[ বিশেষ সুবাস ]( শারদ সংখ্য)
[ বিশেষ সুবাস ]( শারদ সংখ্য)


লুনা কাকিমাদের বাড়ি প্রতি বুধবার রাত আটটায় 'চিত্রহার' দেখতে গিয়ে একটা সাবানের বিজ্ঞাপনের সুবাস নিয়ে বাড়ি ফিরতো শ্রেয়া। কি সুন্দর যে গানটা!
-'পহেলা পেয়ার, লাই জীবন মে বাহার।'
গানটার বাংলা করলে মানেটা মোটামুটি এরকম দাঁড়ায়,
-'প্রথম ভালোবাসা, জীবনে আনল বসন্তের আশা। '
ছন্দ মেলানো গানের শব্দগুলো যেন একদম বুকের ভেতর রিমিঝিমি বাজনা বাজায়! বাড়ি ফিরে সারারাত থাকতো সেই রেশ। পরেরদিন কেমিস্ট্রি ক্লাসে সুমিতা দিদিমণি পড়া জিজ্ঞেস করলে গুলিয়ে যেতো সবকিছু। বারবার কানের কাছে ভ্রমরের মতো গুনগুন করে যেত সেই অদ্ভুত গান আর তার মন ভালো করে দেওয়া শব্দ -
-'পহেলা পেয়ার!'
বুধবার আসার আগে কি যে এক উত্তেজনা হতো! ঐ একটি দিনই টিভি দেখতে যাওয়ার সুযোগ পেতো শ্রেয়া। বুধবার ওভারটাইম থাকায় বাবা দেরী করে বাড়ী ফিরতেন। তাই মা আর শ্রেয়া সন্ধে আটটা থেকে সাড়ে আটটা বাড়ি না থাকলেও বাবা টের পেতেননা। আসলে অন্যের বাড়ি টিভি দেখতে যাবে মেয়ে-বউ এটা বোধহয় মেনে নিতে বাবার পৌরুষে খুব বাধতো! বাবাকে দু-একবার টিভি কেনার কথা বলায় খুব রাগারাগি করেছিলেন বাবা পড়াশোনার দোহাই দিয়ে! মা বুঝিয়ে বলেছিলেন -বাবার সামান্য আয়ে টিভি কেনার বিলাসিতা ওদের মানায়না! খুব রাগ হতো শ্রেয়ার বাবার ওপরে !
গলায় মোটেই সুর না থাকলেও বাড়িতে বেশ কয়েকবার গুনগুন করে ওই সাবানের বিজ্ঞাপনের গানটা গাইবার চেষ্টা করতো শ্রেয়া। একদিন লুনা কাকিমাদের বাড়িতেও গেয়ে ফেলেছিল গানটা। সেদিন লুনা কাকিমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা ওর পিসতুতো ভাই অঞ্জন আড়াল থেকে শ্রেয়ার গানটা শুনে ফেলে ভয়ংকর হাসাহাসি করেছিল!এই অঞ্জন আর শ্রেয়া একই স্যারের কাছে কেমিস্ট্রি পড়ে। অঞ্জন খুব ভালো ছাত্র। অঞ্জনের কটাক্ষ ভরা হাসি দেখে শ্রেয়া খুব রেগে গেলে লুনা কাকিমা ব্যাপারটা চাপা দেবার চেষ্টা করেছিলেন আপ্রাণ। শেষমেষ চিত্রহার পুরোটা না দেখেই জোর জবরদস্তি মাকে নিয়ে ওবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল শ্রেয়া। লুনা কাকিমাকে বলেছিল,
-"সপ্তাহে একদিন মাকে নিয়ে তোমাদের বাড়ি একটু টিভি দেখতে আসতাম কাকিমা। আর আসবো না। বাবাকে বলবো যে করেই হোক একটা টিভি যেন আমাদের কিনে দেয়!"
আসার সময় কানে এসেছিল ঐ অঞ্জনের শ্রেয়ার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলা কথাগুলো! অঞ্জন বলেছিল,
-"জোর জবরদস্তি করে বাবাকে দিয়ে টিভি কেনানোর কথা ভাবছো অথচ নিজে মন দিয়ে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবা-মাকে একটা টিভি উপহার দেবার কথা তোমার মনে আসছে না! সত্যি শ্রেয়া -তোমার জীবনটা ওই টিভির সাবানের বিজ্ঞাপনের মতোই দেখানেপনায় ভরপুর। কাজের কাজ করার কথা তোমার কিছুই মনে হয়না কখনো!"
***************************************
পুরোনো টিভিটা দিব্যি চলছিল। তবু ওটা পাল্টিয়ে বাবা মায়ের জন্য একটা হোম থিয়েটার আজ কিনে আনলো শ্রেয়া। বাবা খুব রাগ করছিলেন অযথা এমন খরচাপাতি করার জন্য। শ্রেয়া কান করেনি ।বাবা-মায়ের খুব প্রিয় 'হারানো সুর' ছবিটা চালিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে ওনাদের অভিব্যক্তি দেখছিল ! কখন যেন শ্রেয়ার বরও ওর পাশে এসে বসেছে। জীবনসঙ্গীর হাতে একটা সামান্য চাপ দিয়ে শ্রেয়া বললো,
-''ভাগ্যিস তুমি সেদিন আমায় অমন অপমান করেছিলে অঞ্জন! তাইতো লেখাপড়ায় মন দিয়ে, ইউ পি এস সির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে এত ভালো চাকরিটা পেলাম। জীবনের মোড় ঘুরে গেল। ধাপে ধাপে উন্নতি করতে করতে আজ সাফল্যের এতটা শীর্ষে আসতে পেরেছি আমি । বাবা মায়ের জন্য কিছু করতে পারলে যে কি আনন্দ! তুমি এমন ভাবে না বললে আমার মধ্যে ঐ চেতনাটা তৈরিই হতো না। আদাজল খেয়ে পড়াশোনায় মন দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার বাসনা জেগে উঠত না আমার মধ্যে। আমাদের একমাত্র মেয়েটাও তো আমাকে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখে ছোট থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছে প্রাণপণে। ব্যাঙ্গালোরে অত বড় চাকরিটা তো এই অল্প বয়সেই পেয়ে গেল মেয়ে।"
অঞ্জন স্বভাবসিদ্ধ দুষ্টু হাসি হেসে শ্রেয়ার মাথার চুলটা একটু ঘেঁটে দিয়ে জবাব দিলো,
-" তোমার মধ্যে ক্ষমতা ছিল শ্রেয়া । কঠিন লড়াইটা তুমিই করেছ। আমি শুধু একটু উসকে দিতে চেয়েছিলাম তোমাকে । তবে আমাকে প্রশংসা করার সঙ্গে সঙ্গে তোমার ওই পহেলা পেয়ার নামের বেসুরো গান আর সেই সাবানটাকেও একটু কৃতিত্বের ভাগ দিও শ্রেয়া। এটা তো মানবে যে গানটার মধ্যে প্রথম প্রেমের সুবাস লুকিয়ে আছে । প্রথম ভালোবাসা সব সময়তেই খুব বিশেষ !তাইনা বলো?"