অমূলক
অমূলক
অমূলক
শুভময় মণ্ডল
রূপা তাদের খুড়তুতো জেঠতুতো মিলিয়ে মোট পাঁচ ভাই বোনদের মধ্যে ঠাকুরমার সবথেকে ন্যাওটা ছিলো। বয়সেও সেই সবার বড়, তার ওপর বাড়ির প্রথম এবং একমাত্র মেয়ে। ঠাকুরমার খুব আদরের নাতনি, যাকে বলে একেবারে চোখে হারান আর কি!
বাকিরা দুষ্টুমি করে কখনও কখনও তবু তাঁর কাছে বকা খেয়েছে কিন্তু রূপাকে সেটুকুও খেতে হয়নি কখনও, তা সে যত অন্যায়ই করুক না কেন! অবশ্য রূপা ভুল বা অন্যায় কাজ করেও না কখনও। তার দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা বাকিদের থেকে বেশিই। ভাইয়েরাও সেটা মানে আর তাই তাকে সম্মানও করে তারা খুব। বাবা কাকারাও তার কথায় গুরুত্ব দেন।
রূপাদের মাটির বাড়ির একতলার ঘরটিতে থাকতেন ঠাকুরমা, তাঁর সঙ্গে থাকতো রূপাও। দোতলায় একটি ঘরে মা, বাবা আর ওর ছোট ভাই ছোটন থাকতো। অন্য ঘরে কাকু কাকিমা আর তাঁদের ছোট ছেলে রাজু থাকতো। লাগোয়া বৈঠকখানা বাড়ির নিচের তলায় জেঠু জেঠিমা আর ওপরের একটা ঘরে রূপার বড় ভাই বাপন আর কাকার বড়ছেলে বুবুন থাকতো।
পরে যখন কলেজে ভর্তি হলো রূপা, ঠাকুরমা তখন থেকে একাই থাকতেন ঐ ঘরে। বাকি আর কাউকে তিনি তাঁর কাছে থাকার অনুমতি দেননি, এমনকি নিজের ছেলেদেরও না! এদিকে তাঁর বয়স হয়েছে, রাত বিরেতে তাঁর যদি কোনো দরকার পড়ে? কারও তো তাঁর কাছে থাকা দরকার, কিন্তু তিনি অনড়।
অগত্যা, বয়স্কা শরীরে বারবার খাট থেকে ওঠা নামা করে কাউকে যাতে তাঁকে ডাকতে না হয় তার জন্য খাটে একটা দড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। সেটা ধরে টানলেই, দরজায় লাগানো টিনের পাল্লায় আগলের গুঁতো লেগে ঠক্ ঠক্ করে আওয়াজ হতো। সেই শব্দ শুনে যে কাছে থাকতো সেই তাঁকে সাড়া দিতো।
এই ঘটনার সূত্রপাত সেই ঠাকুরমার পরলোক গমনের পর। তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া কর্ম সব যেদিন সম্পন্ন হলো, সবাই ক্লান্তির কারণেই সেদিন বেশ তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিল রাতে। মাঝরাতে হঠাৎ ঠাকুরমার ঘরে ঠক্ ঠক্ - একবার, দু'বার, তিন তিনবার!
অভ্যেস বশে সাড়া দিতে হাজিরও হয়ে গেল সবাই, কিন্তু কাকে সাড়া দেবে? ব্যাপারটায় সবাই একটু অবাকই হল, বাড়ির এতগুলো লোক সবাই তো আর ভুল শোনেনি! যাই হোক, ঠাকুরমার ঘরের দরজা খোলা হলো - ভিতরে কেউ কোথাও নেই। খাবারের গামলাগুলো শুধু পড়ে আছে মেঝেয় আর বিছানার উপর ফুল মালায় সাজিয়ে রাখা আছে চন্দন চর্চিত ঠাকুরমার ছবিটা।
কেউ কিছু বুঝতে না পেরে খুব অবাক হলেও, তখনকার মত সবাই যে যার ঘরে ফিরে গেল। কিন্তু পরদিন রাতে আবার সেই ঠক্ ঠক্ এবং ঠাকুরমার ঘরে গিয়ে যথারীতি দেখা গেল সেখানে কেউ নেই! তৃতীয় দিনও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়, পরদিনই পুরোহিতকে ডেকে সব ঘটনা খুলে বলে এর একটা বিহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো তাঁকে। তিনি জানালেন, টোলের পণ্ডিত ভট্টাচার্য মশাইয়ের থেকে সব জেনে এসে পরদিনই এর একটা বিহিত করবেন তিনি।
রূপার আবার এইসব ধম্ম-কম্মে আস্থা নেই বিশেষ। তাই সে বললো - আমি আজ রাতে ঠাকুরমার ঘরে শোবো। আমার তো মনে হয় আমরা অকারণেই ভয় পাচ্ছি। ঘরের ভেতরে থাকলেই জানা যাবে আসলে ঠিক কি ঘটছে সেখানে। ঠাকুরমা আমার ক্ষতি তো অন্ততঃ করবে না, দেখিই না কি চায় সে!
বাকিরা নিতান্তই নিমরাজি হয়েও, শুধু তারই জেদাজেদির জন্য মেনে নিল তার প্রস্তাব, তবে এই শর্ত সাপেক্ষে যে ঠাকুরমার ঘরের ভেজানো দরজার বাইরেই অপেক্ষা করবে বাপন আর বুবুন। দরজার আগলটা খুলেই রাখা থাকবে, সে আওয়াজ দিলেই যাতে তারা ঘরে ঢুকে পড়তে পারে।
রাতে ঠাকুরমার ঘরের বিছানায় শুয়ে রূপা দেওয়ালে ঝোলানো ঠাকুরমার ছবিটা বারবার দেখছিল। ঘরের ডিম লাইটের নীল আলোয় ঠাকুরমাকে যেন কত বিষন্ন লাগছিল তার। শেষ কয়টা দিন ঠাকুরমা বারবার তাকে এখানে থাকতে বললেও, ফাইনাল পরীক্ষার জন্য থাকা হয়নি তার। অবশ্য তিনি গত হবার আগেই ফিরে এসেছিল সে, কিন্তু তখন তাঁর আর বিশেষ বাহ্যিক জ্ঞান ছিল না।
ওদিকে দরজার বাইরে বাপন আর বুবুন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে পড়েছে। বারবার লম্বা লম্বা হাই উঠছে তাদের, কিন্তু ঐ যে দিদির কড়া নির্দেশ আছে সে আওয়াজ না দিলে ঘরে না ঢোকার, তাই সেখানেই অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছিল তাদের। রাত বাড়তে থাকে কিন্তু আজ কোন সাড়া শব্দ নেই কেন কে জানে?
সবার চোখ যখন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল ঠিক তখনই ঠক্ ঠক্! রাত জেগে পড়াশোনা করতে অভ্যস্ত রূপা কিন্তু সজাগই ছিল, সে তড়িৎ গতিতে সুইচ অন করে ঘরের টিউব লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। আলো জ্বলতেই সচেতন হয়ে বাপন আর বুবুনও ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে। রূপা তখন দরজার দিকেই তাকিয়ে বসেছিল, দেখলো সেই ঠক্ ঠক্ আওয়াজটা কিন্তু দরজায় টোকা লেগে হচ্ছিল না!
আসলে ঠাকুরমা গত হবার পর তাঁর সেই ঘরটা ভাঁড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। দরজার পাশে একটা স্কুটারের টায়ার শুইয়ে রেখে তার ওপর একটা গুড়ের টিন রাখা ছিল। টিনে আর গুড় বেশি ছিল না, ওদিকে একটা ধেড়ে ইঁদুর সেই টায়ারের ভিতরে আগে থেকেই বোধ হয় বাসা করেছিল, তাই সেখানে সে আটকে গিয়েছিল এবং বেরিয়ে আসতে পারছিল না।
গ্রামের দিকের প্রচলন অনুযায়ী, গুড় বের করার জন্য ঐ টিনের উপরের দিকে কিছুটা জায়গা গোল বা তিনকোনা করে কেটে রাখা হয়। আর সেই কাটা ভাগটায়, ঐ টিনের ওপর একটা বড় মাটির ডেলা বসানো হয়, যাতে সর্বদা টিনটা খোলা অবস্থায় না থাকে আর তার ভিতরে কিছু পড়ে না যায়।
এখন সেই ইঁদুরটাই ঐ টিনটাকে নিচে থেকে গুঁতো মেরে ওখান থেকে সরিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল! আর তার সেই ধাক্কার জন্যই ঐ মাটির ডেলাটা টিনের ওপর লাফিয়ে উঠছিল। মাটির ডেলাটার সেই টিনের ওপর ঐ ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে পড়ার জন্যই টিনের দরজায় ঠাকুরমার সেই আগলের গুঁতো খেয়ে হওয়া ঠক্ ঠক্ শব্দের মতই অবিকল আওয়াজ উৎপন্ন হচ্ছিল, বোঝো!