস করলেন ; বল্ এর মধ্যে কোন বাঁশিটা তোর পছন্দ ? রাজা অনায়াসেই সাদায় সবুজে মেশানো সাধারণ একটি বাঁশিকে দেখায় | ভাগ্যদেবী বলেন ; আমি জানি তুই ওটাই পছন্দ করবি | তোর মন যে বড়ই পবিত্ৰ রে | এই বাঁশিটা তুই নে, আর আজ থেকে প্রয়োজনে এই বাঁশিই তোকে অনেক সাহায্য করবে | বাঁশি বাজলেই তোর মনের ইচ্ছা পূরণ হবে | তবে সাবধান স্বভাবে তোর মতো মানুষ ছাড়া এই বাঁশি যেন আর কোন মানুষের হাতে না পড়ে ! না হলে তোর বুদ্ধিভ্রষ্ট হবে | অবশ্য একমাত্র তুই আর তোর মতো প্রকৃতির মানুষ ছাড়া আর কেউ বাজাতে পারবে না | ভাগ্যদেবী রাজা রাহানচন্দ্রের প্রণাম গ্রহণ করে আশীর্বাদ করলেন | তারপর অদৃশ্য হলেন | আঁধার একটু একটু করে আলোয় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে |


        সাজানো গোছানো লিলিপুট মানুষদের এই দ্বীপদেশটির নাম কুন্তলা | এই দ্বীপটাকে উত্তরের উঁচু উঁচু পাহাড় দক্ষিণের সমতল অংশকে যেন তার কোল দিয়ে আগলে রেখেছে | লেখার পেনের মতো উচ্চতার মানুষগুলো একটা সময়ে আনন্দে খুশিতে ভরে থাকত | আর আজ তাদের রাজা অকালে মারা যাওয়ায় অতি সংকটে পড়েছে প্রজারা | সেই সুযোগে অযোগ্য -লোভী কিছু রাজ কর্মচারী তাদের দেশের সমস্ত সম্পদ লুটেপুটে দেশের সর্বনাশ করে চলেছে | অনতিদুরেই রয়েছে বেলিকা দ্বীপ | এই দ্বীপের লিলিপুট রাজা ভয়ানক অত্যাচারী | রাজার নাম অরিশ | এই শয়তান রাজা শাসকহীন কুন্তলাদ্বীপের লিলিপুটদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করেছে | শুধুমাত্ৰ কুন্তলদ্বীপ দখল নেওয়ার জন্য | কুন্তলাদ্বীপ দেশের অবস্থা এখন রুগ্ন-জরাজীর্ণ দেহের মতো | কৃষিকাজ বন্ধ, খাদ্য নেই, ঘরে ঘরে অনাহার | তার উপরে অন্য দেশের রাজার লোলুপ দৃষ্টি | সব মিলিয়ে এক বেদনাদায়ক নিদারুণ পরিস্থিতি |


      রাজা রাহানচন্দ্র ভোরের আলো ফোটার আগেই বড় আকৃতির সাজানো সারিবদ্ধ আগাছাগুলো ঠেলে সরিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে পৌঁছে যায় কুন্তলা দ্বীপের প্রাণকেন্দ্রে তথা মৃত রাজার বাসভবনের প্রধান ফটকে | আসলে সারিবদ্ধ আগাছাগুলো বলতে লিলিপুট মানুষদের কাছে ওগুলো বৃক্ষ, বন-জঙ্গল | আর তাদের বাড়িঘরগুলো রাহানচন্দ্রের কাছে খেলনাঘরের মতো | সকালের অবস্থা যাচাই করার জন্য রাজা রাহানচন্দ্র রকমারি গাছে ভর্তি খুব কাছেই একটি বাগানে এসে লুকিয়ে পড়ল | একটু পরেই রাজা দেখল লিলিপুটদের মৃত রাজার রাণী কণাবতী তার ছোট ছোট রাজপুত্র-রাজকণ্যাদের নিয়ে সাধারণ পোশাকে বাড়ির ভিতর থেকে ভবনের প্রধান ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল | সঙ্গে বাক্সপ্যাটরা আর বেশ কিছু পোটলা-পুটলি | ভবনের যারা কর্মচারী ছিল তারাও প্রত্যেকে হাজির হোল | তবে সকলের চোখেই জল | তাহলে কি ওদের সামনে কোন বড় বিপদ !!! মনে হচ্ছে দেশ ছাড়তে চলেছে | কিন্তু কেন ? তাছাড়া নিজের ঘর-বাড়ি ছাড়তে যাবে কেন ! ব্যাপারখানা কী বোঝার জন্য রাহানচন্দ্র গাছের আড়াল থেকে শুনবার চেষ্টা করতে লাগল | শুনল-- তারপর যা বুঝল তা এইরকম… বেলিকা দ্বীপের রাজার হুকুম দুই দিনের মধ্যে রাজবাড়ি ত্যাগ করে অন্যকোথাও চলে যেতে হবে , নয়ত সকলকেই হত্যা করা হবে | আর এখন এই দুইদিনের সময়সীমা শেষ | এমন সময় বেলিকা দ্বীপের রাজা অরিশ তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে হঠাত্ উপস্থিত | ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যায় রাণী কণাবতীর দিকে | তারপর খাপ থেকে তরোয়াল বের করে হুংকার দিয়ে বলে; রাণী, তোমরা এই বাড়িতেই থাকবে, আর কর্মচারীরা বিদায় নেবে | জোরে কান্নার রোল ওঠে | রাণী অনেক অনুনয়-বিনয় করে , তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছোট্ট রাজপুত্রকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় রাজা অরিশ | তারপর রাজপুত্রের গলায় তরোয়াল ধরে গর্জে ওঠে ; আমার নির্দেশ অমান্য হলে এক্ষুণি এর শিরোচ্ছেদ করব ! এই দৃশ্য দেখে রাণী কণাবতী মূর্চ্ছা গেলেন | রাজা রাহানচন্দ্র আর চুপ করে থাকতে পারলনা | চিত্কার করে বলল; রাজা অরিশ!! এতবড় সাহস তোমার ! তরবারি হঠাও, ছেড়ে দাও রাজপুত্রকে | যুদ্ধ করো আমার সঙ্গে | রাহানচন্দ্রের হুংকারে কেঁপে উঠল সমগ্র অঞ্চলটা | সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে বিশাল আকৃতির একটা মানুষকে দেখে ঘাবড়ে যায় | ভয় পেয়ে অনেকে ছোটাছুটি শুরু করে দেয় | রাহানচন্দ্র সকলকে আশ্বস্ত করে বলে; ভয় নেই , আমি রাজা রাহানচন্দ্র | আমাকে স্বয়ং ভাগ্যদেবী, কুন্তলা ও বেলিকা দ্বীপের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াবার আদেশ করেছেন | ভক্তের কল্যাণ আর দুষ্টের দমন এখন আমার একমাত্ৰ লক্ষ্য | তারপর মূর্চ্ছা যাওয়া রাণী কণাবতী উঠে বসতেই তাকে নিজের পরিচয় জানিয়ে অভয় দিয়ে বলল ; আপনারা সকলেই বাড়ির ভিতরে যান | দেশ আপনার , বাড়ী আপনার , প্রজা আপনার | আপনাকে বড় প্রয়োজন সকলের | যান, আপনি দয়া করে বাড়ির ভিতরে যান | সংকট কেটে গেছে | আমি রাজা অরিশকে উচিত শিক্ষা দেব | তারপর রাজা অরিশের দিকে তাকিয়ে ঝংকার দিয়ে বলে ; যুদ্ধ করো, চালাও অস্ত্র ! রাজা অরিশ ভীত-সন্ত্রস্ত, সে তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে পালাবার পথ খোঁজে | সে খেঁকিয়ে ওঠে, বলে ; তোমাকে ছাড়ব না দানব, হত্যা করব | রাজা রাহানচন্দ্র হো-হো করে হাসতে থাকে | তারপর বলে ; রাজা অরিশ তাহলে হার স্বীকার করে রণে ভঙ্গ দিতে চাইছ | কিন্তু তোমাকে তো যুদ্ধ করতেই হবে | রাজা অরিশের সৈন্যরা, যার কাছে যা ছিল রাহানচন্দ্রকে লক্ষ্য করে ছুড়তে থাকে | গাছের ডাল ভেঙ্গে রাজা রাহান রাজা অরিশ সহ সকলকেই বেধড়ক পিটিয়ে দ্বীপের বাইরে পাঠিয়ে দেয় |

      কিছুক্ষণ পর দ্বীপের সমস্ত লিলিপুট মানুষ ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে | রাণী কণাবতীর সভাসদ্ বর্গের কয়েকজন রাণীর নির্দেশে তাদের দেশের নানান সমস্যার কথা তুলে ধরে | রাজা রাহানচন্দ্ৰ খুব তাড়াতাড়ি সব সমস্যার সমাধান হবে বলে জানায় | সকলকে নিশ্চিন্ত থাকার কথা বলে | তারপর রাজা ভাগ্যদেবীর দেওয়া উপহার, বাঁশির সাহায্য নিয়ে কুন্তলা দ্বীপের মানুষদের ক্রমশঃ দুঃখ-কষ্ট দুর করে | রাণীকেই রাজসিংহাসনে বসিয়েছে তাদের দেশের প্রজারা | রাজা রাহানচন্দ্রকে তারা সকলেই ভগবানের মতো মানে, পুজো করে | রাহানের পরামর্শে রাণী কণাবতী তার প্রজাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে | কুন্তলাদ্বীপ আজ আলোয় আলোকিত, হাসিতে মুখর এক শান্তির দেশ হয়ে উঠেছে | কিছুকাল পর রাণী কণাবতীর রাজপেয়াদার মাধ্যমে খবর আসে বেলিকা দ্বীপের রাজা অরিশ ভয়ানক অত্যাচার চলাচ্ছে তার দেশের প্রজাদের ওপর | রাণী কণাবতী আর স্থির থাকতে না পেরে রাহানচন্দ্রকে বলেন ; কিছু একটা করুন প্রভূ ! রাহানচন্দ্র বলে ; হুম্ , রাজা অরিশ জান্তব হয়ে উঠেছে | ওর বিনাশ অনিবার্য | বলেই রাহানচন্দ্র সমুদ্রের কিনারায় চলে যায় সঙ্গে কণাবতীর মন্ত্রিসভার সেনাপতিকে সঙ্গে নিয়ে | তারপর রাহানচন্দ্রের বাঁশি বাজতেই ভাগ্যদেবীর দেওয়া সেই নৌকো মুহূর্তে উপস্থিত হয় | তারপর ওদের দু'জনকে বয়ে নিয়ে চলে বেলিকা দ্বীপের উদ্দেশ্যে | নৌকোটা অনেক পথ চলার পর মাঝ সমুদ্রে হঠাত্ দাঁড়িয়ে পড়ে | হতবাক-হতম্ভব রাজা রাহানচন্দ্র | করজোড়ে ভাগ্যদেবীকে আহ্বান জানায় | দেবী আবির্ভূতা হন | রাণী কণাবতীর সেনাপতি প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নেয় | দেবী বলেন ; ওরে… নৌকোয় উঠে একবারও বলেছিস্ তোদের গন্তব্যস্থল ? দু'জনেই দেবীকে প্রণাম করল, রাহানচন্দ্র বলল ; না- মা, কুন্তলাদ্বীপ অভিযানের কথা মা আপনি বলেছিলেন, আর এখন আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না | ভুল হয়েছে মা… ক্ষমাপ্রার্থী আমি -- কণাবতীর সাহসী সেনাপতি বলে ওঠে ; আমরা তো বেলিকা দ্বীপ যাচ্ছি মা, অত্যাচারী শাসক রাজা অরিশকে শায়েস্তা করতে | দেবী প্রসন্ন হলেন , ওদের আশীর্বাদ করলেন | তারপর অদৃশ্য হলেন | নৌকো চলতে শুরু করল | কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকোটা ওদের বেলিকা দ্বীপের সৈকতে নামিয়ে দিয়েই অদৃশ্য হল | সেনাপতি বলে; হ্যাঁ এই সেই বেলিকা দ্বীপ | তারপর সমুদ্ৰসৈকত পিছনে রেখে ওরা এগিয়ে যায় রাজমহল্লার দিকে | কিছুদুর যাওয়ার পর আকাশ কালো করে মেঘ ঘনিয়ে ওঠে | কালো মেঘের কুন্ডলী বয়ে নিয়ে আসে প্রবল ঝড় আর তুমুল বৃষ্টি | প্রস্তুত ছিল না, তাই ঝড়ের তান্ডবে ওরা দিকভ্রান্ত | লিলিপুটদের দেশ, এখানে এতবড় বাড়ি নেই যে রাহানচন্দ্রের থাকার জায়গা হবে | একটা কুটির দেখতে পেয়ে সেখানে সেনাপতিকে আশ্ৰয় নিতে বলে | সেনাপতি রাহানচন্দ্রকে একা ফেলে যেতে রাজি হয় না | অগত্যা প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টির চাবুক খেতে খেতে দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে | একটা বড় গাছের তলায় দুজনেই বসে পড়ে | এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর বৃষ্টি থামতেই তারা ফের রাজা অরিশের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে | তারপর রাজদরবারে এসে উপস্থিত হতেই অরিশের লোকজন রাহানচন্দ্রকে দেখে ভয়ে চিত্কার জুড়ে দেয় | জানা যায় রাজা অরিশ নিখোঁজ | তাকে ও তার মন্ত্রীদের কয়েকজনকে পাওয়া যাচ্ছে না | রাহানচন্দ্র বেলিকা দ্বীপের প্রজাদের অভয় দেয় | এখানে অত্যাচারী রাজা অরিশকে উপযুক্ত শাস্তি ও প্রজাদের মঙ্গল করাই তার একমাত্ৰ লক্ষ্য | হঠাত্ কোমরবন্ধনীতে হাত পড়তেই আত্কে উঠে রাজা রাহানচন্দ্র | তার বাঁশিটাতো নেই ! মাটি থেকে তার পা সরে যায় ,ধপ্ করে বসে পড়ে | চোখ জলে ভ'রে যায় | মুহূৰ্তের মধ্যে যেন জগত্ অন্ধকার হয়ে ওঠে | কাঁদতে কাঁদতে বলে ; আমার প্রিয় বাঁশিখানা হারিয়ে ফেলেছি সেনাপতি | জানি না এবার তোমাদের কিভাবে উপকার করব ! সেনাপতি আশ্বাস দেয়, বলে ; ধৈৰ্য্য-বিশ্বাস রাখুন…মা আছেন সব ঠিক হয়ে যাবে | এতবড় একজন মানুষের কি হতে পারে ! বেলিকা দ্বীপের প্রজারা বুঝে উঠতে পারছে না | সবাই জানতে চায় রাজন'এর এরূপ বিমর্ষ হওয়ার কারণ ! সেনাপতি বলে ; উনি অসুস্থবোধ করছেন | বিশ্রামের প্রয়োজন | আর আপনারা ধরে নিতে পারেন বেলিকা দ্বীপ এখন থেকে অত্যাচারী রাজা অরিশের শাসনমুক্ত | যান এবার নিজ নিজ কাজে স্বাধীনভাবে মনোনিবেশ করুন | প্রজাসকল ফিরে যায় | কিন্তু এদিকে রাহানচন্দ্রের মনের অবস্থা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তার এরকম দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞানহীনতা পরিচয়ে | মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার | অঝোর ধারায় অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে কেঁদে চলে | এমন সময় দ্বীপের দক্ষিণের প্রান্ত থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসে | সে কান্না থামিয়ে ভালো করে শোনবার জন্য উঠে দাঁড়ায় | সেনাপতিও শুনতে পাচ্ছে বলে জানায় | সুর শুনতে শুনতে দু'জনেই দক্ষিণের দিকে চলতে শুরু করে | কিছুদুর যাওয়ার পর বাঁশির আওয়াজের সঙ্গে কার যেন আর্ত চিত্কার ভেসে আসে | উদ্বেগ আর কৌতুহলের মাঝে যাঁতাকলের পেষাই'এর মতো অবস্থা রাহানচন্দ্রের | তবুও দ্রুত পা চালায় তারা | আর বেশিদুর যেতে হোল না, থমকে দাঁড়ায় …… বড় বড় গাছের আড়ালে অস্পষ্ট চেহারাটা বড়মানুষের মনে হচ্ছে ! মহিলা না পুরুষের ! ভাবতে থাকে রাহানচন্দ্র | সেনাপতি সাহসী, বলে ; এগিয়ে দেখে আসি রাজন ? হাত নাড়িয়ে না-সূচক ইশারা করে রাহানচন্দ্র | বাঁশি একনাগাড়ে বেজেই চলেছে , বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে যায় সে | পরক্ষণেই দুই দ্বীপবাসীদের ভয়াবহ অবস্থার কথা মাথায় আসতেই তার সারা শরীর শিউরে ওঠে | বসে পড়ে | চলার শক্তিটুকুও কেউ যেন কেড়ে নিয়েছে | দিশা দেখাও মা ভাগ্যদেবী……এখন এই প্রার্থনাটুকুই তার একমাত্ৰ অবলম্বন | চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসতেই সেনাপতির চিত্কারে রাহানচন্দ্র চোখ খুলতেই তার শরীর-মনের গ্লানি-অপরাধবোধ ও সমস্ত জড়তা এক লহমায় কেটে গিয়ে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে | তারপর ধাতস্থ হয়ে বলে ; একি ! রাণী উর্মিমালা না ? রাণী বলে ; হ্যাঁ ,তুমি ঠিক চিনেছ দেব, আমিই তোমার স্ত্রী রাণী উর্মিমালা | চোখের জলে আর আবেগে রাজা-রাণী ভাসতে থাকে | সেনাপতির সঙ্গে রানীর পরিচয় হোল | রাজা-রাণীর আলিঙ্গনের মুহূৰ্ত পুরো বেলিকা দ্বীপ জুড়ে আকাশ-বাতাস শান্ত হয়ে এক নব্য আলোর বন্যায় প্লাবিত হয়ে ওঠে | সবার মুখে হাসি……| রাজা-রাণী উভয়ের মুখমন্ডল থেকে এখনও জিজ্ঞাসার চিহ্নগুলি মিলিয়ে যায় নি | স্বাভাবিকভাবেই একে অন্যে এখানে আগমনের হেতু জানার জন্য উদগ্রীব | প্রথমে রাহানচন্দ্র ব'লে শেষ করে | রাণীও জানায় ভাগ্যদেবীই তাকে নতুন জীবন দিয়েছেন | তিনিই তাকে নতুন জীবনের আলোকে ছুটতে সাহায্য করেছেন | তিনিই তার একমাত্ৰ সহায় |রাহানচন্দ্র বড় গাছটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে; আচ্ছা রাণী, তুমি তো ওখানে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাচ্ছিলে, একটু আগে ঐ বাড়ির ভিতর থেকে কার চিত্কার ভেসে আসছিল বলতো ? রাণী বলে; ওটা বেলিকার রাজা অরিশের | আমার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত | বন্দী করেছি তাকে | কিন্তু এখন কি করি বলতো দেব ? এতক্ষণ চিত্কার বন্ধ ছিল রাজা অরিশের | ফের চেঁচামেচি শুরু করে | সেনাপতি বলে ; হে দেবী,হে রাজন ঐ বাড়িটার পাশে যেতে আজ্ঞা হোক | ওরা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই রাজা অরিশের তীক্ষ-কর্কশ বাক্যবাণ কাণে আসে | বলতে থাকে কাউকে ছাড়ব না , সবাইকে মেরে ফেলব | আমার দেশে এসে আমার উপরেই খবরদারি ! আমার দেশে আমিই রাজা…… যা বলব সবাইকে তা শুনতে হবে ,মানতে হবে | হত্যা করব……ছেড়ে দাও আমাকে | রাণী উর্মিমালা বলে ; এই রাজা অত্যন্ত ভয়ংকর, ছেড়ে দিলে অনেকের ক্ষতি করবে | তাই……… | এমন সময় ভাগ্যদেবী আবির্ভূতা হলেন | তিনি বললেন আরো সুযোগ দাও ওকে | ও যদি পরাজয় স্বীকার করে মানবিক হয়ে রাজার ভূমিকা পালন করে তাহলেই ও বেঁচে থাকতে পারবে | রাজা অরিশকে ছেড়ে দেওয়া হল | ছাড়া পেতেই সে স্বমূর্তি ধারণ করে | পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কুন্তলা দ্বীপের বীর-পরাক্রমশালী সেনাপতিকে আক্ৰমণ করে | শুরু হয়ে যায় দু'জনের ভয়ংকর লড়াই | সমানে সমানে টক্কর চলে বেশ কিছুক্ষণ | হাঁপিয়ে উঠেছে দুজনে | এমন সময় তরবারি ঘোরাতে গিয়ে হাত ফসকে মাটিতে পড়ে যায় রাজা অরিশের তরবারি | সেনাপতির মোক্ষম আঘাত গিয়ে লাগে তার ডান হাতে | সেনাপতি দাঁতে দাঁত ঘসতে থাকে | তরবারি উঠিয়ে হাতে নিতে বলে | ডান হাত অকেজো , বাম হাত দিয়ে যুদ্ধ করে | কিছুক্ষণ চলার পর সেনাপতির আঘাতে ভূপতিত হয় রাজা অরিশ | তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে | ভাগ্যদেবী বলেন ; কালের নিয়মে যা ঘটে তা সকলকেই মেনে নিতে হয় | অরিশের রাণী দূর্বাকে এই দেশের শাসনভার তুলে দিতে হবে | তবে পাশে থাকতে হবে রাহান-উর্মি, তোদের এখন থেকে এই দুই দ্বীপের ভার মহারাজা-মহারাণী হয়ে সামাল দিতে হবে | সেনাপতি আনন্দে বলে ; মা অনুমতি করুন , আমাদের কুন্তলা দ্বীপের মহারাজা রাহানচন্দ্রের সঙ্গে বেলিকা দ্বীপের মহারাণী উর্মিমালার নতুন করে বিয়ে দিতে চাই | আমার বিশ্বাস রাণী কণাবতী এতে খুব খুশি হবেন | ভাগ্যদেবী বললেন ; কি জানিস রাহান, হরবোলা দ্বীপের ভয়ংকর পরিস্থির মধ্যে পড়ে তোদের বেঁচে থাকা আর এই অঞ্চলে আসার একমাত্ৰ উদ্দেশ্য এই দুটো দ্বীপের মঙ্গলসাধন | সেনাপতি ঠিক বলেছে | তবে তাই হোক ……ভাগ্যদেবী অদৃশ্য হলেন |

     কুন্তলা আর বেলিকা দ্বীপে সাজো সাজো রব | আলোর মালা আলোক সজ্জায় মেতে উঠেছে লিলিপুটবাসী | আনন্দের বন্যায় দুটো দ্বীপ মিলেমিশে একাকার | প্রত্যেকেই বিয়ের দিনের অপেক্ষায় দিনগুনে চলেছে


 



Rate this content
Log in