Sayandipa সায়নদীপা

Tragedy

0.4  

Sayandipa সায়নদীপা

Tragedy

বাজি : পঞ্চম কিস্তি

বাজি : পঞ্চম কিস্তি

5 mins
1.4K


ডিসেম্বর, ২০১৮

                     (১২)


হিঃ হিঃ হিঃ ….

এখনো হেসে যাচ্ছে ও। আমার ওপর হাসছে … দেখছে যে একদিন যে ওকে নিয়ে পুতুল খেলা খেলেছিলো আজ সে অন্য কারুর হাতের পুতুল… ওপর থেকে একজন সব লক্ষ্য করে… সব…


“সংকেত বাবু, এই যে সংকেত বাবু শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?”


আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। কিন্তু একি! এ আমি কোথায়? এটা তো আমার রুম… আমি তাহলে রাস্তায় আর দাঁড়িয়ে নেই? ওটা কি স্বপ্ন ছিল? কিন্তু তা কি করে হয়?


“সংকেত বাবু…”

 “হ্যাঁ?”

 “কেমন লাগছে?”

 “ঠিকঠাক।”

 “হুম, হঠাৎ করে প্রেশারটা কমে গিয়েই বিপত্তিটা হয়েছিলো। যাক বিশেষ ভয়ের কিছু দেখছিনা।”

 “ডাক্তার বাবু আর কিছু হবে না তো দাদাভাইয়ের?”

 “না না ঠিকই আছে সব, তবে একটু খেয়াল রাখবেন আর এরকম হচ্ছে কিনা, সেক্ষেত্রে কিন্তু…”

 “আচ্ছা।”

 “এবার হালকা কিছু খেতে দিন ওনাকে, তারপর ওষুধ গুলো দেবেন। আমি এখন আসছি, কোনো দরকার হলে খবর দেবেন।”

 “ঠিক আছে।”


ডাক্তার বেরিয়ে যায়। বোন একটা বাটিতে করে ওটস নিয়ে আসে। আমি ভুলে যাই বাটিটা ধরতে, কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে। আমার চারিদিকটা যেন শূন্য হয়ে আসছে… একটা বিশাল অন্ধকার আমাকে যেন হাঁ করে গিলতে আসছে… মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেলো আজ থেকে প্রায় আট বছর আগের কোনো এক বিকেলে সে বলেছিলো আমায়, 


“জানো তো যখনই তোমায় ছাড়া আমার জীবনটা ভাবতে যাই তখনই কেমন যেন একটা বিশাল অন্ধকার দেখতে পাই চোখের সামনে, মনে হয় সে যেন একটা বিশাল হাঁ করে আমায় গিলতে আসছে।”

সেদিন তার কথা শুনে হেসেছিলাম শুধু, রোম্যান্টিক ঈমাজিনেশন বলে ঠাট্টা করেছিলাম, উপদেশ দিয়েছিলাম কল্পনার জগতে না ভেসে বাস্তবিক হতে। সে বলেছিলো এগুলো কল্পনা নয়, অনুভূতি। 

আজ বুঝতে পারি ঠিক বলতো সে, ভুল ছিলাম আমি।


“দাদাভাই সেন্স ফেরার সময় বিড়বিড় করে কি বলেছিলি? কে হাসছে তোর ওপর? পুতুল খেলা… এসব কি বলেছিলি?”

 “ও কিছু না… আমার মনে পড়ছে না।” মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম আমি।

 “আমি বোধহয় জানি…”

 “কি?” অবাক হলাম।

 “রেনেসাঁ দি বিশেষভাবে তোর ওপর হাসেনি রে, ও তো এখন সবসময় হাসে, সবার ওপর হাসে...”

 “ত… তুই কি করে জানলি?” চমকে উঠলাম আমি।

 “মিশাকে যখন খুঁজতে গেলি তখন আমিও গিয়েছিলাম তোর পেছন পেছন, আগেই শুনেছিলাম রেনেসাঁদির কথা। আজ নিজের চোখে দেখলাম।”

 “কি শুনেছিলি?” আমার হাতের মুঠোটা হঠাৎ করেই শক্ত হয়ে গেল, বুকের ভেতর যেন একসাথে দশটা হাতুড়ি একসাথে কেউ পিটতে লাগলো।

 “আমরা এখান থেকে চলে যাওয়ার পর পরই নাকি ওর নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়, কাউকে চিনতে পারতো না। একটা ঘরের মধ্যে বসে থাকতো সারাদিন। চিকিৎসা চলছিলো… এর দু বছরের মাথায় হঠাৎ করে সান্যাল কাকু আর কাকিমা কার এক্সিডেন্টে মারা যান, রেনেসাঁ দিও ওদের সাথে ছিলো কিন্তু ও বেঁচে যায়। স্যান্যাল কাকুর ভাইপো আর তার স্ত্রী এখন ওদের বাড়িটার দখল নিয়েছে। রেনেসাঁদিকে নাম কা ওয়াস্তে দুটো খাবার দেয় খেতে, সেভাবে কোনো যত্নই করে না আর। চিকিৎসাও করায় না বোধহয়। এক্সিডেন্টের পর ওর মাথাটা আরও খারাপ হয়ে যায়। এখন তো যখন তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। জামা কাপড়ের অবস্থা তো দেখলি! পরিচিত লোকে দেখলে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে আর কি।

এখন কাঁদছিস কেন? কেঁদে কি হবে? ওর এই অবস্থার জন্য দায়ী কে?”

 “আমি!”

 “আমি অনেক পরে একবার মেদিনীপুর এসে পুষ্পলদার কাছে জেনেছিলাম তোর ওই বাজির ব্যাপারে… বিশ্বাস হয়নি যে আমার দাদাভাই এটা করতে পারে! তোকে প্রশ্ন করতে তুই বলেছিলি ‘একটা ছোট্ট ভুল’ এটা, আর আমি যেন আমার বড় দাদার সমালোচনা না করি। সেদিন চুপ করে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ… নিজের চোখে দেখলি তো দাদাভাই তোর সেই ছোট্ট ভুলটার পরিণতি?”


কোনো কথা বলতে পারছিনা আমি। এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে একটা ছুরি দিয়ে নিজের শরীরটাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিই যে শরীরটা দিয়ে দিনের পর দিন ওকে স্পর্শ করতাম আমি, নিজের জিভটা এক ঘায়ে কেটে ফেলি যে জিভটা দিয়ে দিনের পর দিন ওর সাথে প্রতারণা করে গেছি…


“ভগবান সব ফিরিয়ে দেয় দাদাভাই… যে তোকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিল তুই তাকে নিয়ে নোংরা খেলা খেলেছিলি, ওর অনুভূতিগুলোকে বিক্রি করেছিলি তুই। আজ তাই ভগবান কড়ায় গন্ডায় সব ফিরিয়ে দিয়েছেন। মিশা… হাঃ হাঃ … জীবনে ভালোবাসা পেলি না আর।”


                     (১৩)


রাত কটা বাজবে এখন? এক’টা দেড়টা! চুপি চুপি উঠে এলাম ছাদে… ঠান্ডা হওয়া এসে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল শরীরের ভেতর অবধি। হিম পড়ছে। ছাদের একটা বিশেষ কোণে এসে দাঁড়ালাম… জ্যোৎস্না রাতে দেখতে পেলাম ঘুমন্ত শহরটাকে; কিন্তু যেটা দেখার প্রত্যাশা নিয়ে উঠে এসেছিলাম সেটা দেখতে পেলাম না। আগে আমাদের ছাদের এই কোণটায় এসে দাঁড়ালেই দেখা যেত ওদের বাড়িটা। কতবার দুজনে দুজনের ছাদে উঠে শুধু নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছি একে ওপরের দিকে। মাঝে এখন আরও বাড়ি উঠেছে, একতলা দোতলা, তাই আর ওর বাড়িটা দেখা গেল না।


নিজেকে এতটা ক্লান্ত বোধহয় কোনোদিনও মনে হয়নি… ভীষণ বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার জায়গাটা আজ আমার থেকে অনেক দূরে… নিজের হাতে তাকে সরিয়ে ফেলেছিলাম অনেক দূরে, সেই বহু বছর আগে… তখন থেকে বিশ্রাম তো নিইনি আর! যন্ত্রের মতো কাজ করে গেছি প্রতিনিয়ত… প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় রোজ ঘুম থেকে উঠেছি, খেয়েছি, কাজে গেছি, সব সম্পর্কের দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু বিশ্রাম তো নেওয়া হয়নি!


চোখ দুটো বন্ধ করে হাত দুটো দুপাশে প্রশস্ত করে দিলাম… একটা উন্মত্ত ঠান্ডা হওয়া এসে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো আমার শরীরটা। আমি অনুভব করতে পারছি, স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি আমার শরীরের ওপর আর একটা শরীর… আমার বুকের ওপর লম্বা চুলের ছোঁয়া… মিষ্টি একটা গন্ধ… আমার চিবুকে নরম স্পর্শ… আমার শুষ্ক ঠোঁটে হঠাৎ আর্দ্রতা…


 আমি দেখতে পাচ্ছি একুশ বছরের সংকেতকে। এই বাড়িটারই একটা রুমে নিজেকে বন্দি করেছে সে। হাঁটু গেঁড়ে মেঝেতে বসে পাগলের মতো কাঁদছে। কাঁদছে সে… আর কাকে যেন বোঝাবার ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে বলছে, 

“ভালোবাসিনি… আমি ভালবাসিনা… বাসিনা আমি ভালো… আমাকে এগিয়ে যেতে হবে… এগিয়ে যেতে হবে…”


সহসা চোখটা খুলে ফেললাম। আমি তিরিশ বছরের সংকেত সেন এবার হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম নোনা ধরা ছাদের মেঝেতে… ডুবে যেতে থাকলাম ওই কালচে অন্ধকারে… আজ আর কান্না এলোনা, গলার কাছে দলা পাকিয়ে যেতে থাকলো সব কিছু। চোখ বন্ধ করে ফেললাম আবার। পৌঁছে গেলাম সেই একুশ বছরের সংকেতের কাছে। চিৎকার করে ছেলেটাকে বলে উঠলাম,


“তুই একটা ভন্ড… মিথ্যেবাদী… প্রতারক… দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ প্রতারক তুই---যে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ঠকিয়ে গেছে নিজেকে… হ্যাঁ রে তুই ঠকাচ্ছিস নিজেকে…ঠকাচ্ছিস...”


চোখ খুললাম, একরাশ জ্যোৎস্না ছড়িয়ে গেলো আমার মুখের ওপর। উঠে দাঁড়ালাম আমি, আবার দুই বাহু প্রশস্ত করে একটা জোরে নিশ্বাস নিলাম… গলার কাছে জমে ওঠা কষ্টটা হঠাৎ করে যেন শিথিল হয়ে গেল। শোনার কেউ নেই, তাও আমি চিৎকার করে উঠলাম,

“আমিও ভালোবেসেছিলাম… আমিও ভালোবেসেছিলাম…”


                     (১৪)


গোটা পাড়াটা শুনশান হয়ে আছে। রাস্তায় দু একটা কুকুর ছাড়া আর কারুর দেখা পেলাম না। এগিয়ে যাচ্ছি আমি একলা। আজ ২৫শে ডিসেম্বর, বড়দিন। উৎসাহী ছেলের দল আনন্দে মাইক চালিয়ে দিয়ে ঘুমোতে চলে গেছে। 

 আজ বড়দিন, উৎসবের দিন। মাইক থেকে একটা গান ভেসে আসছে, 


“তোমাকে বুঝিনা প্রিয়

বোঝোনা তুমি আমায়

দূরত্ব বাড়ে, যোগাযোগ নিভে যায়।


গরাদ শোকে সূর্যমুখী

গরাদ শোকে সূর্যমুখী

খয়েরি কুঁড়ির ফুল

সূর্য খুঁজে বেড়ায়…”


 একটা ছিমছাম একতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। রাত্রি বেলা, গেটটায় ভেতর দিক থেকে ঝুলছে একটা বড় তালা। প্রাচীরে ঠেস দিয়ে বসে পড়লাম ওখানেই। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। এখন সকালের অপেক্ষা শুধু, এই বাড়িটার মধ্যে আমার একটা খুব প্রয়োজনীয় জিনিস অবহেলায় পড়ে রয়েছে আজ বহু বছর ধরে। আজ আমি এসেছি তাকে নিয়ে যাবো বলে, আজ আর কিছুই আটকাতে পারবেনা আমায়… কেউ পারবেনা আটকাতে। অনেকদিন পর বিশ্রাম নেবো তার বুকে, সত্যিকারের বিশ্রাম… আর তারপর শুরু করবো এক নতুন সাধনা; যন্ত্র থেকে আবার মানুষ হয়ে ওঠার সাধনা। 

এখন শুধু সকালের অপেক্ষা…


(শেষ)


গানের ঋণ - প্রজাপতি বিস্কুট(২০১৭)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy