অনুক্ত
অনুক্ত
(মহাপৃথিবীর ওপার থেকে পাঠানো চিঠি)
বিলাস,
তোমায় বলার ছিল কিন্তু বলা হয়নি যত কথা, ভেবেছিলাম সব লিখে পাঠাবো তোমায়। কিন্তু সে প্রয়োজন বোধ হয় ফুরিয়ে গিয়েছিলো। তাই লেখা তো হলো কিন্তু পাঠাতে আর পারলাম কই?
বসন্তে নিঃস্ব পর্ণমোচীকেও সযত্নে রাখা হয় - নতুন করে সে সবুজ হয়ে উঠবে বলে আবার। কিন্তু চিরহরিৎ যখন নিঃস্ব পর্ণমোচীর রূপ নেয়, তীব্র কুঠারাঘাতে নিশ্চিহ্ন করা হয় তাকে - ভালো আসবাব বানানোর জন্য! মানুষের পরিণতিও ঐ চিরহরিৎ-পর্ণমোচীর নিয়তি থেকে বিন্দুমাত্র আলাদা নয়, ঠিক কিনা বলো?
দুঃখ পেলে? না সেটা দেওয়া আমার অভিপ্রায় ছিল না! না হলে, তার অফুরন্ত ভাণ্ডার তো ছিলোই আমার কাছে! ভরিয়ে দিতে পারতাম... মিথ্যা বলবো না, ইচ্ছেও হয়েছিলো একবার, খুব ইচ্ছা হয়েছিলো সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু হৈয়াঙ্গবীন তোমায় দিই, অন্তত বন্ধকই রাখি ক'টা দিন!
দুধ আর বিষ - এখন রঙের দিক থেকে কোনো ফারাক নেই তাদের! সরাসরি বিষপান করানো যায় না তো এখন! তাই তার একান্ত নিজস্ব নীল রঙের খ্যাতি হারিয়েছে সে। এখন নীলকন্ঠকেও দুধ বলেই গরল দিতে হয়। সেই গরল দুধের মতই ফোটে তাঁর অন্তরের আগুনে - নীল বাষ্প দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে যায়। উপরের ফেনাটুকুও হারিয়ে যায় একটু একটু করে শীতল হতে হতে।
যখন আমার হৃদ্স্পন্দন চমকিত হতো তোমার মাকড়ির স্পর্শে, নিস্তেজ স্পর্শেন্দ্রিয়ও সজাগ হয়ে উঠতো যখন তোমার শীতল করতলের উষ্ণতায় - মনে হতো তখন, তুমিই নেবে বুঝি সেই অমৃতটুকু! সেই ফেনার শুকিয়ে যাওয়া সর সরিয়ে ভিতর থেকে তুলেও এনেছিলাম তাকে!
কিন্তু মহাজনী কারবার তখন বন্ধ করেছো তুমি। সুখের কিছু নকল অলংকারের ঐশ্বর্য্যে তোমার মুগ্ধ দু'চোখ! তাই অনন্ত নাগের হলাহলে ঢাকা আমার একান্ত আপন সেই পীযূষকে আর দু'হাত ভ'রে তুলে দেওয়া হলো না তোমায়।
অন্ধকার বিনিদ্র রাতে, নীরব, নিঃশব্দ কক্ষের দুগ্ধফেনসম অকঠোর শয্যায় - শুধুই বিষাক্ত একাকীত্বের শীতল সরীসৃপতুল্য আনাগোনা! অপেক্ষা ছিলো শুধুই - কখন তার মারণ দংশনে স্তব্ধ হয়ে যাবে হৃদগতি।
অনেক দূরে, কোনো চন্দ্রাতপঘেরা প্রাঙ্গন'পরে আপন শিশুকে ঘুমের দেশে ডেকে নিয়ে যায় যেমন করে মা - তাঁর ঘুমপাড়ানি গানটা কানে আসছে না, শুধু শেষনিদ্রায় হারিয়ে যেতে যেতে মনে ছুঁয়ে রয়ে গিয়েছিলো যেন তাঁর সেই চিরন্তন ভালোবাসার শেষ স্পর্শটুকু।
আমার জীবন নাটকের অন্তিম রাত পোহালো, বাঁশিটা রেখে গেলাম - কোনো ভবিষ্যতের অরফিউসের জন্য।
ভালো থেকো,
তোমার অবিনাশ।