বাঁশকথা
বাঁশকথা


আমি কিন্তু আদ্যপ্রান্ত খুব নিরীহ এবং মানুষ নামক একটি জীব।
নিতান্ত সাধারণ ।খেটে খাওয়া শ্রেণীর।পড়াশুনো যাহোক কিছু দূর টেনে, টুনে করেছিলাম।
প্রতিদিনের দারিদ্রতা,আমাকে কেতাবি জগত থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।
তাই খুব বেশি পাঠ্যজ্ঞান অর্জন করতে পারিনি।
এতদূর পড়ে হয়ত ভাবছেন,আমি আত্মজীবনী লিখতে বসেছি।একদম না।আসল ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলি।
সেদিন মোড়ের দোকানে চা খেতে বসেছি।হঠাৎ কোথা থেকে এক ইস্কুলের বন্ধু, দুজন সাঙ্গ,পাঙ্গর সাথে হাজির।
এসেই উল্টো দিকের চেয়ার দখল করে বসে পড়ল।বছরের অর্ধেক দিন আমার পরবাসে কাটে।অর্ধেক দিন পরিবারের সাথে।সেটা বন্ধুদের সবাই জানে। বাড়িতে আমার জীবন অবসরপ্রাপ্ত কোন অফিসারের মতো।
সেই নিয়ে গিন্নীর বেজায় অভিযোগ ।উঠতে,বসতে খোটা।আমি গায়ে মাখি না। এক কান দিয়ে শুনি, অন্য কান দিয়ে বের করে দিই।সবাই পারে না।আমি পারি।
লেখালেখি করি।এটা আমার সাধনা।মোড়ের এক পাশে আমাদের লাইব্রেরিটা।বাড়ি এলে রোজ সেখানে একবার হাজিরা দিতে যায়।পুরনো প্রেমিকের মত আমাকে আকর্ষণ করে।এক চক্কর না কাটলে দিনটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।যেসব বই আছে।বেশিরভাগ পুরাতন।অনেক আগে হজম করে ফেলেছি।এখন শুধু গন্ধ শোকা।তারসাথে পেপারের হেডলাইন গুলো দেখে নিই।সব শেষে হাজিরা খাতায় দু,তিনটে সাইন ঠুকে চলে আসি।একটা নিজের।দুটো অন্যের।লাইব্রেরিটাকে মডেল করার প্রস্তাব এসেছে।তাই এসব করা
!...আজকালকার ছেলে,মেয়েরা তো স্মার্টফোন নিয়েই ব্যস্ত।পাঠাগারে বসার সময় পর্যন্ত নেই।...এমন দুঃসময়ে আমরাই পালে হাওয়া ভরছি।কারণ মডেল হলে,সুবিধে আছে।সবথেকে বড় কথা,নতুন বই আসবে।তাতে আমারই লাভ। ছুটির দিনগুলো ভালোভাবে কাটবে।
আমি গরম চায়ের সাথে সিঙাড়া ভেঙে মুখে ঢুকিয়েছি।অমনি বন্ধুটি হো হো করে হেসে বলে উঠল,বন্ধু হে...বলি পাঁচ তারিখে দূর্লভপুর যাচ্ছো তো?গাঁয়ে,গাঁয়ে বাস দিচ্ছে নেতারা। চিন্তার কোন কারণ নেই।
কথাটা শুনে মেজাজ হারিয়ে ফেললাম। সিঙাড়ার দুকান জুড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,বাস দেবে মানে? নেতারা নিজেদের ভাবেটা কি হ্যা? গরীবগুলোর রক্ত পান করে মন ভরে না।আবার নতুন বাঁশ দেওয়ার ফন্দি!
বন্ধুটি সাথে,সাথেই আমাকে শান্ত করে বলে উঠল, সেই বাঁশের কথা বলছি না বন্ধু।এ বাস হল,চারচাকাওয়ালা লাইন বাস।
যাক,শুনে অল্প রাগটা কমলো।তবু গম্ভীর গলায় বলে উঠলাম,আমি বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসেছি। বাসে চেপে নেতাদের বাঁসুরি শুনতে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই।
সেখান থেকে বেরিয়ে গুমটির পাশে এসে দাড়ালাম।গরম,গরম চপ ভাজা দেখছি।
আগের বার ছুটিতে এসে দেখেছিলাম, গোটা মোড়ে একটাই মাত্র চপের ভ্যান।
এবছর দেখি আবার তিনটে বেড়েছে।বুঝলাম,সত্যি,সত্যিই চপশিল্পে উন্নতি ঘটছে।আমি নিজেও একজন চপভক্ত বাঙালি।মহারাষ্ট্রে বড়া,পাও দিয়ে চপের অভাব পূরণ করে থাকি।
একটা ভ্যানের কাছে দেখলাম, নিতাই দাড়িয়ে আছে।চপ খাচ্ছে । দুজন একই সঙ্গে ইস্কুল ছেড়েছিলাম।এখন ও মস্তবড় রাজমিস্ত্রী। জিজ্ঞাসা করলাম,কেমন আছো নিতাই?
জবাবে সে চপের উপর বিটনুন ছিটিয়ে বলে উঠল,ভালো নেই রে মহেশ।মালিকরা সকাল,সন্ধে বাঁশ দিচ্ছে।তুমিই সুখে আছো বন্ধু।
আমি অবাক হয়ে বলে উঠলাম,আমার শুধু একা সুখ কেন? তোমারই বা অশান্তিটা কিসের?দুবেলা কেমন মালিক বাস পাঠাচ্ছে ঘরে! চেপে কাজে যাচ্ছো!এর পরেও বলছো, সুখে নেই?
কথাটা শুনে নিতাই তাবলানো বন্ধ করে বলে উঠল,আরে ভাই...এ বাস চার চাকাওয়ালা ডিজেল ইঞ্জিন নয়।এ বাঁশ হল ঝাঁড়ের বাঁশ।একেবারে কঞ্চি সমেত।এক সাথে দশটা বাড়ির কাজ ধরেছি।এখন লেবার পাই কোত্থেকে?তাই মালিকদের গালিগালাজ শুনতে হচ্ছে।বড় ফাঁপর ব্যাবসা বন্ধু।যতদিন রাজমিস্ত্রী ছিলাম।অসুবিধা ছিল না।যেই বেশি টাকার চক্করে কনট্রাক্টর হয়ে গেলাম।আর রেহায় নেই।দিন,রাত শুধু টেনশন আর টেনশন।সেইথেকে মাথায় টাক পড়ে গেল।
সন্ধ্যাবেলায় দাওয়াতে বসে আছি। বন্ধুদের আড্ডায়।এমন সময় সুবোধদা এসে,আমাকে চুপিসারে ডাকলো।
আড্ডায় মেসি আর রোনাল্ডহোকে নিয়ে তর্ক চলছে।আমার এসব পছন্দ নয়।যেখানে নিজের দেশই নেয়। সেই বিশ্বকাপ নিয়ে এত মাতামাতির কারণ বুঝি না। তাই সুবোধদার ডাকে সরে এলাম।
কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল, গোটা কতক বাঁশ দিবি?
কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম।অন্ধকারে সুবোধদা আমার অভিব্যক্তি ঠিক ঠাওর করতে পারেনি। তাই আবার বলতে শুরু করল,সারা গাঁয়ে খোঁজ করলাম।কেউ দিতে রাজি হল না।তাই শেষমেশ তোর কাছে এলাম।দাম দিয়ে নেব।এমনি চাইছি না।
আমি এবার সন্দিহান গলায় বলে উঠলাম,তুমি ঠিক কোন বাসের কথা বলছো, একটু বুঝিয়ে বলবে?
এতক্ষণে দাদাটি আমার প্রশ্নটা বুঝে ফেলেছে।তাই বিরক্তি ঝেড়ে বলে উঠল,ধুর তেরি!...আমি তোর বাঁশঝাড়ের কথা বলছি। প্যান্ডাল খাটানোর জন্য কয়েকটা বাঁশ দরকার।অন্য বাঁশ নিতে তোর কাছে আসব কেন রে?..সেসব দেওয়ার জন্য অনেক লোক আছে।
সেই মত সকাল,সকাল সুবোধদার লোক বাঁশ কাটতে শুরু করে দিল।
খবরটা কিভাবে আমার বড় জ্যেঠুর কানে পড়ে গেছে।
তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত মাষ্টারমশাই আমার কাকা,জ্যেঠুরা মোট পাঁচ ভাই।আমার বাবা কেবলমাত্র বেঁচে নেই।তিনি ভাইদের মধ্যে ল।পড়াশুনো করেননি।বাকি সবাই শিক্ষিত।এবং হিসেবে এত নিখুঁত যে কেশবনাগ ফেল।তাদের একেবারে উল্টো ছিলেন আমার বাবা।তাই সাত তাড়াতাড়ি যমরাজের হাত ধরে বিদায় নিয়েছেন। এখন উপর থেকে হিসেবি ভাই,দাদাদের অঙ্কযুদ্ধগুলো
দেখছেন!
জ্যেঠু এসেই আমাকে প্রথমে একচোট গালাগাল শুনিয়ে দিলেন।তারপর বলে উঠলেন,কী মনে করেছিস তুই নিজেকে?...আমাদেরকে না জানিয়ে বাঁশ কাটাস কোন সাহসে?
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম।কারণ বাবার পৃথক হওয়া প্রায় বছর সাতেক হয়ে গেছে।এত বছর ধরে আমার বাবা এ ঝাঁড়ে বহু বাঁশ কেটেছেন। তখন কেউ কোনদিন বাঁধা দেননি। কারণ সবাই জানতেন, এটা বাবার বাঁশঝাড়।আজ বাবা নেয়।তখন সেটা সবার হয়ে গেল। মাষ্টারজেঠুর লাফঝাপ আমাকে বিরক্ত ধরিয়ে দিল।
তাই বলেই ফেললাম,তা পুরো ঝাড়টাই আপনি নিন না। বাবা তো জীবদ্দশায় আপনাদের কারো কোন ক্ষতি করেননি।শুধুমাত্র মরণকালে রেখে গেছিলেন এই বাঁশ ঝাড়খানি।এখন যদি আপনারা স্বেচ্ছায় বাবার সেই ঝাড়ের বাঁশ নিতে রাজি থাকেন...নিন না।তারজন্য লাফঝাপের কোন দরকার নেই।
এদের আর একটি বড় গুণ হল।হিসেবটা নিখুঁত বুঝলেও।কাব্যিজ্ঞানের প্রতি এতটুকুও আগ্রহ নেই।তাই আমার কথার আসল মানেটা ধরতে পারলেন না। উত্তরে তিনি আবার বলে উঠলেন,আমি একা নেব কেন?বাকি চারজনেরো সমান ভাগ আছে।সবাই নেবে।
উত্তরে বাকি তিনজন ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানালেন।
এদিকে আমি তো আর হাসি পেটের ভেতর রাখতে পারছি না।এত হাসি পাচ্ছে। ওনারা ভাবছেন,আমি বোধহয় পাগল,টাগল হয়ে গেলাম। বাবার বাঁশের ভাগ হচ্ছে দেখে।
কিছুদিন পর একটা সাহিত্য সম্মেলনে ডাক পড়ল।কোলকাতা যেতে হবে।তাদের আসন্ন পত্রিকার মোড়ক উন্মোচন।তারসাথে গল্প প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার দেবেন।
বিজয়ীদের মধ্যে আমিও একজন।তাই যাব ভাবলাম।খরচাপাতির চিন্তা মাথায় আসতেই, পরিতোষকে ফোন লাগালাম।নদীয়ায় বাড়ি।কোলকাতায় থাকে।সপরিবারে।ভাল চাকরি করে।অনেক বছর আগের কথা, দুজন একসাথে নাইট গার্ড করতাম। আমি সংসার টানতে,আর ও পড়াশুনোর খরচ জোগাতে।ওর সেই পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।মাত্র তিন মাসের পরিচয়। আজ দশ বছর পরও অম্লানভাবে রয়ে গেছে। তাই ওখানে আমার থাকা এবং খাওয়াটা ম্যানেজ হয়ে গেল।
পরিতোষের বাসা থেকে ফেরার দিন দুপুরবেলা।একটা তরকারির স্বাদ আমার জিভে লেগে গেল।
কিছুতেই আর বুঝতে পারলাম না। তরকারিটা ঠিক কিসের?
তাই মাসিমাকে বলেই ফেললাম,আচ্ছা..মাসিমা ওই লাস্টের সব্জিটা কীসের ছিল যেন?
উনি সহাস্যে জবাব দিয়ে উঠলেন,বাঁশের।উত্তরটা শুনে আমি রীতিমত চমকে উঠলাম।পরিতোষরা যে বাঙাল সেটা জানি।এবং বাঙালদের রান্নার সুনাম সর্বজনবিদিত।তা বলে উনারা যে বাঁশটাকেও সুস্বাদু রান্না করে ভালবেসে খাওয়াতে পারেন!!...এটা জানা ছিল না।
আমি বললাম,বাঁশ!!...বাঁশের আবার রান্না হয় নাকি?
-----এটা হল কচি বাঁশ।মোচা ছাড়িয়ে নরম অংশটা বের করে রান্না করা হয়।কেন ভাল লাগেনি বুঝি?
উত্তরে আমি কী বলব খুঁজে পেলাম না। সত্যিটা বলতেও শরমে বাঁধছে।তবু বলতেই হল।
---অপূর্ব!... এমন স্বাদ তো মাংসেও পাওয়া যায় না।
তিনি খুশি হলেন।কিন্তু আমার দুঃখটা বুঝতে দিলাম না।
যতই হোক বাঁশ খাওয়া কি কখনো সুখের হয!!
প্রতিবার ছুটি শেষ হওয়ার আগে একবার আমি শুশুনিয়া পাহাড়ে ঘুরতে যায়।ছেলের ইস্কুল কামায় হবে।তাই গিন্নীকে বললাম,যাবে?আমাকে "আদিখ্যেতা" বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল।মাকে বলিনি।বললেই,চলে আসতো। আর এসেই আমাকে মন্দিরে নিয়ে মা কালীর খড়গের সামনে ঠাই বসিয়ে রেখে দিত।সেটা আমার সহ্য হয় না।
তাই মাকে না বলে একা বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।দশ কিলোমিটার রাস্তা।রাস্তায় চা,চপ খেতে খেতে দশটার মধ্যে পৌছে গেলাম।
সামনে মরুত বাহা ইকো পার্কের গেট।সরকার এই একটা কাজ খুব ভাল করেছে।যাত্রীনিবাস,কটেজ আর পার্ক বানিয়ে রুক্ষ্য জায়গাটাকে একদম রঙিন করে তুলেছে।মন জুড়িয়ে যায়।
দোকান ঘেঁষে চলতে গিয়ে এক জায়গায় দাড়িয়ে পড়লাম।ভীষণ সুন্দর একখানা কলাকৃতি দেখে।
সুদৃশ্য একটি জাহাজ।যেন সমুদ্রে ভাসছে।কাঠের হবে হয়তো।তাই উৎসুকভাবে দোকানীকে জিজ্ঞেস করলাম,দাদা ওটা কীসের তৈরি একটু বলবেন?
উনি খুশি হয়ে উত্তর দিলেন,বাঁশের।
উত্তরটা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ!
এতদিন তো শুধু লোক মুখে বাঁশের বদনামের কথা শুনে এসেছি।তাই বাঁশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা মনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল।সেই বাঁশ দিয়ে যে কোন শিল্পী এমন আশ্চর্য একটা জিনিস তৈরি করতে পারেন,কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি।
মনে,মনে শিল্পীকে স্যালুট না জানিয়ে, পারলাম না।
এখন সেটা আমার লেখার টেবিলে সবসময় শোভা পায়।