অপেক্ষা:-
অপেক্ষা:-


শীতের সকাল, সকালের মিঠে রোদ্দুর উপভোগ করার জন্য আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে পরলাম। টিউশন থেকে আসার পরেই মেজাজটা বিগড়ে রয়েছে আমার। দিদি আমার পছন্দের কুর্তিটা পরে ইউনিভার্সিটি চলে গেছে। আমার দিদি অমৃতা আর আমি অদিতি। তা আজ সকালে স্যারের বাড়ি সেরে এসে দেখি আমার পছন্দের ড্রেসখানা পরে তিনি বিদ্যার্জন করতে পাড়ি দিয়েছেন। দপ করে মাথাটা গরম হয়ে গেলো। কোথায় আমি ভেবেছিলাম এই ড্রেসটা পরে আমার কলেজের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে যাবো। কিন্তু দিদি সব সময়ই এরকম, আমার জিনিস গুলো নিয়েই বেশি টানা হ্যাচড়া করে। মা ডাকলেন যখন মুখভার করে খেতে বসলাম। মা বুঝতে পেরে বললেন,"কেনো মুখটা বাংলার পাঁচ করে রেখেছিস আদু?" |
খেঁখিয়ে বললাম, "কেনো জানো না তোমার সোহাগী গুণধর বড়কন্যা আমার পছন্দের ড্রেসটা পরে বেরিয়েছে! মা তুমি কিছু বললে না দিভাই কে?"
মায়ের কিছু বলার আগেই বাবা বললেন,"ঠিক ঠিক।এ তো খুব ভাবনার বিষয়। কিন্তু আদু মা একটা কথা ভাব দিদি বিয়ে হয়ে চলে গেলে পরে সবকিছু তো তোরই থাকবে। অমু তো তখন তোর জামাকাপড় পড়তে যাবে না, তাই না?"
বাবার কথায় এবার আরো বেশি বমকে গিয়ে বললাম, "উফ্। যত তাড়াতাড়ি শাকচুন্নিটার বিয়ে হবে, ততই মঙ্গল। আমি একটু প্রাণ খুলে বাঁচবো। দিভাইয়ের তাড়নায় অতিষ্ট হয়ে গেছি...." বলতে বলতে আমিও দুমদাম পা ফেলে চলে যেতে লাগলাম। শুনতে পেলাম বাবা আর মা আমার কথায় হাসতে হাসতে একে অপর কে বলাবলি করছেন,"এই দু'বোন এখন যতটা আদায় কাঁচকলায়, আগামী দিনে দেখবে এরাই হরিহর আত্মা হয়ে উঠেছে...."
**********************
বাড়িতে আজকে অনেক হইচই। হবে নাই বা কেনো? শাকচুন্নিটার আজকে বিয়ে তো। বাবাগো হাফ ছেড়ে বাঁচবো সত্যি। জন্মের পর থেকে দিদি নামক একটা দুঃসহ বোঝা বয়ে বেড়িয়েছি আমি। এবার জামাইবাবু বুঝবে কি জিনিস বিয়ে করে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কিন্তু বেজায় খুশি। দিদি চলে গেলে দিদির সঙ্গে আর বিছানা ভাগাভাগি করতে হবে না। দিদির সব জামাকাপড় আমার। আলমারিটার দখলদারিও আমার। আর সবচেয়ে বেশি জরুরি যেটা, দিদির স্কুটিটাও আমার হয়ে যাবে। সত্যি কি যে আনন্দ লাগছে তা বলে বোঝাবার নয়। ওইদিকে বিয়ের আসরে দিদির মুখটা কেমন হয়ে আছে। চুপচাপ বিয়ের মণ্ডপে বসে আছে দিভাই। বাবার চোখ ছলছল করছিল কন্যাদানের সময়। মনটা ভারী হয়ে গেলো আমারও। মামী মাসি কাকী জেঠি সকলেই কেমন হাপুস নয়নে দিদিকে দেখে চলেছে। মন্ত্র পাঠের দ্বারা দিদির বিয়ে সমাধান হলো। পরদিন বিকেলে দিদি চলে যাবে। বাড়িতে সকলেই হাসি মুখে চোখের জল লুকোচ্ছেন। আমি শুধু অপেক্ষারত কখন দিদি যাবে আর আমি সব দখল করে বসবো। হলোও সেই। নির্দিষ্ট সময়ে দিদি জামাইবাবুর হাত ধরে সকলের চোখের অদৃশ্যে চলে গেলো। পেছনে রয়ে গেলো কেবল মধুমাখা স্মৃতি।
****************************
আজ সকালে আবার সাজসাজ রব আমাদের বাড়িতে। সকলে মিলে আমরা দিদির বৌভাত অনুষ্ঠানে যাবো কিনা। সময়মত পৌঁছলাম আমরা। বাহ্, দিদির মুখে আজকে কোনো দুঃখ নেই, আক্ষেপ নেই। কি সুন্দর মিটিমিটি হাসছে দেখো। দিদির হাসিমুখটা দেখে বড্ডো ভালো লাগলো। কাছে গেলাম যখন আমার গাল টিপে দিয়েছিল দিদি। সেদিন রাতে খোশমেজাজে আমরা সকলে বাড়ি ফিরেছিলাম। বাবা মায়ের মুখে শান্তির রেশ দেখে আমিও খুব নিশ্চিন্ত ছিলাম। অনেকদিন পর মা কে শুনলাম গুনগুনিয়ে গাইতে। বাবাও দেখলাম অনেক সুখী। দিদিভাই ভালো আছে দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেছে বাবা মায়ের।
কিন্তু একি! আমার এ কি হলো আজকে?
দিদির বৌভাত সেরে আসার পর আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। থেকে থেকে দিদির মুখটা মনে পড়ছে কেবল। আমার কেমন যেন লাগছে। আস্থির অস্থির মতন। উঠে বসলাম আমি।
একা এই ঘরটায় থাকতে পারছিনা কেনো আজকে? গলাটা রুদ্ধ হয়ে আসছে কেনো আমার? কি দুঃসহ অবস্থা।
সমগ্র বিছানা জুড়ে শুধু এইপাশ ঐপাশ করছি। ঘুম আসছে না। যতবার ভাবছি ততই মনে হচ্ছে দিভাই কে ছাড়া বড্ডো খালিখালি আর বেমানান লাগছে ঘরটা! শুধু কি ঘরটা? মনে হচ্ছে আমার জীবনটাও নিঃসঙ্গতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। দিদির সঙ্গে কাটানো ভালোমন্দ, খুনসুটি ভরা, ঝগড়া করা সমস্ত মুহুর্ত গুলো ভেসে ভেসে আসছে আমার মনের আকাশে।
কখন যে চোখের কোন বেয়ে নোনাজল গড়াতে শুরু করেছে টের পাইনি।
মনেমনে শুধু অস্ফুটে বলছি,
"দিদি আজ আর একবার আয় না রে আমার কাছে। আমার কিচ্ছু চাই না দিদি এই বিছানা, এই আলমারি, স্কুটি কিচ্ছু না। সব কিছু তোর। আমার কিছু চাই না। বিশ্বাস কর তোর সঙ্গে আর ঝগড়াও করবো না। এখন আমার পাশে শুধু তোকে চাই দিদি। একটি বারের জন্য আয় না দিদি এই বাড়িতে, এই ঘরে, আমার কাছে....."