অন্য রাগ
অন্য রাগ


মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুমটা ভাঙল তনুজার। রাত্রি তিনটে পনেরোয় চৈতির ফোন! ঘুমচোখে রিসিভ করল,”কীরে! এত রাতে ফোন কেন?” বিপরীতে ভেসে আসা কথাগুলো শুনে মুহূর্তের জন্য ওর পায়ের তলার মাটিটা যেন সরে গেল!
“কী বলছিস তুই?”
“হ্যাঁ রে তনু।এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কোন উপায় আমার কাছে ছিল না।“
“যন্ত্রণা?তুই কি বলছিস কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি... ভয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে....”
“তনু আমি আর দেরি করতে পারছি না। আমার হাতে বেশি সময় নেই, তোকে যেকটা কথা বলছি মন দিয়ে শোন। তোকে আমি একটা ভয়েস রেকর্ডিং পাঠিয়েছি দেখবি। ওটা শুনলেই তুই সব জানতে পারবি। কিন্তু তোকে কথা দিতে হবে, এটা শোনা হয়ে গেলেই তুই চিরতরে ডিলিট করে দিবি, কেউ যেন এর কথা কোনদিনও জানতে না পারে। মনে থাকবে?”
“কিন্তু তার আগে তুই বল...”
ফোনটা কেটে গেল। তনুজা পাগলের মত চৈতিকে আরো বারকতক ফোন করল, কিন্তু কোন সাড়া নেই।
তনুজার চোখের সামনে পৃথিবী দুলছিল। সদ্য বিয়ে হয়েছিল চৈতির। রক্তিমদা ইন্ডিয়ান অয়েলে কাজ করে। এই তো সেদিনের কথা, ওরা সকলে কত মজা করেছিল, চৈতিও কত খুশি ছিল। ছোটখাট সমস্যা হতেই পারে, কিন্তু তাই বলে বিয়ের চারমাসের মধ্যেই রক্তিমের মত ভালোমানুষকে খুন করবে চৈতি, তা যেন দুঃস্বপ্নেরও অতীত।
তনুজা কি করবে ভেবে পেল না। ফোন করবে, পুলিশকে সব বলবে? কিন্তু তাহলে তো ওরা চৈতিকেই ধরবে, ওর নিজেরও হেনস্থার শেষ থাকবে না। আসলে কি হয়েছে তা চৈতি ছাড়া কেউ বলতে পারবেনা। কিন্তু চৈতির ফোনটাও বন্ধ।
নাহ, ঘটনার সত্যাসত্য না জেনে এর মধ্যে পুলিশকে জড়ানোটা ঠিক হবে না। দেখা যাক আগে কি হয়।
ভোর হতে না হতেই তনুজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। চৈতিদের নতুন বাড়ির অ্যাড্রেসটা ওর জানা ছিল, যতক্ষণে ও পৌঁছল, ততক্ষণে বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেছে। পুলিশের গাড়িও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
কোনরকমে ভিড় সরিয়ে সামনে গিয়ে তনুজা যা দেখল, তাতে ওর মাথাটা ঘুরে গেল। খাটের উপর রক্তিম লুটিয়ে পড়ে আছে ছুরিবিদ্ধ হয়ে, আর খাটের নীচে পড়ে আছে চৈতির নিথর দেহ, হাত বেয়ে চুঁইয়ে পড়েছে রক্তের রেখা।
ধুপ করে তনুজা মাটিতে বসে পড়ল। আশেপাশের কোলাহল ওর কানে ঢুকছিল না। একজন পুলিশ এসে বলল,”সার সব জায়গা খুজেছি,মেয়েটার ফোনটা কোথাও পাইনি স্যার।“
*******
বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ঢুকল তনুজা।ঘরে ঢুকতেই নীহার বলল,”এতক্ষণে আসা হল? সেই সকালে বেরিয়ে গিয়েছিলে, বলা নেই কওয়া নেই, গোটা দিনে মাত্র একবার ফোন। কোথায় ছিলে? সব ঠিক আছে তো?”
ধরা গলায় তনুজা বলল,”সব বলব। প্লিজ আমায় একটু একা থাকতে দাও এখন।“
পাশের ঘরে এসে থম মেরে বসে রইল তনুজা। হঠাত চৈতির বলা শেষ কথাগুলো মনে পড়ল। হোয়াটস্যাপটা চেক করে রেকর্ডিঙটা চালিয়ে হেডফোনটা কানে গুজলো সে।
“মনে আছে তনু, ছোটবেলা থেকেই সবাই আমাদের কি বলত? হরিহর আত্মা। আমাদের বন্ধুত্বটাই তো সেরকম। তুইও আমায় বন্ধুই ভাবতিস, না?সবার মত? কিন্তু আমি তো আরো একটু বেশি চাইতাম রে তোর থেকে।
হ্যাঁ রে, আমি তোকে প্রচন্ড ভালোবাসি, পাগলের মত বাসি। তোকে ছাড়া একটা মুহূর্তও বাঁচতে চাইনি আমি, শুধু তোকে বলতে পারিনি কখনো। তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম আমি। না রে রক্তিমের কোন দোষ নেই, ও তো আমায় কাছে টানতেই চাইত, কিন্তু আমিই পারিনি রে.. সবটা অসহ্য লাগত আমার... ওই বাড়িতে... আমার পাশে রক্তিম...পাগল হয়ে যেতাম আমি রে... আর তাই তো আজ... শেষ করে দিয়েছি ওকে। জানি খুব বড় ভুল করেছি, এর সাজা আমাকে পেতেই হবে... শুধু এটুকু জানি, তোকে যখন পাইনি, তখন আর কেউ আমার হতে পারবেনা এই দুনিয়ায়...”
থরথর করে কাঁপছিল তনুজা। পাশের ঘরে টিভিতে চলছিল,” হলদিয়ায় দম্পতির মৃত্যু… পুলিশ কারণ অনুসন্ধানে…।"