Mitali Chakraborty

Tragedy Classics

4  

Mitali Chakraborty

Tragedy Classics

অন্বেষণ

অন্বেষণ

5 mins
338


(১)

এক নিয়মমাফিক জীবনের বৃত্তে ঘুরে চলছে তমোঘ্ন, শতরূপা আর কৌশিকের জীবন। শতরূপা এবং কৌশিকের কর্মস্থলে আর তমোঘ্নর স্কুলে পৌঁছানো সবই চলে নিয়ম মেনে। স্বাস্থ্যকর ডায়েটের চার্টটাও সচরাচর টপকাতে পারে না নিয়মের বেড়াজাল। তমোঘ্ন বয়সের দিক দিয়ে ছোট থাকলে কী হবে, হাবেভাবে সেও তার বাবা কৌশিকের মতই ধীরস্থির আর গুরুগম্ভীর। দেখেশুনে কে বলবে সে মাত্র চোদ্দ বছরের একটা ছেলে! কৌশিক এক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের প্রফেসর, শতরূপাও এক প্রাইভেট কলেজে পার্টটাইম লেকচারার। কৌশিক আর শতরূপার একমাত্র সন্তান তমোঘ্ন। ছোট থেকেই কৌশিক পুত্রকে শিখিয়েছে নিয়মানুবর্তীতা। এখন তমোঘ্নও তার বাবার মতই জীবনযুদ্ধে এগিয়ে থাকার এবং জয়ী হবার সূত্রগুলো অনুসরণ করে নিয়মের জালে জড়িয়ে ফেলেছে নিজেকে।


(২)

আজকে সকালেও নিয়ম মেনেই দিনের শুরু হলো। জলখাবার খাওয়া হয়ে গেলেই তমোঘ্ন বাবা মায়ের সঙ্গে স্কুলে যাবার জন্য তৈরী। প্রত্যেক দিনই তমোঘ্নকে স্কুলের বাস অবধি পৌঁছে দেয় কৌশিক আর শতরূপা। কচিকাঁচাদের সঙ্গে তাদের বাবা, মা অথবা দাদুঠাম্মাদের বাসষ্ট্যান্ডে নিয়ে তৈরী হওয়া জটলা'টা চোখে পড়ার মতো। সকাল সকাল বন্ধুদের দেখা পেয়ে কিচিরমিচির করতে শুরু করে দেয় খুদেরা। বাদ যাননা তাদের অবিভাবকেরাও। কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে একলা থাকতেই পছন্দ করে তমোঘ্ন। বাস না আসা অবধি সে যেমন নিজেদের গাড়ি থেকে নামে না, তেমনই বাসে উঠেও অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে হৈচৈ করে না। কৌশিক তার ছেলের এমন মনোভাবে খুশি হলেও শতরূপার ভালো লাগে না। মনে হয় নিয়মের বেড়াজালে ফেঁসে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে তমোঘ্নর ছোটবেলাটা। মাঝে মধ্যেই শতরূপা আপত্তি করে তমোঘ্নর ঘাড়ে এত নিয়মের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বহুবার মৃদু কথাকাটি হলেও কৌশিকের যুক্তির সামনে সেই আপত্তি তেমন একটা দাঁড়াতে পারেনা।

বাসে তমোঘ্নর জন্যে বরাদ্দ আছে একটা নির্দিষ্ট সীট। তমোঘ্নর সঙ্গে শতরূপাও নামে। বাসেও ওঠে তমোঘ্নর পিছুপিছু। তারপর তমোঘ্ন ওর সীটে বসে পড়লে নিজেই নেমে আসে বাস থেকে। অন্যদিন তমোঘ্নর পাশে বসে ওরই এক ক্লাসমেট। কিন্তু আজ বাসে উঠে শতরূপা দেখল ওই সীটে বসে আছে অন্য একটি বাচ্চা ছেলে।

শতরূপা একটু অবাক হল। এই বাচ্চাটাকে তো বাসে চেপে আগে স্কুলে যেতে দেখেনি সে! ব্যাপারটা নিয়ে সেদিন তেমন গা করেনি শতরূপা। এদিকে সীটে বসার পর তমোঘ্ন তার ব্যাগ থেকে বার করে ফেলেছে ফিজিক্সের বইখানা। বাবার মতই ফিজিক্স তার প্রিয় বিষয়। বাকি বাচ্চারা কী করছে, সেদিকে নজর না দিয়েই সে ডুবে গেল ফিজিক্সের সূত্রাবলীতে। বাইরের দিকে।

পরদিন আবার সেই বাচ্চা ছেলেটি জানালার ধারে, বসে আছে একই সীটে। শতরূপা আজ লক্ষ্য করলো বাচ্চাটির অন্য ছেলেমেয়েদের প্রতি তেমন উৎসাহ নেই। চিৎকার চেঁচামেচি বা হাসাহাসি কিছুই করছে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া বড় রাস্তাটার দিকে।


(৩)

সেদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে শতরূপা গল্পচ্ছলে তমোঘ্নকে জিজ্ঞেস করে,

“হ্যাঁরে তমু, ওই ছেলেটা কে রে?”

প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায় তমোঘ্ন।

“কে মা? কোন ছেলেটার কথা বলছ তুমি?”

“আরে ওই ছেলেটা। যে তোর পাশের সীটে বসে স্কুলে যাওয়ার সময়।”

"চিনি না মা।" সংক্ষিপ্ত উত্তরে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যতে চায় তমোঘ্ন। তার চোখমুখ দেখেই বোঝা যায় মায়ের এমন বেহিসাবি প্রশ্নে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছে সে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে এক বিশেষ আকর্ষণ আর আগ্রহ চেপে ধরে শতরূপাকে। ওই বাচ্চা ছেলেটা সম্পর্কে জানতেই হবে তাকে!

কেন সে এমন তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে? 

পরদিন সকালে তমোঘ্নকে বাসে তুলে দেওয়ার সময় শতরূপা দেখে ছেলেটির দৃষ্টি যেন খুঁজে চলেছে কাউকে।

শতরূপার ভীষণ জানতে ইচ্ছা করে কাকে খুঁজে চলেছে ছেলেটা? 


(৪)

পরদিন সকালেও সেই ছোট্ট ছেলেটা বসে আছে তার নিজের জন্যে নির্দিষ্ট সীটে। বাস থেকে নামার সময় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না শতরূপা। বাসের কন্ডাক্টর দাঁড়িয়েছিল দরজার কাছে। শতরূপা তাকে জিজ্ঞেস করে, “তমোঘ্নর পাশে যে ছেলেটা এখন বসে সে কে? আগে যে ছেলেটা বসত সে কোথায় গেল?”

“ম্যাডাম ওই ছেলেটা নতুন ভর্তি হয়েছে। ও দাদুর সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে আসে। আগে জানালার ধারে ওই সীটে যে ছেলেটা বসতো, ওর বাবা ট্রান্সফার হয়ে ফ্যামিলি নিয়ে দিল্লী না কোথায় চলে গেছে। সীটটা খালি ছিল বলে বাচ্চাটা ওখানে বসে।”

কন্ডাক্টরের উত্তরে অনেক কিছু জানতে পারলেও খুশি হতে পারে না শতরূপা। যতদিন যাচ্ছে ছেলেটির প্রতি আগ্রহ ততই বেড়ে চলেছে তার। পরদিন তমোঘ্নকে বাসে তুলে দিয়ে কী একটা চিন্তা করে থমকে দাঁড়ায় সে। নিয়ম অনুসারে শতরূপার এবার বাস থেকে নেমে গিয়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠা উচিত। কিন্তু শতরূপা নামছে না। মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তমোঘ্ন একটু অবাক হলেও সে বুঝতে পারে যে মা তাকিয়ে আছে পাশে বসা ছেলেটার দিকে।

“বাবুসোনা!” আদর করে ছেলেটাকে ডাকে শতরূপা। তমোঘ্ন তখন দুই ভ্রূ কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করছে তার মায়ের গতিবিধি। ছেলেটা মুখ তুলে তাকালো শতরূপার দিকে। তমোঘ্নকে পাত্তা না দিয়েই সে বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার নাম কী সোনা?”

“রুদ্রনীল।” একটু ইতস্তত করে জবাব দেয় ছেলেটা। শতরূপা আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না, “তুমি বাইরে তাকিয়ে কী দেখো বাবু?”

এক মুহুর্তের জন্যে হলেও থমকে যায় ছেলেটার চোখমুখ। কিন্তু তারপর শতরূপাকে অবাক করে দিয়ে উদাস কণ্ঠে ওইটুকু বাচ্চা ছেলেটা বলে ওঠে, “মাকে খুঁজি।”

“মা!” হঠাৎ যেন সমস্ত আকাশ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে শতরূপার মাথায়, “কিন্তু এখানে কোথায় তোমার মা?”

“মা এই রাস্তা দিয়েই যায়।” সংক্ষিপ্ত জবাব দেয় ছেলেটা।

শতরূপা কিছু বোঝে না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তার মানে?”

ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “আমার মায়ের অফিসের গাড়ি এই রাস্তা দিয়েই যায়। আমি যখন স্কুলের জন্য বের হই মা তখন তৈরী হতে থাকে, মায়ের সঙ্গে তখন ভালো করে কথা হয় না। আমি যখন স্কুল থেকে বাড়ি পৌঁছি তখনও মা বাড়িতে থাকে না।”

ছোট্ট ছেলেটি দম নেওয়ার জন্যে একটু থামে। ছেলেটি ঢোক গিলে আবার বলতে শুরু করে, “আমি যখন রাতের খাওয়া সেরে ঘুমোতে যাই তখন মা আসে। আমার মা যে খুব ব্যস্ত। বাবাকে হারিয়েছি তিন বছর হলো। আসলে মায়ের অফিসের গাড়িটা এই রাস্তা দিয়েই যায় শুনেছি, তাই চেয়ে থাকি মাকে যদি একটু দেখতে পাই! মায়ের যে আমার জন্য সময় ভীষণ কম। মা সারাক্ষণ শুধু বলে নিয়ম করে সময় মতন খেলতে, খেতে, ভালো করে পড়াশোনা করতে তাহলে আমিও নাকি মায়ের মত বড় চাকরি করতে পারবো আগামীদিনে।”

এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে ছোট্ট ছেলেটা। হাঁপিয়ে গেছে সে, জলের বোতল বের করে জল খেতে খেতে আবার চেয়ে থাকে বড় রাস্তার দিকে।

চিনচিন করে ওঠে শতরূপার বুকটা। এইটুকুনি ছেলে নিয়মের ফাঁসে আটকে মায়ের স্নেহসুধা থেকে বঞ্চিত...! শতরূপা ভাবে সে নিজেও তো কর্মরতা, তবুও সে চেষ্টা করে সন্তানকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার আর এই ছোট্ট বাচ্চাটি মাকে এক ঝলক দেখার জন্য এত ব্যাকুল। তার ছোট্ট দুচোখে কেবল অন্বেষণ, অন্বেষণ শুধু একটু স্নেহের!

শতরূপার মাথায় বনবন করে ঘুরছে বাচ্চা ছেলেটির কথাগুলো।

ওইদিকে তমোঘ্ন তখনও ফিজিক্সের বই হাতে সূত্র মুখস্ত করতে ব্যস্ত।

তাকে যে অনেক বড় হতে হবে।

কৌশিকের তৈরী নিয়ম অবলম্বন করে জীবন যুদ্ধে আরো এগিয়ে যেতে হবে!


 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy