অটোগ্রাফ:-
অটোগ্রাফ:-
ঝনঝন করে সকাল ৭টায় অ্যালার্মটা বেজে উঠলো। নন্দিতা ধড়ফড় করে উঠে বসে। উঠেই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। বিপ্লব এখনও ঘুমোচ্ছে, ওর জন্য আবার বেড-টি তৈরী করে তবেই ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হয়। চায়ের জল চাপিয়ে নন্দিতা রিকু আর রিন্টিকে ডাকতে ওদের রুমে গিয়ে দেখে রিকু উঠে পড়েছে ইতিমধ্যে, রিন্টি তখনও ঘুমে। রিকুকে ব্রাশ করতে যাওয়ার জন্য বলে রিন্টিকে আদর করে ঘুম থেকে ওঠানোর চেষ্টা করছে নন্দিতা। হঠাৎ কলিং বেলের কর্কশ শব্দে চমকে উঠে নন্দিতা। চোখে ঘুম জড়ানো রিন্টিকে কোলে নিয়ে সে দরজা খুলে দেখল নিত্যদিনের ময়লা-আবর্জনা নিয়ে যাওয়ার জন্য যে লোকটা আসে, সেই লোকটা দাঁড়িয়ে।
নন্দিতা অবাক হয় জিজ্ঞেস করলো, "আজ এত সকাল সকাল চলে এলেন ভাই?"
সে মাথা চুলকে বললো, "আজ্ঞে দিদিমণি আজ কাজ সারি সক্কাল সক্কাল চইল্যা যামু তাই.." ডাস্টবিনটা লোকটাকে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে দেখে বিপ্লব ততক্ষণে উঠে চায়ের জোগাড়পাতি করছে। নন্দিতাকে ঢুকতে দেখে বললো, "বেড টি টাও সময় মতো পাওয়ার ভাগ্য নেই আমার, হাত পুড়িয়ে নিজেকেই চা বানাতে হচ্ছে। ম্যাডাম তো কাচরাওয়ালার সাথে কথা বলতে আর তার খোঁজ খবর নিতেই ব্যাস্ত.... হুহ্, যত্তসব। "
নন্দিতা অবস্থা বেগতিক দেখে 'জলদি চা বানিয়ে আনছি' বলে বিপ্লবকে ফ্রেশ হতে পাঠায়।
রিকু বয়সে রিন্টির থেকে বড়, সে এখন নিজেই স্কুলের জন্য প্রস্তুত হয়ে যেতে পারে, কিন্তু রিন্টি এখনও মায়ের উপর নির্ভরশীল। রিকু বিপ্লবের সাথেই বেরিয়ে যায় স্কুলে আর নন্দিতা রিন্টিকে পৌঁছে দেয় তার নার্সারী স্কুলে। বিপ্লবকে চা দিয়ে, রিন্টিকে ব্রাশ করিয়ে তার হাত মুখ ধুইয়ে নন্দিতা আবার ঢোখে রান্নাঘরে। প্রাতরাশ তৈরী করে, বিপ্লব ও রিকুর জন্যে লাঞ্চ-বক্স তৈরী করতে ব্যস্ত হয়ে পরে সে।
ওইদিকে চা আর খবরের কাগজের পাতায় ডুবে থাকা বিপ্লবের কাছে চুপিচুপি এসে দাঁড়ায় রিন্টি। বাবাকে ডেকে বলে, "বাপি এই দেখো না, স্কুলের মিস্ এই ড্রয়িং টায় রং করে নিয়ে যেতে বলেছে, কিন্তু কাল রাতে করতে ভুলে গেছি, আমায় করিয়ে দাও না বাপি...।"
বিপ্লব কাগজ থেকে মুখ না উঠিয়েই রিন্টিকে বললো, "মায়ের কাছে যাও মামনি, দেখছো না আমি পেপার পড়ছি..."।
রিন্টি তবুও বায়না করতে থাকলে বিরক্ত হয়ে সে নন্দিতাকে ডেকে বলে, "নন্দিতা, কি এমন রাজ্যের লোকের জন্য রান্না করছো যে একটু রিন্টিকে সামলাতে পারছো না?"
নন্দিতা বলে, "তুমি একটু দেখে না, আমি রান্নাঘরের কাজগুলো সেরে নেই..."।
বেজায় ক্ষেপে গিয়ে বিপ্লব বলে, "এই তো সাধারণ কিছু কাজ, এটা নিয়ে কি যে এত ব্যস্ত যে বাচ্চাটার দিকে ধ্যান দিতে পারছো না, অসহ্য....কি করো সারাদিন বাড়ি বসে? তোমার তো টাকা রোজগারেরও হ্যাপা নেই আর বড় বড় কথা..."।
নন্দিতা আর কিছু না বলে রিন্টিকে নিজের কাছে রান্নাঘরে নিয়ে যায়। বিপ্লব আর রিকু বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষন। রিন্টিকে তৈরি করে এবার নন্দিতা তাকেও পৌঁছে দিয়ে আসে স্কুলে। এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় নন্দিতা।
চোখটা বুজে আসে, ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমে ঢলে পরে খেয়াল থাকে না, ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে কলেজের অডিটোরিয়াম ভর্তি ছাত্রছাত্রীরা, ডিবেট কম্পিটিশন চলছে। একের পর এক অকাট্য যুক্তি রাখছে নন্দিতা, প্রতিপক্ষের ছাত্রটি পারছে না নন্দিতার অকাট্য যুক্তিগুলোকে খণ্ডন করতে। সহসা ঘুম ভেঙে যায় নন্দিতার। ঘড়ি দেখে মনেমনে প্রমাদ গুনে, বেলা হয়ে গেলো অনেক। দুপুরের জন্য ভাত রান্না বাকি, স্নান, দৈনিক পুজো-আর্চা, কাপড়কাচা সব বাকি। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে হাত চালিয়ে কাজ করতে থাকে নন্দিতা। সমস্ত কাজ সেরে আবার বেরোয় রিন্টিকে স্কুল থেকে আনতে। রিন্টি এলে পর তাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ফোন করে বিপ্লবকে। জিজ্ঞেস করে,"হ্যাঁ, বলছি খেয়েছো?" ওই প্রান্ত থেকে বিরক্তির সুরে বিপ্লব বলে, "উফ্! তুমি কি আমার মা জননী নাকি যে খেয়েছি কি খাইনি তার কৈফিয়ত দেবো? যা না খাবার দিয়েছো...ওই তো মাথামুন্ডু কি সব ভাজা আর রুটি, হুহ্... এরজন্যে আবার ফোন করে জিজ্ঞেস করছো খেয়েছি কিনা! আদিখ্যেতা...রাখো ফোন"। নন্দিতা আর কিছু বলে না, ফোনটা রেখে দেয়। এটা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে এখন, বিপ্লব সব কিছুতেই নন্দিতার কিছু না কিছু খুঁত বের করে, নন্দিতা কিছু বলে না তেমন। পাল্টা উত্তর দেওয়া যে তার স্বভাব নয়, চুপচাপ শুনে যায় শুধু।
রাতের বেলা সবাই ডাইনিং টেবিলে। রিকু আর বিপ্লবকে খাবার পরিবেশন করে দিয়ে রিন্টিকে খাওয়াচ্ছে নন্দিতা নিজ হাতে। বিপ্লব রিকুকে স্কুল সমন্ধে কিছু কিছু জিজ্ঞেস করছে যখন, তখন রিকু বলল, "আগামী শনিবার স্কুলে পেরেন্টস্ টিচার মিটিং। ক্লাস টিচার বলেছেন মা এবং বাবা তোমরা উভয়েই যেন পি.টি.এমে উপস্থিত থাকো"।
রিকুর কথায় বিপ্লব প্রথমে যেতে একটু নিমরাজি হলেও পরে রিকুর অতিশয় বায়নায় পি.টি.এমে যাওয়ার জন্য হ্যাঁ বলে দেয়। খাওয়া হয়ে গেলে রিকু আর বিপ্লব শুতে চলে যায়। নন্দিতা রিন্টিকে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে যখন খেতে বসে তখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ১১ টা বাজতে চললো। ঠাণ্ডা ভাত, ডাল আর একটু মাছের ঝোল নিয়ে বসে নন্দিতা। খাওয়া সেরে যখন বেডরুমে এলো, ততক্ষণে বিপ্লব ঘুমে অচৈতন্য। নন্দিতা তার মোবাইলে আসা কিছু কিছু নোটিফিকেশনগুলো দেখে, মোবাইলটি রেখে আলোটা নিভিয়ে ইষ্টদেবকে প্রণাম করে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে ভাবে কাল সকালে আবার নতুন করে জীবনের সংগ্রাম শুরু করতে হবে।
**********************************
আজ শনিবার, রিকুর স্কুলের পি. টি. এম। আজ রিন্টির স্কুল বন্ধ আর বিপ্লবেরও অফিস বন্ধ। রিকু, বিপ্লব জল খাবার খেয়ে তৈরী হতে চলে যায়। রিন্টিকে তৈরী করে এবার নন্দিতার তৈরী হওয়ার পালা। বিপ্লব টোন কেটে বললো, "রিকু দেখিস তোর মায়ের জন্যই আমাদের দেরি হবে, রাইট টাইমে পৌঁছাতে পারবো না স্কুলে..."।
রিকু একটু আমতা আমতা করে বলে, "না আসলে মা বোনুকে তৈরী করে দিচ্ছে তো বাপি...,"
রিকুকে নন্দিতার পক্ষে বলতে শুনে বিপ্লব বলে উঠলো, "রাখ তো! এসব হচ্ছে ইচ্ছে করে দেরী করার অছিলা। আমাদের মা-ঠাম্মারা এর থেকে বেশী কাজ করতো জানিস বাবু, তুই হয়েছিস এক মা ন্যাওটা, বড় হয়ে বিয়ে করলে হবি বৌ ন্যাওটা, শুনে রাখ রিকু তুই আমার মতন হবি বুঝলি, বৌকে এত মাথায় চড়াবি না...."।
রিকু কি বুঝলো কে জানে শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো তার বাবার দিকে। রিন্টিকে কোলে তুলে নন্দিতা এসে বললো, "চলো, হয়ে গেছে আমার, চলো...."।
বিপ্লব বললো, "এই তো মহামান্যা নন্দিতা দেবী এসে পড়লেন, চল রে রিকু এবার রওনা দেই আমরা..."।
রিকুর ক্লাসরুম। রিকুর ক্লাস টিচার অভিবাদন করলেন নন্দিতা ও বিপ্লবকে এসে বসার জন্য। কথা হচ্ছে বিপ্লব ও টিচারের মধ্যে। সব শেষে বিপ্লব যখন বিদায় নিতে উদ্দ্যত তখন রিকুর টিচার মিস সেন নন্দিতাকে ডেকে বললেন, "নন্দিতা দি আপনার একটা অটোগ্রাফ দেবেন প্লিজ...."।
নন্দিতা হতবাক, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অবাক বিপ্লব। তাচ্ছিল্যের সুরে সে বলল, "মিস সেন আপনি নন্দিতার মতন একজন সাধারণ, পাতি গৃহবধূর অটোগ্রাফ কেন নিতে চাইছেন?"
বিপ্লবের চমক ভাঙলো মিস সেনের কথাতেই। তিনি বললেন, "আপনি সাধারণ গৃহবধূ কাকে বলছেন বিপ্লব বাবু? নন্দিতা দি আপনার লেখাগুলো আমি পড়ি, এত পজিটিভ লেখেন আপনি, এত রিলেট করতে পারি আপনার লেখাগুলোর সাথে নিজের জীবনকে সেটা সত্যিই অদ্ভুত। বিভিন্ন ই-ম্যাগাজিন, সাহিত্যপত্রিকা, লেখালেখির ওয়েবসাইট গুলোতে আপনার লেখা প্রকাশিত হয়, আমি আপনার সব লেখা পড়ি..."।
মিস সেন কলম আর একটি খাতা এগিয়ে দিলেন নন্দিতার দিকে। বিপ্লব তখনো ঘোরের মধ্যে আছে যেন, মিস সেন বিপ্লবকে বলছেন, "আপনি খুব লাকি বিপ্লব বাবু নন্দিতা দি আপনার স্ত্রী। নন্দিতা দি এত ভালো লেখেন, এত গুণী মহিলা নন্দিতা দেবী, আমি তো ওনার লেখার ফ্যান হয়ে গেছি...।"
স্কুল থেকে বেরিয়ে রিকু বিপ্লবের হাত ধরে হাঁটছে রাস্তায়, রিন্টি নন্দিতার কোলে। বিপ্লব একটু নন্দিতার দিকে চেয়ে বললো, "তুমি লেখো এ কথাটা আগে বলো নি তো কখনো?"
নন্দিতার উত্তর দেওয়ার আগে রিকুই বলে ওঠে, "বাপি তুমি মাকে কখনো জিজ্ঞেসই করোনি, ক্লাসটিচার তো ক্লাসে সব সময় আমায় বলেন মায়ের থেকে লেখালেখির এই বিশেষ গুণটা অর্জন করতে..."।
এবার বিপ্লব কিছু বলে না আর, চুপ করে থাকে। বাড়ি ফিরে নন্দিতা এখন রান্না নিয়ে ব্যস্ত রান্নাঘরে। বিপ্লব কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, "বলছি কি নন্দিতা....না মানে, তুমি কবে থেকে এত লেখালেখি করো? আসলে আমি এত ব্যস্ত থাকি তোমার এই নবরূপ সম্পর্কে আমার তো তেমন ধারণাই ছিল না...."।
নন্দিতা এবারে খুব শান্তস্বরে বলে, "তোমার মনে পরে বিপ্লব আমাদের প্রথম সাক্ষাতের কথাটা? কলেজের ডিবেটের দিন, ওইদিনও আমার ডিবেটের বিষয়ের তর্ক আর যুক্তিগুলো আমিই কাগজ ঘেঁটে, বইপত্র ঘেঁটে, লিখে পড়ে শিখে এসেছিলাম যে যুক্তিগুলো তুমিও খন্ডাতে পারছিলে না। ওইদিন শুধু প্রতিযোগিতা নয় জয় করেছিলাম তোমার মনও। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের কাছে আসা, আর আমাদের মধ্যে ভালোবাসার বীজের উৎপত্তি। তুমি তো জানতে ছোটবেলা থেকেই লিখতে ভালোবাসি। কলেজের মাসিক সাহিত্যিক পত্রিকাতেও ছেপে বেরতো আমার লেখা। কলেজ শেষে তোমার চাকরি আর আমার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্যে উঠে পড়ে লাগা। তারপর আর কি? বিয়ের পর আমি আটকে যাই সংসারের জালে, লেখালেখির সখ-আহ্লাদ সব মিটে গেলো রিকু আর রিন্টি হওয়ার পর। এখন বাচ্চারা একটু বড় হয়েছে, তাই প্রত্যহ দৈনিক কাজগুলো সেরে দুপুরে খাওয়ার পর খালি বসে না থেকে আবার নিজের সখটা পূর্ণ করছি। আমি আবার লিখছি, তুমি নিজের কাজ কারবার নিয়ে এত ব্যস্ত থাকো যে তোমায় আর বলা হয়নি কথাটা....যাই হোক, এই নাও চা, তোমার ফেভারিট আদা চা...."
বিপ্লব চা হাতে নিয়ে লক্ষ্য করলো নন্দিতার মুখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু চোখ দুটো এখনো উজ্জ্বল সেদিনের মত যেদিন প্রথম কলেজ ডিবেট প্রতিযোগিতায় নন্দিতাকে দেখেছিল। এদিকে নন্দিতার চোখে মুখে আত্মবিশ্বাসের নবরূপ প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে, নিজেকে নবরূপে ফিরে পেয়েছে যে সে....।