ভোরের সূর্য্য শেষ পর্ব
ভোরের সূর্য্য শেষ পর্ব
পর্ব একান্ন
( শেষ পর্ব )
শশাঙ্ক উদাস মনে বসে ভাবছে । ভাবছে নয় ; যেন জেগে স্বপ্ন দেখছে । স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট, চারুকাকার প্রত্যাখ্যান , জেঠুমণির ঘর বাড়ি দখল, হেডস্যারের পিওনের চাকরি অন্যকে দিয়ে দেওয়া , দরবেশ গাজীর অনুকম্পা, টাকা ছড়ানো থেকে বন্দী করে রাখা, এবং বোন-ভগ্নিপতির ষড়যন্ত্র , তার ফাসির আদেশ - সব একে একে চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে উঠছে।
শশাঙ্ককে গুম হয়ে বসে থাকতে দেখে বিপাশা বলল - কি হল তোমার ? এত কি ভাবছ ?
শশাঙ্ক নির্বিকার । কোন কথা বলছে না দেখে বিপাশা ওর নাকটা ধরে নাড়িয়ে দিতেই বলল - উমম্ !
- কি ভাবছ ?
- ভাবছি এ কি করে সম্ভব ?
- কি ?
- ফাঁসির দড়ি গলায় ঝুলে পড়তেই কেমন সোজা তোমার সামনে চলে এলাম !
হক সাহেব এসে বললেন - ও তো ঠিক বলতে পারবে না । আমি বলছ দি !
শশাঙ্ক হক সাহেবর দিকে চেয়ে রইল ।
- গাজীকে দিয়েই শুরু করি । কল্যাণপুরের বোমা বিস্ফোরণে তুমি জড়িত - রিপোর্ট পেয়ে তল্লাশি করছি । গাজী এসে বলল - আসামীকে ধরতে চান ? আসুন আমার সঙ্গে । একটুও চিন্তা না করে তাকে অনুসরণ করে উঠলাম সেই ভাঙা বাড়িটায় - যেখানে তুমি বন্দী ছিলে । গাজী বলল - দেখুন তো এই লোকটা কি না ? তোমাকে দেখেই চিনে ফেললাম । তারপর থানায় এনে চার্জশীট তৈরী করে কোর্টে চালান করে দিলাম। তখন তো জানতাম না গাজী তোমার চেহারার মুখোশ পরিয়ে শ্যামলকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছে । তোমার চুপ করে থাকা, পারিপার্শ্বিক তথ্য প্রমাণ এবং সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তোমার ফাঁসির আদেশ হয়ে গেল । আমার প্রমোশন হল । তার বেশ কয়েকমাস পর ডাক্তারের কলকাতার বাড়িতে বিপাশার কাছে সব শুনে আসল অপরাধী শ্যামলকে গ্রেপ্তার করলাম । গাজী তখনও অধরা । একদিন পাগলা গারদ থেক পালিয়ে আসা বিপাশা এবং ডাক্তার বাবু ও তাঁর মেয়ে জ্যাকলিনকে নিয়ে পাটনায় বিখ্যাত উকিল সর্বেশ্বর পাণ্ডের সঙ্গে দেখা করলাম । তাঁর প্রচেষ্টায় হাইকোর্ট তোমাকে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তির আদেশ দিলেন ।
শশাঙ্ক বলল - তারপর ?
- তঙমি তো কণ্ডেমড সেলে চলে গেছ । ডাক্তার বাবু এবং আমি রায়ের কপি নিয়ে জেলার সাহেবের সঙ্গে দেখা করি । তোমার ফাঁসির জন্য নির্দিষ্ট দু'দিন আগে ।
জেলার সাহেব তো বরাবরই আমুদে প্রকৃতির । তিনি বললেন - ফাইন ! আইন যখন তার পক্ষে গেছে আমরা একটু ডাইনে ঘুরি ।
শশাঙ্ক বলল - মানে ?
- আরে শোন না । জেলার বললেন - তাঁর স্ত্রী নাকি বলেছেন খবরটা তোমাকে না জানাতে । ফাঁসির দিন ভোর বেলায় বিপাশাকে এনে তোমাদের দুটি হৃদয় এক করে দেবেন ।
সেই ভাবে প্ল্যানমাফিক যুগপৎ ফাঁসির মঞ্চ এবং বিয়ের অনুষ্ঠানের মঞ্চ রেডি করা হল । ফাঁসির মঞ্চের নীচে একটা এস্কেলেটরের মত ইলেকট্রিক যান ফিট করে দেওয়া হল । তুমি জানলে তোমার ফাঁসি হচ্ছেই । সেইভাবে তৈরি করে তুমি যেন ঠিক বিপাশার মুখোমুখী এসে দাঁড়াও তার ব্যবস্থা করা হল । নিয়মমতো ফাঁসির আগের রাতে তোমাকে আপ্যায়ণ করে খাওয়ানো হল । তুমি যাতে সারারাত জেগে তোমার কথা জানাতে পারো সে জন্য সঞ্জনা ম্যা'ম আর জেলার সাহেব তোমার সঙ্গে অভিনয় করে গেলেন ।
- বাপ রে ! মাথায় ঢোকানো মুশকিল । তবে উকিলবাবু ডাক্তারের মেয়ের সঙ্গে তাঁর ছেলের বিয়ছ জেলখানায় দিলেন কেন ?
- সেটাও ভেবে চিন্তেই করা । জেলার সাহেব মিঃ পাণ্ডেকে বোঝালেন ছেলের বিয়ে স্মরণীয় করে রাখতে তিনি জেলখানায় যদি বিয়ের বন্দোবস্ত করেন তোমার এবং বিপাশার বিয়ের সঙ্গে তবে তা' একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে । পাণ্ডেজী রাজী হয়ে গেলেন । ব্যস আর কোন সমস্যাই রাইল না ।
- স্যার ! সুযোগ যখন পাওয়া গেলই আপনাকে একটা প্রশ্ন করি - আমাকে গ্রেপ্তার তো করলেন ; আমার কথাগুলোয় পাত্তা দেননি কেন ?
- আরে সেটাই তো আমার জীবনের বড় ভুল । আর তার জন্য চাকরিও খোয়াতে বসেছিলাম । কিন্তু ওই যে জেলার সাহেব ! সাক্ষাৎ ভগবান হয়ে জুটলেন । কি করলেন জানি না ; কোর্টের আদেশে ডিমোশন দিয়ে এস পি সাহেবকে থুতু ফেলে চাটা করালেন । আমি বেঁচে গেলাম ।
- সব তাঁর ইচ্ছা ।
শশাঙ্ক বলল - আমি বাঁচলাম, বিপাশা বাঁচল আবার আপনিও ?
জেলার সাহেব বললেন - এবার বাঁচার মত বাঁচতে শিখ। অন্তরের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিবি না কখনও । আমরা চাই জীবনকে সুখে দুঃখে বরণ করে নিতে । দেখ না ! আজ, আজ এই কাজ করে নিজেকে কত উৎফুল্ল মনে হচ্ছে আমার ।
পাণ্ডেজী, ডাক্তার বাবু, তোরা - আমরা এখন তো যেন একটাই পরিবার ।
শশাঙ্ক বলল - পড়েছি স্যার । অসদো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মামৃতং গময় ।
জেলার সাহেব বললেন - ওঁ শান্তি: ! ওঁ শান্তি: !! ওঁ শান্তি: !!!
( শেষ )