বালি-ঘড়ি(শেষ পর্ব)
বালি-ঘড়ি(শেষ পর্ব)
"অবশেষে জিয়া একটা উপন্যাস শেষ করে ফেললো। আজ পূর্ণিমা, গোল থালার মতো চাঁদটা সমুদ্রের বুকে নেমে এসেছে যেন। ঝাউ গাছ গুলো হাল্কা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। পায়ে পায়ে জলের কাছে নেমে এসেছিল জিয়া। ঢেউ এসে পা ধুইয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ রিসর্টের ফাইফরমাশ খাটে যে বাচ্চা ছেলেটা তার ডাক ভেসে আসে, উঠে আসে ও। ছেলেটার নাম বাবলু, কত বয়স, দশ এগারো। ও দাঁড়িয়ে ছিল সমুদ্রের পাড়ের ঝাউ-বনে। বলল পূর্ণিমার ভরা জোয়ার আসছে। জল বাড়ছে। রিসর্টের গেটে জল এসে যাবে, তাই ফিরে যেতে। জিয়ার মনে পড়ে তিনবছর আগে মন্দারমণিতে অনির সাথে এমনি এক শ্রাবণী পূর্নিমার রাতে মন্দিরের চাতালে বসে কত কবিতার জাল বুনেছিল।....."
ফোনটা বেজে ওঠে, শুভায়ুর ফোন। শ্রী ধরতেই বলে অফিসের কোনও পার্টি আছে, রেডি হয়ে থাকতে, একটু পরেই শুভায়ু এসে ওকে তুলে নেবে।
শ্রীর শরীর ভাল না। মেয়েটার সামনে বোর্ড বলে মনের জোরে চলাফেরা করছে। এসব পার্টিতে যেতে ওর একদম ভাল লাগে না। কিন্তু শুভায়ু বুঝবে না। হাল্কা সবুজ বিষ্ণুপুরী সিল্ক আর ছোট্ট হীরার পেনডেন্টটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায় শ্রী। চোখের নিচের কালি ঢাকতে হাল্কা মেকআপ করতে হয়।
পার্টিতে শুভায়ুদের 'এম- ডি' র সাথে শ্রীর আলাপ করাতেই উনি বলেন -"আচ্ছা , আপনি কি লেখালেখি করেন ?"
শ্রী লজ্জিত হয়ে বলে -"কেন বলুন তো ?"
-"মনে হয় কয়েকটা সাহিত্য গ্ৰুপে আপনার লেখা পড়েছি। নামটা শুনে মনে হচ্ছে..... আচ্ছা ঐ নীল-পাখী, মরুভূমি, হঠাৎ বৃষ্টি এগুলো আপনার লেখা? দু তিনটে ম্যাগাজিনে এগুলো পড়েছি, তবে আজকাল আপনি বড্ড কম লেখেন কিন্তু!"
হঠাৎ আরও কয়েকজন এগিয়ে এসে আলাপ জমায় । শুভায়ু একটু অপ্রস্তুত। হঠাৎ করে পার্টির মধ্যমনি হয়ে ওঠে শ্রী।
ফেরার পথে একটাও কথা বলে নি শুভায়ু। ওর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিল শ্রী। এম- ডি রায় সাহেব দু দিন পর ওনার বাংলোয় নিমন্ত্রন করেছেন। আরও তিনজন সাহিত্যিক আসবেন সেখানে। আজ শ্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন বই প্রকাশের ব্যাপারে সে কি ভাবছে?
এর কোনও উত্তর ছিল না শ্রীর কাছে। কয়েকটা ম্যাগাজিনে আজকাল তার লেখা গেলেও বই ছাপার ব্যপারে কিছুই ভাবে নি ও।
কিন্তু গাড়ির এই গুমোট পরিবেশে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল শ্রীর। বাড়ি এসে শুভায়ু সোজা শুয়ে পড়লো।
সারা রাত পেটের ব্যাথায় কষ্ট পেয়ে ভোরের দিকে শ্রীয়ের চোখটা একটু লেগে এসেছিল। একটা বাজে স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো হঠাৎ। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে। বেল ফুল গুলো ফোটার আগেই কলি গুলো ঝরে গেছে। রজনীগন্ধার গাছেও পোকা লেগেছে। টবের অল্প মাটিতে জুঁই গাছটাও সেভাবে প্রাণ পাচ্ছে না । কেমন নেতিয়ে পড়েছে। দীর্ঘশ্বাসটা চেপেই রান্নাঘরে ঢোকে শ্রী।
".......একটা বালি-ঘড়ি কিনেছে জিয়া, বেশ বড়ই। সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে। ঘড়ি গুলো উল্টে দিলে যেমন নতুন করে সময় গণনা শুরু হয়, তেমন ভাবে যদি জীবনটাও উল্টেপাল্টে নেওয়া যেতো !! অনি চলে গেছে। সামনের লড়াইটা জিয়ার একার। তবে ও হারবে না। ওকে জিততেই হবে। ও নিজের চারপাশটাকে শামুকের খোলের মত শক্ত করে নিয়েছে, নিজের নরম মনটাকে গুটিয়ে রেখেছে তার ভেতর........."
না, আর পেট চেপে বসে লেখা যাচ্ছে না। কয়েকদিন ধরে বড্ড রক্তস্রাব শুরু হয়েছে, বন্ধ হচ্ছে না। টেস্ট গুলো করিয়েছিল কয়েকদিন আগে। আর দুদিন পর রিপোর্ট আসবে। শুভায়ুকে বলা হয় নি। আজকাল ও বড্ড কথা কম বলে। শ্রী বুঝতে পারে না তার লেখালেখিতে আপত্তি, নাকি পরিচিতি আর নাম হচ্ছে তাতে আপত্তি। সব সময় দোষ ধরা আর চিৎকার করা শুভায়ুর স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এম-ডি সাহেবের বাড়ি বাধ্য হয়ে গেছিল শুভায়ু। সেখানেই কয়েকজন সাহিত্যিক ও প্রকাশকের সাথে কথা হয়েছিল শ্রীর। শুভায়ু অবশ্য সে সময় অফিসের কাজের ব্যাপারে এক ম্যানেজারের সাথে কথায় ব্যস্ত ছিল। ফেরার পথে সেই শীতলতা। শ্রী কিছুই বলে নি আর।
কয়েকজন প্রকাশকের ফোন এসেছিল। বই প্রকাশে অনেকেই আগ্ৰহ দেখাচ্ছে, দুটো প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখা বার হচ্ছে।
কিন্তু শুভায়ু আর মেয়েদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। সা
হিত্যের প্রতি এদের কোনও আগ্ৰহই নেই।
মেখলার টেস্টের রেজাল্ট ভাল হয় নি তেমন। অথচ মেখলাকে কিছু না বলে শুভায়ু শ্রীকেই কথা শোনায়। বলে -"মা তো স্বনামধন্যা লেখিকা, মেয়ের দিকে তাকানোর সময় কোথায় ? সেলেব্রিটিদের বাচ্চারা কেন মানুষ হয় না এবার বুঝতে পারছি!"
আজকাল লেখালেখি কমিয়ে দিয়েছে শ্রী, কিন্তু পাঠকদের অনুরোধে মাঝে মাঝে কলম ধরে। আসলে লিখতে না পারলে নিজেরই ভালো লাগে না। বেল ফুলের গাছের গোড়াটা খুঁচিয়ে দিচ্ছিল শ্রী। আবার কুঁড়ি এসেছে। শ্রী এর যত্নে গাছগুলো বেড়ে উঠছে।
হঠাৎ শুভায়ুর চিৎকারে ছুটে যায় মেয়েদের ঘরে। মৌলীকে বকছিলো শুভায়ু। শ্রী যেতেই সব রাগ গিয়ে পড়ে শ্রী এর উপর।
-"মা যদি সারাক্ষণ প্রেমের গল্প লেখে, মেয়ে তো প্রেম করতেই শিখবে!! ছিঃ, যেমন মা, তেমন মেয়ে..." আরও বাছা বাছা শব্দ প্রয়োগে শুভায়ু ফুঁসছে তখন। মৌলী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
শ্রী কিছু বলতে যেতেই মেখলা বলে ওঠে -"তুমি এর মধ্যে এসো না। তুমি তো কিছুই দেখো না....ঐ ফালতু লেখা লেখির বাইরে আর কি কর তুমি ?"
নিজের বড় মেয়ের এমন কথায় মাথাটা কেমন গরম হয়ে যায় শ্রীর।এই প্রথম একটা থাপ্পড় মেরে বসে মেখলাকে। কিন্তু সাথে সাথেই শ্রী ছিটকে পড়ে সোফায়। জীবনে প্রথম শুভায়ু হাত তুললো ওর উপর। অবাক হয়ে তাকায় শ্রী। গালটা জ্বলছে, দুই মেয়ের সামনে এত বড় অপমান, দু চোখে জলের ধারা নামে। শুভায়ু বলে চলেছে -"আমার মেয়েদের কোনও ব্যাপারে তুমি আসবে না। থাকো তোমার সাহিত্য নিয়ে। "
শ্রী উঠে নিজের ঘরে আসে । এক এক করে মনে পড়ে অনেক কথা, একদিন শুভায়ুর হাত ধরে বৈদ্যবাটির সেই বাড়ি এসেছিল। দু তরফে কারোর কোনও নিকট আত্মীয় ছিল না। শ্রী বাবা মার অবর্তমানে জেঠুর বাড়ি গলগ্ৰহ হয়ে ছিল। আর শুভায়ু চাকরী পাওয়ার পরের বছর ওর বিধবা মা মারা গেছিল। বিয়ের পর থেকে ওরা দুজনেই ছিল দুজনের অবলম্বন। হাসি কান্না সুখ দুঃখের সাথী। একদিন ওর কবিতা, ছোটগল্পর প্রথম পাঠক ছিল এই শুভায়ু। কত উৎসাহ দিত ওকে শুভায়ু একসময়, অর্থ যশ প্রতিপত্তি আর সময় সেই মানুষটাকে কত বদলে দিয়েছে। শোকেসে সাজানো বালি-ঘড়ির দিকে চোখ পড়ে শ্রী-র। সেই প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে দীঘায় গিয়ে কিনে দিয়েছিল শুভায়ু। সময়টাকে স্মৃতিতে বন্দী করতে চেয়েছিল। বহুদিন ওটা উল্টে রাখা হয় নি। সময় যেন থমকে আছে ঐ বালি-ঘড়িতে।
সারা রাতে মেয়েরা বা শুভায়ু একবারও এ ঘরে আসে না। ভোর রাতে আস্তে আস্তে শ্রী বেরিয়ে যায়। শরীরের কষ্ট ছাপিয়ে মনের কষ্ট তাকে আজ শক্ত করেছে। মোবাইলটাও সাথে নেয় না।
******
সারাদিন দেখে সন্ধ্যায় থানায় যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল শুভায়ু। শ্রী এর ফটো লাগবে, তাই ওর ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে হাত দিয়েছিল এই প্রথম। এক তাড়া মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট হাতে ঠেকতেই অবাক হয়েছিল। সাথে একটা ছোট্ট খামে দুটো মোটা অঙ্কের চেক। শ্রী এর বই বেরিয়েছিল !! আর একটা ছোট্ট ডাইরি।
বায়োপসির রিপোর্টটা পজেটিভ, কয়েক মাস আগেই জেনেছিল শ্রী অথচ কাউকে বলে নি। ওর গল্প সংকলন আর উপন্যাস গুচ্ছের বই বেষ্ট সেলার হয়েছিল। তাই নতুন বই এর আগাম চেক দিয়েছিল প্রকাশক।
একমাস হয়ে গেলো, শ্রী এর কোন খবর নেই।
সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টির পর আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা, বহুদিন পর আজ শুভায়ু বারান্দায় এসেছে, মিষ্টি বেল ফুলের গন্ধে মনটা কেমন করে ওঠে। জুঁই গাছেও কুড়ি এসেছে। চারপাশে শ্রী এর চিহ্ন অথচ কোথায় যে গেল সে!......
শুভায়ু এতদিন বোঝেনি শ্রী তার কতটা জুড়ে রয়েছে, শ্রীয়ের অবর্তমানে মনটা হাহাকার করছে।কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে!!শূন্য ঘরে শোকেসের উপর বালি-ঘড়িটা বহুদিন পর চোখে পরে শুভায়ুর। এটা শ্রী শখ করে কিনেছিল দীঘায়।
হঠাৎ মেয়েদের চিৎকারে সম্বিত ফেরে, মেখলা, মৌলী একসাথে তাকে ডাকছে। টিভিতে ব্রেকিং নিউজে দেখাচ্ছে এবারের আনন্দ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে উপন্যাস বালি-ঘড়ি। শ্রেষ্ঠ লেখিকা শ্রীলেখা দেবী। অবাক বিস্ময়ে তিনজন তাকিয়ে থাকে টিভির পর্দায়। মোবাইল আর ল্যান্ড ফোনটা একসাথেই বেজে ওঠে। কিন্তু ওরা সবাই স্তব্ধ....