বাংলার নববর্ষ এর উৎপত্তি
বাংলার নববর্ষ এর উৎপত্তি
বাংলা নববর্ষের উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের নিতে হবে ইতিহাসের পাতা উল্টাতে হবে।বাংলা সন বা, বাংলা সাল নামে যেহেতু ডাকা হয় সন ও সাল শব্দ দুটি যথাক্রমে আরবি এবং ফারসি শব্দ। সুতরাং এর শুরুটা মোঘলদের কেউ করেছিলেন। ভারততত্ত্ববিদ আল বিরুনি কিতাব’ উল হিন্দ’-এ (রচনাকাল আনুমানিক ১৩৩০ খ্রি:) সেখানে ভারতবর্ষের যে সব অব্দের যেমন শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ শকাব্দ,বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দ এর নাম উল্লেখ করেছেন তাতে বঙ্গাব্দ নেই।
বঙ্গাব্দ চালু হয় তার মান এই দাঁড়ায় এর অনেক পরে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। এবং মেনে নিতে হয় সম্রাট আকবরের রাজজ্যোতিষী আমীর ফতে উল্লাহ সিরাজীর এই নতুন অব্দের প্রচলিত করার মূল কান্ডারি।
বাংলা সন শূন্য থেকে শুরু হয়নি, যে বছর বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়, সে বছর হিজরি সন ছিল ৯২৩ হিজরি। তাই সম্রাটের নির্দেশে প্রবর্তনের বছরই ৯২৩ বছর বয়স নিয়ে বাংলা সনের হিসাব শুরু হয়েছিল ।আকবরের সিংহাসনে আরোহনের ২৫ দিন পর অর্থাৎ বুধবার ২৮ রবিউস সানি (১১ মার্চ) তারিখে নতুন বর্ষের সূচনা হয়েছিল। এই দিনটি ছিল পারসিক বছরের নওরোজ।
আসলে ভারতে তখন চলছিলো সৌরবর্ষের। আর এই সৌরবর্ষের চেয়ে চন্দ্রবর্ষ ১০/১২ দিন কম হবার ফলে কৃষকদের কৃষিকাজ সংক্রান্ত কাজে দিনক্ষণের সঠিক হিসাব রাখা কঠিন হয়ে গিয়েছিলো।
৯৬৩ হিজরী সনের মহররম মাসের ১ তারিখ থেকে বৈশাখী সনের প্রথম দিন গণনা শুরু হয়। হিজরি ৯৬৩ সনের ১লা মহররম আর ১লা বৈশাখ ৯৬৩ একই দিন ছিল। এবং হিজরি ৯৬৩ সনের সাথেই বঙ্গাব্দ যুক্ত হতে থাকে। কিন্তু আগেই বলেছি চন্দ্রমাসভিত্তিক হিজরি সন ১২/১২ দিন হওয়ায় হিজরি সনের তুলনায় বিগত কয়েকশত বছরে বঙ্গাব্দ বেশ কম। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, বাংলা সন চালুর ভিত্তি হলো হিজরি সন। হিজরি সনের বর্তমান বয়স ১৪৪২ বছর। বাংলা সনও হিজরি সনের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ১৪ বছর। তবে এই পার্থক্যের কারণ হলো আরবি মাস কখনো ২৯ দিনে হয়ে থাকে। তবু এ হিসাবে একটু সন্দেহ থেকেই যায়।
বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ তখন ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত।এটি কৃষকদের কাছে 'ফসলি সন' নামে পরিচিত হয়, যা পরে 'বাংলা সন' বা 'বঙ্গাব্দ' নামে প্রচলিত হয়ে ওঠে।
কিন্তু আকবরের শাসনামলের অনেক আগে থেকেই দুটি শিব মন্দিরে বঙ্গাব্দ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরে সম্রাট আকবর তার শাসনামলে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে রাজজ্যোতিষী ফতেউল্লাহ শিরাজির সহায়তায় এটি পরিবর্তন করে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য আনেন এই মতটি মেনে নেওয়া যায় না।
কয়েকজন ঐতিহাসিক তাই বাঙ্গলা দিনপঞ্জি উদ্ভবের কৃতিত্ব আরোপ করেন ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের উপর। ভারতের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নববর্ষের উৎসবগুলো হিন্দু বিক্রমী দিনপঞ্জির সাথে মিল আছে ।সে হিসাবে বিক্রমাদিত্যকে বাংলা দিনপঞ্জির আবির্ভাবের স্বীকৃতি দিলে একটা অসুবিধা হয়।ঐ অঞ্চলের মতো বাংলায় বঙ্গাব্দের সূচনা ৫৭ খ্রিস্টপূর্বে হয়নি, বরং ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছিল, যা নির্দেশ করছে বঙ্গাব্দের সূচনা প্রমাণ সময়কে কোন একসময় পরিবর্তিত করা হয়েছে। মনে করা হয় শশাঙ্কের শাসনামলেই এই পরিবর্তন হয়েছে। কোন কোন পণ্ডিত দের মতে শশাঙ্ক ৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল স্বাধীন রাজত্ব শুরু করেছিলেন।
অন্য পণ্ডিতদের মতে স্রংসন নামে এক তিব্বতী রাজা ৬০০খ্রিষ্টাব্দের কিছু আগে মধ্য ও পূর্ব ভারত জয় করে তিনি তিব্বতের কৃষি কাজের প্রচলিত রীতি ভারতবর্ষে চালু করেন ।স্রংসনের নামের শেষাংশ থেকে সন শব্দ টি এসেছে বলে তারা মত দেন।
আরো একটি কথা বলতে হয়।নববর্ষ উদযাপন উৎসব নিয়ে বলতে হয় । ইসলামে উৎসব বলতে শুধু দুটি উৎসব রয়েছে প্রথমত ঈদুল ফিতর এবং দ্বিতীয়ত ঈদুল আযহা।সে হিসাবে এটি একটি ইসলামবিরোধী উৎসব।কারণ এই উৎসবে অনেক বিধর্মীদের সংস্কৃতি পালন করা হয়।ইসলামী এই দিনটি উদযাপনের কোন নির্দেশনা নেই। এটি সম্পূর্ণ হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটি উৎসব। এই দিনে বিভিন্ন ধরনের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ প্রদর্শনী, উল্কি আঁকা, বিভিন্ন কাজ করা হয় যা ইসলামবিরোধী।
আবার বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে। যেমন- বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জৈষ্ঠ্য, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ ,ভদ্রা থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন , কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রহায়ণ পুষা থেকে পৌষ ,মঘা থেকে মাঘ , ফাল্গুন - এটাও চিত্রা থেকে এমন করেই বাংলায় নক্ষত্রের নামে মাসের নামকরণ হয়।
তাই বলা যেতে পারে।খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে প্রাচীন ভারতের রাজা বিক্রমাদিত্যের নামানুসারে যে হিন্দু বিক্ৰমী পঞ্জিকা প্রণয়ন করা হয়েছিলো। এই পঞ্জি অনুসারে ভারতের পূর্বাঞ্চল, উত্তর পূর্বাঞ্চল ও নেপালের বিভিন্ন অংশে বসবাসরত গ্রামীণ বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে নিছক একটি ঋতু উৎসব হিসেবে প্রচলিত ছিলো পহেলা বৈশাখ এ বাংলায় । তবে তার আমেজ বাংলা অব্দি পৌছতে চলে এসেছিলো ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ। ৭ম শতকে বাংলা বর্ষের প্রমাণ সময়ে বেশ পরিবর্তন এনে বাংলার বুকে বাংলা দিনপঞ্জির উদ্ভব ঘটান বাংলার প্রথম স্বাধীন নৃপতি গৌড়েশ্বর মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক ।