ভানগড়ের রাত
ভানগড়ের রাত
রাজস্থান সবাই গেছেন। আমি তখন সংসার ধর্ম ছেড়ে সাধুর বেশ ধরেছি। সন্ন্যাসি মানে নিরামিষ খাবার খেয়ে , দুই বেলা নাম জপ করা নয়। ধর্ম পালন করার জন্য জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। যার জন্য তীর্থস্থান গুলো ছুটে যান হয়তো মানুষেরা। পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে। যাইহোক পুস্তক এর যেতে গিয়ে , একদিন ভরত পুরে দূর্গ ডিগ গিয়েছিলাম। প্রথম দূর্গ দেখলাম ভালো লেগেছিলো খুব। খুব সুন্দর জায়গাটাও। আছে জলমহলও। কথায় ওখানেই রামানন্দ বলেছিলো ভানগড়ের করা।
সপ্তদশ দশকে ভগবন্ত দাসের ছোট ছেলে মাধো সিং ভারতের স্থাপত্যের একটি নিদর্শনটি তৈরি করেছিল । দুর্গের প্রতিটি ইটে রয়েছে মোগল সাম্রাজ্যের আভিজাত্যর চিহ্ন। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া রাতের ভানগড় দুর্গকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, তবু সাহসের বরাভয়ে সে এলাকায় ভূতের দেখা পেতে ওৎ পাতে অনেকেই। আমি ও তাদের দলে। যদিও এই কেল্লার চারিপাশে নেই কোনও জনবসতি।
কিছুতেই রামানন্দ যাবে না আমার সাথে। কিন্তু রাধা রানীর কৃপায় , এক তান্ত্রিক দেখা মেলে, বর্ষণার পথে। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা। সে প্রথম দর্শনেই বলে " ঈশ্বরের বেটা হয়ে , তোরা ভুত প্রেত কে ভয় করিস। তাছাড়া তোরাতো লেখা পড়া জানা"
এই অঞ্চলে মানে এমনকি গোবর্ধন অঞ্চল এ বৈষ্ণব সাধুরাও আমাদের তেমন চেনেন না কিন্তু, এ কিভাবে। উনি আমাদের চিনলেন। ভক্তি গদগদ হয়ে একটা লম্বা চওড়া প্রনাম ঠুকে দিলাম। বাবা অভয় দিলেন আমাদের সে নিয়ে যাবে। কারণ সত্যি তো ভাণগড়ের যাবার ইচ্ছে আমাকে সাধণা ভজনায় মন বসাতে দিচ্ছে না, রাত বাড়ার আগেই আমরা বিদায় নিলাম বাবার ডেরা থেকে।
পরেরদিন রাতে রামানন্দ কিছুতেই যাবে না আমার সাথে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেলাম ওকে। ও দেখি ঐ তান্ত্রিক কে সন্দেহ করছে ও বলে " ও লোকটাও গন্ডগোলে নয়তো। এতো দূরে অচেনা পথে রাতে যাবে কেন উনি? "
আমি অনেক কষ্ট বোঝালাম তান্ত্রিক মানুষ তাই উনার কাছে রাতটাই নিরাপদ। রামানন্দ কে প্রয়োজন ছিলো না, কিন্তু আমি ভালো বাইক চালাতে জানি না । হয়তো চেষ্টা করলে পারবো, কিন্তু ডবল ক্যারি অতোটা পথ সম্ভব নয়। গিয়ে দেখি সুজন বন্ধু ও হাজির যাবে আমাদের সাথে। সে নাকি এই বাবার চ্যালা। আমার মুখ বাংলার পাঁচের মতো দেখে , বাবা বললো " চিন্তা মত কর। আজ যাবো, সাধান ( গাড়ি) হামার আছে।"
দেখি একটা পুরনো দিনের ঘোড়ার গাড়ি। আমার মনে একটা খটকা লাগলো। কিন্তু রামানন্দ জন্য সব গুলিয়ে গেলো। জেদের বশে রওয়ানা দিলাম। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি আমার গুরুদেব এর আমি একমাত্র শিস্য। ফলে উনার অবর্তমানে আমি, গোবিন্দ কুন্ডু পাশে অবস্থিত এ বিশাল আশ্রমের মালিক। তাই আমার ক্ষতি অনেক ই চায়। রামানন্দ বললো ওরা সেই রকমই ফন্দি এঁটেছে। কিন্তু আমার সুজন কে বিশ্বাস করি।
যাইহোক গোবর্ধন থেকে ঘন্টা ছয়েকের রাস্তা হবে ভানগড়।রাজস্থানের আলওয়ার জেলার রাজগড় পৌরসভায় অবস্থিত। সবচেয়ে বড় কথা ভানগড় সরিস্কা টাইগার রিজার্ভের ধারে। এখানে বেশি লোক জন বাস করে না। বিশ বছর আগে এ অঞ্চলে বাস করত হাজার খানেক মানুষ।
লোক কথা অনুযায়ী।এক সুন্দরী রাজকুমারীর কাহিনী এই রাজ্যে বাস করতো। সেই রাজকুমারীকে পছন্দ হয়েছিল এক তান্ত্রিকের। জাদু ছড়িয়ে বশ করার চেষ্টা করেছিলেন রাজা রানীকে, রাজা রানী যাতে রাজ কুমারী কে বিয়ে দেয় ঐ তান্ত্রিক এর সাথে। যদিও রাজকুমারী তা বুঝে ফেলে মেরে ফেলেছিলেন তান্ত্রিককে। যদিও মৃত্যুকালে যে শাপ দিয়ে গিয়েছিলেন ওই তান্ত্রিকএক সুন্দরী রাজকুমারীর কাহিনী। সেই রাজকুমারীকে পছন্দ হয়েছিল এক তান্ত্রিকের। জাদু ছড়িয়ে বশ করার চেষ্টা করেছিলেন ওই সম্রাজ্ঞীকে। যদিও রাজকুমারী তা বুঝে ফেলে মেরে ফেলেছিলেন তান্ত্রিককে। তান্ত্রিক মৃত্যুকালে দিয়ে যাওয়া অভিশাপে , আজ ভানগড়কে ভৌতিক নগরীর হয়ে গেছে ।, সবাই নাকি এক সাথে মরে গিয়ে ছিলো এখানে।
অবাক করা বিষয় ঘোড়ার গাড়িটা থামলো ঠিক ভানগড়ের সীমানায় । জানিয়ে রাখি এখানেএকটি বোর্ডও রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে যে সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের পরে শহরের থাকা কঠোরভাবে বারণ। তখন সূর্য উদয় হয়নি, কারা জেনো ডাকলো আমাকে নাম ধরে। গা ছমছম একটা ভাব। তান্ত্রিক বাবা আমার গায়ে একটা জল ছিটিয়ে বলো। সূর্যোদয় আগে গাড়ি থেকে যেনো না নামি। আজ সারাদিন না খেয়ে আমাকে এখানে ই অপেক্ষা করতে হবে সন্ধ্যা পর্যন্ত নয়তো ঘোর বিপদ।
সারাদিন কেটে গেল ঘুমিয়ে আর নেট ঘেটে ঘেটে আরো আতংক বেড়ে গেলো, আজ অবধি এই ভুতেরে শহরে যারা থাকতে এসেছে তাদের খুঁজে পাওয়া যাইনি। যতো গুলো মিডিয়া হাউজ কিংবা প্যারানরমাল রিসার্চ সেন্টার এর উপর গবেষণা করতে এসেছিল তারোও এখানে বেশি রাত অবধি কাজ করার ঝুঁকি নেয়নি আছে। এখানে দিনের বেলায় ও কেউ কেউ নূপুর এর শব্দ, নিঃশ্বাস এর উত্তাপ পেয়েছে।
চোখ খুলে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে , আমার গায়ে জল ঢেলে দিয়েছে তান্ত্রিক, আমার হাত পা বাঁধা । অদ্ভুত রহস্যময় ব্যাপার রামানন্দ কে গাছের সাথে বাঁধা, কালি ঠাকুর একটি মূর্তি তবে সেটা ভয়ঙ্কর, যদিও তার দুই টি হাত পায়ের তলায় শিব নেই, গায়ে অনেক সাপ জরানো তাও জ্যান্ত। একটা বলি কাঠ মালা দিয়ে সাজাছে সুজন।
আমি বাবা জিজ্ঞেস করলাম "কি হয়েছে এসব রামানন্দ কে, গাছে বেঁধে রাখা হয়েছে কেন?"
বাবা জাবাব দিলো" ওকে তো এখানে প্রয়োজন নেই ও এসে কেন?"
একটু ভয়ে নরম আমি প্রশ্ন করলাম" এসবের মানে কি?"
একটা বির্শ্রী অট্টহাসি হাসলো তান্ত্রিক, সে হাসিতে সারা জঙ্গলের পাখিরা ও ভয়ে চিৎকার করে উঠল। বললো " আমি সেই তান্ত্রিক যাকে এই রাজ্যের রাজকুমারী মেরে ফেলে ছিলো তোর জন্য। একটা গাড়য়ানের ছেলে তুই, রাজকন্যা তোকে ভালোবাসতো বলেই , আমাকে বিয়ে করেনি। আজ তোর বলি দিলে আমি মুক্ত হবো। আমার প্রতিশোধ নেওয়া শেষ হবে। সেই দিন তোকে বাঁচাতে ও আমাকে মেরেছিলো। আজ এই গন্ডি পেড়ালেই ও শেষ হয়ে যাবে, জয় হবে আমার ই। "
তান্ত্রিক যোগ্য হোম করতে ব্যাস্ত হলো। ঐ মন্ত্র পাঠ মধ্যে ও আমি শুনতে পেলাম নপুরের আওয়াজ গন্ডি চারিদিকে ইতস্তত ঘরা ফেরা করছে। প্রান যাওয়ার ভয় ভুতের ভয়ে চেয়ে কম, এটা উপলব্ধি করে ইসরা করলাম রামানন্দ কে পা দিয়ে গন্ডী টা মোছার জন্য।
ও সক্ষম হলো। এটা দমকা হাওয়া নিভিয়ে দিলো হোমের আগুন। একটা তরবারি দিয়ে, কে যেন কেটে ফেললো তান্ত্রিক এ মাথা। তান্ত্রিক মাথাটা আর্তনাদ করলেও , শরীর জায়গা দেখলাম হাড় গড় পরে আছে। সুজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। জ্ঞান হারাবে বা কেন? কোথা থেকে হাজির হলো সিনামা , ছবিতে দেখা একটা গোটা রাজ কুমারী। সুচিত্রা সেনের , কিংবা ঐশ্বরিয়া বচ্চনের চেয়ে সুন্দরী। আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। যখন সে হিন্দি তে বললো। সে নাকি কয়েক শত বসন্ত আমার অপেক্ষা আছে। সে জানতো ভালো বাসার জয় একদিন হবেই। আমি নাকি ফিরে আসবো ই সে জানতো।
যাইহোক আপনি ভাবছেন, এ গল্প লেখার জন্য আমি জীবিত কিভাবে ফিরলাম। সেই গল্পেই আসছি। হঠাৎ রাজকন্যার চোখ এ জল অভিমানের সুরে বললো ," আজ দিন কোন দিন নিশ্চিত তুমি ভুলে গেছো।"
জীবনে জ্যান্ত মানুষের সাথে প্রেম করি নি, ভুতের সাথে কিভাবে করবো। তবে বন্ধু বান্ধবদের থেকে গল্প যা শুনেছি। মেয়েদের একটাই অভিযোগ ছেলেরা তাদের জন্মদিন আর বিবাহ বার্ষিকী টা ভুলে যাই। উপস্থিত বুদ্ধি করে বললাম" ভুলবো কেন আজ তোমার জন্মদিন"
ভয় লাগছিলো ভুল বললেই ঘাড় মটকে দেবে। যাইহোক রক্ষা এ যাত্রায়। খুশিতে রাজকন্যা একটু নেচে নিলো। তারপর বললো " তা আমার উপহার কৈ "
উপস্থিত বুদ্ধি করে বললাম" ওইতো গাড়িতে রেখে এসেছি এখনি নিয়ে আসছি।" আগেই বলেছি, বোধহয় লোক কথা অনুযায়ী ঐ সীমানার বাইরে রাজকন্যা কিংবা ওর লোকজন বাড়াতে পারে না তাই রক্ষা। সীমানা পেরিয়ে দাঁড়ালাম না। যতোক্ষন দম ছিলো প্রাণ পনে দৌড়ে গেলাম , ততক্ষণ । দুপুরে পৌছালাম আশ্রমে। দেখালাম অনেক মানুষের ভিড়। আমি আশ্রম থেকে দিল্লি যাচ্ছি বলে বেড়িয়ে ছিলাম। রামানন্দ আমাকে এগাতে গিয়েছিলো মথুরা পর্যন্ত সেটাই সবাই জানতো। শুনলাম ফেরার পথে সুজন ও বর্সনা রোডে গিয়ে ছিলো কোন কাজে সেখানে ই ওরা পথ দূর্ঘটনায় মারা গেছে। রাতে র গল্প টা তাই কাউকে বলতে পারলাম না। মথুরা তে থাকতে পারলাম না। হাজার হোক আমি তো জানি ওদের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী।।।
