Sayandipa সায়নদীপা

Crime Horror Thriller

3.4  

Sayandipa সায়নদীপা

Crime Horror Thriller

অমঙ্গলের দূত

অমঙ্গলের দূত

45 mins
19.6K


“তিতি এবার ওঠ রে আর কতো ঘুমোবি!

নে নে উঠে পড়… তাথৈ এ নিয়ে দুবার ঘুরে গেল তোর খোঁজ করে…”

“উমম… তাথৈ! এই সাত সকালে কেন? স্কুল যায়নি?” ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলো তিতি।

“আজ তো শনিবার, স্কুল ছুটি। আর কেন এসেছিল সেটা তো জানিনা, বললো তার তিতি দিদির জন্য নাকি কি সারপ্রাইজ আছে।”

তিতির ভ্রূটা কুঁচকে গেল আর তখনই বাইরের ঘর থেকে একটা পরিচিত গলার স্বর ভেসে এলো, “জ্যেঠু তিতি দিদি এখনো ওঠেনি! উফফ কতো ঘুমোয় রে বাবা!”

তিতির রুমে ঢুকেই উচ্ছসিত গলায় তাথৈ বললো, “বলতো তিতি দিদি কাল রাত্রে কি হয়েছে; বলো বলো।”

“উমম… জানিনা। তুই বল।”

“মাম্মাম নতুন বিল্লিরানীটাকে রাখার পারমিশন দিয়ে দিয়েছে।”

“আবার একটা বিড়াল!” তিতি কিছু বলার আগেই সর্বানী দেবীর আতঙ্কিত গলা শোনা গেলো।

“আরেকটা কেন বলছো জেম্মা! তুমি কি জানোনা জন্সি হারিয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ, তোর তিতি দিদি বলছিলো সেদিন; কিন্তু জন্সি এখনো ফেরেনি! বাড়িতে এমনি আশ্রয় নেওয়া কুকুর বিড়ালকেও কেউ যদি দূরে ছেড়ে দিয়ে আসে তারা ঠিক গন্ধ শুঁকে শুঁকে বাড়িতে ফিরে চলে আসে আর এ তো পোষা বেড়াল। আশ্চর্য!”

“জানো জেম্মা টফি আন্টি বলছিলো যে জন্সি নাকি এতদিনে মরে গেছে!” তাথৈ এর গলাটা কেঁপে উঠলো, চোখের কোণেও যেন একফোঁটা জল চিকচিক করতে দেখা গেলো।

“আরে না না জন্সি ঠিক ফিরে আসবে দেখিস। মন খারাপ করতে নেই বোকা। আচ্ছা তোর নতুন বিল্লিরানীর নাম কি রাখলি?”

“এখনো তো ওকে ঘরেই আনিনি। এই ফেরার পথে নিয়ে যাবো, চিকুদের গেটের সামনে ঘুমোচ্ছে দেখে এলাম।”

“আচ্ছা আচ্ছা।

এই তিতি আবার ঘুমোলি নাকি! ওঠ ওঠ কলেজ যাবিনা!”

আকাশের কোনায় কালো হয়ে মেঘ জমেছে, বেশ একটা ঠান্ডা বাতাস বইছে। এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে বোধহয়। আজ শনিবার কলেজ ছুটি হলে সেখানে থেকেই সোজা কোচিং এ যায় তিতি তাই বিকেলে ফেরার সময়টা বড্ড ক্লান্ত লাগে। আজ বোধহয় মেঘ করেছে বলে রাস্তাঘাট এতো ফাঁকা। রাস্তার এই শূন্যতা যেন তিতির ক্লান্তিটাকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আহহ… আউচ্… পায়ে যেন হঠাৎ করে কোনো সূঁচাল জিনিস বিঁধে গেলো তিতির। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল এক টুকরো কাঠের মধ্যে আটকে থাকা একটা পেরেক সোজা ঢুকে গেছে তার পায়ের বুড়ো আঙুলে। অসাবধানে রাস্তায় হাঁটার ফল। ঝুঁকে পড়ে পেরেকটা তিতি বের করলো পা থেকে, জায়গাটা থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে আর সেই সাথে শুরু হয়েছে যন্ত্রনা। আশেপাশে তাকালো তিতি। সামনেই তৈরি হচ্ছে একটা বিশাল ফ্ল্যাট বাড়ি, কনস্ট্রাকশনের কাজ এখন মাঝপথে আর ওখান থেকেই বোধহয় কোনোভাবে এসে পড়েছে এই পেরেক লাগানো কাঠের টুকরোটা। শ্রমিকদের কাউকে দেখা গেলো না, আজকের মত ছুটি হয়ে গেছে মনে হয়। ব্যাগ হাতড়ে একটা ব্যান্ডেড খুঁজে পেলো তিতি। রক্তক্ষরণের জায়গাটা ঘিরে লাগাবার চেষ্টা করলো সেটা, এতে বিশেষ লাভ হবেনা হয়তো তাও বাড়ি না পৌঁছানো অবধি তো আর কোনো উপায়ও নেই। ব্যান্ডেডটা লাগানো হয়ে যেতেই বাড়ি যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো তিতি, আর তখনই শুনতে পেল ডাকটা, ‘মিঁয়াও’... শব্দটা ভেসে এলো ওই কনস্ট্রাকশন সাইটটা থেকে। অকারণেই কৌতূহলী হয়ে চোখ চালালো তিতি। প্রথমে কিছুই দেখতে পেলোনা, কিন্তু পায়ে পায়ে একটু এগিয়ে যেতেই আবার শুনতে পেল ডাকটা আর তারপরেই চোখ পড়লো ছোট্ট সাদা অবয়বটা। তিতির মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো, “জন্সি!”

জন্সিকে নিয়ে তিতি যখন তাথৈদের বাড়ির গেটে ঢুকলো তখনই শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই তিতি আন্দাজ করতে পারলো কোনো কারণে বাড়ির আবহাওয়া বেশ উত্তপ্ত। শ্রাবনী কাকিমা বসে আছেন পেপার নিয়ে, মুখটা গম্ভীর। আস্তে আস্তে তিতি জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে কাকিমা!”

“আরে তিতি তুই! আয় আয়।

জন্সি! কোথায় পেলি ওকে?” শ্রাবনী দেবী বেশ অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন। তিতি জন্সিকে পাওয়ার পুরো ঘটনাটা বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করলো। জন্সিকে তিতির কোল থেকে নিতে নিতে শ্রাবনী দেবী বললেন, “বাঁচালি তুই আমাকে। উফফ… আমার মেয়েটার তো কোনো কান্ড জ্ঞান নেই...”

“কেন কি হয়েছে কাকিমা?”

“আরে আর বলিস না। জন্সি হারিয়ে যাওয়ার আগের থেকেই বায়না জুড়েছিলো একটা নাকি অন্যরকম দেখতে বিড়াল দেখেছে, পুষবে সেটাকে। আমি তো এলাও করিনি প্রথমে। এবার জন্সি হঠাৎ তিনদিন বেপাত্তা হয়ে গেলো, তাথৈ তো কেঁদে কেটে অস্থির করছিল তাই কাল আমি শেষে বিরক্ত হয়ে বলি যা তোর নতুন বিড়ালটাকে নিয়ে আয়…”

“হ্যাঁ, আজ সকালে আমাকে বললো গিয়ে।”

“হুম… তোদের বাড়ির থেকে ফেরার সময় সেটাকে যখন নিয়ে এলো তখন কি দেখলাম জানিস?”

“কি?”

“একটা কালো কুচকুচে বেড়াল। ভাবতে পারিস একটা কালো বেড়াল তুলে এনেছে পুষবে বলে! কালো বেড়াল আবার পোষার জিনিস নাকি!”

“আহা কাকিমা এত রাগ করবেননা…তাথৈ তো ছোটো এখনো, আর তাছাড়া আজকালকার দিনে এসব কুসংস্কার না মানাই ভালো।”

“তুই যাই বল তিতি, চিরকাল শুনে এসেছি কালো বেড়াল অমঙ্গল ডেকে আনে সংসারে। কেমন কুতকুতে চোখ দুটো, দেখলেই আমার গা ছমছম করছে। আমি কিছুতেই ওটাকে রাখতে দেবোনা ঘরে। আর এবার তো জন্সিও ফিরে এসেছে, তাই ওই আপদটাকে বিদেয় করেই ছাড়বো।”

“তা তাথৈ কোথায়?”

“আর বলিস না সেই আপদটাকে নিয়ে দরজায় খিল দিয়ে বসে আছে।”

“আচ্ছা আমি দেখছি।”

“তাথৈ… তাথৈ দরজা খোল… দেখ আমি তিতি দিদি… কাকে এনেছি একবার দেখ।”

তিতির ডাকে কাজ হলো। তাথৈ দরজা খুলে বেরিয়ে এলো, কোলে একটা কালো বেড়াল। বিড়ালটাকে দেখা মাত্রই তিতির যেন কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল মনে। কে জানে এটা কাকিমার কথার প্রভাব কিনা! তিতি জানেনা কালো বিড়াল সত্যিকারের অমঙ্গল বা অপদ কিনা কিন্তু এর এই কালো কুচকুচে রং আর কুতকুতে সবুজ চোখ দুটোর দিকে তাকালে যে কারুর গা ছমছম করবে।

জন্সিকে দেখেই তাথৈ ওই কালো বিড়ালটাকে নামিয়ে রেখে ছুটে গিয়ে জন্সিকে কোলে তুলে নিলো তারপর আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে থাকলো। কিন্তু তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওই কালো বেড়ালটা তেড়ে গেল জন্সির দিকে, তাথৈ এর কাছে থাকা জন্সি ভয়ে আরও কুঁকড়ে একেবারে সেঁধিয়ে গেলো তাথৈএর কোলের মধ্যে। ছোটবেলা থেকে বাড়ির আদরে মানুষ হওয়া জন্সি এরকম একটা বিভৎস জংলী বিড়ালকে দেখে ভয় পাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। শ্রাবনী দেবী বললেন, “দেখেছিস কিরকম সর্বনাশা… উফফ আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।”

তিতিও যে কম ভয় পেয়েছিলো এমনটা নয়; তাই সে নরম গলায় তাথৈকে বললো, “তাথৈ কাকিমা ঠিকই বলেছেন এই বিড়ালটাকে ঘরে রাখিস না, দেখলি তো জন্সিকে কেমন করছে। এ রাস্তার বেড়াল রাস্তাতেই ভালো।”

তিতি স্পষ্ট দেখলো তাথৈএর মুখটা নিমেষে অন্ধকার হয়ে গেল।

“সত্যি বলতে শ্রাবনী বলেই এতো সহ্য করে। ছেলে মেয়ে দুটোই কুকুর বিড়ালকে নিয়ে এমন আদিখ্যেতা করে…”

“তাথৈ তো আফটার অল একটা বাচ্চাই মা।”

“তাথৈ না হয় বাচ্চা কিন্তু তাতানতো নয়। সেও কুকুরটাকে নিয়ে… কি অদ্ভুত শখ বাবা! ছেলেটা কুকুর নিয়ে মাতামাতি করে আর মেয়েটা বিড়াল।”

“আহা তুমি খারাপ দিকটাই দেখছো কেন! ভেবে দেখো তো একই বাড়িতেই কুকুর বেড়াল একসাথে মিলেমিশে থাকছে… কি আমেজিং না!” এতক্ষণে তিতির বাবা অম্বরিশ বাবু মুখ খুললেন।

“রাখো তোমার আমেজিং…” রাগত স্বরে বললেন সর্বানী দেবী।

“আচ্ছা রাখলাম। এসব বাদ দাও, অন্য একটা কথা শোনো।”

“কি?”

“স্যান্যালরা বাড়িটা দিয়েই দিলো শেষমেষ…”

“যাহ… স্যান্যাল কাকুরাও!” তিতি হতাশ গলায় বললো।

“হ্যাঁ রে। না দিয়েই বা যাবে কোথায়! যা দিনকাল পড়েছে, খবরের কাগজ খুললেই একটা না একটা খবর থাকেই প্রমোটারদের জুলুমবাজির, খুন খারাপিও তো হচ্ছে ব্যাপকহারে। বলা তো যায়না বাড়ির মায়া করতে গিয়ে শেষে প্রানটাই চলে গেলো...”

“ভাবা যায় আমাদের এই ছোটো শহরটাতেও প্রমোটারদের জুলুমবাজি কতো বেড়েছে, নাহলে বাবুয়ার বাবার মতো লোক অতো সুন্দর বাড়ি বাগান সব ছেড়ে দেন! আমার বড় ভয় করে আজকাল।” ভয়ার্ত গলায় বললেন সর্বানী দেবী।

“ঠিকই বলেছো; সে দিন হয়তো আর বেশি দূরে নেই যেদিন আমাদের বাড়িতেও হানা দেবে ওরা...।”

পড়ায় কিছুতেই মন বসাতে পারলো না তিতি। রাতে খাবার টেবিলে হওয়া কথা গুলো বারবার কানে বাজছে তার। শেষমেষ তাদের বাড়িটাও একদিন প্রমোটারদের খপ্পরে চলে যাবে! এটা ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হবে! চোখ ফেটে জল এলো তিতির। এই বাড়িটা তো শুধু তাদের কাছে বাড়ি নয়, এ বাড়িটা তাদের কাছে দাদাই আর ঠামুর শেষ চিহ্ন, বাড়িটার আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে ওদের স্মৃতি। কতো কষ্ট করে দাদাই বানিয়েছিলেন এই বাড়িটা সে গল্প তিতি অনেকবার শুনেছে ঠামুর মুখে।

কয়েকবছর আগে অবধিও কি সুন্দর ছিল এই জায়গাটা। ছোট বড় কত বাড়িতে ভর্তি ছিল। যে যার নিজের বাড়ি হলেও এক বাড়ির সাথে অন্যবাড়ির কি সুন্দর সম্পর্ক ছিলো আর এখন ওই বিশাল বিশাল ফ্ল্যাটবাড়ি গুলোতে মুখোমুখি থাকে সবাই অথচ কেউ কাউকে চেনে না, কেউ কারুর খোঁজ নেয়না, যে যার নিজের মতো থাকে। আর তিতিদের মতো যারা নিজেদের বাড়িতে আছে এখনো তাদের তো চেনার প্রশ্নই ওঠে না। পাড়াটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। প্রতিবেশীদের মধ্যে যে সহজাত ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল সেটা যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে।

রাত একটা বাজে। রোজ পড়া শেষ করে তিতির ঘুমোতে যেতে প্রায় দু’টা বেজে যায়; কিন্তু আজ পড়ায় মন বসছিলো না বলে তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো সে। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা, শুয়ে থাকতেও কেমন অস্বস্তি করছে। জল খাবে বলে উঠে বসলো তিতি, বোতলের জল শেষ। জল ভরতে যেতে হবে রান্নাঘরে। খাট থেকে নেমে বোতলটা তুলতেই ধুপ করে কোনো কিছু একটা পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলো তিতি। আওয়াজটা এসেছে বাইরের দিক থেকে। এতো রাত্রে এরকম আওয়াজ অস্বাভাবিক বৈকি। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো তিতি। সারাপাড়া অন্ধকার। টিমটিম করে জ্বলতে থাকা স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোটা ছাড়া আর কোনো আলোর চিহ্ন মাত্র নেই। তিতিদের বাড়ির উল্টোদিকের বাড়িটাই তাথৈদের, মাঝে শুধু একটা সরু রাস্তা। ওদেরও সারা বাড়ি অন্ধকার। যে আওয়াজটা পেয়েছিলো তিতি তার উৎসের কোনো সন্ধান করতে পারলোনা। বৃষ্টি হয়েছে বলে বেশ একটা ঠান্ডা ঝোড়ো বাতাস বইছে বাইরে আর তাতেই হয়তো কোনোকিছু উল্টে গিয়ে শব্দ হয়ে থাকবে। আসলে ছোটো থেকেই তিতির কান খুব তীক্ষ্ণ, সবাই বলে বিড়ালের কান। তাই অনেক দূরে হওয়া ছোটখাটো শব্দও ও ঠিক শুনতে পেয়ে যায়। এবারও সেরকম কিছুই হবে হয়তো। ছোটবেলায় পড়া সমরেশ বসুর গোয়েন্দা গোগোলের একটা গল্পের কথা মনে পড়ে গেল তিতির যেখানে ছোট্ট গোগোল “ইঁদুরের খুটখুট” শুনতে গিয়ে এক বড় ডাকাত দলকে ধরে ফেলেছিলো। তখন তিতিও মাঝে মাঝে ভাবতো সেও একদিন হয়তো এরকম শব্দ শুনে কোনো বড় অপরাধ রহস্যের সমাধান করে ফেলবে। সেই কথা মনে পড়তেই এখন নিজের ওপরে নিজেরই হাসি পেয়ে গেল।

রুমে ঢোকার আগে বেখেয়ালেই চোখটা চলে গেলো তাথৈদের বাড়ির দিকে আর তখনই….

তাথৈদের বারান্দায় দুজোড়া জ্বলন্ত চোখ, তিতির দিকেই যেন স্থির হয়ে আছে তার দৃষ্টি! “আঁ… আঁ…” মুখ থেকে সহসাই একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো তিতির আর আপনা থেকেই কয়েক পা পিছিয়ে গেল পেছন দিকে। তাথৈ তবে কালো বিড়ালটাকে ছাড়েনি, এটা নিশ্চয় ওরই চোখ হবে… জন্সির চোখ তো এত বিভৎস নয়।

চারিদিকে একটা কুয়াশার আস্তরণ চেয়ে গেছে। অন্ধকারের মধ্যেই জমাট বাঁধা সাদা কুয়াশা পরিবেশটাকে কেমন যেন আচ্ছন্ন করে তুলছে। তিতির শরীরটাও যেন সেই আচ্ছন্নতায় মেতেছে, পা দুটো যেন আটকে গেছে এই ব্যালকনিতে। রুমে ফেরার শক্তি নেই। চারিদিক নিস্তব্ধ, এতো রাত্রে সবাই যখন ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে তিতি তখন জেগে, সম্পূর্ণ একলা দাঁড়িয়ে এই মোহময়ী আবেশে। হঠাৎ করে নিস্তব্ধতার মধ্যেই সাঁ সাঁ করে একটা রব উঠলো; নিস্তব্ধতা পুরোপুরি ভাঙলো না বটে কিন্তু শব্দটা তিতির কর্ণকুহরে এসে যেন বিঁধে গেল। কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে নীচের দিকে তাকিয়েই চমকে গেল তিতি। দশ পনেরোটা কুকুর একসাথে হেঁটে চলেছে দল বেঁধে অথচ কারুর মুখে টুঁ শব্দ নেই। এমন আশ্চর্য দৃশ্য তিতি আগে কোনোদিনও দেখেছে কিনা সন্দেহ। একটা কুকুরও কোনো শব্দ করছেনা মুখে, যেন কোনো মন্ত্রবলে কেউ ওদের বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছে। তিতির গা টা শিরশির করে উঠলো, অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলো তিতি।

দলের শেষ কুকুরটা হঠাৎ করে থেমে গিয়ে সোজা তাকালো ওপরের দিকে, তার চোখ তিতির চোখে… নাহ সে চোখে কোনো হিংসা নেই, রাগ নেই, রয়েছে কেমন যেন একটা অসহায়তা। সে যেন তার মৌন দৃষ্টি দিয়ে তিতিকে ডাকছে কাছে। তিতির পা দুটো হঠাৎ যেন আলগা হয়ে গেল, কোনো এক মোহের বশে ও সিঁড়ি বেয়ে সোজা নিচে নেমে এলো। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। কুকুরটা যেন ওর অপেক্ষাতেই ছিল। সে এবার হাঁটা লাগালো। তিতিও কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে এগিয়ে যেতে থাকলো কুকুরটাকে অনুসরণ করে। সে যেন নিজের মধ্যে আর নেই, কুকুরটা যেন ওকে নিজের দৃষ্টি দিয়ে সম্মোহিত করে ফেলেছে। এগোতে এগোতে কখন যেন ও পৌঁছে গেছে আজ বিকেলের সেই কনস্ট্রাকশন সাইটটায়। সেখানে একটা জায়গায় সারবেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে সব কুকুরগুলো। তিতির পথ প্রদর্শক কুকুরটাও গিয়ে যোগ দিলো তাদের সাথে। ওরা সবাই মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছে। তিতিও মুখ তুলে ওপরে চাইলো… আর তাতে যে দৃশ্যটা সামনে দেখলো সেটা দেখার জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। অসম্পূর্ণ ফ্ল্যাট বাড়িটার দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে তিনটে লম্বাটে সূঁচাল রড আর সেই তিনটে থেকে ঝুলছে তিনটে কুকুরের মৃতদেহ। সূঁচাল জিনিটা ওদের গলা এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে আর সেই ক্ষত স্থান থেকেই অবিরত ঝরে যাচ্ছে রক্ত। নিচের সিমেন্টের চাতালটা হয়ে উঠেছে লালে লাল। আশ্চর্য এই টুকু দেহ গুলোতে এতো রক্ত ছিল!

এই পৈশাচিক দৃশ্যে তিতির সমস্ত সম্মোহন যেন আচমকাই ভেঙে গেলো আর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো এক তীক্ষ্ণ আর্তনাদ… সে আর্তনাদ নিমেষেই রাত্রের সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে দিলো… আকাশ বাতাস ভেদ করে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো চারিদিকে…

ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো তিতি। ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। চট করে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো সে… এই তো তার রুম… তার বিছানা… উফফ পুরোটাই তাহলে স্বপ্ন ছিলো। এমন বিভৎস স্বপ্ন আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়লো না। মা ইতিমধ্যেই ছুটে এসেছেন, “কি হলো রে! চিৎকার করে উঠলি কেন!”

“খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখলাম মা।”

“উফফ এতো বড় হয়েছিস এখনও…!” সর্বানীদেবীর কথাটা শেষ হলো না, তার আগেই তাথৈদের বাড়ির থেকে ভেসে এলো একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার। সে চিৎকারের সাথে তিতির স্বপ্নের চিৎকারটার বোধহয় বিশেষ পার্থক্য ছিলো না। রাত্রে তিতি ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল, তাই বোধহয় চিৎকারটা আরও স্পষ্ট ভাবে শোনা গেল। মা মেয়ে মুহূর্তের জন্য চোখের দৃষ্টি বিনিময় করে ছুটলেন তাথৈদের বাড়ির উদ্যেশ্যে।

তাথৈদের গেটে ঢুকতে ঢুকতে তিতি দেখতে পেলো ওদের বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে, সবার চোখমুখ আতঙ্কগ্রস্ত। তাথৈ ওর মা কে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে রেখেছে মায়ের শাড়িতে, শরীরটা ওর তিরতির করে কাঁপছে। বাকি সবার দৃষ্টি বাগানের দিকে। তিতি আর সর্বানী দেবী কিছুটা অবাক হয়েই বাকিদের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল বাগানের দিকে আর সঙ্গে সঙ্গে ওদের দুজনের গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা মিশ্র আর্তনাদ।

তাথৈদের বারোমাসা শিউলি গাছটার একটা শুকনো সূঁচাল ডাল থেকে ঝুলছে তাতানের প্রিয় পোষ্য জনের দেহটা… ডালটার সূঁচাল অংশটা ঢুকে গেছে জনের গলা ভেদ করে… সেখান থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে নীচে… ঠিক যেমনটা তিতি আজ ভোরের স্বপ্নে দেখেছিলো… মাটিতে পড়ে থাকা সাদা শিউলি ফুল গুলোর গায়ে লেগেছে লাল রঙ।

“আমি বলেছিলাম… কতবার বলেছিলাম এই অপদটাকে ঘরে তুলিস না... তুলিস না… শুনলি আমার কথা? দেখলি তো যে দিন এলো সেদিন রাতেই কি কান্ড ঘটলো!”

“আহ শ্রাবনী… মেয়েটা একেই ভয় পেয়ে আছে তুমি আবার তার ওপর বকাঝকা করছো কেন! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে একটা একফুটের বিড়াল জনের দেড় ফুটের শরীরটাকে ওই ডালটায় তুলে ফেললো!”

“আমি সেটা বলতে চাইনি, আমি বলছি কালো বিড়ালকে লোকে বলে অমঙ্গলের দূত, আর সত্যিই দেখলে তো ওটা আসার পর কি ঘটে গেলো!”

“এসব কুসংস্কারের কথা ছাড় না। আগে ভাবতে হবে কাজটা করলো কে?”

“ভাবাভাবির আর কি আছে? তিতি তো বললো ও কাল রাতে একটা আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলো, নিশ্চয় কেউ চুরি করতে ঢুকেছিলো আর জন বাধা দিতে যেতেই…”

“সবই হলো কিন্তু জন কোনো চিৎকার করলো না কেন? নাকি ওর চিৎকার আমরা শুনতে পেলাম না! আর জন তেড়ে গেলে চোর তো ভয়ে পালাবে তা না করে সে জনকে এভাবে… উফফ ভাবলেই শিউরে উঠছি… কি বিভৎস!”

“শিউলি গাছটার দিকে তাকালেই যেন গা ছমছম করছে। নীচটায় কতো জল ঢাললাম তাও যেন রক্তটা ধোয়া হলোনা। ওখানের মাটিটা খুঁড়ে ফেলতে হবে।”

“গাছটাও কেটে দেব।”

“সেই ভালো। কতো সাধ করে কত খুঁজে পেতে গাছটা লাগিয়েছিলাম আর ওটাতেই এরকম ঘটতে হলো!”

“আচ্ছা শ্রাবনী কিছুই তো খোয়া যায়নি তাই না?”

“হ্যাঁ, সেরকম কিছু তো বুঝতে পারছি না খোয়া গেছে বলে।”

“সেটাই তো আশ্চর্য! চোর এলো, জনকে এভাবে শেষ করে দিলো অথচ কোনো চুরি করলো না!”

“আচ্ছা এমন নয় তো যে কোনো ডাকাত দল আমাদের বাড়িটা টার্গেট করছে আর তাই বাড়ির কুকুরটাকে আগে ভাগে সরিয়ে দিল?”

“কি যে বলোনা শ্রাবনী! জনের মতো একটা বাচ্চা কুকুরকে ডরাবে একটা ডাকাত দল? ধুরর… ডাকাত দলই যদি হতো তাহলে আগে থেকে এরকম একটা পুঁচকে কুকুরকে মেরে আমাদের সাবধান করে যেতনা।”

“কে জানে বাবা! সব সম্ভাবনাই যদি অসম্ভব মনে হচ্ছে তাহলে সত্যিটা কি!”

আজ রবিবার, ছুটির দিন। অন্যান্য সময় এই দিনটা কতো আনন্দে কাটে কিন্তু আজ পরিস্থিতি অন্য। সারাদিন প্রায় কিছুই খেতে পারেনি তিতি, খেতে গেলেই সকালের দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বিকেলের দিকে তাথৈদের বাড়ি গেলো তিতি। শিউলি গাছটার দিকে তাকাতেই ওর যেন মনে হলো জন এখনো ঝুলে আছে ওখানে। তাড়াতাড়ি চোখটা ফিরিয়ে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলো ও। ঢুকতেই দেখতে পেল তাথৈ সোফায় মুখ গুঁজে শুয়ে আছে, ক্ষণে ক্ষণে ওর শরীরটার কেঁপে ওঠা দেখে তিতি বুঝতে পারলো তাথৈ কাঁদছে। আস্তে করে গিয়ে বসল তাথৈ এর পাশে, তারপর আলতো করে ওর পিঠে হাত রাখলো। তাথৈ মুখ তুলে দেখলো ওকে। তিতি নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”

“তিতিদিদি জানো তো মা না জন্সি আর ন্যান্সিকে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছিল।”

“ন্যান্সি?”

“নতুন বিল্লিরানীটা।”

“ওহ… আমি তো তোকে কালকেই বললাম ওটাকে ঘরে না রাখতে কিন্তু তুই শুনলি না।”

“মাম্মাম বলছে যে ন্যান্সির জন্যই নাকি জন মরে গেছে। আচ্ছা তিতি দিদি ন্যান্সি কি করল যে জন মরে গেলো?”

একটা সাত বছরের শিশুর এই সরল প্রশ্নের কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলোনা তিতি। সে নিজেও বলছে কালো বিড়ালটাকে ঘরে না রাখতে কিন্তু কেন বলছে তার কোনো উত্তর নেই নিজের কাছেই।

“আচ্ছা তাথৈ জন্সিকে কেন বের করে দেবেন কাকিমা? জন্সি আবার কি করলো?”

“মাম্মাম বলছে এসব কুকুর বেড়াল আর ঘরে রাখতে দেবেনা। মাম্মাম তো ওদের বেরই করে দিয়েছিলো। আমি আবার তুলে এনে লুকিয়ে রেখেছি।”

“কোথায়!”

“জন্সি আমার ঘরে আছে আর ন্যান্সি দাদাভাইয়ের।”

“কাকিমা জানলে কিন্তু খুব বকবেন।”

“জানি, কিন্তু আমি ওদের কোত্থাও যেতে দেবোনা।”

হঠাৎ করেই সোফার থেকে ঝুলে থাকা তিতির পায়ে একটা নরম স্পর্শ অনুভূত হতে নিচের দিকে তাকাল ও, দেখলো সেই কালো বিড়ালটা কখন যেন এসে ওর পায়ে নিজের গা ঘসছে। আতঙ্কে পা টা সোফায় তুলে নিলো তিতি। এতক্ষণে তাথৈয়েরও নজর পড়েছে বেড়ালটার দিকে। সে খপ করে বিড়ালটাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো, “খুব দুস্টু হয়েছ তুমি, জানো না মাম্মাম দেখলে কি হবে? চলো ঘরের মধ্যে থাকবে চলো।”

তাথৈ বিড়ালটাকে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ তিতির নজর গেল বেড়ালটার পায়ের দিকে... একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল ওর সারা শরীরে। বিড়ালটার নখ গুলো লাল হয়ে আছে… কেন? রক্ত?

তাথৈদের বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে তিতির কেমন যেন একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে! ওই কালো বেড়ালটার নখে রক্তের দাগ গুলো কিভাবে এলো! তাতানকে বলতে সে তো স্রেফ উড়িয়ে দিলো; বললো গাছের তলায় ঘুরতে গিয়ে হয়তো লেগে গেছে। হ্যাঁ সেটাই হয়তো ঘটেছে কিন্তু তাও তিতির মন থেকে অস্বস্তিটা যাচ্ছেনা কিছুতেই। তাথৈ বলছিলো কাল নাকি জন, জন্সি আর ওই কালো বেড়ালটার মধ্যে খুব ঝগড়া হচ্ছিল। কিন্তু আজ অবধি জন্সি আর জনের মধ্যে কখনো তো ঝগড়া হতে দেখেনি তিতি, ওই নতুন বেড়ালটার জন্যই এসব হলো। নয়তো জনকে হয়তো এভাবে মরতে হতো না। ও আর জন্সি একসাথেই রাতে ডাইনিং এর ম্যাটে ঘুমাতো কিন্তু কাল তিন জনে ঝগড়া করছিল বলে ওদেরকে আলাদা আলাদা জায়গায় শুইয়েছিল তাথৈ। কাকিমা ঠিকই বলেছেন হয়তো ওই কালো বেড়ালটার জন্যই হয়তো এরকম হলো। কি হিংসুটে চোখ মুখ ওটার!

আজও রাত্রে ঘুম আসছেনা কিছুতেই। ইউটিউবে নিজের প্রিয় কার্টুন সিনচ্যানের ভিডিও দেখতে বসলো তিতি। কিন্তু নাহ আজ সিনচ্যানও ওর মন ভোলাতে পারছেনা। চোখের পলক পড়লেই যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কালকের দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আর সেই সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠছে আজ সকালে দেখা জনের মৃত্যুর দৃশ্যটা। আশ্চর্য একটা স্বপ্নের সাথে বাস্তবের এতো মিল!

রাত এখন প্রায় আড়াইটা। তিতির মনে হলো ওর রুমের উল্টোদিকে থাকা তাথৈদের ব্যালকনিটায় যেন কেউ এসে দাঁড়ালো। কে হতে পারে! তাতান! সেই হবে হয়তো। তার তো মন মেজাজ ভালো নেই। যে জনকে এতো ভালোবাসতো আজ সকালে তারই এরকম বিভৎস মৃত্যু দেখে স্থির থাকাটা বড়ই শক্ত। কিন্তু তাতান হঠাৎ নিজের রুম ছেড়ে ওর মা বাবার বেডরুমের ব্যালকনিতে এসে কেন দাঁড়াতে যাবে! কাকু তো বাড়ি নেই, ডিউটি গেছেন। তাহলে কি কাকিমা! কিন্তু এতো রাতে… নাকি অন্য কোনো ব্যাপার? তিতি জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ভালো করে… হ্যাঁ… ওই তো স্পষ্ট কেউ যেন নড়ছে ব্যালকনিতে… ছটফট করছে মনে হচ্ছে… খাট থেকে একলাফে নামলো তিতি। দরজা খুলে সোজা ছুটে গেল ব্যালকনিতে আর তখনই ধুপ করে একটা আওয়াজ।

তিতির দরজা খোলার সময়টুকুর মধ্যেই তাথৈদের ব্যালকনিতে থাকা ছায়ামূর্তিটা কোথায় যেন অন্তর্হিত হয়েছে। রুমের মধ্যে ফিরে যাচ্ছিল তিতি কিন্তু হঠাৎ কি মনে হতে ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে নিচে রাস্তার দিকে তাকালো আর যা দেখলো তাতে ওর সারা শরীর জুড়ে একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে গেল... টিমটিমে স্ট্রিট ল্যাম্পটার হালকা আলোয় অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পেলো রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে একটা শরীর… প্রাণ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু দেহটার থেকে একটা কালচে তরল বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় কালচে দেখালেও তিতি জানে ওটার রং লাল...

“মিস মিত্র আপনি অতো রাত্রে ব্যালকনিতে কি করছিলেন?”

“আ… আমার মনে হয় যে ওদের ব্যালকনিতে কেউ রয়েছে তাই সেটা দেখার জন্য…”

“থাকতেই পারে কিন্তু তা বলে আপনি অতো রাত্রে ব্যালকনিতে দেখতে চলে গেলেন যে ওদের ব্যালকনিতে কে আছে? ব্যাপারটা কি বলুন তো?”

“আমি সত্যি বলছি। আগের দিন কুকুরটার ওভাবে মৃত্যু… আমি ভয় পেয়েই দেখতে গিয়েছিলাম।”

“ভয় পেলে তো লোক নিজের ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে যায় আর আপনি কিনা বাইরে চলে এলেন। তবে তো বেশ সাহসী বলতে হয় আপনাকে।”

………………………………………………………………..

পুলিশি জেরা যে কি পরিমান ভয়ঙ্কর হতে পারে তা আজ মর্মে মর্মে টের পেলো তিতি। ওই দীর্ঘ জেরার প্রতি মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছিল পুলিশ যেন ওকেই দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যস্ত। অথচ কাল তিতি যদি না বেরোত তাহলে শ্রাবনী কাকিমা হয়তো … যদিও এখনো কি ঘটবে ডাক্তাররা কিছুই বলতে পারছেন না। কি করে হলো এসব! কাল জন, আজ কাকিমা! আর দুটো হামলার পদ্ধতিতেও কি মিল! সেই একই রকম ভাবে গলাতে সূঁচাল জিনিস বিদ্ধ করে দুজনকেই আঘাত করা হয়েছে। জনকে শিউলি গাছের সূঁচাল ডালে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল আর কাকিমার গলায় কিচেন নাইফ। তিতির মনে দৃঢ় বিশ্বাস ওর দরজা খোলার আওয়াজ পেয়েই হয়তো আততায়ী চটজলদি পালাতে যায় আর তাই ছুরিটা এফোঁড় ওফোঁড় বিঁধতে পারেনি, তার আগেই নীচে ফেলে দেয় কাকিমাকে। তিতি ভাবে আগের দিন যদি জনকে ওই অবস্থায় না দেখতো তাহলে হয়তো আজ কাকিমাকে ওরকম ভাবে দেখে নিজের নার্ভ স্ট্রং রাখা কঠিন হয়ে পড়তো। কিন্তু একটা ব্যাপারে তিতির ধোঁয়াশা কিছুতেই কাটছেনা সেটা হলো, না তাথৈ-তাতান কোনো শব্দ শুনেছিল, না তিতি। তিতি তো প্রায় নিজের সামনেই ঘটতে দেখেছিলো ঘটনাটা কিন্তু কাকিমাকে একবারও তো চিৎকার করতে শোনেনি! এ কি করে সম্ভব! আগের দিন জনও কোনো চিৎকার করেনি আর কাল কাকিমাও না। আততায়ী কি এমন কিছু করছিল যাতে ওদের গলার স্বর ফুটছিলো না! তিতির আবার মনে পড়ে গেলো ওর স্বপ্নের কথাটা। সেখানেও তো কুকুরগুলো মুখে কোনো শব্দ ছাড়াই হাঁটছিল আর তিতিও সম্মোহিতের মতো কোনো শব্দ না করেই ওদের অনুসরণ করেছিলো। একবার কোথাও যেন তিতি শুনেছিল যে অনেক সময় স্বপ্ন নাকি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়ে যায়। তবে কি সেটাই সত্যি নাকি তিতি শুধু শুধুই স্বপ্নের সাথে ঘটনা দুটোকে মেলাবার চেষ্টা করছে?

মা এখন হসপিটালে আছে। তাথৈদের কোনো আত্মীয় এখনো এসে পৌঁছাতে পারেনি, তাই প্রতিবেশীরাই ভরসা এখন। মাত্র কটা বাড়িই তো শুধু অবশিষ্ট আছে এ পাড়ায়। বাড়িতে তাথৈ আর তাতান একলা, ঠিক একলা নয় অবশ্য, জন্সি আর ন্যান্সি আছে। ওদের বাড়ি এসেছে তিতি; এইমুহূর্তে তাথৈ আর তাতানকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা ও। কারুর মা যখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে তখন তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কি হতে পারে সেটা জানা নেই তিতির। একটু আগেই বাবা হসপিটাল থেকে ফিরে জানালেন অবস্থা অবনতির দিকে। তাথৈ আর তাতান অবশ্য এখনও জানেনা সে কথা।

তিতিকে দেখতে পেয়েই ওকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো তাথৈ। তাথৈ এর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তাতানের দিকে তাকিয়ে তিতি জিজ্ঞেস করলো, “কিছু খেয়েছিস তোরা?”

“আর খাওয়া! গলা দিয়ে কিছু নামবে না রে...

ওফফ আমার মাম্মামের গলাটা….

তিতি বলনা আমার মাম্মাম কার কি ক্ষতি করেছিল যে আমার মাম্মামকে…”

“শান্ত হ তাতান। তুই এভাবে ভেঙে পড়িস না, তাথৈ তো আরো ভেঙে পড়বে।”

“কি করে হলো এসব? কেন হলো?”

“জানিনা। আশ্চর্য কথা যে দু দুটো দিনই আমি বেরিয়ে এলাম কিন্তু না কাউকে রক্ষা করতে পারলাম আর না যে এসব করলো তাকে দেখতে পেলাম।”

“তুই সত্যি কাউকে দেখতে পাসনি?”

“একই কথা বারবার কেন জিজ্ঞেস করছিস তাতান? পুলিশ জেরা করে করে মাথা খারাপ করে দিলো তারপর তুই! আমার তো নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে এখন!”

“সেটা নয় তিতি। আমি বুঝতে পারছিনা কে কিভাবে বাড়িতে ঢুকে এসব কান্ড ঘটাচ্ছে আর অন্য কেউ টেরই পাচ্ছিনা। পরশু রাতে বাড়ির দরজা বন্ধ, বৃষ্টি হয়েছিল বলে জানালাও বিশেষ খোলা ছিলোনা। শুধু ড্রয়িং রুমে একটা জানালাই খোলা ছিল। সেটা দিয়ে জন বেরোতে পারে ঠিকই কিন্তু কোনো মানুষ তো ঢুকতে পারবেনা! আর জন শুধু শুধু বেরোতেই বা যাবে কেন!

আর কালকে মাম্মাম… বাবা বাড়ি না থাকলে মাম্মাম আরও ভালো করে দরজা জানালা লাগায়, রাত্রে তো ব্যালকনির দরজাও লাগানো থাকে। তাহলে কে এলো! কিভাবেই বা এলো!”

“কাকিমা অতো রাতে ব্যালকনিতে গেলেনই বা কেন? কিছু কি দেখতে পেয়েছিলেন উনি!”

“দাদাভাই… তিতি দিদি… কোনো ঘোস্ট আসেনি তো রাতে যে জন আর মাম্মামকে!” আবার কেঁদে ফেললো তাথৈ।

তাথৈএর এই নিরীহ প্রশ্নে তিতি আর তাতান দুজনেই চমকে উঠলো। কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকার পর তাতান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সত্যিই সব যেন অশরীরী কান্ড…”

“তিতি দিদি আমার মাম্মাম ঠিক হয়ে যাবে তো?”

তাথৈ এর কথার কোনো উত্তর দিতে পারলোনা তিতি, হসপিটাল থেকে ফিরে এসে বাবার বলা কথা গুলো মনে পড়তেই ওর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো শুধু।

তিনদিন কেটে গিয়েছে। শ্রাবনী দেবীকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে, ফেরার আর কোনো আশা নেই বললেই চলে। তবুও রোজগার চলছে প্রার্থনা, মানত, ভগবানের ওপর ভরসা রাখার প্রচেষ্টা। তাথৈদের দিদা, মাসিমনি, পিসিমনি, কাকু সবাই এসেছেন। সেদিন ওদের বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে তিতি আর যায়নি ও বাড়ি। এখন সব খবর মায়ের কাছ থেকে নেয়। সেদিন তাথৈএর শেষ প্রশ্নটা ওর বুকে যেন শলাকার মতো বিঁধে আছে, কোনো উত্তর দিতে পারেনি সেদিন। তিতি জানেনা কিভাবে গিয়ে মুখোমুখি হবে ওই সাত বছরের শিশুটার! কিভাবে গিয়ে মুখোমুখি হবে নিজের ছোটবেলার প্রিয় বন্ধু তাতানের! নিজের মধ্যেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তিতির। এক অদ্ভুত অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছে মন... মনে হচ্ছে সেদিন কি আরেকটু সক্রিয় হলে দেখতে পেতো আততায়ীকে?

আজ তিনদিন রাত্রে তিতি ভালো করে ঘুমোয়নি বললেই চলে। রোজ একটা থেকে তিনটা তিতি চোখ রেখে বসে থাকে তাথৈদের ব্যালকনির দিকে, কানটাকেও সজাগ রাখে। ওর মনে কেমন যেন একটা দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে আততায়ী আবার ফিরবে। এই বিশ্বাসের হয়তো কোনো ভিত্তি নেই তাও ও অপেক্ষায় থাকে। পুলিশের তদন্ত আদৌ অগ্রসর হচ্ছে কিনা কিছুই জানা যায়নি। আরও কয়েকবার তারা এসে তিতিকে কয়েক প্রস্থ জেরা করে গেছে। অন্যদের জেরা করলেও তাদের মেইন টার্গেট যেন তিতি। বাবা বলছেন তিতি সাক্ষী ছিল বলে হয়তো ওকে এতো জেরা করছে, কিন্তু তিতির মনে হয় ওরা বোধহয় ওকেই অপরাধী ভাবছে।

ঘড়ির কাঁটায় ঠিক রাত আড়াইটা। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা রাতপাখি ডেকে উঠলো। তারপর আবার সব নিস্তব্ধ। তিতির চোখটা একটু লেগে এসেছিল, তখনই খুট করে একটা হালকা আওয়াজ হলো। অন্য কেউ হলে হয়তো শুনতে পেতনা কিন্তু তিতির কানে ঠিক ধরা পড়লো শব্দটা। ও চমকে উঠে চোখ খুলে দেখলো হ্যাঁ ওই তো তাথৈদের ব্যালকনির দরজা খোলা, সেখানে অন্ধকারের মধ্যে একটা অবয়ব নড়াচড়া করছে, ছটফট করছে বলাই ভালো। নাহ আজ আর তিতি দেরি করবে না। চটজলদি নিজের ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে কিছু না ভেবেই চিৎকার করতে শুরু করলো ও। তিতির চিৎকার শুরু হতেই তাথৈদের ব্যালকনিতে ছটফট করতে থাকা ছায়া মূর্তিটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। আর তখনই তিতি নজর করলো এমন কিছু যা দেখে সহসাই ওর সব চিৎকার নিমেষে থেমে গেল।

তিতির চিৎকারে ওর নিজের বাড়ির লোক থেকে শুরু করে তাথৈদের বাড়ির সবাই মোটামুটি জেগে উঠেছে। আশেপাশের বাড়ি গুলোতেও আলো জ্বলে উঠলো। তিতির ইশারায় তাথৈদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল ব্যালকনিতে পড়ে রয়েছে তাথৈ এর কাকিমার সংজ্ঞাহীন দেহটা; গলায় কাছে একটা কাটা দাগ, কোনো সূঁচাল বস্তুকে গলায় চেপে ধরলে যেমন হয় সেরকম। ক্ষত স্থান থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে, তবে ক্ষতটা বিশেষ গভীর নয়। হয়তো তিতির চিৎকারের জন্যই আততায়ী বেশিকিছু করার সময়টা পায়নি।

আজ সকালেই তাথৈএর মাসিমনি আর পিসিমনি বাড়ি চলে যান তার বদলে আসেন তাথৈ এর কাকিমা। কুকুর বিড়াল একদম সহ্য করতে পারেননা বলে কাকিমা পারত পক্ষে তাথৈদের বাড়ি আসাটা এড়িয়েই চলতেন কিন্তু এবার বাধ্য হয়ে এসেছিলেন। কাকু তো আগে থেকেই ছিলেন এখানে। রাতে তাথৈ আর কাকিমা তাথৈ এর মায়ের ঘরে ঘুমাচ্ছিল আর তাতান ও কাকু ছিল অন্য ঘরে। সবাই এখন একটা ব্যাপারেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে যে একই ঘরে থাকা সত্ত্বেও তাথৈ কোনো শব্দই শুনতে পেলোনা! আর শ্রাবনী কাকিমার মতোই এই কাকিমাকেও তিতি ছটফট করতে দেখলেও চিৎকার বা কোনো রকম কোনো শব্দ করতে শোনেনি।

তাথৈ এর কাকিমাকে হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হলো। চোখে মুখে জল দিতে তাঁর সংজ্ঞা ফিরলেও কিছুই মনে করতে পারছিলেননা। এমনকি কোনো কথাই বলেতে পারছিলেননা। তিতিও যেন নিজের বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। একের পর এক প্রশ্নবান ওর দিকে নিক্ষিপ্ত হলেও ও নিরুত্তর। তবে তিতির পরিবর্তনের দিকে কেউ বিশেষ একটা আমল দিলোনা এই মুহূর্তে।

সকাল হতেই তাথৈ এর কাকু কাকিমাকে নিয়ে চলে গেলেন তাঁদের নিজেদের বাড়ি। কাকু বললেন এই বাড়িতে আর ফিরবেন না। হসপিটাল থেকে কাকিমার গলায় ব্যান্ডেজ করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁকে দিয়ে একটাও কথা বলানো যায়নি। হসপিটাল থেকে কোনো ভালো সাইকোলজিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এবার এই ঘটনার পর কাকু যে আর এক মুহূর্তও এবাড়িতে থাকতে রাজি হবে না তা তো জানাই ছিল। ফোনে এই ঘটনা শোনার পর অন্য আত্মীয়রাও নানা অছিলায় এড়িয়ে যাচ্ছে তাথৈদের। তিতির মা ওকে বারণ করে দিলেন তাথৈদের বাড়ি যাওয়ার জন্য। সবার মনে কেমন একটা ভয় জন্মে গেছে… কেউ কিছুই বুঝতে পারছেনা অথচ একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে! কোথাও কোনো প্রমাণ নেই, কোনো কারণ নেই তাও ঘটছে। ঘটনাটা শুধু তাথৈদের বাড়িতে ঘটলেও গোটা পাড়া জুড়েই একটা আতঙ্কের আবহাওয়াটা ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ তো আবার বলা শুরু করেছে কোনো মানুষ না এ কোনো বিদেহীর কাজ। তাথৈএর দিদা এসে ন্যান্সিকে দেখেই আঁতকে উঠেছিলেন এবং তারপর তাকে বের করে দেন বাড়ির বাইরে। ন্যান্সিকে ইদানিং তিতিদের বাড়ির আশে পাশে বেশি ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছে।

অন্ধকারের মধ্যে বারান্দার দোলনায় বসে আছে তিতি। তাথৈ দের বাড়ি যাওয়া আপাতত বন্ধ ওর। মা গেছেন সেখানে। তিতির মনটা কেমন উদাস লাগে আজকাল। সেদিনের ঘটনার পর কারুর সাথে আর কথা বলতে পারেনা। একটা আতংক এসে যেন ওর সারা শরীরে সাপের মত পেঁচিয়ে বসে আছে। পরপর তিনটে এমন বিভৎস ঘটনার সাক্ষী থাকার পর শরীর ও মন দুটোই বিদ্রোহ করতে লেগেছে।

একটা মৃদু বাতাস বইছে এসময়। আরামে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো তিতির।

“ম্যায়াও”....

“ন্যান্সি!” সন্ধ্যের অন্ধকারে যদিও ঠিক ঠাহর হলো না তবুও মনে হলো যেন ন্যান্সিই।

প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ন্যান্সি তিতিকে ভ্রূক্ষেপ করল কিনা বোঝা গেলো না তবে এক লাফে সোজা ঢুকে গেল তিতিদের বাড়ির ভেতরে। তিতিও ছুটলো তার পেছন পেছন। রান্নাঘরের দরজা খোলা, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিতির বাবা।

“বাবা একটা বিড়াল ঢুকেছে বাড়িতে, দেখেছ তুমি?”

দুদিকে মাথা নাড়লেন অম্বরিশ বাবু। তিতি আবার বেরিয়ে যাচ্ছিল বাগানে কিন্তু হঠাৎ মনে হলো মা বাবার রুমের থেকে কোনো একটা আওয়াজ আসছে। তিতি ছুটলো সেদিকে। মা বাবার রুমে ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেল তিতি, বাবা তো এখানে বসে অনেক ফাইল নিয়ে কাজ করছেন, এমনকি কাজে এতটাই ডুবে আছেন যে তিতির উপস্থিতি টেরই পেলেননা। বাবা এখানে, তাহলে রান্নাঘরে কে ছিল!

তিতি আবার ছুটলো রান্নাঘরে, দুধের কড়া মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে… মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে একটা তরল… তরলটার রং হলুদ… “মিঁয়াও”... চমকে উঠলো তিতি, জানলার গ্রীলের ফাঁক গলে দৃষ্টি গেল বাইরের দিকে। প্রাচীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে, সোজা তাকিয়ে আছে তিতির চোখে… ওর চোখ দুটো জ্বলছে... ঠিক যেমনটা তিতি জ্বলতে দেখেছিলো জনের মৃত্যুর দিন রাত্রে। গোঁ গোঁ শব্দ করে সংজ্ঞা হারালো তিতি।

“তিতি চল টিউশন যাই, অনেকদিন যাওয়া হয়নি।”

মুখ তুলে তাকালো তিতি, সামনে দাঁড়িয়ে তাতান। কি অবস্থা হয়েছে ওর! মুখটা ফোলা, চোখের তলায় কালি, একমুখ দাড়ি! যে ছেলেটা রোজ সেভ করতো তার আজ এ কি অবস্থা! অবশ্য তিতি নিজে আজ কয়েকদিন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি একবারও, নয়তো দেখতে পেতো দীর্ঘদিন অনিদ্রার ফল হিসেবে ওরও চোখের তলায় জমেছে কালি, বসে গেছে চোখ।

“কিরে তিতি যাবিনা টিউশন?”

তাতানের প্রশ্নের কি উত্তর দিতে হয় জানেনা তিতি, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে তাতানের মুখের দিকে।

“কি রে কিছু বলল?” সর্বানীদেবী উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

তাতান হতাশ গলায় উত্তর দিল, “নাহ।”

তিতির কাঁধে হাত রাখল তাতান, কেঁপে উঠল তিতি। তারপরেই হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

সর্বানীদেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “দেখছিস তো কি অবস্থা, কত লোক কতরকম কথা বলছে। ডাক্তারের কাছে যে নিয়ে যাবো সেটাও তো পারছিনা। নিজের রুম থেকে তো নড়তেই চাইছেনা...” কেঁপে উঠলো সর্বানীদেবীর গলাটা।

তাতান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তিতির দিকে। ওর চোখে মুখে আজ এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, তাতানের বিশ্বাস পারলে তিতিই পারবে ওর মাম্মাম, কাম্মা আর জনের অপরাধীর ওপর আলোকপাত করতে। তিতি নিশ্চয় সেদিন এমন কিছু দেখেছিলো যার জন্য ও এতটা শক পেয়েছে। কিন্তু কথা না বললে তো কিছুই জানা যাবেনা।

তাতান হঠাৎ করেই তিতির দুই কাঁধে হাত দিয়ে ওকে ঝাঁকাতে আরম্ভ করলো আর অনবরত বলতে লাগলো, “পড়তে যেতে হবে… চল… অনেক দিন বন্ধ হয়েছে… কত পড়া এগিয়ে গেছে, সামনে সেম… চল… ঘরে বসে আরাম করলে চলবে না… চল…তিতি ওঠ...”

কেটে কেটে এই একই শব্দ গুলো বারবার বলতে থাকলো তাতান, একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে তিতির মনের হারিয়ে যাওয়া সচেতনতাটাকে এভাবেই ফেরাবার চেষ্টা করতে লাগলো। এর বেশি আর কোনো উপায় যে ওর জানা নেই। কিন্তু নাহ… তিতির কোনো উত্তর নেই। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলো তাতান। সর্বানীদেবীর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু, সর্বানীদেবীর দুচোখ বেয়ে নামছে জলের ধারা।

“যাবো।”

হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে রোবটের মত যান্ত্রিক গলায় কথাটা বলে উঠলো তিতি। প্রথমে অবাক হলেও মুহূর্তের মধ্যে সর্বানীদেবী আর তাতানের চোখে মুখে এক আনন্দের আবেশ খেলে গেল।

বহুদিন পর টিউশনে আসছিল তাই আসার আগে একবার ফোন করে আসা উচিৎ ছিল কিন্তু অতো কিছু ভেবে কাজ করার মতো মানসিক অবস্থা তাতানের ছিল না। আসলে আজ ওর উদ্দেশ্য টিউশনি পড়ার থেকেও বেশি ছিল তিতিকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা এবং তারপর ওর সাথে কথা বলা। পুলিশ কি করছে না করছে জানেনা তাতান কিন্তু ও নিজে এখন ওই অপরাধীকে খুঁজে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাকে পেলে ও আগে জানতে চাইবে কেন তার এতো আক্রোশ ওর পরিবারের ওপর, তার কি ক্ষতি করেছে ওরা!

স্যারের বাড়ি গিয়ে জানতে পারলো স্যার এই সপ্তাহটা পড়াবেন না, অগত্যা তাই সাইকেল ঘোরাতে হলো। কিন্তু ইতিমধ্যেই আকাশের কোণে জমতে শুরু করেছে কালো মেঘ, সাথে বইছে ঝোড়ো হওয়া। কিছুক্ষণ আগে অবধিও আকাশ পরিষ্কার ছিল অথচ এখন বিচ্ছিরি অবস্থা; এই ধুলোর ঝড় ঠেলে বাড়ি ফেরা মুশকিল।বাড়ি থেকে বেরোবার পর তিতি আর একটা কথাও বলেনি। তাতান জিজ্ঞেস করলো, “শর্টকার্টটায় যাবি?”

তিতি সম্মতি সূচক ইশারা করলো শুধু, কোনো কথা বললো না। এই রাস্তাটা পারতপক্ষে ওরা এড়িয়েই চলে, কোনো বিশেষ কারণ নেই কিন্তু তাও আসতে ইচ্ছে করেনা।। গলিটা কেমন যেন স্যাতস্যাঁতে, অন্ধকার হয়ে থাকে দিনের বেলায়, মানুষের দেখা মেলা ভার এ রাস্তায়। এখন তো আবার বিকেল বেলা তাই তিতি আর তাতান ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।।

কিছুটা এগোবার পরই তিতির সাইকেলের সামনের চাকাটা হঠাৎ সশব্দে বাস্ট করলো, আওয়াজের বিভৎসতায় তিতি থরথর কাঁপতে শুরু করেছে। সর্বানী কাকিমা বলছিলেন এখন এরকম ছোটখাটো জিনিসেও তিতি চমকে ওঠে, ভয় পেয়ে কাঁপতে শুরু করে। এখন সেটা নিজের চোখে দেখল তাতান। কিন্তু এখন উপায়! ফিরতে হবে তো হেঁটে, শর্টকাট হলেও রাস্তাটা নেহাৎ কম নয় হাঁটার পক্ষে, ইতিমধ্যেই বৃষ্টি নেমেছে। প্রথমে ঝিরিঝিরি পড়া শুরু করলেও ক্রমেই ফোঁটার আকার বাড়ছে। সাময়িক আশ্রয়ের সন্ধানে এদিক ওদিক চোখ চালাতে চালাতে তাতনের হঠাৎ নজরে এলো ভাঙা মন্দিরটা, ওখানে সাপ খোপ থাকাটা বিচিত্র কিছু নয়, তার ওপর এরকম বৃষ্টির দিন! কিছুটা দোনামনা করেই শেষমেষ সাইকেল দুটো স্ট্যান্ড করে তিতিকে নিয়ে এসে সে উঠলো মন্দিরের চাতালে, এই জায়গাটা ফাঁকা তাই সাপ খোপ এলে নজরে পড়বে সহজে। চাতালের ওপরটায় ছাউনি আছে, এখন বিভিন্ন জায়গা ফেটে জল পড়ছে যদিও। তাও একটা অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত স্থান দেখে তিতিকে নিয়ে সেখানে দাঁড়ালো তাতান। কোনো একসময় যে মন্দিরটা যথেষ্ট বড় ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তাতান অবাক হলো, এতো বড় এত সুন্দর মন্দিরটা সংস্কার করা হয়নি কেন!

চিন্তার তরঙ্গ ছিন্ন হতেই ওর নজর গেল তিতির দিকে, এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে দেখছে মাটির সাথে ধাক্কা খেয়ে ক্রমশ ছিটকে যাওয়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে। তাতানের এবার একটু একটু ভয় করতে লাগলো, এরকম অন্ধকার গলি, বৃষ্টির সময় তিতিকে নিয়ে একলা দাঁড়িয়ে আছে! বৃষ্টিটাও যে কখন থামবে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছেনা। এখন আর অবশ্য সে বেশি ভয় পায়না। যার জীবনে পরপর এতগুলো বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে তার মনে আপনা থেকেই একটা সাহস এসে যায়।

“তিতি”

তাতানের ডাকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায় তিতি। “আমাকে প্লিজ বলবি তুই সেদিন কি দেখেছিলি?” নরম গলায় জিজ্ঞেস করে তাতান। কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না মেয়েটা। আগের মতোই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাতানের দিকে।

“বল তিতি, প্লিজ। শেয়ার কর আমার সাথে, দেখবি তোরও ভালো লাগবে।”

“বিশ্বাস করবিনা তুই… কেউ করবে না বিশ্বাস…” এতক্ষণে কথা বলে তিতি।

“কেন বিশ্বাস করবোনা? ঠিক বিশ্বাস করব। তুই বলে তো দেখ।”

“পাগল… পাগল বলবি আমায়… সবাই পাগল বলবি...”

“বলবো না। প্রমিস। তুই প্লিজ বল।”

“আমায় মেরে ফেলবে…”

তিতির কথায় চমকে ওঠে তাতান, “কি?”

“ও আমায় মেরে ফেলবে… ও বলে গেছে…”

“কে মেরে ফেলবে তোকে? আর কেনই বা মারবে?” তাতানের গলাটা কেঁপে ওঠে উত্তেজনায়।

“ও মেরে ফেলবে আমায়… আমি যে ওকে দেখে নিয়েছিলাম… উফফ … মেরে ফেলবে… মেরে ফেলবে… কি ভয়ঙ্কর ওর চোখ দুটো… উফফ… আহহ… নাহ… নাহ…” সামনে যেন কিছু দেখতে পেয়েছে এমন ভাবে দুহাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে ফেলে তিতি, কাঁপতে থাকে থরথর করে। তাতান আস্তে আস্তে হাত রাখে তিতির কাঁধে। ভীষণ অসহায় লাগছে নিজেকে, ভীষণ কান্না পাচ্ছে এই মুহূর্তে, কিন্তু ওর তো কাঁদতে নেই। নিজের প্রিয় পোষ্যর ভয়ংকর পরিণতি দেখেও ওর কাঁদতে নেই, নিজের মাকে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখেও ওর কাঁদতে নেই, নিজের প্রাণচঞ্চল ছোট্ট বোনটাকে চোখের সামনে ক্রমশ শুকিয়ে যেতে দেখেও ওর কাঁদতে নেই, নিজের বাবাকে বিহ্বল অবস্থাতে দেখেও ওর কাঁদতে নেই আর এখন নিজের ছোটবেলার প্রিয় বন্ধুর এই রকম করুন অবস্থা দেখেও ওর কাঁদতে নেই, কারণ ও ছেলে… ছেলেদের কাঁদতে নেই। কিন্তু ওর মনের মধ্যে ঘনীভূত হওয়া মেঘটা আজ যে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে, আর আটকে রাখা যাচ্ছে না তাকে; সেটা বৃষ্টি হয়ে চোখের কোণ থেকে ঠিক ঝরেই পড়লো নীচে, মিশে গেল ওর গোঁফ দাড়ির জঙ্গলে। বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ছে ক্রমশ, বৃষ্টির কণা গুলো একে অন্যের সাথে ধাক্কা খেয়ে চারিদিকটাকে অস্পষ্ট করে তুলেছে, মনে হচ্ছে যেন কোনো স্বচ্ছ দেওয়ালে ঘেরা ঘরে বন্দি ওরা দুজন।

“তোমরা ওখানে কি করছো বসে?” মন্দিরের ভেতর থেকে হঠাৎ একটা বজ্র গম্ভীর স্বর ভেসে এলো। তাতান ও তিতি দুজনেই চমকে উঠলো। মন্দিরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একজন; পরনে গেরুয়া ধুতি, খালি গা, গলায় অনেকগুলো ছোটো বড় রুদ্রাক্ষের মালা, লম্বা লম্বা চুল দাড়ি যা যত্নের অভাবে জটার রূপ নিয়েছে, আর কপালে লাল তিলক, তার সাথে সমান ভাবে লাল তাঁর চোখ দুটো। বয়েস বোঝার উপায় নেই তবে কালো চুলদাড়ি গুলো দেখে অনুমান হয় খুব বেশি বয়েস হবে না এনার। তিতি ভয়ে খামচে ধরলো তাতনের হাতটা। তাতান কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “বৃষ্টির জন্য এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি। বৃষ্টি কমলেই চলে যাবো।”

“ভেতরে এসে বোস। ওখানে থাকলে ভিজে যাবে, বৃষ্টির তীব্রতা আরো বাড়বে।” আগের মতোই গম্ভীর স্বরে কথা গুলো বললেন সেই সাধু। ভেতরে যাবে কি যাবে না যে নিয়ে দোনামনা করতে লাগলো তাতান, ওর নিজেকে নিয়ে ভয় নেই কিন্তু তিতি যে আছে ওর সাথে!

“ভয় পেওনা এসো ভেতরে।” তাতানের মনের কথাটা যেন ধরতে পেরেই কথাগুলো বললেন উনি।

তিতিকে ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো তাতান তারপর সাধুকে অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকলো । তিতির শরীরটা সেই আগের মতোই কেঁপে যাচ্ছে। মন্দিরের ভেতরটা মিশমিশে অন্ধকার, একটা লণ্ঠন জ্বেলে অন্ধকার দূর করার কিছুটা চেষ্টা করা হলেও ঘরটার আয়তনের তুলনায় তা নেহাতই সামান্য। চোখটা অন্ধকারে একটু সয়ে যেতে তাতান দেখলো সামনে একটা পাথরের কালি ঠাকুরের মূর্তি তবে আমাদের দেখা চিরাচরিত মূর্তির মতো নয়, কেমন যেন অন্যরকম। মূর্তিটার মুখে সিঁদুর মাখানো আর গলায় জবা ফুলের মালা। মুহ্যমান ফুলগুলোকে দেখে মনে হল সকালের দিকে পরানো হয়েছিলো হয়তো। তাতনের অবাক লাগল, এখানে কোনো জানালা নেই নাকি! তারপর ভালো করে চোখ চালাতে খেয়াল করে দেওয়ালের গায়ে থাকা কালচে রঙের জানালাটা। অন্ধকারে মিশে থাকায় প্রথমে বোঝা যায়নি।

“তোমরা এদিকে কি করছিলে?” চমকে ওঠে তাতান। তারপর আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, “টিউশনি গিয়েছিলাম, সেখান থেকেই ফিরছিলাম।”

“আগে তো দেখিনি কোনোদিন!”

“আসলে আমরা এ রাস্তায় আসিনা সচরাচর। আজ মেঘ করেছে দেখে ভেবেছিলাম এটা দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাবো কিন্তু…”

“হুম… বুঝলাম।

একি! মেয়েটি এভাবে কাঁপছে কেন?” সহসাই তিতির দিকে এগিয়ে এলেন ওই সাধু। তিতি ভয়ে পিছিয়ে গেল কিছুটা। তিতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওই সাধুর চোখ দুটো যেন আরও বেশি করে রক্তিম হয়ে উঠল, “বিপদ… এই মেয়ের সামনে খুব বড় বিপদ…” সাধু যেন আরও কিছু বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন; তাতান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিসের বিপদ?”

“তোমরা কিছুই বুঝতে পারোনি? মেয়েটি তোমার কে হয়?”

“আমার বন্ধু। আমরা সামনা সামনি বাড়িতে থাকি।”

“তাহলে তো নজরে পড়ারই কথা… ও কোনো অস্বাভিক আচরণ করেনি ইদানিং?”

“হ্যাঁ করছে… মানে একটা মেন্টাল শক পেয়েছিল তাই…”

“খুব খারাপ দৃষ্টি পড়েছে ওর ওপর। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর চোখে… ভয় পেয়ে আছে ও… বিপদ আসতে বেশি দেরি নেই… খুব তাড়াতাড়ি কিছু ব্যবস্থা না করলে রক্ষা করতে পারবে না।”

সাধুর দিকে তাকিয়ে তাতান মনে মনে ভাবল বেশ তো! তিতিকে ভয় পেয়ে এরকম কাঁপতে দেখেই এই লোকটা খারাপ দৃষ্টি, বিপদ কাটানো এসব বলে একটা কিছু একটা খারাপ মতলব ভাঁজছে নিশ্চয়! নিশ্চয় এসবের নাম করে বেশ কিছু টাকা পয়সা হাতাবার তালে আছে। তাতান ভাবল এক্ষুনি কোনো ভাবে এর হাত থেকে পালাতে হবে, কিন্তু কিভাবে? মন্দিরের ছাদে ওঠা গমগম শব্দ জানান দিচ্ছে বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ নেই এখনো। তবে এখন উপায়?

“না বাবা। ভুল ভাবছো তুমি, নিজের কোনো স্বার্থ চরিতার্থ করতে কথা গুলো বলছি না আমি।” চমকে উঠল তাতান। আশ্চর্য, লোকটা থট রিডার নাকি! সাধুই আবার বললেন, “তোমরা আজকালকার ছেলে মেয়ে এসব বিশ্বাস করোনা জানি। কিন্তু তাও মেয়েটার অবস্থা দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে, ভয়ও পাচ্ছি কারণ আমি যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর জীবন সংশয়... তাই বলছি।” লোকটার চোখের দৃষ্টিটা হঠাৎ কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেল, যেন বহুদূরের কিছু দেখতে পাচ্ছেন মানসচক্ষে।

এবার তিতির দিকে এগিয়ে গেলেন উনি; ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া তিতির মাথায় হাত রেখে যথাসম্ভব নরম গলায় বললেন, “মা রে ভয় পাসনা। তুই আমার শুধু বল কিভাবে পড়লি এর খপ্পরে? আমার মন বলছে তুই জানিস সে কথা। বল আমায়…”

সাধুর গলায় স্বর নাকি তাঁর স্পর্শ কোনটা ঠিক বুঝতে পারলোনা তাতান, কিন্তু এর মধ্যেই কোনো একটা বা হয়তো দুটোই ম্যাজিকের মতো কাজ করলো। তিতি এতক্ষণে তাতানের আড়াল ছেড়ে সামনে এসে সোজা হয়ে দাঁড়ালো যদিও কোনো কথা বললো না। শুধু তাকিয়ে রইলো সাধুর দিকে, ওর দু চোখ বেয়ে ঝরে পড়তে লাগলো নোনাজলের ধারা। সাধু আবার নরম গলায় বললেন, “কি হলো মা, বল।”

এতক্ষণে তিতি মুখ খুললো, “ও আমাকে মেরে ফেলবে।”

“কে ও?”

“ও… খুব ভয়ঙ্কর… খুব… উফফ… ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে… না… না… মেরোনা আমাকে…” আবার দুহাতের তালু দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো তিতি, সশব্দে কেঁদে উঠলো।

কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সাধু আবার ওর মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, “বল মা আমায়, ওর নাম কি? কে তোকে ভয় দেখাচ্ছে? কথা দিচ্ছি তোকে সাহায্য করবো আমি।”

সাধুর কথা আবার ম্যাজিকের মতো কাজ করলো। জড়ানো গলায় তিতি উত্তর দিলো, “ওই কালো বেড়ালটা… নাকি অন্য কেউ! আমি জানিনা… আমি কিচ্ছু জানিনা…”

সাধু তাতানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন কালো বেড়ালের কথা বলছে ও কিছু জানো তুমি?”

“হ্যাঁ… মানে…. একটা কালো বেড়াল… আমার বোনের… কিন্তু একটা ছোট্ট বেড়াল ওকে মারবে কিভাবে!” হতভম্ভ হয়ে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তাতানের।

“বেড়াল! কতদিন আছে তোমাদের বাড়িতে?”

“এই জাস্ট কয়েকদিন আগে বোন তুলে এনেছে রাস্তা থেকে।”

“হুম… ওকে বাড়িতে আনার পর অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি?”

তাতান কিছুক্ষণ নীরব রইলো। ওর মনে দোলাচল, লোকটাকে সব বলা ঠিক হবে আদৌ! ওদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে কোনো ক্ষতি করতে চাইছে না তো! কিন্তু লোকটা যে ওর মনের কথা বুঝে যাচ্ছে, আবার ওই লোকটার কথাতেই তিতি কেমন পাল্টে গেল মুহূর্তে, একটু হলেও নরম্যাল হলো... তবে কি লোকটার সত্যি কিছু পাওয়ার আছে! খানিকটা দ্বিধা নিয়েই জনের মৃত্যু থেকে শুরু করে কাকিমার ওপর আক্রমণের ঘটনা গুলো এক এক করে বললো তাতান। সব শোনার পর সাধু বললেন, “আচ্ছা এসব তো শুনলাম এবার ওই দিন গুলোতে সকাল থেকে ঠিক কি কি ঘটেছিলো যতটা পারো মনে করে একটু বলতো দেখি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সবটা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করি।”

অন্যকেউ এমন প্রশ্ন করলে তাতান হয়তো বিরক্ত হতো কিন্তু আজ সেটা পারলোনা। চেষ্টা করে করে অনেকক্ষণ ধরে সব মনে করে করে বললো। সেসব শুনে সাধুর মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি বললেন, “বুঝেছি সব। এই জন্যই এখন ওর সব রাগ গিয়ে পড়েছে এই মেয়েটার ওপর! মেয়েটা প্রত্যেকবার ওর শিকারের সময় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে…”

কয়েক মুহূর্ত কিছু যেন ভাবলেন ওই সাধু, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “বেড়ালটা এখন কোথায় থাকে?”

“আমাদের আর তিতিদের বাড়ির আশেপাশেই ঘুরঘুর করে, কখনো আমাদের বাগানে আবার কখনো ওদের। আসলে আমার দিদা ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন তো।”

“সর্বনাশ! তোমার দিদা ঠিক আছেন?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“নাহ। কিছুনা… একটু দাঁড়াও আমি আসছি।” এই বলে সাধু অন্ধকারের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হলেন। তাতান ক্ষনিকের জন্য ভাবলো এই সুযোগে পালিয়ে যাবে কিনা… কিন্তু পারলো না। ওই সাধু এতক্ষনে ওর মনের কোণে কোথাও একটা ক্ষীণ আশা জাগিয়ে তুলেছেন এই সব সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার। সেই আশার আলোকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে যেতে পারলোনা ও।

বেশ কিছুক্ষণ পর সাধু ফিরে এলেন। এক হাতে তিনটি জবা ফুল আর অন্য হাতে কি ধরা আছে বোঝা গেলো না। প্রথমে একটি জবা তিতির হাতে দিয়ে সাধু বললেন, “এই ফুলটা রাখ মা। মায়ের ফুল এটা। এই ফুলটাকে কখনও কাছ ছাড়া করিস না, ওই শয়তানটা যদি তোর কোনো ক্ষতি করতে আসে তখন এটা ওর গায়ে ছুঁড়ে মারবি। মা তোকে রক্ষা করবেন।” এরপর তাতানের দিকে ঘুরে বাকি দুটো ফুল দিয়ে বললেন, “একটা তোমার দিদাকে দেবে আর একটা তোমার কাছে রাখবে। জানি তোমার অবিশ্বাসী মন, তবে একটাই অনুরোধ মায়ের ফুল এটা, যেখান সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দিও না। জলে ভাসিয়ে দেবে। তোমার বোনের বোধহয় এর প্রয়োজন নেই, তার ক্ষতি শয়তানটা করতে পারবে বলে মনে হয়না।”

“কেন?”

“তোমার বোন যে তাকে ভালোবাসে। কেউ যদি শয়তানটাকে ভালোবাসে তাহলে তার ক্ষতি ও করতে পারেনা। ঘৃণাই ওকে শক্তিশালী বানায়, যারা যারা ওকে ঘৃণা করে তাদের রক্ত পেলে ও আরও শক্তিশালী হয়।”

“আপনি তো ন্যান্সিকে দেখেননি কখনও তাহলে এতো কথা জনলেন কি করে?”

“তুমিই তো আমায় বললে বাবা, আর তোমার কথা শুনে কিছু হিসেব কষলাম আমি।”

“একটা বেড়াল… আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা।”

“বেড়াল নয়, বেড়াল তো অবলা জীব আর ওই অবলা জীবটার ভেতরেই বাসা নিয়েছে কোনো অতৃপ্ত আত্মা, সেই ঘটাচ্ছে এসব। সে কিভাবে ওর শরীরে এলো সেটা আমি জানিনা।”

“আত্মা! মানে বলতে চাইছেন ভুত?”

“হ্যাঁ ওইরকমই। তোমার মন বড় অবিশ্বাসী। আমার অবাক লাগছে একটার পর একটা এরকম ঘটনা ঘটে গেছে তাও তোমরা কোনো পদক্ষেপ নাওনি কেন?”

“পুলিশ ইনভেস্টিগেট করছে।”

“পুলিশ… ওরা এর কি করবে?” স্মিত হাসলেন সাধু, “বাবাকে গিয়ে বোলো কোনো নামি ভটচাজকে ডেকে পুজো করাতে। আশা করি তিনি বুঝবেন।”

তাতান কোনো উত্তর দিলনা না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তিতিই এবার বলে উঠল, “আপনি পারবেননা কিছু করতে?”

“আমি! আমি মুখ্যু মানুষ রে মা। তাছাড়া তোর এই বন্ধুটির শুধু মনে হচ্ছে আমি বুঝি তোদের কথার জালে জড়িয়ে কোনো ক্ষতি করবো।

এই তো এক্ষুনি ভাবছে যে তোর মন ভোলাচ্ছি আমি যাতে তুই বাড়িতে ডাকিস আমায়।” চমকে উঠলো তাতান, লোকটা তারমানে সত্যিই থট রিডার, “আপনি কি করে বুঝছেন আমি কি ভাবছি?”

সাধু হাসলেন শুধু, তাতানের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন, “একটুকরো কাগজ দিতে পারবে?”

“দিচ্ছি।”

ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে দিলো তাতান। সাধু কাগজটার মধ্যে বাম হাতের মুঠো খুলে গুঁড়ো গুঁড়ো কিছু ঢাললেন ছাইয়ের মতো। দিয়ে বললেন, “এটা কোনো একটা খাবারে মিশিয়ে বিড়ালটাকে খাইয়ে দেবে গিয়েই, তাহলেই দুর্বল হয়ে যাবে ওর মধ্যে থাকা আত্মাটা। তোমাদের বাড়িতে পুজো করা অবধি কারুর কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা যদি ঠিকঠাক খাওয়াতে পারো।”

সাড়ে সাতটা বেজে গেছে ঘড়িতে, এতক্ষনে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই সন্ধ্যে নামে কিন্তু মেঘলা আকাশ আজ সন্ধ্যের অন্ধকারটাকে যেন আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। বৃষ্টিটা থামতেই মোবাইলের টর্চের ভরসায় তিতির হাত ধরে রাস্তায় নেমে পড়ে তাতান। তারপর দুজনের সাইকেল দুটোকে নিয়ে হাঁটা লাগায় বাড়ির উদ্যেশ্যে। মনের মধ্যে হাজারটা দোলাচল, লক্ষাধিক প্রশ্ন, শরীর জুড়ে অজানা অতঙ্ককে সঙ্গী করে শর্টকাট রাস্তাটা পেরোতেও যেন লেগে যায় একযুগ।

তাতানদের বাড়ির গেটে ঝুলছে মস্ত তালা। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে গেটটা খুলে ঢুকলো তাতান, পেছন পেছন তিতি। বাবা আর দিদা হসপিটালে গেছেন, তাথৈকে রেখে গেছেন তিতিদের বাড়িতে। সেরকমই কথা ছিলো। তিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, সে জিজ্ঞেস করলো, “ন্যান্সিকে এটা খাওয়াবি কিভাবে?”

তাতানের খেয়াল হলো সত্যি তো ন্যান্সি অন্যদিন বাগানে ঘুরতে থাকে, আজকে এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় গেছে কে জানে! তবু একবার এমনিই চেষ্টা হিসেবে মোবাইলের টর্চের আলোটা সে ফেলতে শুরু করল আশেপাশে, সেই সাথে চালালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। হ্যাঁ… ওই তো ন্যান্সি একটা সানশেডের তলায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। সারা শরীরটা ভিজে একসা। এই ছোট্ট বিড়ালটাই তবে সব কিছুর মূলে! ভাবতেও অবাক লাগছে। তাতান সাহস করে এগিয়ে গেল ওটার দিকে, কিন্তু তিতি পারলনা। টর্চের আলোটা গায়ে পড়তেই চমকে উঠল ন্যান্সি, করুন চোখে তাকাল তাতানের দিকে। তিতির এই মুহূর্তে এটাকে দেখে যেন আর ভয় লাগছেনা, বরং মায়া হচ্ছে। ওর চোখ দুটো বড় অসহায় লাগছে। মুহূর্তের মধ্যে তিতির মনে পড়ে গেল সাধুর বলা সেই কথাটা, “বেড়াল তো অবলা জীব আর ওই অবলা জীবটার ভেতরেই বাসা নিয়েছে কোনো অতৃপ্ত আত্মা, সেই ঘটাচ্ছে এসব।” বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে বন্দি তাতান। সে জানেনা বিকেলে দেখা হওয়া লোকটা ভন্ড কিনা, কিন্তু ডুবন্ত ব্যক্তি যেমন খড়কুটোকে আশ্রয় করেও বাঁচার চেষ্টা করে তাতানের এখন সেই অবস্থা। ন্যান্সিকে কোলে তুলে নিল ও। তারপর তিনজনে মিলে ঢুকলো ঘরের ভেতর। আলো জ্বেলে রান্নাঘরে গেল তিতি, খুঁজে পেতে দুধটা নিয়ে গরম করতে বসালো। তিতিকে যত দেখছে তত অবাক লাগছে তাতানের, এই কয়েকঘন্টার মধ্যে যেন আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে মেয়েটার মধ্যে। কদিন ধরে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা মেয়েটা আজ যেন কিছু একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতে বদ্ধপরিকর। তবে কি ওই সাধু সত্যিই ম্যাজিক জানেন!

একটা বড় বাটিতে করে গরম দুধ নিয়ে এলো তিতি। তাতান তাতে মিশিয়ে দিলো সাধুর দেওয়া গুঁড়ো জিনিসটা। দুধের রঙে একটা হালকা পরিবর্তন হলো কিন্তু ন্যান্সির তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে মহা আনন্দে চুকচুক করে খেতে শুরু করল, মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে ফেলল পুরো দুধটা। তারপর আনন্দে তিতির পায়ে মাথা ঘষতে এলো কৃতজ্ঞতা স্বরূপ, কিন্তু তিতি আতঙ্কে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ন্যান্সি কেমন যেন অবাক হয়ে তিতির দিকে তাকিয়ে রইলো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এখন এই ছোট্ট শরীরটাকে ভর করে এর মধ্যে বাস করছে একটা শয়তান।

তাথৈ আজ রয়ে গেছে তিতিদের বাড়িতে। তিতিকে এতো দিন পর স্বাভাবিক অবস্থায় দেখে সবার মনে খুশির জোয়ার। কিন্তু তিতির মন থেকে অস্বস্তি যাচ্ছেনা কিছুতেই। সাধুর কথা যদি সত্যি হয় তাহলে শীঘ্রই এর প্রতিকার করতে হবে, নয়তো আরও বিপদ ঘনিয়ে আসবে। কিন্তু না তিতি না তাতান কেউই বাড়ি ফিরে কাউকে বলতে পারলোনা আজ বিকেলের ঘটনাটা, কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকলো। এসব শুনলে বাড়ির সকলের প্রতিক্রিয়া কি হবে কে জানে!

তাথৈ আর তিতি দুজনে মিলে আজ শুয়েছে তিতির ঘরে। বেশকিছুক্ষন গল্প করার পর তাথৈ ঘুমিয়ে পড়লো। আজ তিতিরও খুব ক্লান্ত লাগছিলো তাই অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরও চোখে ঘুম নেমে এলো। আজ অনেক দিন পর গভীর ঘুম নেমেছে ওর চোখে। কিন্তু হঠাৎ করে বুকের ওপর একটা অসম্ভব চাপ লাগতেই চোখ খুললো তিতি। নাইট ল্যাম্পের মৃদু আলোয় দেখতে পেলো সাদা শাড়ি পরা একটা নারী শরীর চেপে বসেছে ওর বুকে, কোনো একটা সূঁচাল জিনিস যেন বিঁধিয়ে দিতে মরিয়া ওর গলায়। কিন্তু এ আদৌ মানুষ! কোনো মানুষের চেহারা এতোটা বিভৎস হয়! নাইট ল্যাম্পের আলোয় যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে করে তিতি দেখতে পেলো এর সারা শরীরের চামড়া যেন পচে ঝুলে গেছে, একটা চোখের কোটর ফাঁকা, আরেকটা চোখেরও কেমন যেন বিভৎস অবস্থা। সর্বোপরি ওর গলায় ভেদ করে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে আছে একটা বড়ো ছুরি। চিৎকার করতে গিয়ে তিতি টের পেল যে ওর গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না, প্রানপনে চেষ্টা করেও ওটাকে সরাতে পারছেনা নিজের ওপর থেকে। সাধুবাবার দেওয়া জবা ফুলটাও শোয়ার আগে রেখে দিয়েছিল পড়ার টেবিলে, সেটা নেওয়ারও উপায় নেই এখন। ক্রমশ তিতির গলায় ঢুকে যাচ্ছে ধারালো কোনো জিনিস, এবার রক্ত গড়িয়ে যাওয়ার স্পর্শ পেল তিতি। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। এভাবেই তবে শ্রাবনী কাকিমা…

“মিঁয়াও”, ডাকটা শুনে চমকে ওঠে চোখ খুললো তিতি; ন্যান্সি ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওই অশরীরীটারওপর। তিতিকে ছেড়ে ওটা পড়ে গেলো নিচে। তারপর ন্যান্সি আর ওই মহিলার মধ্যে শুরু হলো এক অসম লড়াই। অবাক হয়ে তিতি দেখলো ওই মহিলার শরীরটা হঠাৎ করে রূপান্তরিত হলো জন্সির শরীরে, তারপর মুহূর্তের মধ্যে আবার মানুষের আকার ধারণ করলো। এভাবে ক্ষনে ক্ষণে পরিবর্তিত হতে লাগলো তার রূপ। বিস্মিত, হতভম্ব তিতির দু চোখ বেয়ে জল নেমে এলো। কালো রং কে কেন এতো ঘৃণা! শুধু কালো বলেই আজ এতদিন ধরে সে ন্যান্সিকে ভুল বুঝে গেছে, শুধু সে তো নয় সবাই ন্যান্সির আগমনকেই অমঙ্গল হিসেবে দেখেছে। অথচ একবারও সন্দেহ করেনি দুধ সাদা জন্সিকে…

“জন্সি! ন্যান্সি! তোরা এতো রাত্রে মারপিট করছিস কেন! আর ন্যান্সি তুই কখন এলি?” ন্যান্সি আর জন্সির লড়াইয়ের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছে তাথৈ এর। ঘুমঘুম চোখে বিছানা থেকে নেমে সে এগিয়ে যায় বিড়াল দুটোর দিকে। জন্সি মুহূর্তের মধ্যে ন্যান্সিকে ছেড়ে দিয়ে এসে কোলে উঠে যায় তাথৈ এর। ন্যান্সি আর পারেনা, লুটিয়ে পড়ে মাটিতে, ওর সারা শরীর রক্তাক্ত। ইতিমধ্যেই সর্বানী দেবী আর অম্বরিশ বাবুও ছুটে এসেছেন এত আওয়াজ শুনে। ন্যান্সিকে দেখেই আঁতকে ওঠেন সর্বানী দেবী, “এই কালো বিড়ালটা কখন ঢুকলো!”

“আজ এই কালো বিড়ালটাই না থাকলে তোমরা আমাকেও আর ফিরে পেতে না কোনোদিনও।”

এতক্ষনে সবাই একসাথে তাকান তিতির দিকে, ওর গলা থেকে ঝরে পড়া সরু রক্তের ধারাটা দেখে চিৎকার করে ওঠেন সর্বানী দেবী।

দিনের বেলাতেও এই গলিটা কেমন অন্ধকার হয়ে থাকে। তাই তো টিউশন পড়তে যাওয়ার সময় এই রাস্তাটা দিয়ে যেতে মন চায়না। এখন সকাল সাতটা। কাল সন্ধ্যেবেলা ঠিক সাতটার সময়ই তিতিকে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তাতান। আজ ও আবার এসেছে এখান, তবে আজ সাথে তিতি নয় রয়েছেন ওর বাবা সুরেশ বাবু আর তিতির বাবা অম্বরিশ বাবু। সকলেই ভীষণ উত্তেজিত। কালরাত্রের ঘটনার পর তিতি আর ঝুঁকি নিতে চায়নি। বিকেলবেলা মন্দিরে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার কথা খুলে বলেছিল বাবা, মাকে। ওনারাও পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারেননি ব্যাপারটাকে, বিশেষ করে রাত্রের এই ঘটনার পর। সর্বানীদেবী চেয়েছিলেন তক্ষুনি জন্সিকে ঘরের বাইরে বের করে দিতে কিন্তু তিতি আটকিয়েছে। কারণ ও জানতো এরকম করলে জন্সির শিকারদের তালিকায় সর্বানীদেবীর নামটাও উঠে যাবে। সকাল হতেই তাথৈদের বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। জন্সি এখনও তিতিদের বাড়িতেই রয়েছে, তাথৈকে কিছুই জানানো হয়নি। তাথৈ ছাড়া বাকি সকলের মধ্যেই এক নতুন আতঙ্ক জন্ম নিয়েছে কাল রাতের পর। তিতিদের বাড়ির পরিবেশটা আরও বেশি করে থমথমে হয়ে গেছে, তিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে দেখে যে আনন্দের রেশটা এসেছিলো সেটা আবার হারিয়ে গেছে। প্রতি মুহূর্তে একটা ভয় কখন কি ঘটে যায়! ন্যান্সিকে পশুদের হাসপাতালে ভর্তি করে আসা হয়েছে। তিতিকে বাঁচাতে একেবারে ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে ওই ছোট্ট শরীরটা। এখন ওর ওপর আর কারুর ঘৃণা নেই, বরং সবাই এখন ওর জন্য প্রার্থনায় ব্যস্ত। এখানে আসার প্রস্তাবটা তাথৈএর দিদাই দিয়েছেন। তিনিই বলেন যে মানুষটা তিতিকে চোখে দেখে ব্যাপারটা বুঝে গেলেন তার ক্ষমতার ওপর সন্দেহ করা উচিত না, অতএব ওনাকেই গিয়ে ধরা উচিত প্রতিকার করার জন্য। আর তাই সক্কাল সক্কাল তাতানদের এখানে আসা।

“কিহে ছেলে! তোমার বান্ধবীটি ঠিক আছে তো?” তাতান মন্দিরের চাতালে উঠতেই ভেতর থেকে ধেয়ে এলো প্রশ্নটা, প্রশ্নকর্তার গলার স্বরে উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট। তাতান বিনীত স্বরে জিজ্ঞেস করলো “বাবা ভেতরে আসবো?”

“এসো।”

সুরেশ বাবু আর অম্বরিশ বাবুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো তাতান। ওনাদের দুজনকে দেখে সাধুর চোখে প্রশ্ন। তাতান পরিচয় করিয়ে দিলো, “ইনি আমার বাবা সুরেশ মজুমদার আর উনি আমার সেই বান্ধবীর বাবা অম্বরিশ মিত্র।”

“হুম। এবার বলুন আপনাদের আগমনের কারণ।”

তাতান উত্তেজিত ভাবে সন্ধ্যে থেকে কাল রাত্রের সব ঘটনা বিস্তারিত ভাবে বলল। সাধু খুব শান্ত ভাবে শুনলেন সব। তারপর তাতানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তারমানে তোমরা ভুল জনকে সন্দেহ করেছিলে আর তাকেই খাইয়ে দিয়েছো আমার দেওয়া সেই চূর্ণ!”

“হ্যাঁ বাবা।” মাথা নিচু করে বললো তাতান।

“এই ভুলটা না করলে রাত্রের ঘটনাটা ঘটতো না। আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম বলে তোমাদের সাবধান করেছিলাম। যাই হোক মায়ের অশেষ কৃপা যে মেয়েটির বেশি ক্ষতি করতে পারেনি শয়তানটা।”

“বাবা আপনি দয়া করে চলুন। আমাদের ওই শয়তানটার কবল থেকে মুক্ত করুন।” অসহায় গলায় মিনতি করলেন অম্বরিশ বাবু।

অম্বরিশ বাবুর কথা শুনে সাধু তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। তারপর তাতানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কিহে ছেলে আমাকে সন্দেহ হচ্ছে এখনও?”

তাতান দু দিকে মাথা নাড়ে। সাধু মৃদু হেসে বলেন, “আবার ভুল বুঝছ বাবা, তোমাকে উপহাস করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করিনি কথাটা। আসলে অবিশ্বাসী বাতাবরণে তাকে পরাজিত করা কঠিন।

তবে আমি জানি তোমার মনের অবিশ্বাস এখন বিলুপ্তির পথে।”

তাতান জোর গলায় বলে ওঠে, “আপনি প্লিজ চলুন।”

“চলো।”

সাধু এসেছেন প্রায় খালি হাতে। পুজোআর্চার কোনো সরঞ্জামই আনেননি। সর্বানীদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “পুজোর জন্য কি কি লাগবে?”

“কিচ্ছুনা। শুধু একটা খালি ঘর। আসবাব কিছু না থাকলে খুবই ভালো।”

“কিন্তু এরকম ঘর কোথায় পাবো!” চিন্তিত হয়ে ওঠেন সর্বানীদেবী।

তিতি বলে, “দাদাই আর ঠামুর ঘরটা বোধহয় সব থেকে ভালো হবে। ওখানে ফার্নিচার অনেক কম আছে।”

“তবে সেখানেই নিয়ে চলো আমাকে।”

সেই ঘরেই নিয়ে যাওয়া হল সাধুবাবাকে। ঘরের মেঝেয় বসে তিনি তার কাঁধে ঝুলিয়ে আনা কাপড়ের ছোট্ট পুঁটলি থেকে বের করলেন দুটো জবা ফুল, আর সেই সাথে কালকের সেই ছাইয়ের মতো গুঁড়ো বস্তুটা। আর কোনো উপকরণ নেই। এবার উনি আদেশ দিলেন জন্সিকে আনার জন্য। তবে তাথৈএর হাত দিয়েই আনতে বললেন, অন্যরা আনতে গেলে নাকি ক্ষতির সম্ভাবনা আছে।

জন্সিকে নিয়ে তাথৈ যে ঘরে ছিল সর্বানীদেবী সে ঘরে ঢুকতেই জন্সি লাফ মেরে ঘরের এক কোণে চলে গিয়ে সর্বানীদেবীর দিকে তাকিয়ে রাগে গর্জন করতে শুরু করল। ওর চোখ দুটো ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে, এই টুকু একটা বিড়ালেরও যে এমন ভয়ঙ্কর রূপ থাকতে পারে তা কল্পনাও করতে পারেনি কেউ। তাথৈ এর হাত দিয়ে ওকে নিয়ে যেতে বলেছেন সাধুবাবা কিন্তু ওই টুকু বাচ্চাটাকে এই শয়তানটার কাছে যেতে দিতে মন চাইছেনা সর্বানীদেবীর। যদিও সকাল থেকে তাথৈএর কাছেই ছিলো এটা তাও এখন এর এই ভয়ংকরী চেহারা দেখে ইতস্তত করতে শুরু করলেন উনি। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিজেই জন্সিকে তুলতে গেলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিড়ালটা লাফ মেরে সর্বানীদেবীর ওপর পড়ে গিয়ে নখ দিয়ে আঁচড়ে দিতে থাকলো তাঁর মুখ, কপাল। যন্ত্রনায় চিৎকার করতে লাগলেন সর্বানীদেবী। ঘটনার আকস্মিকতায় তাথৈ ভয় পেয়ে গেলেও সর্বানীদেবীর কাছে এসে জন্সিকে ছাড়াবার জন্য হাত বাড়াতেই সেটা সুড়সুড় করে নেমে পড়লো, এই ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য নেই ওটার।

জন্সিকে ঘরে ঢুকিয়ে দিতেই সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন সাধুবাবা, তারপর ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। তাতান দরজায় কান পাততে গেলে দিদা ধমকে উঠলেন। ওরা সবাই ঘরটা থেকে খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল তখন সর্বানী দেবী ফিসফিস করে বলেন, “ভুত তাড়াতে তো অনেক সরঞ্জাম লাগে বলে শুনেছি কিন্তু এনার কাছে তো…”

“আহ সর্বানী… সন্দেহ কোরোনা। তোমার মেয়েকে বাঁচিয়েছেন উনি, ভরসা রাখো।” সর্বানীদেবীকে মৃদু ধমকে ওঠেন তাথৈএর দিদা। এখন সবার ভেতরে চলছে তুমুল ঝড়, উৎকণ্ঠায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে সবার। এক এক সেকেন্ড যেন এক এক ঘন্টা মনে হয়। নিজের হাজারো ভয়, আশঙ্কা, উৎকন্ঠাকে পাশে রেখে তিতি তাথৈকে নিয়ে সরে গেল অন্য ঘরে। এইটুকু বয়েসে এরকম ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা না হওয়াই ভালো।

প্রায় দু’ঘন্টা ধরে ঘরটার ভেতর যেন চলছে তুমুল ঝড়। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে বিকট চিৎকার, কখনো বা আসবাব পত্রের দুমদাম শব্দ। সে কি ভয়ঙ্কর অবস্থা তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সাধুবাবা, তাঁর কোলে জন্সি। সবাইকে দেখে সে “মিঁয়াও” বলে একটা ডাক ছাড়ল। সর্বানীদেবীর কুঁচকে যাওয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে সাধু বাবা বললেন, “ভয় নেই। এ এখন আপনাদের সেই পুরোনো বেড়াল। যে আত্মা এর শরীরে ভর করেছিলো সে একে ছেড়ে চলে গেছে।” কারুর যেন বিশ্বাস হতে চাইছেনা সে কথা। জন্সি লাফ মেরে সাধুবাবা কোল থেকে নেমে লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে সবার কাছে এসে এসে নিজের মাথা ঘষে দিতে লাগলো সবার পায়ে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনোকারণে ভারী আনন্দ হয়েছে ওর, যেন বহুদিন পর পরিবারের সবাইকে একসাথে দেখতে পেয়েছে। ঘরের ভেতরটায় উঁকি দিয়ে সর্বানীদেবী দেখলেন খাটটা তার আগের অবস্থান থেকে বেশ খানিকটা সরে গেছে, আলনাটা মেঝেতে উল্টে আছে আর গোদরেজের বড়ো আলমারিটা অবধি কাত হয়ে গেছে, দেওয়ালে বাধা না পেলে ওটাও নিশ্চয় উল্টে পড়তো। সাধুবাবা সর্বানীদেবীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, “কিচ্ছু করার ছিল না আমার। বড্ড জেদি, যেতেই চাইছিলো না। তাই এরকম তান্ডব করেছে।”

“বাবা ওই আত্মাটা এখন কোথায়? ও আর আসবেনা তো?”

“আছে। তবে আপনাদের আর কোনও ক্ষতি করতে পারবেনা। অন্য জায়গায় নিয়ে চলে যাবো ওকে।”

“ওর মুক্তির ব্যবস্থা করা যায়না? নয়তো আবার কাউকে যদি...”

“ওর মুক্তি হবে, তবে ওর মুক্তির জন্য একটা বিশেষ কাজ করতে হবে নয়তো কোনো কিছুতেই ও মুক্তি পাবে না।”

“কি কাজ বাবা।”

“আপনাদের ও নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমিই সে ব্যবস্থা করব।”

“একটা প্রশ্ন করবো বাবা?” তাতনের দিদা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

“নির্ভয়ে মা।”

“বাবা এই আত্মাটি জন্সিকে ধরলো কিভাবে? মানে এসব ভুতে ধরার ব্যাপার তো আমাদের গ্রামেই দেখেছি, এই শহরে…?”

মৃদু হাসলেন সাধু, তারপর বললেন, “কিভাবে ধরলো জানতে হলে আগে জানতে হবে আত্মাটি কার।”

“বলুন না বাবা।”

পার্থিব মোহ ত্যাগী সাধুও হঠাৎ করে কেমন যেন ভাবুক হয়ে গেলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন, “মেয়েটির নাম ছিল শর্মিলা। স্বামী পরিত্যক্তা নিঃসন্তান মেয়েটি একটি চায়ের দোকান চালাতো। সেই দোকানটাই ছিলো ওর ঘর আবার ওর দোকানও। ওই করেই কাটছিল জীবন কিন্তু সব দিন তো সমান যায়না। আশেপাশে যত জায়গা ছিল সব এক প্রমোটার কিনে নিলো, শর্মিলাকে বললো ওর দোকানটা দিয়ে দিতে হবে কিছু টাকার বিনিময়ে। শর্মিলা পড়াশুনা না জানা মূর্খ মেয়ে মানুষ হলে কি হবে জেদ ছিলো তার ভয়ঙ্কর। কিছুতেই রাজি হলোনা দোকান ছাড়তে। সবাই অনেক বোঝালো, প্রমোটার হুমকি দিলো কিন্তু তাও ওকে টলানো গেল না কোনোভাবেই। এরপর যা হবার তাই হলো। শর্মিলা রাতারাতি উধাও হয়ে গেল, নিজের কোনো লোক না থাকায় কারুর কোনো খোঁজ নেওয়ার তাগিদও ছিল না। কেউ কেউ হা হুতাশ করলেও খোঁজার চেষ্টা করলোনা কেউই। আসলে সবাই মনে মনে জানতো শর্মিলা কোথায় গেল। ওর দোকানটা ভেঙে দিয়ে এরপর কাজ শুরু হলো “রাজলক্ষী এপার্টমেন্ট” এর।”

“তারপর?”

“তারপর আপনাদের বাড়ির বিড়ালটি একদিন কোনো খেয়াল বশে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে, পৌঁছে যায় নির্মাণের কাজ চলতে থাকা ওই বহুতলের কাছে। তারপর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ওখানেই একটি জায়গা বেছে সেরে ফেলে নিজের কাজটি, আর ঠিক ঐ খানটাতেই মাটির নীচে প্রমোটারের লোকেরা খুন করে চাপা দিয়েছিল শর্মিলার দেহটা। তাই শর্মিলার আত্মা এতদিন বন্দি হয়ে ছিলো ওখানে, এবার সেদিন সুযোগ পেয়ে সে ঢুকে পড়ে জন্সির দেহে এবং আপনাদের বাড়ি আসে। এখানে এসে কেউ ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করলেই তার ওপর নিজের মৃত্যুর বদলা নিতে শুরু করে। তাতানের কাছ থেকে যা শুনেছি তাতে করে আমার অনুমান হয় যে আপনাদের কুকুরটি নিজের ঘ্রাণ শক্তি দিয়ে বুঝতে পেরেছিল যে এ তার পুরোনো সঙ্গী বিড়ালটি নয়, তার রূপে অন্য কেউ। তাই সে ওকে তীব্র ভাবে অপছন্দ করছিল, তাতানের কথা মতো ওরা নাকি ঝগড়াও করছিল যা আগে কখনো ঘটেনি। এরপর বিড়ালরূপী শর্মিলার আত্মা বদলা নেয় কুকুরটির ওপর। দ্বিতীয় শিকার তাতানের মা, তাঁকে ও আঘাত করলো সেই দিন যেদিন উনি লাঠি দিয়ে মেরে ওকে ঘর থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলেন। তৃতীয় শিকার তাতানের কাকিমা, উনি তো এমনিতেই কুকুর বেড়াল অপছন্দ করতেন তাই যেদিন আসেন সেদিন রাতেই… তিতিকে কেন আক্রমণ করেছিল এতো তিতি নিজেই জানে ভালো করে...”

“কিন্তু আমরা তো ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী নই, তাহলে আমাদের ওপর কেন?”

“আসলে যে ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী তাকে না পেয়ে রাগে অন্ধ হয়ে আপনাদের ওপরই নিতে শুরু করেছিল বদলা। তবে এখন আপনার নিশ্চিন্তে থাকুন আর কোনো ভয় নেই।”

“যদি অপরাধ না নেন একটা কথা জিজ্ঞেস করবো বাবা?”

“বলুন মা।”

“বলছি যে আপনার নামটা যদি একটু বলেন আর আপনি কি ওই মন্দিরেই থাকেন? মানে যদি আবার দরকার পড়ে আর কি…” ইতস্তত কন্ঠে প্রশ্নটা করেই ফেললেন তাতানের দিদা। মন থেকে সংশয় কাটছে না।

“নাম! হাঃ হাঃ হাঃ… আমাদের কোনো নাম হয়না মা। নামের মোহ ত্যাগ দিয়েছি… জন্মের সময় বাবা অবশ্য একটা নাম রেখেছিলেন আদর করে… হারাধন… সে নাম এখন অতীত। ওসব ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি কবেই। ভয় পাবেননা মা, আপনারা এখন সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত, আমি বলছি তো। ভরসা রাখুন।”

তিতি আর তাতান আশ্চর্য হয়ে দেখলো কালকের সেই রক্ত চক্ষু গুরুগম্ভীর মানুষটা যেন কোথাও হারিয়ে গেছেন তার বদলে একটা ভাবুক প্রকৃতির মানুষ যেন এখন দাঁড়িয়ে সামনে। তাতান ফিসফিস করে তিতির কানে কানে বললো, “সাধুবাবার হলোটা কি?”

“চুপ এখন।” তিতি মৃদু স্বরে ধমকে উঠলো তাতানকে। সাধুবাবা ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন… উনি তো আবার মনের কথা বুঝে যান।

১০

ওই ঘটনার পর প্রায় দিন পাঁচেক কেটে গেছে। জন্সি এখন একদম স্বাভাবিক। ন্যান্সিও ফিরে এসেছে সুস্থ হয়ে, তার এখন খাতিরই আলাদা। আর হঠাৎ করেই তাতানের মায়ের অবস্থারও অনেক উন্নতি হয়েছে, বিপদমুক্ত প্রায়। ডাক্তাররা একে মিরাকল ছাড়া কিছুই বলতে পারছেননা। তাতানরাও জানে এটা মিরাকেলই। তাতানের শুধু খারাপ লাগে এই ভেবে যে ওই সাধুবাবাকে ও কতই না সন্দেহ করেছিল অথচ উনি না থাকলে কি যে হতো! একটা পয়সাও নেননি উনি দক্ষিনা হিসেবে, এমনকি কোনো জলখাবারও খেতে চাননি। শুধু তাথৈ এর অনুরোধ ফেলতে না পেরে একটা সন্দেশ খেয়েছিলেন ওর হাতে।

“তাতান… তাতান… শিগগির টিভি খোল।” তিতিকে উত্তেজিত গলায় বলতে বলতে ঢোকে তাতানের ঘরে। স্বাভাবিকভাবেই তাতান প্রশ্ন করে, “কেন রে?”

“আরে নিউজে দেখাচ্ছে কাল রাত্রে প্রমোটার বিজয় শর্মার অস্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হয়েছে। গলার নলি বরাবর কেউ ছুরি ঢুকিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে।”

“বিজয় শর্মা মানে রাজলক্ষী এপার্টমেন্ট… মানে…”

“হ্যাঁ রে… এবার বোধহয় শর্মিলার আত্মা মুক্তি পাবে। সত্যি সাধুবাবা না থাকলে…”

“আমার একটা জিনিস এখনো ভাবলে অবাক লাগে জানিস…”

“কি?”

“ ওই আত্মাটা সাধু বাবাকে নিজের পাস্ট, প্রেজেন্ট সব নিয়ে এতো কথা বলে গিয়েছিলো ওই সময়ের মধ্যে!”

“তুই এখনও ওনাকে সন্দেহ করছিস!”

“আরে না না। রাগ করিস না। আচ্ছা চল না আজ বিকেলে গিয়ে ওনার সাথে দেখা করে আসি।”

“সত্যি যাবি?”

“হ্যাঁ রে বাবা।”

পরিশেষে: সেদিন বিকেলে তাথৈ আর তাতান গিয়েছিল মন্দিরে কিন্তু কোথাও সাধুবাবার কোনো চিহ্ন মাত্র দেখতে পায়নি। শুধু তিতি মন্দিরের এক কোণে একটা ভাঙা লণ্ঠন খুঁজে পায়।

মন্দির থেকে বেরিয়ে দুজনে খানিকটা বেখেয়ালেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় রাজলক্ষী এপার্টমেন্টের সামনে। কাঙ্খিত ভাবেই কনস্ট্রাকশনের কাজ বন্ধ ছিল সেদিন। এরপর আশেপাশের কিছু লোককে শর্মিলার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে দেখা গিয়েছিল যে ওখানকার সবাই প্রায় চিনত তাকে, বেশিরভাগ জনই নিয়মিত খদ্দের ছিল তার দোকানের। ওখানকার লোকেরা সেই সব তথ্যই দিচ্ছিলো যা সাধু বাবা আগের দিন দিয়েছিলেন ওদের। তবে একটা নতুন তথ্য ওইদিন তিতিরা জানতে পেরেছিল; জেদি,বদ মেজাজি শর্মিলার ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওর কালী ভক্ত স্বামী সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন… আর সংসার ত্যাগের আগে নাকি তাঁর নাম ছিলো হারাধন ঘোষ।

***


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime