anindita das

Classics Inspirational Children

3.6  

anindita das

Classics Inspirational Children

শরৎ আলোয়( শরৎকাল)

শরৎ আলোয়( শরৎকাল)

6 mins
572



সামনের সপ্তাহ থেকে পুজোর ছুটি পড়ে যাচ্ছে স্কুলে। আকাশের রং আজকাল নীলের মধ্যে সাদা মেশানো। দিদুন বলে ,

- "এটা শরৎ আকাশ সাম্য দাদুভাই। এমন আকাশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান আছে - নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা ।"

দিদুনের বলা এই শরৎকাল সত্যিই খুব সুন্দর । এই সময়তেই প্রত্যেক বছর দুর্গা পুজো  হয় যে । শরৎকাল দিয়ে ক্লাসে বাংলা রচনা লিখতে

হয়েছিল এবার ইউনিট টেস্টে। মায়ের লিখে দেওয়া রচনাটা মুখস্থ করে সাম্য ভালোই লিখেছে । শুরু করেছে এইভাবে ,

- আশ্বিনের শারদ প্রাতে. ..!"


আজকে সাম্যর ইউনিট টেস্ট শেষ হলো। ওর বন্ধুরা প্রত্যেকেই খুব উত্তেজিত। কার কটা পুজোর জামা হয়েছে, বন্দুক- ক্যাপ কেনা হয়েছে - তাই নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। প্রত্যেকে নিজের নিজের পাড়া বা হাউসিং আবাসনের ঠাকুর, প্যান্ডেল, লাইটিং নিয়ে অনেক অনেক গালভরা বিশেষণে ভূষিত বাক্য ব্যবহার করে চলেছে সমানে। জিকো তো বলেই ফেলল, 


-" আমাদের পাড়ায় এবার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে মুম্বাই থেকে ব্লগ ব্লাস্টার সুপারস্টার দিনেশ কুমার আসছে পুজো উদ্বোধন করতে। পুজোর চার দিন রাতে ফাটাফাটি ফাংশান হবে। আমার বাবা ভিআইপি পাশ পেয়েছে - পুজো কমিটিতে আছে বলে। আমরা যখন ইচ্ছে প্যান্ডেলে ঢুকবো আর বেরোবো। " 

জিকোর কথাটাকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে রিজুল বলল, 


-" অনেকগুলো নিউজ চ্যানেল থেকে এবার আমাদের হাউজিংয়ের পুজো কাভারেজ করতে আসছে। অষ্টমীর দিন আমাদের কুমারী পুজোটা খুব স্পেশাল হবে এবার। ঐদিন আমার বাংলা চ্যানেলের ডান্সিং সুপারস্টার - সারাবাংলা ফেমাস লিটল ডান্সার মুকুলিকা বানার্জীকে আমাদের মন্ডপের কুমারী পুজোর আসনে বসিয়ে পুজো করা হবে। কি হাই -ফাই ব্যাপার বুঝতে পারছিস ! "


  একে একে নীল, কৌস্তুভ, দেবর্ষি - প্রত্যেকেই তাদের পুজোর ঠাকুর দেখা খাওয়া-দাওয়া আর নানা ধরনের প্ল‍্যান নিয়ে জবরদস্ত আলোচনা চালাতে লাগলো বন্ধুদের সাথে। ওরা প্রত্যেক বছর পুজোর দিনগুলোতে - মানে ষষ্ঠী থেকে দশমী কলকাতাতেই থাকে। রাত জেগে প্যান্ডেল হপিং করে ঠাকুর দেখে বেড়ায়, পুজোর ভোগ খায় চুটিয়ে, দুবেলা নতুন নতুন জামা পরে অনেক রকম ছবি তোলে। একদম যাকে বলে -'ফুল মস্তি!'


  সাম্যর কি যে খারাপ লাগে! মা যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে গাইতে সাম্যকে ডেকে বলে , 

- "আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে - গানটা আমার সঙ্গে একটু গা সাম্য।"


 তখন কি যে বিরক্ত লাগে সাম্যর! শরৎএর এত গান, আকাশ স্যারের কাছে আঁকা শরৎ কাশফুলের ছবি - সবকিছু বড্ড অর্থহীন লাগে। বারবার মনে হয় কেন যে বাবা- মা প্রত্যেক বছর পঞ্চমীর দিন ভোরবেলা ওকে নিয়ে কলকাতার বাইরে বেড়াতে চলে যান। লক্ষ্মী পুজো পর্যন্ত চলে সেই বেড়ানোর পর্ব। গোটা পুজোর ছুটিটাই যখন ঘুরে টুরে হা ক্লান্ত হয়ে কলকাতায় ফেরে সাম্য - তখন কলকাতায় দুর্গাপুজোর অবশিষ্ট আর কিছুই নেই। আছে শুধু স্কুল খুললে বন্ধুদের কাছে শোনা - তাদের চমৎকার পুজো কাটানোর নানা রকম রঙীন, মন মাতানো সুন্দর সুন্দর মুহূর্তের গল্প। 


বাবা এবং মা দুজনেরই অত্যন্ত পছন্দের জায়গা পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে কিন্তু কোথাও শরৎকালকে খুঁজে পায়না সাম্য।


ওর মনে হয় - পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গেলে শরৎকাল বোধহয় হারিয়ে যায় কোথাও ! 


   বহুবার সাম্য বাবা-মাকে অনুরোধ করেছে পুজোর সময় কলকাতায় থাকার ব্যাপারে। কিন্তু, সাম্যকে জড়িয়ে আদর করে মা বুঝিয়েছেন - সারা বছরের মধ্যে এই পুজোর ছুটিটাই একটু বড় করে পান বাবা-মা। অতএব প্রচন্ড ঘুরতে ভালোবাসা - দুজন ভ্রমণপিপাসু মানুষ এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যেক বছর বেশ একটু অফ বিট জায়গা বেড়াতে ভালোবাসেন। ইচ্ছে করেই সাম্যর বাবা-মা এমন জায়গা বেছে নেন - যেখানে দুর্গাপুজোর শোরগোল নেই। সারাবছর অফিসে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে - পুজোর ছুটিটাতে একটু বিশ্রাম আর আয়েশ করে নিতে চান বাবা মা। কলকাতার পুজোর হট্টগোলে থাকলে - এই আমেজটুকু পাওয়া হয়না বাবা-মায়ের। বিয়ের পরের বেশ কয়েকটা বছর চুটিয়ে পুজোর ছুটিতে বাবা-মা ঘুরে বেরিয়েছেন। তারপর সাম্য জন্মালো। সে সময় দু তিনটে বছর বেড়ানোটা বন্ধ রেখেছিল বাবা-মা । তারপর সাম্য খুব ছোট থাকতে থাকতেই - বাবা-মা পুজোর সময় বাইরে ঘুরতে যাওয়ার উদ্যোগটা আবার নিয়ে নিলেন। সেজন্যই কলকাতার পুজোয় কোনোওদিনই সাম্যর থাকা হয়নি। 


   বাবার যুক্তি - পুজোর সময় কলকাতায় শব্দদূষণ এতো সাংঘাতিক আর মানুষের ভিড়ে যানজট এবং অন্যান্য অসুবিধা এতটাই প্রবল যে কলকাতায় পুজোর সময় পরিবার নিয়ে থাকার কোনোও মানেই হয়না। তাই এই ক্লাস সিক্সে ওঠা  অবধি সাম্যর প্রত্যেকটি দুর্গাপুজো কেটেছে কোনোও পাহাড়ী, নির্জন জনমানব শূন্য, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের - মন ভালো করে দেওয়া জায়গায়। অবশ্য এই -'মন ভাল হওয়া'র ব্যাপারটা কিন্তু অত্যন্ত আপেক্ষিক। এই মনটা ভালো হয়েছে শুধুমাত্র বাবা-মায়ের। নির্জনে বাবা-মা সাম্যর হাত ধরে অনাবিল আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছেন পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে, ট্রেকিং করেছেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আউড়েছেন। কিন্তু সাম্যর কথাটা এতটুকুও ভাবেননি। সাম্য যে বারো বছরের হয়ে যাওয়ার পরেও আজ অবধি কলকাতার পুজো দেখল না , পাড়ার প্যান্ডেলে ঋষিদার আবৃত্তি করা ' এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে' শুনে অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে হাততালি দিতে পারল না - সে কথাটা একবারও বাবা-মায়ের মনে কোনোও রেখা পাত কেন যে করে না! 


***********************************************************


আজ বাড়ি ফিরে জোর চমক! হঠাৎই বাবার বন্ধু -' সরষে কাকু' এসে উপস্থিত হয়েছেন সাম্যদের বাড়ি। পৃথিবী বিখ্যাত ভূপর্যটক -'সরষে কাকু। ' বাবা-মা আর 'সরষে কাকু' এক কলেজে পড়াশোনা করেছেন। একদম ছোট বয়স থেকেই কাকুর সারা পৃথিবী চষে বেড়ানোর খুব শখ। কলেজে পড়তে পড়তে সময় - সুযোগ পেলেই হুট করে এদিক-ওদিক বেরিয়ে পড়তেন। তাই বন্ধুরা মজা করে তপোব্রতর নাম দিয়েছিল -' পায়ের তলায় সরষে।' ছোট্ট করে শুধু - ' সরষে ।'

সেই সুবাদে তপোব্রত ওর বন্ধুদের ছেলে-মেয়েদের কাছে পরিচিত -'সরষে কাকু' নামে। 

  তা সেই 'সরষে কাকু' মানে চিরকুমার তপোব্রতকে ওর বন্ধুর ছেলেমেয়েরা খুব ভালোবাসে। বাচ্চাদের জন্য তপোব্রতর ঝুলিতে রয়েছে অঢেল গল্পের সম্ভার। সাম্যও ওর 'সরষে কাকুর' খুব বড় ফ্যান। দুর্দান্ত লোকগীতি গাইতে পারেন সরষে কাকু। 


স্কুলে কলকাতার পুজো ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য মনটা যে ভীষণ মেঘলা হয়েছিল সাম্যর। কিন্তু 'সরষে কাকুর' হাঁকডাক এবং অদ্ভুত সুন্দর একটা গান ,

-" নদীর কিনারে কাশের ফুল গো বাতাসে ঝলমল করে। " শুনে

 মন খারাপটা অনেকখানিই কেটে গেল যেন সাম্যর।

 রাতে ডিনার টেবিলে বেশ গুছিয়ে গল্প হচ্ছে সবাই মিলে। মা অনেক কিছু রান্না করেছেন।'সরষে কাকু' অনেক মজার মজার গল্প শোনাচ্ছেন সবাইকে। সাম্য শুনছে সবকিছু - কিন্তু একটু পরে পরেই মনটা কেমন উদাস হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও। পাড়ার প্যান্ডেলের কাজ প্রায় শেষ। বাড়িগুলোকে টুনি বাল্বের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। আকাশে বাতাসে উৎসব , অপেক্ষা আর আনন্দ মিলেমিশে শরৎ প্রকৃতিতে কেমন যেন - রঙীন গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। পুজো এলে এ শহরের উত্তাপটাই যে ভীষণ অন্যরকম হয়ে যায় !


  হুঁস ফিরল 'সরষে কাকুর' কথায়! স্বভাবসিদ্ধ মজাদার ভঙ্গীমায় সরষে কাকু' মাকে জিজ্ঞেস করলেন, 

-" শেলী তোদের পাড়ার পুজোটা অনেক দিনের পুরোনো বল? প্রচুর আনন্দ হয় নিশ্চয়ই পুজোর কটা দিন? "

মা কিছু বলার আগেই বাবা উত্তর দিলেন, 

" হ্যাঁ বড্ড হইচই আর গ্যাঞ্জাম হয় রে! আমরা তাই পঞ্চমীর দিন ভোরবেলা কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে যাই প্রত্যেকবার।"

 'সরষে কাকু' বললেন, 

-" হ্যাঁ ফেসবুকে তো দেখি তোরা প্রত্যেক বছর পুজোর ছুটির ট্রিপের সুন্দর সুন্দর ছবি পোস্ট করিস। তুই আর শেলী তো খুব হাসি হাসি মুখে সব পোস্ দিস! কিন্তু সাম্য টাকে বড্ড আনমনা লাগে রে ছবিগুলোতে! সাম্য - বাবা তোর বোধহয় কলকাতা শহরটা ছেড়ে পুজোর সময় বেড়াতে যেতে একেবারেই ইচ্ছে করে না ।না রে?"

শেলী আর সুতনু - মানে সাম্যর বাবা মা অবাক হয়ে দেখলেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তাদের ছোট্ট সোনা সাম্য! বলে বটে সাম্য টা পুজোর সময় কলকাতা ছেড়ে যাবো না কোথাও ! পাড়ার পুজোয় চারদিন ভোগ খাব, শ্রীভূমি স্পোর্টিং আর চালতাবাগানের ঠাকুর গুলো দেখবো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এতটাই বিমর্ষ হয়ে ছিল ছেলে! আজ তপোব্রত একটু খুঁচিয়ে দিতেই কেমন অসহায়ের মতো কেঁদেই চলেছে সাম্য! 

আহারে! নিজের হাতের তালুর মতো চেনা সন্তানকে বুঝতে এতটা ভুল হয়ে গেল শেলী- সুতনুর!


তপোব্রত বললেন, 


-" সুতনু - পুজোর সময়কার কলকাতার দূষণ, জনস্রোত, হট্টগোল - এই প্রত্যেকটা জিনিস তুই নিজে কলকাতাতে থেকে উপলব্ধি করেছিস বহু বছর ধরে। তারপর তুই আর শেলী মনস্থির করেছিস যে পুজোয় তোরা কখনোও কলকাতায় থাকবি না। নিজেদের মতো করে বাইরে ঘুরতে যাবি। কিন্তু বেচারা সাম্য তো জ্ঞান হবার পর থেকেই তোদের সাথে সাথে - পুজোর সময় কলকাতা থেকে অনেক দূরে কাটাচ্ছে। ছেলেটা তো কলকাতার পুজোতে কেমন আনন্দ হয় - সেটা কখনোও উপলব্ধি করবার কোনোও সুযোগই পেল না রে! এই পুজোর আনন্দের রেশ - নিজের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে শিকড়িত করবার অধিকারটুকু কি সাম্য কখনো পেতে পারে না তোদের কাছ থেকে? থাকতে দে না ছেলেটাকে দু-চার বছর কলকাতার পুজো। উপভোগ করতে দে ওর সোনালী শৈশব - দুর্গোৎসবের অনাবিল আনন্দে অবগাহন করে। তারপরেও যদি সাম্য কলকাতা ছেড়ে তোদের সঙ্গে বেড়াতে যেতে না চায় - তাহলে বুঝবি পুজোর সময় কলকাতার ভিড়ভাট্টা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ওর না পসন্দ। তোদের ছেলে - মানুষের সাথে, মানুষের ভিড়ে, মুখের মিছিলে - জীবনের যথার্থ মানে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। আর যদি সাম্যর কলকাতার পুজো না ভালো লাগে - তাহলে তোদের সাথে যাবে আবার নিরুদ্দেশের পথে কোথাও বেড়াতে! "


 সাম্যদের এবারের পুজোয় বেড়াতে যাওয়ার টিকিট ক্যানসেল হয়ে গেছে। ষষ্ঠী থেকে দশমী - সকাল-বিকেল কি কি করবে সাম্য তার একটা লিস্ট বানিয়েও ফেলেছে চটপট। ঢাকের আওয়াজে ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুর্গা ঠাকুরকে প্রণাম জানিয়ে সাম্য বললো,

 -"একবার স্কুলটা খুলুক এবার পুজোর ছুটির পরে। সব বন্ধুদের কাছে এবার আমিও আমার দুর্গা পুজোর মজার মজার গল্প গুলো বলতে পারব। শরৎকাল নিয়ে রচনা লিখতে দিলে আমি নিজেই পুরোটা লিখতে পারবো। মায়ের লিখে দেওয়া রচনা মুখস্থ করতে হবে না আমায়।। "


ভাগ্যিস এই 'সরষে কাকু' দের মত কিছু কিছু মানুষ শরৎ আলোর কমল বনে আনন্দের মোহন রূপ নিয়ে থাকেন সাম্যদের জীবনে ...! 


    

    

 

     



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics