বালি-ঘড়ি(প্রথম পর্ব)
বালি-ঘড়ি(প্রথম পর্ব)


"......সমুদ্রের নীল জল আছড়ে পড়ছে বালিয়াড়ির বুকে, এক সার ঝাউ বনের হাল্কা ছায়ায় বসে ছিল জিয়া। আজ সমুদ্র বড্ড বেশি উত্তাল, ঢেউ গুলো বালিয়াড়ির উপর উঠে আসছে মাঝে মাঝেই। জিয়ার মনেও আজ উথাল পাথাল ঢেউ। চাঁদপুরের এই নির্জন রিসর্টের খবর খুব কম পর্যটক জানে, তাই ভিড় কম। নিরিবিলিতে সপ্তাহটা কাটাবে বলে একাই এসেছিল সে। পরের উপন্যাসটা এখানে বসেই লিখবে ভেবেছিল। কিন্তু আজ দু দিন হয়ে গেল লেখা- লেখির ইচ্ছাটাই চলে গেছে। শুধু বালিয়াড়িতে বসে ঐ দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশির দিকে তাকিয়েই সময় কেটে যাচ্ছে।
মনের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ বেদনা গুলো আস্তে আস্তে হাল্কা হয়ে উড়ে যাচ্ছিল। কত পুরানো স্মৃতি এসে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল মনে। সেই একসাথে প্রথম সমুদ্র দেখা..... বালির বুকে নাম লেখা..... "
-"মা, তোমার ফোনটা একটু লাগবে। " মৌলীর ডাকে ফিরে তাকায় শ্রী। সবে আজ কয়েক দিন পর একটু লেখার সময় পেয়েছিল। লেখালেখিটা ফোনেই করে শ্রী। আজকাল লেখালেখির সময় পায় বড্ড কম। সংসারের সব কাজ একা হাতে শেষ করে দুপুরটায় একটু লিখতে বসে, এখনি মেয়ের ফোনটা চাই। হয়তো 'হোয়াটস- এ্যাপে 'পড়া জানবে । কম্পিউটারে বড় মেয়ে মেখলা বসে রয়েছে। শুভায়ু মেয়েদের মোবাইল কিনে দেবে না এতো তাড়াতাড়ি। বড় জন বারো ক্লাস, ছোট জন নাইন। সারাক্ষণ মায়ের ফোনেই ওদের সব কাজ হয়ে যায়।
-"তোমার অপ্রয়োজনীয় লেখালেখি পরে করলেও চলবে। ফোনটা এখন দাও। " বিরক্তি ঝরে পড়ে মৌলীর স্বরে। শ্রী ফোনটা দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
দূরের আকাশে মেঘ জমেছে, বাতাসে একটা গুমোট ভাব, ঝড় উঠবে মনে হয়। বারান্দার টবে লাগানো বেলফুলের গাছটায় কুঁড়ি এসেছে। লতানো জুঁই গাছটাও কচি পাতা ছেড়েছে। রজনীগন্ধার ডাঁটি বের হচ্ছে। এবার ফুল আসবে। শ্রীয়ের প্রিয় রঙ সাদা, এই তিনটে ফুল শ্রীর খুব প্রিয়। বিয়ের পর যখন বৈদ্যবাটিতে থাকত বাড়ির সামনে একটা ছোট বাগান করেছিল শ্রী নিজে হাতে। সারা বছর রকমারি ফুলে ছেয়ে থাকতো সে বাগান। শীতে নিজে হাতে দু চারটা সবজিও করতো। পাঁচ বছর বৈদ্যবাটির সেই ছোট্ট দু-কামরার বাড়িতে খুব সুখে ছিল ওরা। সকালে সেদ্ধ ভাত খেয়ে শুভায়ুর ট্রেন ধরতে ছোটার পর সারাদিন অখণ্ড অবসর। সে সময় তো ফেসবুক ছিল না। বই পড়ে, কবিতা লিখে আর ঘরের টুকটাক কাজ করেই সময় কেটে যেতো। রাত আটটায় শুভায়ু ফিরলে দু জনে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসতো। কত গল্প হতো।
মেখলাকে ভালো স্কুলে দেওয়ার তাগিদায় শুভায়ু কলকাতায় এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল। সাড়ে তিন বছরের মেখলা আর পাঁচ-মাসের মৌলীকে নিয়ে বৈদ্যবাটি ছেড়ে এখানে উঠে আসতে খুব কষ্ট হয়েছিল শ্রীর। তিন-কামরার এতো বড় ফ্ল্যাটটা কিনতে গিয়ে বাধ্য হয়ে বৈদ্যবাটির বাড়িটা বিক্রি করতে হয়েছিল শুভায়ু কে। এর পর দুই মেয়ে কে বড় করতে গিয়ে কি ভাবে এতোগুলো বছর পার হয়ে গেছিল শ্রী টের পায় নি। শুভায়ুও বদলে গেছিল এখানে এসে। উন্নতির পিছনে ছুটতে ছুটতে বাড়িতে সময় দিতে আর পারতো না। কেমন খিটখিটে হয়ে উঠেছিল দিন দিন। বছরে একবার সবাইকে নিয়ে কোথাও ঘুরিয়ে দেয় নিয়ম করে। মেয়েদের নামি স্কু্লে পড়ানো ছাড়াও নাচ ,ক্যারাটে, আঁকা, সাঁতার এ সবে নিয়ে যেতো শ্রী একাই। তবে শুভায়ু মেয়েদের খুব ভালবাসতো। সময় দিতে না পারলেও ওদের খোঁজখবর রাখতো। কিন্তু শ্রী আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছিল। একেক সময় হাঁফিয়ে উঠত সে। নিজেকে মনে হতো এ-বাড়ির কেয়ারটেকার। মেয়েরাও বড় হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। রাতে অফিস থেকে ফিরেই আজকাল শুভায়ু কোনোকিছু অগোছালো দেখলে এমন ভাবে বলে, যে শ্রীর খুব খারাপ লাগে। রান্না আর ঘর গুছোনোর জন্যই যেন ও এই বাড়িতে আছে !! প্রথম প্রথম মুখ বুজে চলতো। আস্তে আস্তে মেয়েরা ও বাবার দেখাদেখি মাকে দোষারোপ করতো সব ব্যাপারে। অথচ ওরাই অগোছালো করে সব চেয়ে বেশি। মেয়েদের নিয়ে দৌড়ানোটা নাকি কোনও কাজের পর্যায়েই পড়ে না। শুভায়ুর একটাই প্রশ্ন -"কি করো সারাদিন ? বাড়িটাও গুছিয়ে রাখতে পারো না একটু !!"
অথচ এই শুভায়ু একসময় রান্না থেকে ঘর গুছোনো সবেতেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিত।
বড় ঘড়িটা ঢং ঢং আওয়াজে জানিয়ে দিল পাঁচটা বাজে। অবশ্য ঘড়িটাকে পনেরো মিনিট ফাস্ট করে রেখেছে শুভায়ু, তাতে ওদের স্কুল আর অফিসে বার হতে সুবিধা হয়। মৌলী বারান্দায় এসে তাড়া দেয় -"এখনো রেডি হও নি !! চলো এবার "। ও এখন পড়তে যাবে ইংলিশ ম্যামের কাছে। মেখলা যাবে কম্পিউটার ক্লাসে। এই ঘড়ির পাঁচটার শব্দে ওরা বেরিয়ে যায়। শ্রী তাড়াতাড়ি একটা চুড়িদার পরে বেরিয়ে আসে। অটোয় দশ মিনিটের রাস্তা, অটো পেতেই পাঁচ মিনিট লেগে যায় আরও। দুই মেয়ে মাকে দোষারোপ করে চলেছে। আসলে ওরা জ্ঞান হওয়া থেকে দেখে এসেছে মাকে বাবা এভাবে, ছোট ছোট ঘটনায় দোষ দেয় এবং মা মুখ বুঝে সহ্য করে।
ওদের ক্লাসে ঢুকিয়ে সামনের একটা পার্কে এসে বসে শ্রী । দেড় ঘণ্টার অবসর হাতে। মনটাকে শান্ত করে ফোনটা নিয়ে বসে। গল্পটা আজ লিখেই ফেলবে। কিন্তু ফোন হাতে নিয়েই দেখে চার্জ দশের নিচে। ব্যাটারি ব্যাঙ্কটাও সাথে নেই!! নিজের উপর রাগ হয়। একবার ভাবে বাড়ি চলে আসবে। আটটাকা অটো ভাড়া দিয়ে দুবার ফালতু যাতায়াত করতে বড্ড গায়ে লাগে। ফোনটা ব্যাগে রেখে উঠে দাঁড়ায় শ্রী, পেটের ব্যথাটা কয়েকদিন হল খুব বেড়েছে। এখন হঠাৎ কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। ডাক্তার রাহা বলেছিল একটা বায়োপসি করিয়ে নিতে। সাহস করে শুভায়ুকে বলতেই পারে নি সে। শুভায়ুর সময় কোথায় এসব শোনার। এর আগের বার ডাক্তারের কাছে যাবে শুনে বলেছিল, ঘরে বসে থেকে থেকে শ্রী অসুস্থতা ফিল করছে। বাইরে বেরিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে, জিম করতে, হাল্কা খাবার খেতে। গত একবছর ধরে পেটের এই ব্যথাটায় কষ্ট পাচ্ছে শ্রী। অথচ শুভায়ু ওকে ডাক্তারের কাছে নিতে পারে নি। মাত্র ঊনিশ বছরে মানুষ কত বদলে যায়, ভাবে শ্রী। মেয়ে দের জন্মের আগে ছুটি নিয়ে নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতো শুভায়ু। এই ফ্ল্যাটে এসেও ছোটখাটো জ্বর সর্দিতেও ছুটি নিয়ে ও ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে। আর এখন .....!!(চলবে)