নয়নের দৃষ্টি হতে:
নয়নের দৃষ্টি হতে:
অপেক্ষার সময়টুকু যেন আর কাটতেই চাইছে না! গত সাত দিন ধরে এই নিবিড় অপেক্ষা করতে করতে মায়ের কথা মনে করে কতবার যে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে তমালের! বার বার মনে হয়েছে-৫ই সেপ্টেম্বর দিনটা কবে আসবে...! সেদিন কি মায়ের চোখ দুটোর সামনে দাঁড়িয়ে সেই অনন্য মুহূর্তটাকে কানায় কানায় উপভোগ করতে পারবে তমাল?
'দৃষ্টি আই হসপিটাল' এর তিন নম্বর ঘরের সামনে আজ বেশ ভিড়। সাড়ে সাত বছরের স্নিগ্ধতপাকে আজ প্রথমবার নিজের চোখে দেখতে পাবেন ওর বাবা সমীর! স্নিগ্ধতপাদের পরিচিত অনেক মানুষজন আজ সেই বিরল দৃশ্যের মুখোমুখি হবার জন্য এখানে উপস্থিত হয়েছেন।
সমীর রায়! 'নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড স্কুলে'র কৃতী ছাত্র। পরবর্তী পর্যায়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়ার সময় নিজের মাতৃসম রিসার্চ গাইড রত্না ম্যাডামের কাছে ছোটবেলায় ঘটা একটি দুর্ঘটনায় নিজের দুটো চোখ সারা জীবনের মতো হারিয়ে ফেলার আক্ষেপ বহুবার করেছেন সমীর! রত্না ম্যাম সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন সমীরকে। মূলত ওনার উৎসাহেই 'নেট' পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করে দক্ষিণ শহরতলির একটি কলেজে অধ্যাপনার চাকরি পান সমীর। রত্না ম্যাডামের এক প্রিয় ছাত্রীর সঙ্গে বেশ কিছুদিন কোর্টশিপ চলার পর বিয়ে হয় সমীরের। কিন্তু স্ত্রী স্মিতা বা মেয়ে স্নিগ্ধতপাকে কোনদিনই নিজের দু চোখ দিয়ে দেখতে পাবেন না বলে সব সময় একটা মন কেমনের কালো মেঘ ঘিরে থাকতো সমীরকে! ঠিক সাতদিন আগে ইউনিভার্সিটিতে নিজের ঘরে বসে কাজ করতে করতে হঠাৎই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে আকস্মিক মৃত্যু ঘটে রত্না ম্যাডামের! বিস্মিত সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের উনি একটাই কথা শেষ পর্যন্ত অস্ফুটে বলে যেতে পেরেছিলেন! -"আমার ছেলে তমালকে বলো আমার গণ দর্পণের কার্ডটা এই ব্যাগে আছে। আমার ছেলে সবটুকু জানে। এটা নিয়ে আমার চোখ দুটো যেন আমার ছাত্র সমীর রায়কে দেবার ব্যবস্থা...!".
মধ্য কলকাতার রমানাথ লেনের 'গণ দর্পণ' সংস্থা মরণোত্তর দেহদানের সমস্ত রকম ব্যবস্থা করে দেয়। একজন মানুষ তার চোখ, কিডনি, লিভার -ইত্যাদি সমস্ত অঙ্গ মৃত্যুর পরেও রেখে যেতে পারেন অন্য কারো জন্য! অমূল্য উপহার হিসেবে! এর জন্য দরকার শুধু একটু সচেতনতা, মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার পত্রে একটি সই ঐ সংশ্লিষ্ট কোনো বৈধ বিশেষ প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টার্ড ফর্মে। আর অবশ্যই দরকার অনেক অনেক খানি মানবিক চেতনা সম্পন্ন স্বার্থহীন ভালোবাসা!
বেশ কয়েক বছর আগেই রত্না ম্যাডাম ওনার চোখ দুটো দান করে গিয়েছিলেন 'গণ দর্পণ' সংস্থায়। সেই মতো ছেলে তমালকে জানিয়েও গিয়েছিলেন যে ওনার মৃত্যুর পরে ওনার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী ওনার চোখ দুটো যেন অবশ্যই প্রিয় ছাত্র সমীর রায়কে দেওয়া হয়।
রত্না ম্যাডামের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী ওনার চোখ দুটো পেলেন ওনার প্রিয় ছাত্র সমীর রায়। গত সাত দিন ধরে এই পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়াটি চলেছে। আজ ডাক্তারবাবুরা স্নিগ্ধতপার বাবা মানে সমীর বাবুকে চোখ খুলে বাইরের পৃথিবীকে আবার নতুন করে দেখার অনুমতি দিয়েছেন!
আজ সেই ৫ই সেপ্টেম্বর! সাত দিন আগে থেকেই ডাক্তারবাবুরা বলে দিয়েছিলেন যে আজকের দিনে সমীর বাবু রত্না ম্যাডামের চোখ দিয়ে আবার নতুন করে দেখতে শুরু করবেন। ৫ই সেপ্টেম্বর আজ! ঘটনাচক্রে আজকের দিনটা হলো শিক্ষক দিবস! চোখের মতো এমন অমূল্য সম্পদ...! সত্যি, প্রিয় ছাত্র সমীরকে কি অমূল্য রতন উপহারটাই না দিয়ে গেছেন রত্না ম্যাডাম! জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও কিন্তু তিনি ভোলেননি তার ছাত্রের কথা। কতটা সচেতনতা আর স্নেহ থাকলেই না জীবনের শেষ লগ্নেও অন্যের কথা এমনভাবে ভাবা যায়! চোখ দান হয়তো অনেকেই করেন- কিন্তু সঠিক সময় তাদের বাড়ির লোকজন সেই চোখ দান করবার প্রক্রিয়াটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারেন না বলে মহামূল্যবান উপহার নষ্ট হয়ে যায়! কাজে লাগে না কোন প্রয়োজনে। রত্না ম্যাডাম বা তমালের মতন সচেতন মা-ছেলেই বোধহয় পারেন উপহার দেবার এই অমোঘ দায়িত্বকে সঠিক অর্থে রূপদান করতে। ছোট্ট স্নিগ্ধতপা ওর কচি হাত দুটোতে তালি দিয়ে বারবার চিৎকার করে বলছে -"মা দেখো বাবা আমায় দেখতে পাচ্ছে! কি মজা বাবা আমায় দেখতে পাচ্ছে!" মেয়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে স্নিগ্ধতপার মা স্মিতাও চোখের জল সামলাতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সমীর তো ওকেও প্রথম বার দেখতে পাচ্ছেন!
তমালের পরিচয় পেয়ে বারবার তমালকেই যেন দেখে যাচ্ছেন সমীর! সমীরের এই দৃষ্টির মধ্যে কি কোথাও তমালের মা রত্না ম্যাডামের ছোঁয়া আছে? সমীরের চোখের ওই অনন্য আলো, স্নিগ্ধতপা আর ওর মা স্মিতার ওই মহার্ঘ্য হাসিকে - খুব যত্ন করে মনের মধ্যে শুষে নিচ্ছে তমাল!
সত্যি, তমালের মা কি অসাধারণ মানুষ ছিলেন! তাই মৃত্যুর পরেও এই অপার্থিব আনন্দ তিনি দিয়ে যেতে পেরেছেন তমালকে! মানবিকতার পরশপাথর তিনি রেখে গেছেন তমালের জন্য। যতদিন বেঁচে থাকবে তমাল, ততদিন মায়ের এহেন নিঃস্বার্থ পরোপকার করবার মানসিকতাকে উত্তরাধিকার সূত্রে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মায়ের দেওয়া মূল্যবোধের শিক্ষাকে সম্বল করে এ পৃথিবীকে আরও একটু বাসযোগ্য করে যাবার শুভ কর্মযজ্ঞে সামিল হবে তমাল। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে তমাল। জীবনের সমস্ত ওঠাপড়া ভালো-মন্দে মা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। ভীষণ ছুঁতে ইচ্ছে করছে আরেকবার মাকে! আর একটিবার যদি পাওয়া যেত মায়ের স্পর্শ...! সমীর বাবুর চোখ দুটোর মধ্যেই মা যেন রয়ে গেলেন। মৃত্যুর পরেও প্রিয় মানুষগুলোর কাছে এমন ভাবেও তো থেকে যাওয়া যায়...!
-"জীবনের এক্কাদোক্কা ছন্দে পাশের মানুষের জন্য একটু সহানুভূতি, সাধ্যমতো সাহায্য, হার্দিক সহমর্মিতা- জীবনের পরম শিক্ষা।" কথাগুলো মা বারবার বলতেন তমালকে।
মায়ের খুব প্রিয় একটা গানের কথাগুলো মনে করতে করতে তমালের চোখ দুটো জলে ভরে গেল। -"নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো-
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো...!"
মায়ের দেখানো আলোর পথের সন্ধান পেয়ে গেছে তমাল। সে আলোর নিশানা ধরেই এবার শুরু হবে ওর মাকে ছাড়াই নতুন করে পথচলা...!
'গণ দর্পণ' সংস্থা আজ আবার এক নতুন সদস্যকে পাবে। যে সদস্য খুব ভালবেসে চোখ দানের অঙ্গীকার পত্রে সই করবে আজ!
নতুন সেই সদস্যের নাম তমাল...!