অজ্ঞাতনামা
অজ্ঞাতনামা
আমি নেহাতই এক ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি। সারা বছর ধরে যা রোজগার পাতি হয়, তার থেকে একটু একটু করে বাঁচিয়ে রাখি বউ-বাচ্চাকে নিয়ে একটু আশেপাশে কোথাও ঘুরে আসবো বলে। বউয়ের অনেক দিনের ইচ্ছা - বাচ্চাকে নিয়ে পাহাড়ে যাবে, বরফে লুটোপুটি করে খেলা করবে মেয়ের সাথে। গোল গোল বরফের তাল পাকিয়ে ছুঁড়ে মারবে - কার্টুন চ্যানেল দেখে মেয়ে আবদার করেছে নাকি।
সেইমতো, বাধ্য হয়েই একটু আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় হয়ে যাবে জেনেও, সকলে গিয়ে হাজির হলাম সিকিম। আমার কলেজের এক বন্ধু ছিল, যে ওখানে একটা চা বাগানে খাতা সারার কাজ করতো। তো তারই শরণাপন্ন হয়ে এবার গিয়েছিলাম সেই রাজ্যে। বিখ্যাত কাঞ্চনজঙ্ঘা অভয়ারণ্যে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই ফেরার পথে পরলাম বিপদে, না ঠিক আমি ভুক্তভোগী নই, বরং বলা যেতে পারে প্রত্যক্ষদর্শী। আর বিপদটা তো সেখানেই!
খুলেই বলি, সকালবেলা যখন আমার বন্ধুর কোয়ার্টার থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম, তখন সে বারবার বলে দিয়েছিল - তোমার সাথে যে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে, সে অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং ভরসাযোগ্য। পাহাড়ের খাঁজখোজ সমস্ত জায়গা ওর চেনা এবং জানা। যদি কোথাও যেতে বা কোন কিছু করতে ও নিষেধ করে বা এড়িয়ে যায়, তাহলে তোমরাও সেই কাজ করো না বা পারলে এড়িয়েই যেও। এখানে অনেক প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর সব সময় পাওয়া যায় না, সুতরাং অকারণ প্রশ্ন না করে তার পরামর্শ মতই কাজ কর্ম ক'রো। যাও সাবধানে ঘুরে এসো।
আমি তাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তার অফিসের কাজকর্মের চাপের জন্য সে যেতে রাজি হল না। যাইহোক, যাবার পথে তো কোন অসুবিধা হয়নি আমাদের। সেই ড্রাইভার যেখানে যেখানে নিয়ে গেছে তার প্রত্যেকটা জায়গা ছিল অসাধারণ সুন্দর এবং মনোরম, আমাদের তো চোখ জুড়িয়ে গেল। আমার গিন্নি আর মেয়ে তো বরফের উপর লুটোপুটি করে খুব খেলা করলো।
এখন ফেরার পথে, মেয়ে বায়না ধরল একটা রেস্তোরাঁয় কিছু খাবে বলে। আসলে খাওয়াটা তার উদ্দেশ্য নয়, একটা কার্টুনের কাট আউট লাগানো ছিল সেই রেস্তোরাঁর সামনে। সেটাই আকর্ষণের মূল কারণ, সেই জন্যই সে ওখানেই খাবে। আমি সেটা বুঝতে পেরে রাজি হয়ে গেলাম তাকে ওখানে নিয়ে যেতে, কিন্তু এবার বাদ সাধল আমাদের ড্রাইভার। বলল - ওখানে যাবেন না স্যার, ওদের ওখানে বাচ্চা নিয়ে খেতে না গেলেই ভালো।
রেস্তোরাঁটায় ভিড় সেরকম ছিল না, গোটা কতক মাঝ বয়সী লোকের একটা গ্রুপ বসে ওখানে চা বা কফি কিছু খাচ্ছিল। দেখেই বোঝা গেল যে ওরাও আমাদের মতই ট্যুরিস্ট। ওই রেস্তোরাঁয় খেতে না যাওয়ার কোনো কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম না। একে তো এত উঁচুতে আবার কোথায় রেস্তোরাঁ পাবো জানিনা, মেয়েটাও খিদে পেয়েছে বলছে। অন্যান্য লোক তো ওখানে খাচ্ছেও, তাহলে আমাদের সেখানে না খাবার কি কারণ থাকতে পারে?
আমাদের ড্রাইভার মুখে না করলেও, যেহেতু আমি বলেছি তাই রেস্তোরাঁ থেকে একটু দূরে এগিয়ে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়েছিল। সে যথারীতি ভালো-মন্দের পরামর্শ দিয়েছে, এবার সেটা মানা না মানা আমাদের উপর। সে মানা করেছে বলেই হবে বোধহয়, গিন্নিকে দেখলাম খুব একটা আগ্রহী নয় মেয়েকে নিয়ে ওই রেস্তোরাঁয় যেতে, আমারও অবশ্য খুব আগ্রহ বা আকর্ষণ কোনটাই ছিল না।
আর কয়েক মিনিটের মাথাতেই, যখন আমার মেয়েকে ওখানে না যাওয়ার জন্য বোঝাতে এবং আটকে রাখতে ব্যস্ত আমার স্ত্রী, তখনই ঘটে গেল একটা ভয়াবহ ঘটনা। সেই রেস্তোরাঁর জনাকতক ট্যুরিস্টদের একজন ওখান থেকে বেরিয়ে, নিজের গলাটা দু'হাতে চেপে ধরে দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে পড়লো বরফে ঢাকা জমির উপরে। সে দেখি গোগ্রাসে গিলছে সেই বরফগুলোকে, যেন প্রবল পিপাসার্ত সে তার গলায় আটকে যাওয়া কিছু সেই বরফ বা জল খেয়ে নামানোর চেষ্টা করছে।
তাই দেখে আমি একটু অবাক হয়ে, তাকে সাহায্য করবো বলে এগিয়ে যেতেই, আমাদের ড্রাইভার আমার হাতটা ধরে আটকে দিয়ে বললো - ওনার সঙ্গে থাকা লোকজনই ওনাকে সাহায্য করতে যাচ্ছে না যখন, আপনি কেন তার মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছেন? এ' সেই শাপের প্রকোপ, দেখুন না কি হয়! তার এই কথার আমি কোনো জবাব দেবো তার আগেই দেখি - সেই লোকটা বরফে মুখ রগরাতে রগরাতে রক্ত বমি করে মারা গেল!
রেস্তোরাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখি - সেখানেও কেউ নেই, না তার সঙ্গের লোকগুলো, না সেই রেস্তোরাঁর কেউ। ড্রাইভার আমাদের একরকম জোর করেই গাড়িতে তুলে, দ্রুতগতিতে ওখান থেকে আমাদের সরিয়ে নিয়ে চলে এলো নিচের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি, গিন্নির মুখও দেখলাম থমথমে, আর সবথেকে বেশি ভয় পেয়েছে আমাদের মেয়ে। এইভাবে তার চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত সুস্থ মানুষ, হঠাৎ করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মারা গেল - এটা সহ্য করা বোধ হয় তার পক্ষে বেশ কষ্টকর ছিল।
বাকি রাস্তা আর এ বিষয়ে একটাও কথা বলতে সাহস পেলাম না। পরের দিন সকালে দেখি মেয়ের গায়ে বেশ জ্বর এসেছে। ওদের চা-বাগানেরই একজন বয়স্ক ডাক্তার এসে দেখে বললেন - এমনিতে কোনও অসুস্থতা নেই, তবে একটু ভয় পেয়েছে তো। সেটা থেকেই জ্বরটা এসেছে বোধ হয়। বেটার হয়, আপনারা যদি এখান থেকে সমতলের দিকে কোন সুন্দর জায়গায় ওকে নিয়ে চলে যান। পরিবেশ বদলালে মন বদলাবে, আর তখন এই ভয়ের ঘটনাটাও সে ভুলে যাবে।
আমিও ভাবলাম, মেয়ের জ্বরটা একটু কমে গেলেই, ওকে নিয়ে আমরা রওনা দেবো বাড়ির দিকে। কিন্তু ঘটনাটা ঠিক কি ঘটলো ওখানে তা জানার জন্য মনটা তখনও খচখচ করছিল আমারও। আমার বন্ধুকে কথাটা বলতে, সে বলল - দেখ সবটা তো আমিও ঠিক জানিনা, তবে যেটা শুনেছি, উত্তর সিকিমের বেশ কিছু জায়গায় বেশ মারাত্মক একটা কুসংস্কারের চল আছে, এটা খুব সম্ভবত তারই একটা নমুনা।
বললাম - কুসংস্কার, সেটা কিরকম?
সে বলল - চীনের আক্রমণের কারণে, তিব্বত ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসার সময়, অসংখ্য তিব্বতীদের ভিড়ে এখানে এমন একটি পরিবার এসেছিল, যারা অসৎ উপায়ে কোন মহাতপস্বীর মূল্যবান তপস্যালব্ধ সম্পদ নিয়ে পালিয়ে ছিল। শোনা যায়, সেটাতেই ছিল নাকি ওই তপস্বীর জীবনধারণের একমাত্র কারণ। সেটা খোয়া যাওয়ার পরেই তার মৃত্যু হয় এবং মৃত্যুর সময় তিনি তাদের অভিশাপ দেন - ওই সম্পদ যে ধারণ করবে সেই শাপগ্রস্ত হবে, আর ঐ শাপ থেকে নাকি মুক্তি মিলবে তখনই যখন তার হাতে প্রাণ হারাবে অন্য কেউ।
সত্যি মিথ্যা জানি না, কিন্তু এটাই ওখানে প্রচলিত বিশ্বাস এবং সেই অনুযায়ী অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা আজও অন্যের মৃত্যুর কারণ হয়ে নিজেরা শাপমুক্ত হবার চেষ্টা করে। তবে এটা নাকি সত্য ঘটনা যে, তিব্বত থেকে আসা সেই পরিবারের একজন মানুষও স্বাভাবিক ভাবে মারা যায়নি। প্রত্যেকেই দুর্ঘটনা এবং বিষক্রিয়া বা খুন হয়ে মারা যায়। আর সবথেকে বিপদজ্জনক কথা হলো, তাদের চুরি করে আনা সেই সম্পদ নাকি ছোট্ট একটা কৌটোয় রাখা ছিল, যা তারা কাকে কিভাবে দিয়ে গেছে তা কেউ জানে না।
পরবর্তীকালে, কোন না কোন সময় তাদের সংস্পর্শে আসা, প্রায় সব পরিবারেরই দেখা গেছে কেউ না কেউ অস্বাভাবিক মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে। অর্থাৎ নিজেদের চুরি করা সেই সম্পদ তারা কোনভাবে হস্তান্তর করে গেছে তাদের। আর এই ভাবে সেই অভিশপ্ত সম্পদ হস্তান্তরিত হয়ে যে কার কার মাধ্যমে কোথায় কোথায় গেছে, সে সম্পর্কে কারোরই কোনো স্পষ্ট ধারনা নেই।
সেই পরিবারের থেকে ঐ অভিশপ্ত সম্পদ পাওয়া এই অন্যান্য লোকগুলির সঙ্গেও নাকি ঐ রকমই কিছু ঘটেছিল। তারাও নাকি প্রত্যেকে মুক্তি পেতে অন্য মানুষকে মেরে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। সেখান থেকেই ওই কুসংস্কার বা এই দুষ্কর্মের প্রচলন হয়। এমনকি আজও ওখানকার প্রায় সকলেই নিজেদের সেই অভিশাপে শাপিত মনে করে এবং তার থেকে মুক্তির চেষ্টাও চালিয়ে যায়। সেই জন্যই তাদের হাতে ঐ ভাবেই বেঘোরে প্রাণও হারায় অনেক নিরপরাধ মানুষ।
এসব কানাঘুষো অনেকবার শুনেছি তো, তাই বারণ করেছিলাম না জেনে কোথাও না যেতে। এখানে গাড়ি চালায় যত ড্রাইভার, তারা প্রায় সকলেই বিষয়টা জানে। তাই পরিচিত জায়গা ছাড়া এবং পরিচিত লোকের হাতে ছাড়া, তারা নিজেরাও কিছু খায় না বা কোথাও যায় না এবং সঙ্গে থাকা ট্যুরিস্টদের তারা সেখানে নিয়ে যায় না বা যেতেও যায় না। আমিও তাই আগেভাগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম!
নাও, এত ঝক্কি সামলে কষ্ট করে বেড়াতে এসেও ঝামেলার শেষ নেই - বোঝো কান্ড!

