Sangita Duary

Abstract Fantasy Inspirational

3  

Sangita Duary

Abstract Fantasy Inspirational

ভূত ও ভগবান

ভূত ও ভগবান

9 mins
253


...এই না না, একদম দিবিনা, একদম না আ আ আ আ!

সেই দিয়েই ছাড়লো। হতভাগা অনামুখোর দলগুলো, নিজেরা বাঁদর রঙে ঢং খেলা খেলছিস, খেল না! আমায় ভেজানোর কী দরকার? ইয়া ম্যাগো! কোথা থেকে এক খাবলা গু ঘষে দিয়ে গেল গো মুখপোড়াগুলো!

ওরে তোদের ঠাকুরদা তাদের ঠাকুরদা তাদেরও ঠাকুরদাকে জন্মাতে দেখলুম আর তোরা একটু শ্রদ্ধা ভক্তি করবিনা?

নির্বংশ হবি, সবকটা মরবি! এখনকার সব যন্ত্রের যুগ তাই কোনো ইজ্জত নেই আমাদের, একদিন মরবি, সবকটা মরবি, মর মর মর!

ওরে এককালে আমার থানেই কালাচাঁদের পুজোর আখড়া ছিল রে! কত লোকের মানতের সুতো ঝোলানো ছিল শরীরে!

সেসব দিন! আহা! এখন কেই বা আর মানে? কেই বা আর শোনে? এই তো দোলের দিনেই মুখুজ্জেরা কিরকম হৈচৈ করতো! থানের চারপাশে ফুল দিয়ে আবির দিয়ে সাজাতো, সারাদিন কীর্তন, দুপুরের খিচুড়ি লাবড়া! 

তারপর....!

তারপর, সেই যে ঝড়ের রাতে একটা ডাল ভেঙে পড়লো সনাতনের একরত্তি ছেলেটার ওপর, সেই থেকে নাকি আমি...!

হ্যাঁ, সবাই বললে তো! আমার ডালে নাকি ব্রহ্মদত্যির বাস! ভুত প্রেতের আখড়া!

তারপর থেকে ওই থান উঠে গেল। জীর্ণ হতে হতে 'সু', কিংবা 'কু' এর কোনো খ্যাতিই ধরে রাখতে পারলাম না।

সকলের মন থেকে মুছেই গেলাম।

কিন্তু আমার মনে আমি কিন্তু জিইয়ে রাখলাম শতাব্দীর জীবন্ত দলিলগুলো।

কত কিই যে দেখলাম! শুনলাম! বুঝলাম!

নকশাল বাড়ির আগুনে হাত পা সেঁকে কল্লোলকে দত্তদের ভাড়ার ঘরে লুকোতে দেখলাম, রাত বিরেতে পম্পাকে টেনে নিয়ে যেতেও দেখলাম ওই শেয়াল চোখা পুলিশগুলোকে।

আবার কমরেডদের নাম জানিয়ে ছাড়া পাওয়া কল্লোলের দারুণ একটা ভবিষ্যৎও দেখলাম।

রাস্তায় ঘুগনি ফেরি করা রানাকে বিস্কুট কোম্পানির মালিক হতে দেখলাম, ইসু কে দেখলাম, সস্তার গামছা বিক্রি ছেড়ে আস্ত একখান কাপড়ের দোকান দিতে!

মেঘালয় বাড়ির মেয়েটাকে ধর্ষণ করেও মুক্তিমকে এম এল এ হতে দেখলাম,

হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো হাবুলদের টুকরো জমিটায় বাড়ি বানিয়ে রাজার মা'কে যেমন রাতে ঘরে লোক ঢোকাতে দেখলাম আবার দেহব্যবসা না করার অপরাধে রাজার বউকে আগুনে পুড়ে মরতেও দেখলাম।

মিত্তিরদের ওই নেপালী বউটা, এখন বেশ কেমন স্নিগ্ধ লাগে অথচ ও'ই একদিন কলাই পাড়ার দেবলকে মাথায় ডাণ্ডা মেরে পঙ্গু করে দিয়েছিল, মনে পড়ে। সব মনে আছে।

আর সব খুলে বলতে গেলে আস্ত একখান উপন্যাস হয়ে যাবে। থাক।

সারাবছর আমার ধারে কাছে তো আসেনা কেউ,এই এক দোলের সময়ে পাড়ার ছেলে মেয়েগুলো ফুর্তি করতে আসে। শুধু তাই বা বলি কিকরে? আসে তো, আলগা আঁধারে নিষিদ্ধ চাহিদা মেটাতে অনেকেই আসে।

তবে আমার আয়ু এবার ফুরোতে চলেছে। পুরোনো চাল ভাতে বাড়লেও পুরোনো ডাল, এক চিতায় ছাড়া আর কোনো কাজে আসে কি?

-----------------------------------------------

যাক বাবা শান্তি! এই শেষ বিকেলে যাহোক নাচনকোন্দন একটু থামলো। এটা হোলি খেলা নাকি অন্য কিছু?

লম্বা লম্বা প্লাস্টিক পিচকারী নিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই ভিজেয়ে সপসপে করছে। কেন রে, অনুমতি নিতে পরিসনা? যার দিকে ওই বাঁদরে রঙগুলো ছুঁড়ছিস তার তো ভেজার ইচ্ছে নাও থাকতে পারে!

জোর করলেই সব হয়ে যায়?

এই তো আমার সামনেই দাঁড়িয়েছিল মেয়েটা, দৌড়ে পালিয়ে যেতে আমিই ভিজে গেলাম। তোরা তো তবু সাবান মেখে সাফসুত্র হতে পারবি। আমি কী করবো? এই ক্যামিক্যাল মেশানো রঙ শুকিয়ে গেলে জ্বালা করে খুব, বাকল রুক্ষ করে দেয়। তা কি আর তোরা বুঝবি? আমি তো গাছ, তাও আবার অশ্বত্থ! মানুষ তো নই!

মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে ওই হাড় বজ্জাত মানুষগুলোর গায়ে দমাদ্দম পড়ে যাই, আমায় যেমন কষ্ট দেয়, ওদেরও পিষে শেষ করে দিই।

কিন্তু মানুষের মতো নির্দয় হওয়া আমাদের সাজে না যে!

এই তো, মাস কয়েক আগে বাড়তি ডালগুলো ছেঁটে দিলো পাড়ার ছেলেছোকরাগুলো, ভয়ে। যদি আমফনের মতো দারুণ কোনো ঝড়ে মটাস করে ভেঙে পড়ি!

আমূল কাটতে হলে আজকাল নাকি আবার বনদপ্তরের পারমিশন লাগে।


আমার বয়সটা ঠিক কত সেটা আমি নিজেই ভুলে গেছি।

মানুষদের মতো তো আর বাবা মার ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠার রেয়াজ নেই আমাদের!

যেখানেই মাটি পাই সেখানেই আমাদের বেড়ে উঠতে হয়। প্রতিকূলতা মানিয়ে নিতে হয়, মেনে নিতেও হয়।

আপাতত এদিক ওদিক করে প্রায় তিন জোড়া মোটা ডালের কতগুলো যে বিন্যাস রয়েছে তা গুনে নির্ধারণ করা অন্তত আমার কম্মো নয়। মানুষরা করে, করে বলেই তো অতিরিক্ত ডাল কেটে ছেঁটে দেয় দুবার না ভেবে ঠিক যেমন ওরা নখ চুল কাটে!

হয়তো কবে আমাকেও আমূল তুলে ফেলবে! তুলে তো কবেই ফেলত। 

ওই যে বোসেদের বড়ো ছেলে, তার কত ভাবনা আমার থেকে পাঁচ হাত দূরে নিজেদের বাড়িটাকে নিয়ে... এক যুগের গাছ, শেকড় মূল সব তো বাড়ির নিচে, ওই যে লাগোয়া বাথরুমের ভীত খুঁড়তে খুঁড়তে কিছু শেকড় বেরোলো! ঝড়ে গাছ ওল্টালে তো বাড়িসুদ্ধ নিয়েই ওল্টাবে, তাই গাছটাই কেটে দেওয়া হোক। আমিও দাঁত চোখ ডাল পালা পাতা শিকড় সব কটমট করে অভিশাপ দিলাম, নির্বংশ হওয়ার, যেমনটা অসন্তুষ্ট হলেই দিই সব্বাইকে!

নধো কাঠুরেকে ডেকে ওরা কথাও বলে ফেলেছিল। তারপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা হলো... একটা গাছ মানেই তো একটা প্রাণ, সেটাকে অকালে মেরে ফেলা কি ঠিক? ওই এক নম্বর বাড়ির গাছটা কাটার পরেই তো ওদের ছেলেটার এক্সিডেন্ট হলো! তার চেয়ে ডাল গুলো ছেঁটে দিলে ভার কম থাকে! তাছাড়া গাছটা কেমন ছায়া দেয় বাড়িটাকে! থাক থাক পুরো কেটে লাভ নেই।

সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছি কিন্তু এই বারবার অঙ্গহানি আমায় খুব যন্ত্রণা দেয়।

ওহ! বলা হয়নি। বকুলতলা লেনের দুশো দুই নম্বর বাড়ির সামনে আমার একার ঠিকানা।

একার ঠিকানাই বললাম কারণ দুশো এক নম্বরে বহুকাল আগে আমারই এক প্রজাতি ভাই থাকতো। থাকতো মানে থাকতে দেওয়া হয়েছিল আরকি! দুজনে কাঁধ ছুঁয়ে বেড়ে উঠলাম, ডাল পালার প্রভূত বিস্তার হলো, কত পাখি বাসা বাঁধলো!

বসন্তের মাঝামাঝিতে সব পাতা ঝরে আমরা দুজনেই ন্যাড়া হয়ে যেতাম। রোজ গুনতাম কার ক'টা পাতা ঝরলো!

তারপর যখন একটু একটু করে পাতলা গোলাপি কিশলয় প্রতিটা ডগার খাঁজে খাঁজে জেগে উঠতো, একে অপরের রূপে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম দুজন দুজনকে। আহা! কী যে সব দিন ছিল তখন!

ওই যে হোলির দিন, আমাদের ডালে মটকা বাঁধা হতো। পাড়ার ছেলেরা ঢিল ছুঁড়ে মটকা ভাঙতো। কত যে রঙ মেখেছি! রোজ বৃষ্টিতে হয়তো ধুয়ে গেছে কিন্তু বাকলের খাঁজে খাঁজে রেশটুকু আজও অমলিন।

শুধু কি তাই? আরও অন্য একটা যুগে কত লোক যে আমাদের ছায়ায় বসেছে! কত কিশোরী আমাদের ডালে দোলনা ঝুলিয়েছে, কত লুকোচুরি খেলার পাহারাদার হয়েছি, আবার কত প্রেমিক যুগলের সাক্ষাৎস্থলও হয়েছি!

তখনতো এখনের মতো এত ইলেকট্রিক ছিলোনা, চারিদিকে মাকড়সার জ্বালের মতো ওই মোবাইল ফোনের কিংবা অন্তর্জ্বালের জ্বলুনিও ছিল না। ছেলে বুড়োরা সন্ধ্যে হলেই এইখানে বাঁশের পাটাতনে বসে আড্ডা দিতো। দুপুরে মেয়ে বউরা চাটাই পেতে গপ্পো করতো!

কার্তিক পুজোর পর মাটির মূর্তি ডালে তুলে দিয়ে যেত। আমরা অপলক দেখতাম কেমন করে দিনদিন একটা পূজ্যমূর্তি ক্ষয়ে ধুয়ে একটা কাঠামো হয়ে যাচ্ছে!

ভীষণ ঝড়ে যখন তুমুল বেগে হাওয়া ঘুরতো মাথার ওপর,দুজনেই দুজনের জন্য আতঙ্কে থাকতাম। একবার তো ওর মগডাল ভেঙে গিয়েছিল। ওর থেকে বেশি আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। বেচারি সারা শরীরে আঁঠা মেখে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতো, খুব লজ্জা লাগতো আমার, পাতা গুলো ইচ্ছে করে মিইয়ে রাখতাম, ঝিমিয়ে থাকতাম।

শেষমেষ তো দুশো একের মালিক নিজেদের আস্তানা বাড়ানোর জন্য কেটেই ফেললো ওকে।

আমাদের যে চিৎকার করা বারণ, আমাদের যে বাধা দিতে নেই, হাসতে নেই, কাঁদতে নেই এমনকি ডাল পালা মেলে বুক ভরে নিঃশ্বাসও নিতে নেই; তাই নিঃশব্দে নিজেদের উচ্ছেদ করতে দিতে হয়।

ওর ডালে যে সব পাখিগুলোর বাসা ছিলো, সেগুলো উড়ে গিয়েছিল, আমি চেয়েছিলাম ওদেরও আশ্রয় দিতে যাতে ওই পাখিগুলোর স্পর্শে আমি ওর অভাব কিছুটা হলেও ভুলতে পারি।

পাখিগুলো এলো না। মানুষদের মতো তো দৌড়ে গিয়ে ডাকতে পারিনা!

মানুষগুলোর ওপর খুব ঘেন্না হয়, খুব। ইচ্ছে করে নিজেদের পতন দিয়ে এই মানুষ জাতিটাকেই শেষ করে দিই। যেদিন ওকে কাটলো, ওদের নির্বংশ হওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলাম। বোধহয় ও'ও দিয়েছিল, তাইতো টগবগে ছেলেটা দুদিন পরেই...!

মনের আনন্দে সেদিন খুব পাতা উড়িয়েছিলাম, আমাদের নির্বংশ করা, নে এবার তোরা মর, মর মর, ছেলে পুলে গুষ্টি সবাই মর!

---------------------------------------------


সন্ধ্যে প্রায়ই হয়ে এসেছে। 

আজকাল বোসেদের বউটা রোজই আমার গোড়ায় এসে ধুপ জ্বালিয়ে যায়। দুপুরে গোড়ায় জল দেয়। ওইটুকু জলে আমার মুখও ভেজেনা, তবু, ওর এই আন্তরিকতা ভালো লাগে। আচ্ছা, ও ভয় পায় না?

কেনই বা পাবে, এখন আর কেউ ভুত প্রেত ব্রহ্মদত্যি মানে নাকি?

তাহলে বউটা আমাকেই বা এত মানে কেন? এত ভক্তিই বা করে কেন?

ওকি! বাপ্পা না? বোসেদের বাড়িতেই তো ঢুকছে। কান পাতি।

-----------------------------------------------

- ওসব এখন আর কেউ মানে না অঞ্জলি, কোথায় কে কী লিখেছে তা নিয়ে তুমি এত আপসেট কেন? আর সেই জন্যই দুবেলা গাছটার গোড়ায় জল ঢালছো? ধুপ দ্বীপ জ্বালোচ্ছ?

- তাহলে জ্যেঠুদের গাছ কাটার পর তোমার জ্যেঠুর ছেলে মারা গেল কেন?

- ও হো ওটা তো একটা এক্সিডেন্ট। গাছ কাটলেই যদি মানুষ মারা যেত তাহলে, পৃথিবীতে গাছ কাটা নিষিদ্ধ হয়ে যেত।

- তবুও তুমি রাজি হয়োনা, বাপ্পা প্রমোটারকে বলে দাও, তোমরা বাড়ি জমি গাছ কিছুই বেচবে না।

- তুমি পাগল? এত বছরের পুরনো বাড়ি, গাছ। কত দেবে বলেছে আইডিয়া আছে তোমার?

তুমি এ নিয়ে আর ঘ্যানঘ্যান করো না প্লিজ। এত শিক্ষিত হয়ে মনে এত অশিক্ষা পুষে রেখেছো? শেম অন ইউ!

- টাকাটাই বড় হলো? বাবারও তো ইচ্ছে নয় প্রপার্ট বেচার। এযুগের শিক্ষিত ছেলে হয়ে তুমি যে নিজের বাবাকে কষ্ট দিচ্ছো, শেম'টা তো তাহলে তোমার ওপরেও বর্তায়, নাকি?

অঞ্জলি চোখ মুছে দৌড়ে যায় ছেলের খোঁজে।

কী যেন একটা ঘটতে চলেছে! বুকটা টনটন করে ওঠে আতঙ্কে।

-------------------------------------

মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আজ বোতলের পুরোটাই শেষ হয়ে গেছে। আহ! বেশ হালকা লাগছে ভিতরটা। ওই বোসেদের বুড়োটা হেব্বি ঢ্যামনা। সাত কুল গিয়ে এককুলে থেকেছে এখনও বুড়োর শখ ঘুচলো না।

যাক, ছোট ছেলেটা পটে গেছে। আর দেরী করা যাবে না। লোহা গরম থাকতে থাকতেই পিটানো শুরু করতে হবে।

দরজা খুলে পটা ঢুকলো,"গুরু খবর আছে।"

ঢুলু ঢুলু চোখে বাপ্পা হাত নেড়ে ডাকে,"আয় আয়,নে খা। যত খুশি খা। বোসেদের কেসটা মনে হয় সাল্টে গেছে রে!"

পটা মুখ চুন করে মাথা নাড়ে,"না গুরু, মনে হয় এখনো কেস পুরোপুরি হাতের মুঠোয় আসেনি। এই তো ছোট বোসের সাথে বাজারে দেখা হলো, বললো, "ভেবে দেখি, বাবা রাজি হচ্ছে না" আর ওই ওর জ্যেঠুর ছেলে না কে মরে গেল না, ওটারও কী সব ফ্যাক্কর শোনালো মাইরি!"

- হুম! কী ভাবছে? এই গাছ কাটলে ওর ছেলেও...

- তাই তো মনে হলো গুরু, বউটাও নাকি ...!

- হ্যারে পটা ওই গাছে নাকি ভুত ছিল?

- হ্যাঁ এককালে ভগবানও ছিল শুনেছি।

- এখন তাহলে কার থাকার কথা?

পটার চোখ চকচক করে উঠলো,"কী বলছো গুরু?"

বাপ্পা কব্জি ওল্টালো," যদি বাঁশ না থাকে, তাহলে বাঁশি কি করে বাজাবি? ছেলেটাকে যদি খতম করে গাছের গোড়ায় ফেলে দিস, তাহলে...!"

- গুরু গুরু, আইডিয়া। দুপুরে ভুলিয়ে নিয়ে এসে...

- থাক, কাজে করে দেখা। পুত্রশোক পেয়ে বউ নিশ্চয়ই আর বাড়ি কামড়ে গাছ কামড়ে থাকতে চাইবেনা। বুড়োটারও বোধহয় হার্টফেল হয়ে যাবে। যা, পোড়ার জন্য কিছু কাঠ নাহয় আমি দিয়ে দেব।

ওই প্রপার্টি আমি কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেব না। শোন, সাবধানে, আমাদের প্রমাণ করতে হবে, গাছে ভুত নেয়, গাছটাই আসলে... হা হা হা!!!


-----------------------


- "কটা পাখি আছে কাকু? অনেক?"

- "অনেক। তুমি যটা চাইবে, নেবে।

- কিন্তু মা যদি বকে?

- মাকে বলবে কেন? তুমি তো টিফিনেই স্কুল থেকে চলে এসেছো আমার সাথে, পাখি দেখে আবার স্কুলেই ফিরে যাবে। মা জানবে কিকরে?

- ঠিক আছে। তাহলে তাড়াতাড়ি চলো, টিফিন আওয়ার শেষ হয়ে যাবে তো।


ঐতো ছেলেটাকে পটা নিয়ে আসছে। ওইটুকু ছেলে, আখের গোছানোর জন্য বাপ্পা এত নীচে নামতে পারে? কিছুতেই আমি এমনটা হতে দেব না। হ্যাঁ আমি চেয়েছিলাম, অভিশাপও দিয়েছিলাম। কিন্তু বউটা যে রোজ আমাকে পুজো করে! আমি কি করে ওর কোল খালি করে দেব?

মনে পড়ছে সেই আদ্দিকালের এক দোল উৎসব, মুখার্জিরা আবির দিয়ে চারিদিক রাঙিয়ে দিয়েছে, নতমস্তকে প্রণাম করছে! মনস্কামনা জানাচ্ছে। পূরণ হলে আড়ম্বর করে পুজোও দিয়ে যাচ্ছে। সেদিন তো আমি সবার ভালোই চাইতাম, কল্যাণ চাইতাম। আজ কি চাইনা?

আমার বাইরের বাকলেও আজ রঙের ছাপ, এবার মর্মে সেই রঙের শীতল ছোঁয়া পাচ্ছি আবার।

কিন্তু কিই বা করবো আমি? কিই বা করতে পারি?

ভুত কিংবা ভগবান কাউকে কোনোদিন আশ্রয় দিইনি, সবই তো মানুষের কল্পনা, তাহলে কি এবার আমাকেই ভুত, ভগবান দুইই সাজতে হবে?

-------


হঠাৎ করে এত পাতা পড়ার আওয়াজ হচ্ছে কেন? শুকনো তো নয়, নরম পাতা, তাও পড়ার এমন আওয়াজ? অন্য কোথাও হাওয়া হচ্ছে না তো!

অঞ্জলি বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। একি দেখছে ও?

বুবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার মাঝখানে। আর ওই লোকটা কে? ওই বাপ্পা প্রমোটারকে শাখরেদটা না?

"বুবাই..." চিৎকার করে অঞ্জলি দৌড়ে নীচে যায়, ততক্ষণে একটা মোটা গোটা ডাল পটার বুকের ওপর, ঠোঁটের কোণে তাজা রক্ত আর দুই চোখ বিস্ফোরিত, যেন ভুত দেখেছে!


----------------------------


দেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গটা আজ নিজে নিজেই ভেঙে দিয়েছি, সব থেকে বড় ডাল'টা। ওটাতেই তো এককালে মানোতের সুতো বাঁধতো সক্কলকে, ওই ডালেই এক সময় একটা ঝুল দোলনা টাঙানো ছিল। একটা আস্ত মানুষের চিতা দিব্যি সাজানো যাবে ওই ডাল টুকরো করলে।

খুব জ্বালা করছে, সারা গায়ে বড্ড ব্যাথা। পুঁজের মতো আঁঠা বেরিয়ে রয়েছে গাদা গাদা। নিজেকে কিরকম একটা বিকৃত দেখতে লাগছে। কিন্তু মনে একটা দারুণ প্রশান্তি। ওই একরত্তি শিশুটিকে বাঁচাতে পেরেছি। একটা মেয়ের ভক্তির সম্মান রাখতে পেরেছি। নিজেকে কেমন একটা রক্ষাকর্তা মনে হচ্ছে, যেমনটা সেই সময় লাগতো যখন কালাচাঁদের থান ছিল আমার কোলে!

এইজন্যই বোধহয় মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরশীল মানুষকে 'বটগাছ' আখ্যা দেওয়া হয়!

নিজেকে আজ বড্ড হালকা লাগছে মনে হচ্ছে এইভাবেই বুকে করে আগলে রাখি পৃথিবীকে।

কিন্তু ওরা যে বোঝেনা!

আমাদের কষ্টও ওরা বোঝেনা, আমাদের মমতাও ওরা বোঝেনা।

পাতাগুলো বুজিয়ে নিচ্ছি, লোকজন জড়ো হচ্ছে। নানান কথা বলছে। আপাতত নিজের কথা শুনি।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract