anindita das

Inspirational

4  

anindita das

Inspirational

সংযমী

সংযমী

6 mins
502



কুটনো কোটার সময় আলু, ঝিঙে বা লাউয়ের খোসাগুলো সবসময়ই একটু মোটা করে ছাড়াতেন মা। তারপর সবকিছু একসঙ্গে প্রেসারে একটা সিটি দিয়ে নিয়ে অল্প সরষের তেলে পুরো জিনিসটা নুন, হলুদ, কাঁচালঙ্কা সহযোগে ভেজে তুলতেন।নামানোর আগে একটু লাবণ্যের মতো ছড়িয়ে দিতেন সামান্য চিনি আর পোস্তদানা। পাতলা মুসুরির ডাল সহযোগে অনেকদিন শুধুমাত্র এই খোসা -ভাজাটা দিয়েই দুপুরে ভাত খেতাম ‌। চাকরীর সূত্রে বাবা অনেক দূরে থাকতেন, নিয়মিত বাজার হাট হতো না আমাদের বাড়িতে। মাসে একবার বাড়ি আসতেন বাবা‌‌। ওই সময়ে দু-তিন দিন বেশ ঘটা করে বাজার-হাট হওয়ার ফলে ভালো-মন্দ খেতাম আমরা। আর মাসের বাকি দিনগুলোতে প্রায়সই মায়ের সেই বিখ্যাত খোসা ভাজার তরকারিটা ছিল আমাদের বাড়ির খুব কমন আইটেম। অনেক সময় রাত্রে রুটির সাথে খাওয়ার জন্য ভাজা হিসেবে এই খোসা ভাজাই পরিবেশন করতেন মা‌‌। মাঝে মাঝে বড্ড মুখ করতাম মাকে !অনেকদিন হয়েছে খাবারটা পুরো না খেয়েই উঠে পড়েছি। নিম্নবিত্ত পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে সংসার চালাতে গিয়ে মাকে যে কি অসম্ভব প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হতো তা অনেক সময়তেই বুঝেও বুঝতে চাইতাম না যেন! বয়সটা ছিল অল্প, মুখে যে কোন ভাল কিছু খাবার জন্য সাধ ছিল অপরিসীম। তাই হয়তো দেখেও না দেখার ভান করতাম মায়ের অসহায়তাকে। পাড়ার কাকিমাদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে অনেক সময়তেই মা বলে ফেলতেন,

-"আমাদের তো দু'জায়গায় দুটো সংসার।ওর বাবাও তো  চাকরির জায়গায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন, সেখানেও ওনাকে রেঁধে বেড়ে খেতে হয়। এই টানাটানির বাজারে একা মানুষের আয়েতে দু-জায়গায় সংসার চালানোটা সত্যিই খুব সমস্যার।"

   বাড়ির সমস্ত কাজ মা একা হাতে করতেন ‌। দুপুরবেলা কখনো ঘুমোতে দেখিনি মাকে। পুরনো শাড়ি কেটে পর্দা বানানো,আমার ছোট হয়ে যাওয়া জামার নিচে লেস বসিয়ে সেই জামাটাকেই আরো একবার ব্যবহারযোগ্য করে দেওয়া -মোটের ওপর অসম্ভব যত্নশীল ছিলেন আমার মা সংসারটাকে ভালো করে ধরে বেঁধে রাখার ব্যাপারে।

 খাওয়া-দাওয়া নিয়ে, সাধারণ মানের জামাকাপড় নিয়ে কখনো কোনো অনুযোগ করলে মা বলতেন,

-"জীবনে যখন কোনোও অভাব বোধ থাকে - তখনই সেই না পাওয়াটাকে ছাপিয়ে ভালো কিছু করবার একটা জেদ জন্মায় মনে। তোকেও বলছি তাই সুমি - দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনাটা কর মা ‌। একটা চাকরি তোকে পেতেই হবে - যে করেই হোক!"

   আমি সঙ্গে সঙ্গে মা কে উত্তর দিতাম,

-"চাকরি পেয়ে আমি খুব ভালো মন্দ খাব আর ভালো ভালো জামা কাপড় কিনব তুমি দেখে নিও মা! একটু ভালো খাবার জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করতে হয়।দু মাসে একবার বাবা বাড়ি এলে মাত্র দিন কয়েকের জন্য ভালোমন্দ খাওয়া হয় আমাদের। আর ভালো জামা কাপড় পরা তো দুরের কথা! ছোট হয়ে যাওয়া জামাও তুমি কেমন তালি- তাপ্পি মেরে আবার পরাও আমাকে।"

আমার রাগী রাগী মুখে বলা কথাগুলো শুনে মা হেসে ফেলতেন ‌। বলতেন,

-"একটু সংযমী হওয়া ভালো রে! এই যে কষ্টগুলো করে রাখছিস এখন - এরপর তুই জীবনে দাঁড়িয়ে গেলে কখনো কোনোও পরিস্থিতিতেই দেখবি তুই দমে যাচ্ছিস না। কৃচ্ছসাধন মানুষকে পরিপূর্ণ করে সুমি।"

  আমি হাতজোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিতে মাকে বলতাম,

-"সব সময় তোমার এই সংযমী হওয়ার উপদেশটা দিও না মা প্লিজ! বারবার এক কথা শুনতে আমার একদম ভালো লাগেনা!"

****************************************

      'লক- ডাউনের বাজারে' আজ বেশ কিছুদিন ধরে গৃহবন্দী অবস্থায় ফ্রিজে সব সবজিই বাড়ন্ত।আমি যে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল টাতে পড়াই সেখানে ছুটি চলছে। আমার দুই ছেলে মেয়ে এবং আইটি সেক্টরে উচ্চপদে চাকরী করা আমার কর্তামশাইয়েরও ছুটি‌। স্বাভাবিক সময়ে এরকম পারিবারিক ছুটির দিনগুলোতে খুব ভালো- মন্দ রান্না করি আমি,অনলাইনে অর্ডার করেও মন-পসন্দ দোকান থেকেও ভালো ভালো খাবার আনাই। তাছাড়া সপ্তাহে একবার ভালো কোনো রেস্তোরাঁয় সবাই মিলে খেতে যাওয়া তো আছেই!নিজের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা দেখে নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়েই ভাবি ,

-"আমি কি সেই আমি - যে তার গোটা ছোটবেলাটা একটু ভালো খাওয়া, একটু ভালো পরার জন্য কেমন ছটফট করে গেছে খালি! অবরে -সবরে পাতে দু'টুকরো কষা মাংসের পিস আর দুটো সুস্বাদু আলু পড়লে মনে হতো পৃথিবীর সেরা ঐশ্বর্যের অধিকারীনি হয়ে গেছি আমি। ছেলেবেলার সেইসব কৃচ্ছসাধনের দিনরাত্রিগুলো - মায়ের ভাষায় বলতে গেলে 'সংযম' এখনো মনে পড়লে বড্ড উতলা করে তোলে আমাকে!

  এক অসম্ভব ত্রাসে আপাতত দিনগুলো কাটছে এখন আমাদের! একটা বিচ্ছিরি 'মারণ -ভাইরাস' গৃহবন্দী হতে বাধ্য করেছে সারা দেশের মানুষদের। ফ্রিজে কিনে রাখা সবজির পরিমান আস্তে আস্তে কমে প্রায় তলানিতে ঠেকেছে ‌। মাছ- মাংস বা কোনরকম আমিষ জাতীয় পদার্থ আর অবশিষ্ট নেই বাড়িতে। কি যে অসহায় অবস্থা চলছে আমাদের!পকেটে পয়সা আছে কিন্তু সেই পয়সা খরচ করার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না! এ এক অদ্ভুত অবর্ণনীয় বিচ্ছিরি পরিস্থিতি!রান্না করে খাবারগুলো কর্তা এবং ছেলে মেয়ের মুখের সামনে তুলে ধরতে খুব খারাপ লাগছে!সত্যিই কি যে বিচ্ছিরি একটা ভয়াবহ সময় কাটছে আমাদের!আসলে এত উন্নত মানের একটা জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে -এখন রোজকার সেই জীবনে এমন কঠিন টান পড়ায় বড্ড অসহায় লাগছে!

 ফ্রিজে পড়ে থাকা সামান্য কিছু অবশিষ্ট সবজির খোসাগুলো না ফেলে বহুদিন বাদে মায়ের রেসিপি অনুযায়ী সেই 'খোসা-ভাজা' রাঁধলাম। বেশ সুন্দর একটা আইটেম হয়ে গেল ভাত দিয়ে খাওয়ার। কিছুটা বাঁচিয়ে রেখেছি - রাতে রুটি দিয়ে খাওয়ার একটা তরকারিও হয়ে যাবে এই দিয়ে। কিন্তু এরকম কোন পদ যে এর আগে কখনোই পরিবেশন করিনি ছেলেমেয়েদের!এই অকিঞ্চিৎকর খাবারটা কিভাবে যে ওদের সামনে তুলে ধরবো সেটা ভাবতেই কি রকম অসহায় লাগছে যেন আমার!

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মায়ের মুখখানা মনে পড়ল! আমি ছোটবেলায় ভালো খাবার বায়না করলে মায়ের মুখটা যে কেমন করূণ আর অসহায় হয়ে যেত! আজ এতদিন পরে মায়ের অসহায়ত্বটা যেন ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারছি।কারণ আমি নিজে মা হওয়ার পরে প্রাচুর্য এতটাই সুন্দর ভাবে ঘিরে রেখেছে আমাকে যে ছেলে- মেয়েদের ঠিকঠাক ভাবে খেতে না দিতে পারার দুঃখ আমি কোনোওদিনও উপলব্ধি করতে পারিনি! আজ বুঝতে পারলাম -আমাকেও আমার ছেলে মেয়ের বিরক্তির কারণ হতে হবে!

    দুপুরে ভাত খেতে বসে বহুদিন বাদে চেনা রান্নার স্বাদ পেয়ে অজান্তেই কেন যে আমার মুখে ফুটে উঠল অপার্থিব হাসি! কি আশ্চর্য - খাবার নিয়ে ভীষণ খুঁতখুঁতে আমার দুই ছেলে-মেয়ে আর কর্তাও দেখি সোনামুখ করে পরম তৃপ্তিতে খাচ্ছে খোসা-ভাজার তরকারি। ছেলে তো বলেই ফেলল,

-"সবকিছু নরমাল হয়ে গেলেও মাঝে মাঝে এই আইটেমটা রান্না কোরো তো মামমাম ‌‌‌। এটা খেতে খুব অন্যরকম টেস্টি।"

মেয়েও খেতে খেতে বলে উঠলো,

-"এরকম ভাবে রান্না করাটা একটা আর্ট! ইউ আর ওয়ান্ডারফুল মম।"

     চোখে জল চলে এলো ! ছেলে মেয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় না মায়ের সঙ্গে করা আমার দিনের পর দিনের খারাপ ব্যবহারের অনুশোচনায় কে জানে!

   আমার চাকরী পাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যেই মা চলে গিয়েছিলেন কখনো না ফেরার দেশে! সেভাবে মাকে কিছু উপহার দিয়ে উঠতেই পারিনি নিজের রোজগারের টাকায়! একটু আরামের, যত্নের , স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন আমার মা কোনদিনও পেলেনই না! আজ আমার হাতের খোসা ভাজার তরকারিটা আমার ছেলে- মেয়ে এত আনন্দ করে খেলো।মায়ের হাতের অমৃত রান্নাটা খেলে না জানি ওদের কি অসম্ভব আনন্দ হতো!

দ্রুত পায়ে আমার বেডরুমে গিয়ে দেওয়ালে বাঁধানো মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বুক মুচড়ে কান্না এলো! বললাম,

-"কি অসম্ভব সুন্দর একটা শিক্ষা ভাগ্যিস মা তুমি আমায় দিয়ে গিয়েছিলে! সংযমী হওয়াটা সত্যিই খুব জরুরী। সংযমী হওয়ার সাথে সাথেই জরুরী চোখ-কান খোলা রেখে সব ধরনের পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলবার সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারনা থাকা। তাহলেই জীবনে প্রতিকূল বা অনুকূল - পরিস্থিতি যাই হোক না কেন বেসামাল ভাবে হেরে যেতে হয় না। আজ এত বছর পরে - এমন এক জরুরী,আপৎকালীন পরিস্থিতিতে তোমার দেওয়া শিক্ষা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম মা গো।তোমার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা আমার আরো বেড়ে গেল মা। এভাবেই যতদিন বাঁচবো -ধ্রুব তারার মতো পথ দেখিও তুমি।আমার ছেলে-মেয়েকেও আমি তোমার শেখানো সংযমী হবার শিক্ষা এখন থেকে দেবার চেষ্টা করবোই করবো...!"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational