STORYMIRROR

anindita das

Horror

4.3  

anindita das

Horror

অস্তিত্ব

অস্তিত্ব

12 mins
873


এতক্ষণের গাড়ি জার্নিতে সমস্ত শরীরটা ব্যাথায় যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে চার বন্ধুর! চার বন্ধু -সম্প্রীতি, প্রতীক্ষা, অনুসূয়া আর রুপালি। অভিন্ন হৃদয়াত্মা পাঁচ জন -নিজেরা নিজেদের ভালোবেসে যারা নামকরণ করেছে -'পঞ্চ দ্রৌপদী।' পঞ্চম জন অর্থাৎ আলিশা আপাতত অনুপস্থিত। এই দীর্ঘ গাড়ীযাত্রার পথটুকু আলিশা কিন্তু পেরোতে পারেনি। কলকাতা থেকে সিউড়ি অবধি এই যাত্রাপথটুকু অতিক্রম করেছে চারজনই। নার্সারি থেকে ক্লাস টুয়েলভ অবধি এক স্কুলে পড়েছে এই অভিন্নহৃদয় পাঁচ বন্ধু। মাঝ তিরিশে পৌঁছিয়েও কর্মজীবন এবং সংসার জীবনের ব্যাপক ব্যস্ততা ও জটিলতা সামলিয়েও সারা দিনে অন্ততঃ আধঘন্টা সময় ওরা শুধুই বন্ধুত্বের জন্য রাখে। স্কুলবেলাকে ছুঁয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে বড় ভালোবাসে ওরা। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিখাদ আড্ডা হয় সবার। মাঝেমাঝে সময় পেলে টুক করে কনফারেন্স কল করে প্রাণ খুলে হেসে নেয় প্রত্যেকে। তারপরে আবার যে যার মতো গতানুগতিক, সমানুপাতিক ব্যস্ততার ছন্দে ঘেরা নিজের নিজের জীবন।

   পাঁচ বন্ধু মিলে সিউড়ি বেড়াতে আসার এই প্রোগ্রামটা গত দু'বছর ধরে ওরা করেছে। তুমুল আলোচনার পর সিউড়ি জায়গাটা ঠিক হয়েছিল একটাই কারণে। সিউড়ির হাডজন বাজারের কাছে চমৎকার একটি দোতলা বাগানবাড়ি পৈত্রিক সূত্রে উপহার পেয়েছে আলিশা। সময় পেলেই বন্ধুদের সাথে এই বাড়িটা নিয়ে কথা বলতে খুব ভালবাসে ও। বাড়িটার সাবেকী আভিজাত্যকেএকটুও নষ্ট হতে না দিয়েও কিভাবে পরিচিত এক কন্ট্রাক্টর ভদ্রলোককে দিয়ে খুব সুন্দর করে মেরামত করিয়েছে বাড়িটা সে সব বিস্তারিত বর্ণনা বন্ধুরা অনেকবার পেয়েছে আলিশার কাছে। আগে বাড়িটার কোনোও নাম ছিল না। এই 'পঞ্চ দ্রৌপদী'ই অনেক ভেবেচিন্তে বাড়ীটার নাম রেখেছে 'তীর্থা!'এ সম্বন্ধে ওদের যুক্তি হলো -এ বাড়িতে আলিশা এবং ওর চার বন্ধু ছাড়া আর কেউ কখনো থাকতে আসবেনা। কারণ সিউড়ি কোনোও বিখ্যাত প্রতিষ্ঠিত টুরিস্ট স্পট নয় বলে আলিশার সৌখিন বর রৌণক এবং ক্লাস সিক্সে পড়া রৌনকের আগের পক্ষের কন্যা সন্তান দিব্যা আলিশার বাগানবাড়িটি নিয়ে এতোটুকুও উৎসাহিত নয়।(আলিশার কোনোও কিছু নিয়েই কি এরা উৎসাহিত?) একইরকমভাবে আলিশার মাল্টিন্যাশনাল ফার্মের কলিগ-বন্ধু স্থানীয়রা এবং আত্মীয়স্বজনরাও কলকাতা থেকে এত দূরের রাস্তা তেল পুড়িয়ে এসে সাদামাটা কৌলিন্যহীন জায়গাটায় থেকে নিজেদের অর্থ, সময় আর রুচিকে নষ্ট হতে দিতে রাজি নয়। অতএব 'পঞ্চ দ্রৌপদীর' ফাঁকতালে পাওয়া চিলতে অবসরের প্রধান আড্ডাক্ষেত্র হতে চলেছে আলিশার 'তীর্থা' বাড়ি। 

   সাহিত্যের অধ্যাপিকা সম্প্রীতি শৈশবে একটা মারাত্মক 'যৌন হেনস্থা'র শিকার হওয়ার অতীত আছে ‌। অবিবাহিতা সম্প্রীতি পুরুষ জাতিকে একেবারেই বিশ্বাস করেনা। নিন্দুকেরা ওকে 'ঘোর নারীবাদী' বলে অভিহিত করেন।আলিশার বাড়িটির নামকরনের সময় সম্প্রীতি বলেছিল ,

-"শরীর মন যেখানে গিয়ে শুদ্ধ হয় তাই তীর্থ। আর তাই জন্যই আলিশার বাড়িটা আমাদের কাছে তীর্থের মতো পবিত্র এবং অবশ্য গন্তব্য হতে চলেছে‌। লিঙ্গ পরিবর্তন করে তীর্থকে 'তীর্থা' করে নিলাম আমরা বেশ!"

   পাঁচ বন্ধুর নিজস্ব হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের নাম 'পঞ্চ দ্রৌপদী'ও অনেকটা এহেন ভাবনাকে উপজীব্য করেই। যদিও সুন্দরী পেশাদারী গায়িকা প্রতীক্ষার তদানীন্তন সঙ্গীত পরিচালক 'লিভ-ইন-পার্টনার' সুশোভন এদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিল এতসব বিখ্যাত পৌরাণিক চরিত্র থাকতে দ্রৌপদীকে এরা কেন বেছে নিল নিজেদের গ্রুপের নামকরণ করতে গিয়ে! 

  উজ্জ্বল নাট্যব্যক্তিত্ব এবং কিছুদিন হলো একটা খুব তিক্ত বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে ডিভোর্স পাওয়া অনুসূয়া এই প্রসঙ্গে উত্তর দিয়েছিল,

-"আমরা সবাই দ্রৌপদীর কোনোও না কোনোও গুণ নিয়ে জন্মেছি। আলিশা অসম্ভব সাহসী, সম্প্রীতি বিদুষী, প্রতীক্ষা সংগীত- নৃত্যকলায় ভূয়শী প্রশংসা পায় সবার কাছে, আমাকে সবাই তীব্র রসিক বলে জানে এবং দ্রৌপদীর এটা অন্যতম একটি গুণ ছিল। সর্বোপরি আমাদের রসনা রক্ষার দায়িত্বে থাকা শেফ রুপালির রন্ধন পটীয়সী হওয়ার ক্ষমতাটাই বোধহয় দ্রৌপদীকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চিত হওয়া গুণ। কী অদ্ভুতভাবে আমাদের কারো না কারো সাথে দ্রৌপদীর কোথাও মিল রয়েছে। তাই আমাদের দলটার নাম আমরা রেখেছি -'পঞ্চ দ্রৌপদী।''

রুপালি 'রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী' পরিবারের কন্যা। শৈশবেই পিতৃ মাতৃ হারা। দাদারা গড়িমসি করে রুপালির বিয়ের চেষ্টা করেননি কখনো। রুপালিও তাদের উপর এতটাই নির্ভরশীল ছিল যে নিজের জন্য কখনো তেমন কিছু ভাবা হয়ে উঠেনি ওর। অত্যন্ত যত্নশীলা ঘরনী রুপালির ঘর পাওয়া হয়নি আর। এখন নিজেই বিয়ে করতে ও ভয় পায় -বন্ধুদের জীবনের জটিলতাগুলো দেখে! তো এহেন

রুপালি সম্প্রীতির দেওয়া হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের নামকরণটি শুনে টিপ্পনি কেটে বলেছিল,

-''দ্রৌপদীর মতো আমরা আবার পাঁচ বর নিয়ে ঘর করাতে বিশ্বাসী হবো না তো কখনো ?"

 প্রশ্নটা শুনে পাঁচ দ্রৌপদীর বাকি চারজনের উত্তর কিন্তু কমবেশি একই রকম হয়েছিল। নিজেদের পেটেন্ট রহস্যময়ী হাসিটা হেসে তারা বলেছিল,

-" আমাদের যে এমন মানসিকতা সত্যিই নেই এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই।অতএব পাঁচ স্বামী চাই কিনা এরকম প্রশ্ন কেউ করলে উত্তরে আমরা একটাই কথা বলবো - আমরা না বলবো না !"

  এমনই বুদ্ধিদীপ্ত হাসিখুশি ,মজারু সম্পর্ক পাঁচ দ্রৌপদীর একে অপরের সঙ্গে। পাঁচজনেরই মা-বাবা বেঁচে নেই। অন্যান্য পারিবারিক সম্পর্কগুলোর বুনোটও তেমন জোরালো নয়। বন্ধুদের সঙ্গই তাই একে অন্যের বেঁচে থাকার অক্সিজেন!

   দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ ঘন্টার গাড়ি জার্নিতে এতক্ষণ এই কথাগুলোই ভাবতে ভাবতে এসেছে চার বন্ধু। আলিশা ভাবতে পারেনি ওর বাকী চারজন বন্ধুর মতো করে। আসলে আলিশা আর ওর বান্ধবীদের জগত আলাদা হয়ে গিয়েছে! আলিশা আর ওর চার বান্ধবীর জগতের বাসিন্দা নেই যে!

  সম্প্রীতি, প্রতীক্ষা, অনুসূয়া আর রুপালি যতবার আলিশার কথাটা ভাবছে ততবার ওদের মনের ভেতরটা ভেঙেচুরে যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে! কি যে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে! এখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না ওরা! এও কি সত্যি হতে পারে? শুক্র, শনি, রবি তিনদিনের একটা নির্ভেজাল আড্ডা ছুটি কাটাবে বলে কতদিন ধরে কত রকম প্ল্যান-প্রোগ্রামের পর অবশেষে পাঁচজন গাড়িতে উঠলো। কিন্তু গাড়ি দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরোতে না পেরোতেই ঘটনাটা ঘটে গেল! এত আকস্মিক পুরো ব্যাপারটা! আলিশা ছাড়া বাকি চার বন্ধুর প্রবল আপত্তি ছিল বর্ষার বৃষ্টি ভেজা জল কাদার রাস্তায় রাত তিনটের সময় কলকাতা থেকে রওনা দেবার ব্যাপারে। কিন্তু আলিশার অকাট্য যুক্তি ছিল,

 - "তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লে সকাল সকাল পৌঁছে যাব সিউড়ি। তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়বো এদিক ওদিক। বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণ বা বোলপুরের দিকে যাওয়ার মোটেই চেষ্টা করবোনা। নিজেদের মতো করে ঘুরবো লাল মাটির দেশের অনাবিষ্কৃত কিছু জায়গা যা তেমনভাবে ট্যুরিস্টদের মন কাড়েনি কখনো ।"

   আলিশার জোরাজুরিতে বন্ধুরা নিমরাজি হয়েছিল।

   ড্রাইভার ছেলেটির হাত খুব পাকা। রুপালিদের ক্যাটারিং সার্ভিসের গাড়ি চালাচ্ছে ও বহুদিন ধরে। সেও কিন্তু একটু আপত্তি তোলেনি রাত তিনটেতে ম্যাডামদের নিয়ে বেরোনোর ব্যাপারে।        গাড়িতে উঠে পাঁচ বান্ধবী একেবারে কিশোরীবেলার চাপল্যে মেতে ড্রাইভার অংশুকে বলেছিল খুব জোরে গান চালাতে। তারপর পাঁচজনেই সরু, মোটা নানা গলায় বিশাল জোরে চিৎকার করে গান ধরেছিল,

-"নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে!"

বাইরে তখন বেশ মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তা ফাঁকা ‌। হুগলি সেতুর টোল-ট্যাক্স পেরিয়ে গাড়ি সবে সাঁতরাগাছি ছাড়িয়ে সলপের মুখে পৌঁছেছে ।এমন সময়...! 

******************************************

    কি এক অদ্ভুত খেয়াল যে হলো আলিশার! অত রাতে টিপটিপে বৃষ্টির মধ্যে হঠাৎই গাড়ির দরজা খুলে নেমে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ভিজতে শুরু করলো। বাকি চারজন বন্ধুরা তো যাকে বলে চমকে চল্লিশ!

-"এটা কি করছিস আলিশা?"রুপালি আর্ত চিৎকার করে উঠল!

-"উঠে আয় বিপদ হতে পারে!" কড়া গলায় সাবধানী সম্প্রীতি বিকট জোরে হাঁক ছাড়লো।

ড্রাইভার অংশুও অত্যন্ত উসখুস করছে আলিশা ম্যাডামের এরকম আকস্মিক অদ্ভুত আচরণে!

  কিন্তু আলিশা নির্বিকার। বৃষ্টিতে সে ভিজবেই। এমন অদ্ভুত আচরণটা যে কেন করছে ও!

এইভাবে পাগলের মতো মাঝরাতে রাস্তায় নেমে নাচতে নাচতে ভিজে আনন্দ উপভোগ করা যায়? চারিদিক থেকে এত গাড়ি আসছে বারবার ! লরিগুলো দেখলেই ভীষণ ভয় করছে! রাতের রাস্তায় দ্রুত বেগে ধেয়ে আসা ওই বিশালাকার যানবাহনগুলোকে দেখলে মনে হচ্ছে 'অপার্থিব দানব!'

শেষবারের মতো পঞ্চ দ্রৌপদীর চারজন চিৎকার করে 'আলিশা' বলে ডাকলো!

আর ঠিক তখনই বোম্বে রোড থেকে একটা দ্রুতবেগে ধেয়ে আসা লরিটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ...!

******************************************

   আলিশা ওর 'তীর্থা' বাড়ির চাবিটা গাড়িতে উঠে প্রথমেই সম্প্রীতির হাতে দিয়ে দিয়েছিল। হাসতে হাসতে বলেছিল,

-"চিরকাল ক্লাস মনিটর ছিলিস তুই স্কুলে। অতএব এবারকার পুরো ট্যুরের দায়িত্ব তোর। চাবিটা তোর কাছে হ্যান্ডওভার করে দিলাম। আমি এবার মুক্ত বিহঙ্গের মত খালি নাচবো গাইবো আর ফুর্তি করবো।"

   সাঁতরাগাছির সলপ থেকে এই সিউড়ি অবধি পথটা কিভাবে যে ওরা চারজন এসেছে এবং অংশু ড্রাইভার গাড়িটি চালিয়েছে -সেটা বর্ণনা করতে গেলে একটা 'ভয়ের অমনিবাস' লেখা হয়ে যেতে পারে বোধহয়! সম্প্রীতি, রুপালি, অনুসূয়া আর প্রতীক্ষার পথ ফুরোনোর প্রতীক্ষা যেন আর ফুরোচ্ছিলোই না। অথচ ওরা নিজেরাও উপলব্ধি করতে পারছেনা যে - এই যে অদ্ভুত পথটা ওরা আলিশাকে সলপে রেখে নিজেদের জন্য নির্বাচন করল সেই পথের আদৌ শেষ কোথায়! লরিটাকে আসতে দেখে ওরা সমবেতভাবে চিৎকার করে আলিশাকে সাবধান করতে চেয়েছিল। কিন্তু...! 

  ঘটনার আকস্মিকতায় ড্রাইভার অংশু সহ চারবন্ধু একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল! গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরোনোর, আলিশার কাছে যাওয়ার ক্ষমতা ছিলনা ওদের কারোর! অ

ংশু কি ভীষণ করুণভাবে কাঁদতে শুরু করে দিল! কাঁদতে কাঁদতেই বললো,

-"আলিশা ম্যাডাম এমনি ভাড়ার চেয়ে তিনগুণ বেশি দেবেন বলে আমাকে রাজি করিয়েছিলেন। আমি তাই এত রাতে গাড়ি চালাতে রাজি হয়েছি এমন বিপদের পথে। আমার মায়ের আমি ছাড়া আর কেউ নেই! এবার কি হবে!"

  সম্প্রীতি, প্রতীক্ষা আর রুপালি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল! সবারই মনে হচ্ছিল এবার কি হবে! প্রিয় মানুষগুলোর মুখগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল! একমাত্র মাথা ঠাণ্ডা ছিল অনুসূয়ার‌! রীতিমতো মঞ্চ কাপানো দক্ষ পেশাদারী অভিনেত্রী অনুসূয়া! নাটকের প্রয়োজনে বহুবার মঞ্চের নানা ধরনের আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিতে ও পটু। আজ জীবনের এই বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে চার বন্ধুর হয়ে সিদ্ধান্তটা অনুসূয়া নিল। ঠান্ডা গলায় অংশুকে বললো,

-''কান্নাকাটি থামিয়ে চুপচাপ এখান থেকে গাড়িটা চালাতে শুরু করো অংশু। রাতের অন্ধকারে এখনো কেউ আমাদের দেখতে পায়নি। কোনোওরকম জটিলতা তৈরি হওয়ার আগেই আমাদের এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে। না হলে কৌতুহল আর অনুসন্ধিৎসু মনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে জেরবার হয়ে যাবো আমরা। আমাদের গন্তব্য ছিল তীর্থা। আমরা এখন সেখানেই যাবো।"

    একে তো এরকম একটা অদ্ভুত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি - তার মধ্যে অনুসূয়ার এত কঠিন কঠিন শব্দ চয়ন করে নাটকের ঢঙে বলা এমন অদ্ভুত একটা কথা! সম্প্রীতি, প্রতীক্ষা আর রুপালি অবাক হতেও যেন ভুলে গেল! 

রুপালি কেমন ঘোরলাগা কণ্ঠস্বরে বলল, 

-" তোর কি মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে অনুসূয়া বিপদে পড়ে? আমরা এখন এই অবস্থায় আলিসার তীর্থা বাড়িতে যাবো আলিশাকে ছাড়া? তুই কি বলছিস তুই সেটা নিজে জানিস? "

   অনুসূয়া রুপালির কথাটার কোনোও উত্তর না দিয়ে এতক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করে কেমন নির্জীব হয়ে যাওয়া ড্রাইভার অংশুকে ধাক্কা মেরে বললো, 

-" আলিশা ম্যাডাম নেই তো কি হয়েছে - জিপিএস তো আছে! তীর্থা বাড়ি জায়গাটার বিবরণ আলিশার কাছে এতোবার শুনেছি যে ঠিক চিনতে পেরে যাবো। অংশু লোকজন চলে আসার আগে প্লিজ গাড়িটা চালাতে শুরু করো। না হলে এই ঘটনার রেশ যতদূর পৌঁছোবে তুমি ভাবতে পারছোনা! "

  প্রতীক্ষা এমনিতেই নৃত্যশিল্পী বলে যথেষ্ট রূপচর্চা করে। আজও বন্ধুদের সঙ্গে এমন মনের মত একটা ট্রিপে যাবে বলে নিজেকে বেশ মাজা-ঘষা করে এসেছে। গাড়ির ভেতরের  আলো নিভিয়ে রেখেছে ওরা। তবু রাস্তার আলো গাড়ির ভেতর এসে প্রতীক্ষার সুন্দর মুখখানিতে কেমন যেন আলপনার কারুকার্যর আঁকিবুকি কেটে যাচ্ছে। প্রতীক্ষা চোখ মুছে কেমন যেন ঘুম ভেঙে ওঠা কণ্ঠস্বরে চনমনিয়ে বলে উঠলো, 

-" অনুসূয়া তোর প্রস্তাবে আমি রাজী। আমাদের এই ট্রিপটা আমরা বন্ধ করবোনা। এতদিনের এত রকম প্রস্তুতি নিয়ে এত আনন্দ করে আমরা বেড়াতে বেরিয়েছি বন্ধুরা মিলে। এই আনন্দটা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। কে জানে এরপরে আমরা একসঙ্গে কি কোথাও আবার বেড়াতে যেতে পারবো এমনভাবে কখনো আর! অংশু প্লিজ তুমি গাড়ি চালানো শুরু করো। "

  কলেজের গুরুগম্ভীর অধ্যাপিকা সম্প্রীতি তবুও নিজের মতো করে যুক্তি টুক্তি সাজিয়ে সোচ্চার কিছু বলবার উপক্রম করছিলো।

রুপালি ওর হাতটা ধরে ওকে চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল। সুদক্ষ শেফ রুপালি রাস্তায় খাবার জন্য নানারকম কেক ,পেস্ট্রি বেক করে এনেছে। দ্রুত সেসব নিজের হ্যান্ড ব্যাগ থেকে বাইরে বার করে অভ্যস্ত কায়দায় খাবার ভাগ করতে শুরু করতে গিয়েও নিজেকে নিরস্ত করে নিল রুপালি। এখন কেউই খেতে পারবেনা কিছু! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রুপালি সম্প্রীতিকে বললো, 

-" যা হয়েছে তা আমাদের ইচ্ছেতে হয়নি। আমরা কি সত্যিই কেউ এমন পরিনতি কল্পনা করেছিলাম কখনো? আলিশাকে বাদ দিয়ে ওর বাড়িতে আমরা যাব একথাটা কি স্বপ্নেও ভেবেছি আমরা ? তীর্থা বাড়িটা নিয়ে আমাদের মধ্যে কতটা রোমান্টিসিজম ছিল বলতো! আলিশা বার বার বলতো -ওই তীর্থা বাড়িটা আমাদের পাঁচ বন্ধুর - পঞ্চ দ্রৌপদীর পদার্পণে হেসে খেলে উঠবে।আলিশার এই ইচ্ছেটা আমরা পূর্ণ করবো না বল? ঘটনাটা যখন ঘটেই গেছে এবং আমাদের হাতে আর কিছুই করারও নেই তখন আনন্দটুকু উপভোগ করা থেকে নিজেদের বাদ দেই কেন ? তুই আর আপত্তি করিসনা সম্প্রীতি। "

        আলিশা বারবার বলে রেখেছিল শক্তিগড়ের ল্যাংচার দোকানে গরম-গরম ল্যাংচা খাওয়া হবে। 

শক্তিগড় পেরোনোর সময় আলিশার কথা ভেবে বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো চার বন্ধুর! সম্প্রীতির জিপিএসের জোরে আর আলিশার কাছে শোনা নিখুঁত বর্ণনাকে মাথায় রেখে সেই মতো অংশুকে নির্দেশ দিতে দিতে অবশেষে রুপালি ,প্রতীক্ষা, অনুসূয়া আর সম্প্রীতি পৌঁছে গেল আলিশার স্বপ্নের তীর্থা বাড়িতে!

        কি অদ্ভুত সুন্দরভাবে যে তীর্থা বাড়িটাকে সংস্কার করিয়েছে আলিশা! বাড়িটার বাইরেটায় আলিশার পূর্বপুরুষদের আমলের সেই সাবেকিয়ানার ছোঁয়া -অথচ অন্দরসজর সবটুকু আধুনিক আরাম আয়েশের সম্পূর্ণ উপাদান নিয়ে অতিথি অভ্যর্থনার জন্য যেন উন্মুখ হয়ে রয়েছে যেন। অংশু গাড়িতেই রয়ে গেছে।চার বন্ধুর ইচ্ছে করছে সময়কে ধমক দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে স্থবির করে। ইচ্ছে করছে তো অনেক কিছুই। কিন্তু সব ইচ্ছে পূর্ণ হওয়ার জো থাকে কি সবসময়!

      নিঃশব্দতা ভেঙে কথা বললো অনুসূয়া। দৃঢ়চেতা ভঙ্গিতে বন্ধুদের বললো ,

-"আর কি কখনো কবে -এমন সুযোগ হবে?"

প্রতীক্ষা মুখ গোমড়া করে বসে থেকেও হেসে ফেলে মন্তব্য করলো,

-"বাহ্! দিব্যি রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর ছুরি-কাঁচি চালাচ্ছিস? আর কি কখনো হবে এমন সন্ধ্যা হবে - বললে কি ক্ষতি হতো শুনি?"

কথাগুলো বলা শেষ করেই প্রতীক্ষা চট করে গেয়ে উঠলো,

-"হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে!"

রুপালি বলল,

-''হরি তো আমাদের পার করেই ফেলেছেন তীর্থা বাড়িতে এনে ফেলে। এখন শুধু যদি একটু আলিশার খবরটা...!"

  সম্প্রীতির নানা ধরনের বিষয়ে অগধ জ্ঞান। সময়-সুযোগ পেলেই নিজের বিষয় ইতিহাস ছাড়াও অন্যান্য অনেক কিছু নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালোবাসে ও। সম্প্রীতির দিকেই তাই মুশকিল আসানের সন্ধান পাওয়ার আশায় তাকিয়ে আছে বাকি তিন বন্ধু। অনুসূয়া বললো,

-"তুইতো প্যারাসাইকোলজি বিষয়টা নিয়ে অনেকদিন পড়াশোনা করছিস সম্প্রীতি। আলিশার খবরটা একবারে এনে দিতে পারবি না? মেয়েটার এত ইচ্ছে ছিল আমাদেরকে ওর বাড়িটা নিজে ঘুরে দেখাবে। আলিশাকে একবার আনা যায় সম্প্রীতি ? মন থেকে মনে, প্রত্যেক অণু-পরমাণুর অনুরণনে, আলিশাকে একবার আনা যায় সম্প্রীতি...?"

   তীর্থা বাড়ির প্রতিটি ইঁট -পাথর সাক্ষী থেকে যাচ্ছে কিছু ফিসফিসানির আর হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো টুকরো-টুকরো কথোপকথনের! বাড়িটা ভাবছে -তালা বন্ধ দরজা ঠেলে কারা ঢুকেছে ? কেন এসেছে এরা? এদের কণ্ঠস্বরের সতেজতা শুনে মালুম হচ্ছে -এদের অস্তিত্ব এখনো পৃথিবীর চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে! মনে হচ্ছে ইহলোকের নিবিড় মায়ায় এরা অসম্ভব আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রয়েছে। আস্তে আস্তে একটু একটু করে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে এদের কন্ঠস্বর! দেখা না দেখায় মেশা পার্থিব আর অপার্থিব জগতের সীমারেখার সীমায় বারবার প্রতিফলিত হচ্ছে চার বান্ধবীর আন্তরিক আকুতি। আলিশাকে একটিবারের জন্য হলেও ছুঁতে চাইছে ওরা ! নিজেদের পরিবার-পরিজনের কথা তো একবারও কই বলছে না এরা! শুধু আলিশাকেই চাইছে কেন? কি এমন নিগূঢ় কথা আছে এদের আলিশাকে বলার...!

*******************************************************

       নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে কেমন উত্তেজিত আর অস্থির হয়ে উঠেছে আলিশা! ডাক্তার-নার্সেরা মিলে সামলাতে পারছেন না ওকে! প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে আলিশার! আইসিইউর সামনে অপেক্ষারত আলিশার স্বামী রৌনককে পুলিশ বারবার জেরা করে জিজ্ঞাসা করছেন যে গভীর রাতে সলপ নামে জায়গাটায় জ্ঞান হারানোর আগে আলিশা কিভাবে বেঁচে গেলেন গাড়ি দুর্ঘটনার হাত থেকে! আলিশা একা কেন নেমেছিলেন গাড়ি থেকে? আলিশার সঙ্গী চার বন্ধু সম্প্রীতি, অনুসূয়া, প্রেরণা আর রুপালি এবং ড্রাইভার অংশুমান বেরা বোম্বে রোডের ঘাতক লরি চাপা পড়ে তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারিয়েছেন কিন্তু গাড়ি থেকে কোনোও কারণে নেমে পড়ায় আলিশা প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন! অনেক প্রশ্নের উত্তর চাই পুলিশের! কিন্তু আলিশা যে ক্রমশ অত্যন্ত অস্বাভাবিক আচরণ করছেন! ডাক্তার-নার্সরা ইনজেকশন দিয়ে আলিশাকে ঘুম পাড়ানোর আগে শুনতে পেলেন আলিশা চিৎকার করে বলছে,

-"সম্প্রীতি, অনুসূয়া, প্রতীক্ষা রুপালি -আমার তীর্থা বাড়িটা কেমন ঘুরছিস তোরা বল? একটু অপেক্ষা কর আমি আসছি! নিজে ঘুরে ঘুরে দেখাবো তোদের বাড়িটা। কতদিনের অপেক্ষার পর এমন ছুটি পেয়েছি আমরা ! খুব আনন্দ করবো, হুল্লোড় করবো।এত ছুটে যেতে চাইছি তোদের কাছে কিন্তু কি যেন একটা আটকে দিচ্ছে আমায়! চাইলেও তোদের ছুঁতে পারছিনা কেন?"

 **********************************************************

       পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার আগে অংশুকেও ডেকে নিলো ওরা চারজন। এবারে চলে যেতেই হবে। বাড়ির লোকজন দাহ সংস্কারের সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছে। 

প্রতীক্ষা বললো,

-"আলিশার সঙ্গে আর কথা বলে কাজ নেই আমাদের! আমাদের চলে যেতে দেখে মেয়েটা জেদ করবে আমাদের সাথে যাবার। কিন্তু ওর যখন থাকার একটা সম্ভাবনা আছে তা হলে ও থাকুক। আলিশা বেঁচে থাকলে কখনো না কখনো আবার ঠিক তীর্থা বাড়িটাতে আসবেই ও! আলিশার মধ্যেই বেঁচে থাকবে আমাদের পাঁচজনের মধ্যেকার নিটোল বাঁধন - আমাদের পঞ্চ দ্রৌপদীর সমস্ত আনন্দের স্মৃতিগুলো।কোনোও ইহলোক আর পরলোক যাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবেনা! আলিশা তোর অস্তিত্বেই আমরা বেঁচে থাকবো। এবার আমাদের যেতেই হবে বন্ধু। জানি আমাদের ছাড়া তুই খুব খারাপ থাকবি। কিন্তু...!"

       ডাক্তার-নার্সরা দেখলেন অনেকক্ষণ যাবত ছটফটিয়ে বিড়বিড় করে কি সব বলতে থাকা অশান্ত রোগিনী আলিশা মুখার্জি কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে ঘুমের অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছেন ।অদ্ভুত এক অলৌকিক মায়াবী কষ্টের অস্তিত্ব তার সমস্ত চোখেমুখে...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror