ভালোবাসার মার
ভালোবাসার মার
মনসার বয়স এই সবে ১৯ ওদের গ্ৰাম থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের এক কলেজে এখন সে প্রথম বর্ষে পড়ছে।ভালো নাম মানস কিন্তু গ্ৰামে তাকে মনসা বলেই ডাকে কিছু জন তো ওর ভালো নামটাও জানে না।বাবা জয়দেব,বাপ ছেলের ই সংসার।
মা আছে তবে সে ওদের সাথে থাকে না কারন আজ থেকে ১২বছর আগে যখন জয়দেবের মা ও বাবা বেঁচে ছিলো তখন পারিবারিক অশান্তির কারনে সে পরের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো বলে গ্ৰামে লোক মুখে শোনা যায়।আবার কিছু জন বলে জয়দেবের মা ও বাবা দুজনেই যেহেতু কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ছিলো তাই তাদের সেবা করতে করতে সে হাপিয়ে উঠেছিল তার উপর প্রতিবেশী র সাথে অশান্তি তাই সে আর নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারেনি।
আজ মা বিপদতারীনি-এর পুজো,এবারের পুজোটা ওদের বাড়িতেই হচ্ছে কারন স্ত্রীকে গ্ৰাম থেকে বার করে দেওয়ার পর সংসারে র সব দায়ীত্ব জয়দেব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে।৭ বছরের ছেলেকে বড়ো করা থেকে মা- বাবার সেবা,বাড়ির সব কাজ পুজো- আচ্চা এমনকি সে এখন একটা কাপড় দোকান ও খুলেছে গ্ৰামে আর চলছেও ভালো তার ফলে আর্থিক অর্থাভাব হয়নি।
আজ পুজোটা যেহেতু মনসা দের বাড়িতে হচ্ছে তাই বাপ-ছেলে দুজনেই খুব ব্যস্ত।-এর ই মাঝে মনসার পিসি ফোন করে যে তার ছোটো মেয়ের বাচ্চা হয়েছে তাই তার বাড়িতে জেনো কেউ পুজোর ফুল আর কিছু পুরোনো জামা-কাপড় নিয়ে আসে।
বাড়িতে যাওয়ার জন্য কেউ না থাকায় মনসা যায় ওর পিসির বাড়ি।পিসির বাড়িতে তার দুই জামাই ও মেয়েও এসেছে তাদের সাথে একটা দিন মনসার ভালোই কাটে বেশ।
এখানে এসে মাকে ও বেশি মনে পড়েনি ওর, না হলে বাড়িতে থাকা কালীন তো এতো মনে পড়ে যে মাসে একবার একা নিজেই মায়ের সাথে দেখা করে আসে।ওর মা ও অবশ্যই নিজের ভুলের জন্য অনেক ক্ষমা চেয়েছে শশুর-শাশুড়ী মারা যাওয়ার পর তো গ্ৰামের লোক ও জয়দেব কে বলেছিলো মনসার মাকে ঘরে নিয়ে আসতে।কিন্তু কেনো জানি জয়দেব ই রাজী ছিলো না মনসার মাকে আনতে।
মনসার পিসির বাড়ি যাওয়ার দু-তিনদিন পর এক সকালে জয়দেবকে মনসার পিসির ফোন আসে বলে যে মনসাকে সাপে কেটেছে তাই ওরা ওঝা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে সেও জেনো চলে আসে তাড়াতাড়ি।জয়দেবের তো খবর শুনে মাথায় হাত তার বাঁচার একমাত্র সম্বল তাকেও সাপে কাটতে হয় সে আর কোনো কিছুই ভাবতে পারছে না। তাই তাড়াতাড়ি করে সে বোনের বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে সারা রাস্তা মা বিপদতারীনি মাকে স্মরন করতে করতেই গেছে সে।
কিন্তু রাস্তায় ফোন আসে যে তারা মনসাকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে সে জেনো বাড়ি না এসে সোজা হসপিটাল চলে আসে।
জয়দেব হসপিটালে পৌঁছয় সেখানে এসে দেখে যে তার ছেলের নিথর দেহ ওর সামনে।শান্ত মনসা আজ একদম শান্ত হয়ে গেছে।নিজেকে সামলিয়ে ও ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে যে ওর ছেলেকে কোন সাপে কেটেছে...??
কিন্তু উত্তরে যে কথাটা ডাক্তার বলে সেটা শুনে জয়দেবের মাথা ঘুরে যায়...ডাক্তারবাবু বলেন যে"মনসার গায়ে কোনোরকম সাপে কাটার লক্ষন ই নেয় উল্টে বরং ওর নখগুলো কালো হয়ে গেছে আর নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে"।
মনসাকে গ্ৰামে সবাই খুব ভালোবাসতো তাই ওর সাপে কাটার কথা শুনেই কেউ ঠিক থাকতে পারেনি জয়দেবের সাথেই তারা যেতে চাইছিলো কিন্তু এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যে জয়দেবে ই ওদের যেতে বারন করে বলে যে ও ফোন করবে।
গ্ৰাম থেকে মনসার খোঁজ নেওয়ার জন্য যখন জয়দেব কে ওরা ফোন করে..অনেক্ষন ফোন বেজে চলার পর জয়দেব ফোন তোলে এবং ওদের সব কিছু জানায়।এই কথা শুনে তারা বলে যে পুলিশে খবর দিতে কারন এই রকম লক্ষন কোনো সাপেই হতে পারে না বরং অন্য কিছু আছে -এর পিছনে।জয়দেবের মনের অবস্থা একদম ভালো না আর ভালো থাকারাও কথা না।যে ছেলেকে নিয়ে এতো কিছু স্বপ্ন দেখলো, সে ছেলে আর বাবা বলে ডাকবে না,মায়ের সাথে দেখা করার জন্য বায়নাও করবে না,আর বলবে না যে বাবা তুমি আজ দোকান সামলাও বাড়ির দিকটা আমি দেখে নিচ্ছি,জ্বর হলে আর কেউ চিন্তা করবে না।সত্যি কম বয়সে সন্তান হারা কষ্ট খুব ভয়ানক।জয়দেব ফোন করে গ্ৰাম থেকে কিছু ছেলেকে আসতে বলে,আর ওদের সাথেই সদর থানায় গিয়ে পুলিশকে সব জানায়।পুলিশ আকস্মিক মৃত্যুর কারন জানার জন্য তদন্ত শুরু করে এবং মনসার শান্ত শরীরটাকে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দেয়।
জয়দেব ওর ছেলের সাথে থাকার জন্য জেদ করে কিন্তু ওখানে তো থাকার অনুমতি নেই তাই গ্ৰামের ছেলেরায় বুঝিয়ে ওকে গ্ৰামে নিয়ে আসে।
আজ পুরো গ্ৰাম একদম শান্ত সব জায়গায় মনসা কে নিয়ে আলোচনা,মনসার মৃত্যুতে সবাই খুব আঘাত পেয়েছে।একটা জল জ্যান্ত ছেলের এভাবে কি করে কিছু হতে পারে...?
গ্ৰামে লোকের মুখে বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন কথা আলোচনা হচ্ছে কেউ বলছে মনসার এই অস্বাভাবিক মৃত্যু টা কী খুন..?আর যদি খুন হয় তাহলে খুনটা কি সম্পত্তির জন্য হলো..? কারন জয়দেবের অর্বতমানে যে টুকু আছে জমি-জমা আর ওই বাড়িটা সবেই তো মনসার আর যদি মনসা না থাকে তাহলে কার ওর পিসির পরিবারের...?
আজ মনসাকে দাহ করা হলো গ্ৰামের ই শশ্মানে এখনও পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট আসেনি আরও বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে আসতে।আজ মনসার মা আর ওর দিদা ছুটে এসেছিলো মনসাকে শেষবারের মতো একবার দেখতে কিন্তু তাদের শেষ দেখা হয়নি কারন ওরা পৌঁছাবার আগেই চিতায় আগুন পড়ে গিয়েছিলো।মনসার মা আর বাড়ির দিকে যায়নি এতদিন যার জন্য বাড়ি যাওয়ার জন্য বলতো আজ সেই কারনটাও আর নেই তাই ওরা শশ্মান থেকেই ফিরে গেছে।আজ জয়দেব আর ওর স্ত্রীয়ের জন্য খুব কঠিনতম দিন যে ছেলে ওদের মুখে আগুন দিতো সেই ছেলের মুখে আজ আগুন দিতে হলো এই দৃশ্য দুনিয়ার সব থেকে কষ্টতম।
জয়দেব দাহ করে বাড়ি ফিরে এল ওকে দেখে গ্ৰামের কিছু কিছু লোক বলতে শুরু করেছে যে "ওর মধ্যে নাকি ছেলে হারানোর কোনো শোক ই নেই" আবার কেউ বলছে যে"আজ যদি মনসার মাকে জয়দেব নিয়ে আসতো তাহলে অন্তত এই ঘটনাটা ঘটত না"।এই একটা ভুল আমরা সব সময় করি যে হারালো তাকেই দোষটা দিই আচ্ছা মনসা কার সন্তান জয়দেবের তো তাহলে হারালো কে জয়দেব তো,কষ্টটা কার বেশি জয়দেবের তো,তাহলে কি করে বলছে তারা..?সব কষ্ট কি চোখের জল আর জোরে চিৎকার করে বেরোয়..?কেনো কষ্ট গুলো কি মনে মনে নিজেকে না ভেঙে পড়ার স্বান্ত্বনা দিতে দিতে বাইরে হাসিমুখ আর ভিতরে জলের বন্যা করে হয় না..?আমরা তার কষ্টের ভাগীদার না হতে পারি অন্তত নিজের এই কথার ছুরি গুলো না চুবাতে তো পারি..?সবার কষ্ট বের করার রাস্তা এক না কেউ নিজেকে চুপ করে রেখে মুখে হাসি নিয়েও কষ্টগুলো গেলে....
আজ মনসার আত্মার শান্তির জন্য কাজ হচ্ছে সব কাজ জয়দেবে য় করছে যখন সে পুকুর থেকে ঘাট কামিয়ে খোল-কীর্তনের সাথে বাড়ি যাচ্ছিলো সেই দৃশ্য দেখে রাস্তার আশে-পাশের ভালো মানুষগুলোর চোখেও জল এনেদিয়েছিলো আর তারা মনে মনে প্রার্থনা করলো"ভগবান জেনো এই দৃশ্য শত্রুকেও না দেয় দেখার"।
পুলিশ তদন্ত করছে তবে এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর পিছনের কারনটা এখনও খুঁজে পাইনি তবে এটা হয়তো কোনো ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসার মার...
লেখাটি আপনাদের কেমন লাগলো জানিও অব্শ্যই....লেখাতে আমার হাত অতটা যদিও ভালো না তবে এই ছোটো গল্পটি লেখার চেষ্টা করলাম....সবাই কমেন্ট করবেন...
