অনিকেত
অনিকেত
মালদা রেলওয়ে জংশন। ছেলেটা স্টেশনে মাথা নিচু করে বসে কাঁদছিল। বছর তেরও কি চোদ্দো হবে। দূর থেকে একজন মিলিটারি অফিসার ব্যাপারটা দেখছিল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর আর থাকতে না পেরে ছেলেটার কাছে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে প্রথমেই বলল তুমি কান্না থামাও তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে। ছেলেটা এক মনে কাঁদছিল ছিল হঠাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে হচকচিয়ে উঠে। তারপর চোখের জল মুছে নিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে বলুন কি বলতে চাইছেন।
ভদ্রলোক হেসে বললেন আমি মিস্টার মনোরঞ্জন দাস। আমার বাড়ি আসামে। আমি একজন মিলিটারি অফিসার। বাড়িতে আমার মা বউ আর চার সন্তান রয়েছে। চাকরিসূত্রে আমি মালদায় ছিলাম। এখন আমি নিজের বাড়ি যাচ্ছি।
এবার বলো তোমার নাম কি? ছেলেটা চোখ মুছতে মুছতে বলল আমি লক্ষণ সরকার।
এবার ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করল তুমি কাঁদছিলে কেন? ছেলেটা এখন আরো বেশি করে কেঁদে ফেলল। ভদ্রলোক বুঝতে পারল বিশেষ কিছু ঘটেছে তাই এত বেশি করে কাঁদছে ছেলেটা।
উনি ছেলেটাকে একটা টি স্টলে নিয়ে গিয়ে
জলের বোতল কিনে দিয়ে বলল চোখমুখ ধুয়ে নাও আর কিছুটা জল খেয়ে নাও। তারপর এক কাপ চা আরএক প্যাকেট বিস্কুট দিয়ে বলল এগুলো খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি। ছেলেটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। চল ওদিকটায় বসে দুজন একটু গল্প করব।তারপর কথায় কথায় সব জানা হল। ছেলেটা জানালো যে তারা খুব গরিব। বছর চারেক আগে বাবা মারা যায়। ওরা তিন ভাই। ও ক্লাস সেভেনে পড়ে। মা লোকের বাড়িতে কাজ করে কোন রকমে সংসার চালায়। খুব কষ্টে ওদের দিন কাটছে। ওরা পেট ভরে খেত পায়না। ও একটু বড় তাই সব বুঝতে পারে মায়ের কষ্ট। দুই ভাই ছোট ওরা খাবার জন্য খুব হাহাকার করে। মা খুব অসহায় দু চোখ দিয়ে জল পড়ে। ছেলেদের বুকে আঁকড়ে ধরে কোনভাবে দিন কাটাচ্ছে। অর্থাভাবে এবং মায়ের অসহায় অবস্থা দেখে ছেলেটার পড়া হচ্ছে না। পড়ায় মন বসে না। কিন্তু সে অনেক পড়াশোনা করতে চায়। ভদ্রলোক হেসে বলল তুমি পড়াশোনা করতে চাও বাহ্ বেশ ভালো কথা। আমি যদি তোমার দায়িত্ব নিতে চাই তুমি কি রাজি হবে? তোমার মা কি রাজি হবে? চলো তোমার মায়ের কাছে যাই। আজ আমার যাওয়া ক্যানসেল। ছেলেটার চেহেরা খুশিতে চকমক
করে উঠলো। যেন তার খুশির ঠিকানা নেই।
ছেলেটার বাড়ি স্টেশন থেকে অনেকটা দূরে একটা গ্রামে। ভদ্রলোক একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ছেলেটাকে বসিয়ে নিয়ে চলল তার বাড়ি।
ঘন্টা দেড়েক পরে ওরা পৌঁছে যায় গ্রামের বাড়িতে। ছেলেটার মা অবাক হয়ে যায় ভাবে কি ব্যাপার ছেলে আবার কোন গোল বাঁধিয়ে আসল কোথায় গিয়ে !ট্যাক্সি কেন বাড়িতে আর লোকটাই
বা কে ওদের বাড়িতে তো কেউ সচরাচর আসে না! ভদ্রলোক ট্যাক্সি থেকে নেমে আসলে ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে একটা মোরা পেতে বসতে দেয়। তারপর স্টেশনে কি ঘটলো সে কথা নিজের মা কে সব খুলে বলে।
ভদ্রলোক লক্ষণের মাকে বলল আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আপনার ছেলে আমার সাথে যেতে পারে ওর সব দায়িত্ব আমার। আমি ওকে নিজের ছেলের মতোই মানুষ করব। অনিকেতের মা আর দ্বিমত করেনা। ছেলে পড়াশোনা করে ভাল মানুষ হবে এই ভেবে ছেলেকে পাঠাতে রাজি হয়ে যায়। লক্ষণের ভাগ্যটা ও খুব ভালো যদিও সে ভিন্নরাজ্যে নিজের মা আর দুই ভাইকে ছেড়ে গিয়েছিল সেখানে গিয়ে সে আরেকজন মাকে পেয়েছে আরও ছোট বড় ভাই বোনদের পেয়েছে। ওর নতুন মা ওকে আগলে নিয়েছিল নিজের বুকে। ভাইবোনরাও নিজের ভাইয়ের মতই ওকে নিজেদের একজন করে নিয়েছে। লক্ষণ ও তাদের একজন হয়ে গিয়েছে প্রত্যেক কে আপন করে নিয়েছে তার ভালো ব্যবহার আর আন্তরিকতা ও ভালোবাসার মাধ্যমে। কয়েকদিন পর লক্ষণ কে নিয়ে ওর বাবা বাড়ির পাশে একটা স্কুলে যায় যেখানে তার নিজের ছেলে মেয়েরাও পড়াশোনা করে সেখানে তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় ক্লাস সেভেনে। স্কুলেও সে খুব তাড়াতাড়ি সবার সাথে বন্ধুত্ব করে নেয়। টিচার্স রাও ওকে খুব ভালোবাসে। অনিকেতের নতুন বাড়িতে ওরা সব ভাইবোনরা একসাথে বড় হতে থাকে। দেখতে দেখতে মাধ্যমিক পাস করে। দুই দিদির বিয়ে হয়ে যায় একজন মালদা একজন শিলিগুড়িতে। এরপর কলেজে পড়াশোনা করে বি এ পাস করে খুব ভালোভাবে। তারপর নিপকো কম্পানিতে খুব
ভালো একটা চাকরি পায়। এখন সে অনেক বড় হয়ে গেছে। অনিকেত আর ওর ছোট ভাই দুজনেই এখন বিবাহিত। দুজনেরই একটি করে কন্যা সন্তান আছে। লক্ষণের বাবা গত হয়েছে কিছুদিন হলো। মাকে নিয়ে দুই ভাই খুব সুখেই আছে। মাঝে মাঝে সে মালদায় নিজের মাকে দেখতে আসে বউ আর মেয়েকে নিয়ে। ওর নিজের দুই ভাই ও এখন অনেক বড় হয়েছে। লক্ষণ খুব ভাগ্যবান যে ওর দুজন মা আছে। দুটো পরিবার আছে।
গল্পের নাম অনিকেত কারণ যখন ও নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল ওর ক্লাসের একটা ছোট্ট মেয়ে ওকে অনিকেত বলে ডাকত। দুজনের খুব বন্ধুত্ব ছিল।মাধ্যমিক পাস করার পর মেয়েটা ভিন্ন রাজ্যে পড়তে চলে যায়। তখন থেকে তাদের মধ্যে আর যোগাযোগ ছিল না। সেও ভালোভাবে গ্রেজুয়েশন করে। তারপর মেয়েটার ও বিয়ে হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন গৌহাটি স্টেশনে তাদের দুজনের দেখা হয়ে যায় প্রায় কুড়ি বছর পর। এখন আবার তাদের বন্ধুত্ব চলছে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়।
দুজন দুজনের বাড়ির ভালো-মন্দ খোঁজ-খবর নেয়। ওদের বন্ধুত্ব বেঁচে থাকুক।