অন্য শহর
অন্য শহর
অশ্বিনীবাবু রোজ সাঁতরাগাছি থেকে চাঁদনীতে একটি প্রাইভেট অফিসে গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করেন । আষাঢ়ের সন্ধ্যে , বৃষ্টিটা খানিক জোরে শুরু হয়েছে । আজ অফিস থেকে সবাই একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে কারণ বৃষ্টি । অশ্বিনীবাবু ভেবেছিলেন খুব জোর শুরুর আগে হয়তো বাড়ি পৌঁছে যাবেন । বৃষ্টির সময় সেকেণ্ড ব্রিজ ধরে গাড়ি চালানো বেশ রিস্কি । কিন্তু না ইডেনের কাছাকাছি আসতেই বৃষ্টিটা বাড়লো । সাথে এলোপাথাড়ি হাওয়া । বাধ্য হয়ে মেন রাস্তা থেকে একটু ভেতরে নিয়ে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন । বৃষ্টির বেগ বাড়ছে আর তিনি ক্রমশঃ অস্থির হয়ে উঠছেন । একবার কাঁচের বাইরে দেখতে গিয়ে রাস্তার একপ্রান্তে জল ও ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চোখ পড়লো । চোখ যেতেই অশ্বিনীবাবুর মাথার মধ্যেটা কীরকম চক্কর দিলো । যেন জল ও আলোর মিশ্রণে কিছু একটা ধাঁধা তৈরী হয়েছে । খানিক পরে যখন মনে হলো সব স্বাভাবিক তখন দেখলেন গাড়ি গতিশীল । তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন
না । কিন্তু এ কোথায় এসে পড়লেন । কোথায় ইডেন , কোথায় পিজি , কোথায় সেকেণ্ড ব্রিজ !
বড় বেশী ঘাবড়ে গেলেন অশ্বিনীবাবু । উফরন্তু রাত কেটে দিন হয়ে গেলো কীভাবে ? এমনই অবাস্তবতাকে নস্যাৎ করার মতো নানা যুক্তি দিয়ে উত্তর যখন মেলাতে পারছেন না হঠাৎ কোনো এক সিগন্যালে এক মহিলা গাড়ির সামনে হাত দেখালো । ড্রাইভার যিনি তিনি গাড়িটা থামিয়ে পিছনে ফিরলেন । পিছনের সিটেই বসে অশ্বিনীবাবু । এতক্ষণ পরে চালকের মুখটা পুরোপুরি দেখতে পেলেন । " ওমা একি , লোকটার মাথা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেলো কী করে ? " মনে মনে প্রশ্ন উঠতেই রীতিমতো চমকে উঠলেন । লোকটা যেন কেমন যান্ত্রিক গলায় বললো , " প্লিজ ওপেন দ্য ডোর অ্যান্ড লেট ম্যাডাম সোফিয়া ইন । "
কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতোই অশ্বিনীবাবু দরজাটা খুলে দিলেন । গাড়িতে উঠেই শরীর থেকে বেরোনো একটা প্লাগ গাড়ির একটা প্লাগপয়েন্টে গুঁজে দিলো । গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো ।
ড্রাইভারের আসনে বসা লোকটা যান্ত্রিক গলায় প্রশ্ন করলো , " সোফিয়া , মিট আওয়ার নিউ স্লেভ অশ্বিনীরঞ্জন মুখপাধধেয় । "
কথাগুলো এমনই অদ্ভুত যে নিজের নামের উপাধি ভুল হলেও তা কানে গেলো না ।
সোফিয়াও যান্ত্রিক নারীকন্ঠে উত্তর দিলো , " ও হো সো বিউটিফুল । " তারপর অশ্বিনীবাবুর গাল টিপতে লাগলো সোফিয়া । তারপর বললো , " ওয়াও বেবি , সো সফট ইটস চিক । থ্যাঙ্কস জন । "
তারপর অশ্বিনীবাবুর উপর ওদের আরও কিছু মন্তব্য শেষে গাড়িটা একটা বড়ো বাড়ির সামনে থামলো । গেট খুলে গেলো , পাহারায় যে সেও মানুষ । গাড়িটা ভেতরে ঢুকতেই অশ্বিনীবাবুর চোখ গেলো সারি সারি খাঁচার দিকে । তার কোনোটায় বাচ্চা কাঁদছে , কোনোটায় মা বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে । কোনোটায় ব্যাগ কাঁধে কয়েকটা ছেলেমেয়ে , কোনোটায় ডাক্তার স্টোথোস্কোপ নিয়ে দাঁড়িয়ে এবং আরও কত কি ! মোটকথা মানুষের জীবনের সব রূপ , চরিত্র সব এরা খাঁচায় সাজিয়ে রেখেছে । এদের চিকিৎসা লাগে না , পঠনপাঠন লাগে না , মানুষের ব্যবহার্যের প্রায় কিছুই লাগে না । তাই ওদের কাছে এসবই মিউজিয়াম বা চিড়িয়
াখানায় সাজানোরই জিনিস ।
এতক্ষণে অশ্বিনীবাবু বুঝে গিয়েছিলেন যে এটা রোবট অধিকৃত শহর হয়ে গেছে । কিন্তু তা কী করে সম্ভবপর হলো তা তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না । গাড়িটা ক্রমে বাড়ির ভিতরে অনেকখানি গিয়ে থামলো । গাড়ি থেকে সব্বাই নেমে এলো আর বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো । অশ্বিনীবাবুকে ওরা টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে গেলো । বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে একটা পরীক্ষাগারের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হলো । হাত পা বাঁধা অবস্থায় প্রচুর মানুষ রোবট বানিয়ে যাচ্ছে আর তাদের পাহারায় রয়েছে রোবটের দল ।
এরপর যে ঘরে অশ্বিনীবাবুকে এনে দাঁড় করানো হলো সেখানে আরও লোকেরা বন্দী হয়ে রয়েছে । ওনার হাত পাও চেন দিয়ে বেঁধে ওরা চলে গেলো । তিনি দেখলেন ঘরের সবাই মৃতপ্রায় হয়েও কাজ করছে ।
তিনি প্রশ্ন করলেন , " তোমরা এখানে কী করে এলে ? "
কেউ কোনো উত্তর না দিতে আবার জিজ্ঞেস করলেন , " তোমরা কি অসুস্থ ? "
এবার একজন মেয়ে উত্তর দিলো , " হ্যাঁ আমরা খেতে পাই না । এদের খিদমত খাটি আর একে একে মারা যাই । "
ফের প্রশ্ন করলেন , " তোমরা প্রতিবাদ করো না কেন ? "
এবার একজন পুরুষ জবাব দিলো , " প্রতিবাদ ? তা করলেই ওরা শক দিয়ে মেরে দেবে । আমরা অসহায় । "
অশ্বিনীবাবু দেখলেন এক একজন রোবট মনিব আসছে ও নানারকম হুকুম করছে । কেউ বলছে শরীরের গোটাটা পরিষ্কার করে দিতে । কেউ বলছে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে দিতে আবার কারোর আবদার অন্যরকম । মানুষ যবে প্রথম অনুভূতিশীল রোবট বানালো তবে থেকেই রোবটরা মানুষের মতোই প্রেম সম্পর্ক বুঝতে শিখলো । শারীরিক সম্পর্ক যদিও মানুষের মত সন্তানলাভে সাহায্য করতো না তবুও ওরা মনের সুখের জন্য শারীরিক সম্পর্ক গড়তো । ক্রমে সংখ্যা মানুষকেও ছাড়ানোর ফলে তারা মানুষের সাথেও সম্পর্ক গড়তে শুরু করলো ।রোবোটিক মনিবরা এই মানুষগুলোকে নিয়ে তাদের খুশির জন্য শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলো ।
অনেকক্ষণ পর সোফিয়া বলে সেই মনিব অশ্বিনীবাবুকে নিয়ে গেলো এই বলে যে , " গিভ মি সাম প্লেসার । "
ভয়ে এই প্রথম চিৎকার করে উঠলেন অশ্বিনীবাবু ।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে চমকে উঠলেন অশ্বিনীবাবু । ফোনে দেখলেন ২০ টা মিসড কল । বৃষ্টি থেমে গেছে । তিনি গাড়ি সাইড করে এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলেন । ঘড়িতে দেখলেন রাত ১.৩০ টা । হঠাৎ কাঁচে টোকা শুনে কাঁচের বাইরে তাকালেন । একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয়তো এইদিক দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়েছে , এগোতে পারছে না । তিনি ভালো করে ওদের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবেন কি হঠাৎ মনে হলো ছেলেটি আর মেয়েটিকে ঠিক জন আর সোফিয়ার মতো দেখতে । আর না দাঁড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন । এসির লোয়েস্ট পসিবল টেম্পারেচারেও দেখলেন তিনি ঘামছেন । একটা সিগন্যালে চট করে ফোন করে জানিয়ে দিলেন বাড়িতে । সিগন্যাল ছাড়তেই তিনি গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলেন । সেকেন্ড ব্রিজের উপর তখনও কিছু লোক , মনে ভয় হলো এই বুঝি কেউ তাঁর গাড়ি থামিয়ে লিফ্ট চাইবে , তাই স্পিডটা কিছু বাড়িয়ে দিলেন । ভেজা রাস্তার ভয় আর রইলো না ।