Piyali Chatterjee

Classics Crime Inspirational

5.0  

Piyali Chatterjee

Classics Crime Inspirational

অসম্মানিত পবিত্রতা

অসম্মানিত পবিত্রতা

6 mins
577


অঞ্জলী বর্মন খুবই মেধাবী ছাত্রী। স্কুলে তাকে এক নামে সবাই চেনে তা সে শিক্ষক হোক বা ছাত্র-ছাত্রীরা। পড়াশোনার সাথে সাথে সে তার বাবা, মায়ের খেয়াল রাখতে ও সফল হয়। বাবা কোথায় চশমা ফেলে রাখছে, মা কখন ওষুধ খেলো না সব দিকেই নজর মাত্র বারো বৎসর বয়সের মেয়েটির। মাঝেমধ্যে তো দীপ্ত বর্মন তার স্ত্রী নীলিমা বর্মন কে মজার ছলে বলেন :-


"বুঝলে নীলা, আমি একদম নিশ্চিত যে আমার মা ই অঞ্জলী হয়ে ফিরে এসেছে আমার কাছে। সেই কোন ছোটবেলায় মা কে হারিয়েছি। ভগবান কে কত ডেকেছি মা কে ফিরিয়ে দেবার জন্য। ঠাকুর বোধহয় কথা শুনেছেন।"


নীলিমা রান্না ঘর থেকে মুচকি হাসেন। মনে মনে সেও খুশি হয় অঞ্জলীর কথা ভেবে। কিছুদিন আগেই তো প্রিন্সিপাল নীলিমা কে ডেকে বললো :-


"নীলিমা দেবী, সত্যিই ভাগ্য করে এমন একটি মেয়ের জন্ম দিয়েছেন। ধন্য আপনার শিক্ষা। আসলে কি ব্যাপার জানেন তো স্কুলের শিক্ষার পরেও বাড়ির শিক্ষার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন যথার্থ মানুষ হওয়ার জন্য। মনুষ্যত্বের শিক্ষার আলো যে কোনো কালো গুহা কে আলোকিত করে ফেলতে পারে।"


একজন মায়ের কাছে এটাই বিরাট বড় পাওনা। বাড়ি ফিরে সেদিন অঞ্জলী কে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করেছিলেন।


অঞ্জলী প্রতিবার প্রথম হয় এবারও তাই হলো। নীলিমা অঞ্জলীর পছন্দের রান্না করলেন ও অঞ্জলীর বন্ধু দের ডাকলেন। দীপ্ত ও তার নতুন অফিসের সহকর্মী দের ডাকলেন। এই মাস খানেক হলো এই অফিসে ঢুকেছে সে। নতুন সহকর্মীগুলোর সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করার এই বেশ সুযোগ ও বটে। এক এক করে লোকজনের আসা শুরু হয়ে গেল। নীলিমার রান্না খেয়ে সকলেই খুব প্রশংসা করলো। দীপ্ত বর্মনের এক সহকর্মী ছিলেন বরুণ সরকার। তার ব্যক্তিত্ব একেবারেই আলাদা। মুখে সবসময় হাসি লেগেই রয়েছে। সবার সাথে সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় তার। সেদিন সে ও উপস্থিত ছিল দীপ্ত বর্মনের বাড়িতে। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পরে নীলিমা যখন এক এক করে অতিথি দের বিদায় দিতে ব্যস্ত তখন বরুণ সরকার অঞ্জলী কে গিয়ে বললো :-


"মা, বলছিলাম যে তোমাদের ওয়াশরুম টা কোনদিকে? একটু দেখিয়ে দাও না।" এই বলে অঞ্জলীর গাল টা টেনে দিলো একটু।


"আচ্ছা কাকু আপনি আমার সাথে আসুন আমি নিয়ে যাচ্ছি।"


অঞ্জলী নিজের ঘরের ওয়াশরুমেই নিয়ে গেল বরুণ কে। ওয়াশরুমের লাইটের সুইচ টি জ্বালিয়ে ফিরে আসতে যাবে অঞ্জলী এমন সময়,


"একি আমাকে টানছেন কেনো? আমার লাগছে আমাকে ছেড়ে দিন। মা......"


অঞ্জলীর মুখ চেপে ধরলো নম্র, ভদ্র মুখোশধারী সেই সামাজিক ভদ্রলোক টি।

কিছুক্ষন পর অঞ্জলী ভয়ে জর্জরিত হয়ে নিজের ঘরের বিছানার পাশে গিয়ে বসল। বরুণ সরকার ও নীলিমা এবং দীপ্ত কে রাত্রের খাবারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল। নীলিমা অঞ্জলীর ঘরে এসে দেখলো অঞ্জলী বিছানায় শুয়ে আছে। সারাদিন এত ধকল যাওয়ায় সে নিজেও ভীষণ ক্লান্ত তাই শুয়ে পড়লো পাশের ঘরে গিয়ে। অঞ্জলী ভাবতে লাগলো তার বরুণ কাকুর বলা কথাগুলো :-


"শোনো অঞ্জলী এই কথাগুলো যদি তুমি তোমার বাবা, মা কে বলো তবে কিন্তু ওরা তোমাকে খুব বকবে। তোমাকে আগের মতো আর ভালোবাসবে না। তোমাকে সবাই বাজে মেয়ে বলবে। তোমার সাথে আর কেউ কথা বলবে না। বুঝেছো? তাই এই কথাগুলো কাউকে বলবে না।"


বারো বছরের মেয়েটি গুমড়ে রইলো। কিছু মাস পর অঞ্জলী কিশোরী বয়স এ পা দিলো যা আমরা ইংরেজি তে টিনএজ বলি। কিন্তু অঞ্জলীর জন্মদিন এ দেওয়া পার্টি তে তার সাথে আবার ঘটলো সেই এক ঘটনা।


মেধাবী, সকলের প্রিয়, সকলের খেয়াল রাখতো যেই অঞ্জলী সে নিজেই আজ নিজের খেয়াল রাখার অবস্থায় নেই। পড়াশোনায় তার মন নেই, বাবা, মায়ের সাথেও তার কথা বলতে ভালো লাগেনা এখন। নিজেকে সে সম্পূর্ণ একা করে নিয়েছে।


এই বছর অঞ্জলী কলেজে উঠবে স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে। এতগুলো বছরে মাঝেমধ্যেই তাকে তার বাবা, মায়ের উপস্থিতি তে অনুপস্থিতি তে অসম্মানিত করা হয়েছে। সে কিছুই বলতে পারেনি মা, বাবার কাছে বাজে মেয়ে হওয়ায় ভয়ে। অঞ্জলীর ইচ্ছা শহরের বাইরে কোনো কলেজে ভর্তি হয়ে চলে যাওয়ার। সে এই কথা বাড়িতেও জানালো কিন্তু অঞ্জলী দীপ্ত আর নীলিমার একমাত্র সন্তান। তারা অঞ্জলী কে দূরে কোথাও পাঠাতে রাজি হলো না। অঞ্জলী ও কিছুতেই বলে উঠতে পারলো না কিছুই। ভয়ে, লজ্জায় সে দিনে দিনে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। অনেকবার নিজেকে শেষ করতেও চেয়েছে কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক পেরে ওঠেনি।


তবে একদিন অঞ্জলী ঠিক করে যে সে আর চুপ থাকবে না। নিজেকে যদি শেষ হতেই হয় তাহলে সে কিছুতেই সেই অমানুষটিকেও বাঁচতে দেবে না। অঞ্জলীর আঠারো বছরের জন্মদিনে যখন বরুণ সরকার নামক দানব টা আবার অঞ্জলী কে একা পেয়ে তার নোংরা মনের ইচ্ছা কে সন্তুষ্ট করতে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন সে আগে থেকেই একটা মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং অন করে রেখেছিল।


অঞ্জলী ভেবেছিল তার বাবা, মা হয়তো তার কথা বিস্বাস করবে না। তাই এই শেষবারের মত সে এই নরপিশাচ কে বাধা দিলো না। কিছুক্ষণ পর যেই বরুণ অঞ্জলী কে নিজের শিকার ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে অঞ্জলী ধাক্কা মেরে বরুণ কে নীচে ফেলে মোবাইল টা নিয়ে চলে গেল তার বাবা, মায়ের কাছে। সব কিছু দেখে দীপ্ত আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না। সেই মুহূর্তেই পুলিশ ডেকে ভিডিও টা সহ বরুণ কে তাদের হাতে তুলে দিল। সব কিছু শোনার পর অঞ্জলী কে বললো :-


নীলিমা :- "আমাদের কে এত বছর কিছু বলিসনি কেন মা? আমরা থাকতেও তোর সাথে এত বড় অন্যায় করে গেল ও এতগুলো বছর ধরে।"


অঞ্জলী :- "কি করে বলতাম মা। যখন প্রথমবার আমার সাথে ঘটনা টা ঘটেছিল তখন আমার বোঝার বয়স হয়নি তবুও জানতাম যে এটা ঠিক না। তবে তখন ওই জানোয়ার টা আমাকে বলেছিলো যে তোমাদের কে বললে তোমরা আমাকে বাজে ভাববে আর আমার কথা বিস্বাস করবে না। আর যখন একটু বড় হলাম বাধা দিতে চাইলে ওই দানব টা বলতো যে ও তোমাদের কে আমার নামে মিথ্যা বলবে যে আমিই ওকে আমার সাথে এগুলো করতে বাধ্য করেছি। এই ভয়ে আমি এতদিন গুমরে গুমরে বেঁচেছি।"


নীলিমা :- "আমাদের ক্ষমা করে দে মা। তোর জীবনটা আজ আমাদের কারণেই এরকম হয়েগেছে।"


অঞ্জলী :- "না মা তোমার বা বাবার এতে কোনো দোষ নেই। এরকম কত মেয়েরা আছে যাদের সাথে প্রতিনিয়তই ঘটছে এমন ঘটনা। কিন্তু ভয়ে লজ্জায় তারা কাউকে কিছুই বলতে পারেনা। অনেকেই ভাবে যে তাদের হয়তো কেউ বিস্বাস করবে না। তোমরা কিছু বুঝতে পারোনি কারণ আমি তোমাদের কে জানায়নি। তোমরা বিস্বাস করেছিলে ওই শয়তানটার উপরে। এতে তোমার বাবার বা আমার কোনো দোষ নেই মা। দোষটা সম্পূর্ণ ওই মানুষরুপি দানবগুলোর।"


সত্যিই বলেছে অঞ্জলী। এতক্ষন আপনি যেটা পড়লেন সেটা শুধুমাত্র একটি গল্প কিন্তু এই গল্পটি এখন কার সমাজে ঘটে যাওয়া একটি খুবই নিন্দনীয় বিরক্তিকর একটি অপরাধ কে নিয়ে লেখা। অঞ্জলীর মতো আরো হাজার মেয়েরা আছে যারা সত্যিই এরকম অত্যাচারের সম্মুখীন হয় রোজ। কেউ নিজেকে গুটিয়ে এক ঘরে বন্ধ করে নেয়, কেউ বিষন্নতায় চলে যায় আবার কেউ নিজেকে শেষ করে দেয়। যাদের সাথে কখনো না কখনো এরকম ঘটনা ঘটছে বা কখনো যদি ঘটে আমার সকলের কাছে অনুরোধ চুপ করে না থেকে বিষয়টি বিশ্বস্ত কাউকে ব্যাপারটা জানান। হয়তো এমনটা করে আপনি শুধু নিজের না আরো কোনো মেয়ের জীবন বাঁচাতে পারেন। বাসে, ট্রেনে বা রাস্তায় এমন কি মাঝে মাঝে আত্মীয় স্বজন দের বাড়িতেও হয়তো এমন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় অনেককেই। কিন্তু লজ্জায় বা যাবতীয় কারণে মুখ বন্ধ করে সেই জায়গা ছেড়ে চলে যায় তারা। তাই মনে রাখা উচিত যে মুখ বন্ধ করে রেখে হয়তো আমরা আরো বড় একটা শয়তান কে জাগিয়ে তুলছি। তাকে আরো ঠেলে দিচ্ছি বিরাট একটি অপরাধ এর দিকে। ভগবান না করুক এমন জঘন্য অভিজ্ঞতা কারুর হোক। সকলের কাছে আমার অনুরোধ দয়া করে যাদের উপর এরকম অত্যাচার করা হয় তাদের বিচার করবেন না। কি কারণে বা কেন এই ঘটনা গুলো ঘটছে এই প্রশ্ন করে। তার থেকে তাদের পাশে থেকে তাদের কে সাহায্য করুন যাতে তারা মানুষরূপী জানোয়ার গুলোর মুখোশ খুলতে পারে সমাজের সামনে। সবাই একসাথে এমন একটা পৃথিবীর সৃষ্টি করা যাক যেখানে আমাদের মা, বোন বউ বা বন্ধুরা নিরাপদ থাকতে পারে। বাবা, দাদা, স্বামী রূপে প্রত্যেকটি মুহূর্তে আপনাদের ও কর্তব্য তাদের পাশে থাকা এবং তাদের উপর বিশ্বাস রাখা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics