অহং বিষে
অহং বিষে
আজ সকাল থেকেই মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। সকালের চা-টা না খেয়েই বেরিয়ে পড়লেন রমেনবাবু। সামনের মাঠটায় দুবার পাক দিলেন। তারপর তারাপদর চায়ের ঠেকের দিকে পা বাড়ালেন। অনেকদিন যান নি। সবাই বেশ চমকে যাবে। ভাববে, আজ কি হল রমেনদার। বাজারের ভালো চা, ব্যান্ডেড জামা, কুড়ি লাখি গাড়ি চড়া রমেনদা হঠাৎ এই দিকে কি ভুল করে! বেশ মজা হবে। কাগজের কাপের গরম চা’য়ে চুমুক দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে মজা নেবেন। তারপর বলবেন, ‘এতদিনে বুঝলাম, জীবন শুধু টাকায় চলে না; আন্তরিকতা,সৌহার্দ্য বলেও কিছু কথা আছে। তবে তোরা বলতে পারিস, বড্ড দেরী হয়ে গেল এসব বুঝতে। তবে দের আয়ে,দুরস্ত আয়ে… আরে ঐ যে যাকে তোরা ইংরেজিতে বলিস, বেটার লেট দ্যান নেভার।’
ওরা আরো অবাক হবে ওকে এত কথা বলতে দেখে। সচরাচর গম্ভীর, রমেন দত্ত হঠাৎ এত প্রগলভ হল কি রে; এটা ভেবেই ওরা অবাক হবে বেশী করে।
রমেন বাবুর মনে হল, উনি বেশ জোরে হাঁটছেন। এই বয়েসে ওর নিজের হাঁটার গতি দেখে নিজেই চমকে গেলেন। বাইরের কেউ দেখলে মনে করবে উনি ছুটছেন। উইসেন বোল্ট ফেল করে যাবে এই গতির সাথে পাল্লা দিতে।
তবে অবাক হওয়ার পালাটা বোধহয় রমেন বাবুর ছিল।
এত সকালে রাস্তায় লোকের সংখ্যা বেশ সীমিত। সুতরাং ওনাকে লক্ষ্য করাটা দু’পাঁচজনের হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু রমেনবাবু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, ওনাকে কেউ দেখছে না। আশ্চর্য……. তবু হতোদ্যম হওয়া থেকে, নিজেকে নিজেই আশ্বস্ত করলেন মনে মনে এই বলে যে,"অতি উৎসাহে আমিই বেশী তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি। আমি তো এদিকে আসি না, তাই এখানকার লোকজন চিনবেই বা কি করে? সবাই সবার মতো ব্যস্ত, তাই আর খেয়াল করেনি। আমি উত্তেজনার বশে একটু বেশিই ভাবছি।"
একি, এখানেই তো ছিল তারাপদর চায়ের দোকানটা। কিন্তু ধারে কাছে তো কোনো চায়ের দোকানই দেখতে পাচ্ছেন না রমেনবাবু! সামনে একটা বিরাট মল, এখন অবশ্য বন্ধ। আশেপাশে অনেকগুলো ফ্ল্যাটবাড়ি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই পলেস্তারা খসা প্রাচীন ক্লাবঘরটারও অস্তিত্ব নেই কোথাও। জায়গাটাই যেন রাতারাতি ভোল বদলে ফেলেছে। রাতারাতি? নাহ্, মাঝে বয়ে গেছে একুশটা বছরের সময়কাল। আত্মমগ্নতায় সময়ের হিসেবটাই রাখা হয়নি। আর তাই বুঝি মুঠো গলে কখন সে হারিয়ে গেছে আপন গতিপথে। কিন্তু নাঃ, আজ আর সময় নষ্ট করা চলবে না। জীবন তাকে দেখিয়েছে, শিখিয়েছে, সম্পর্কগুলো কতো মূল্যবান। হেলায় তা চিরকালের মতোই হারিয়ে যায়। তাই তো তিনি আজ ঐশ্বর্য্যবান হয়েও নিঃস্ব, হাজার লোকের ভিড়েও একা। তাই আজ যেভাবেই হোক, সেই আড্ডাবাজ বন্ধুগুলোকে খুঁজে বের করতেই হবে তাঁকে। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবেন? কে বলে দেবে তাঁকে তাঁদের ঠিকানা? উদভ্রান্তের মতো খানিক এদিক- ওদিক ঘুরতে ঘুরতে, একটা ছোট লণ্ড্রি দেখে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "এখানে একটা চায়ের দোকান ছিল, লোকটার নাম তারাপদ। চেনো? কোথায় গেছে এখন সে? আর ঐখানে একটা ভাঙাচোরা ক্লাবঘর ছিল, অনেকে আড্ডা দিত, সেটাও দেখছি না। আসলে আমি এদিকে অনেক বছর পর এসেছি, আমার প্রিয়জনদের খোঁজে। একটু যদি খোঁজ দিতে পারো।" "বাবু, আপনি কবেকার কথা বলছেন, আমি জানি না। আমি তো চার বছর হলো দোকান দিয়েছি। এই ফ্ল্যাটগুলো হওয়ার পর। অনেক ঘর লোকের বাস, তাই আমারও রুজিরোজগার হয়ে যায়। আমি তো ঐসব জানি না, দেখিওনি এসে থেকে। আমি কিছু বলতে পারবো না। ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে কেউ থাকতে পারে, আপনার চেনাশোনা। কিছু বুড়া- বুড়িও থাকে তো। ওখানে গিয়ে দেখতে পারেন।"
অথই জলে পড়লেন রমেনবাবু। অচেনা- অজানা বাড়িগুলোয় কিভাবে গিয়ে বন্ধুদের খোঁজ করবেন? তার থেকে, যে দু/চারজনের বাড়ি চিনতেন, সেখানেই গিয়ে দেখা ভালো। এইসব সাত- পাঁচ ভেবে পা বাড়াতে যেতেই, একটা মাঝবয়সী লোককে দেখে কেমন চেনা চেনা লাগল। লণ্ড্রির দিকেই আসছে সে। আশার এই ক্ষীণ আলোটাকেই অন্ধের যষ্ঠির মতো ধরতে চাইলেন রমেনবাবু। পায়ে পায়ে এগিয়ে তার সামনে গিয়ে বললেন, "আপনার নাম কি অরূপ?" লোকটা খানিক হকচকিয়ে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বলল,"কেন বলুন তো? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। এ তল্লাটে দেখিওনি কোনোদিন। কাকে খুঁজছেন?" "খুঁজছি তো বাবা অনেককে। আমার হারানো বন্ধুদের। ঠিকই বলেছো, আমি এখানে থাকি না। বহুবছর আসিওনি। তাই সবকিছু অচেনা ঠেকছে। সেই চায়ের দোকান, ক্লাবঘর, ইতি উতি ছড়ানো ছেটানো বাড়ি কোনোটাই নেই। আমার এক বন্ধুর ছেলের সাথে আপনার মুখের আদলের মিল পেয়ে নামটা জিজ্ঞেস করলাম, খড়কুটো হাতড়ানোর মতোই বলতে পারেন।" মাঝবয়সী লোকটার যেন চাহনিতে কিছু পরিবর্তন হলো। জিজ্ঞেস করলো, সেই বন্ধুর নাম। অখিলেশ নামটা শুনে আশ্বস্ত হয়ে বলল, "হ্যাঁ, আমার বাবা। কিন্তু আপনাকে চিনতে পারছি না, নামটা বলবেন কাইণ্ডলি।" রমেনবাবুর নাম শুনে বলল, "ও আপনিই রমেনকাকু? বাবার মুখে নাম শুনেছিলাম কয়েকবার। কিন্তু বাবা তো চার বছর আগেই মারা গেছেন।" রমেনবাবু কথাটা হজম করতে টাল খেলেন খানিক। অরূপ ধরে বসাল লণ্ড্রির সামনের বেঞ্চিটায়। লণ্ড্রিওয়ালা জলের বোতল এগিয়ে দিল। একটু ধাতস্থ হতেই, অরূপ নিজস্ব ব্যস্ততায় চলেই যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় নিজের সবটুকু প্রাণশক্তি জড়ো করে রমেনবাবু বললেন, "জানি তোমায় বিব্রত করছি। কিন্তু করছি আমার প্রাণের তাগিদে। তাই তোমার ব্যস্ততার মাঝে যদি একটু সময় আমায় দাও, তবে বড়ো উপকৃত হই। তোমার বাবাদের সাথে, মাঝে- সাঝে আমার দেখা হতো ঐ তারাপদর চায়ের ঠেকে, কচিৎ কখনো ক্লাবঘরে। ওরা তাস পিটতো, আমি বসে থাকতাম, আমার আত্মহঙ্কারে বুঁদ হয়ে। ওরা ঠেকে আড্ডা মারতো, গল্পে, হুল্লোড়ে মাতত, আমি উপেক্ষা ভরে দেখতাম আর ছোঁয়াচ বাঁচাতাম আপন তথাকথিত ক্লাসের। কিন্তু আজ জীবনের উপলব্ধিতে জেনেছি, বুঝেছি, কতো অমূল্য সম্পদ হারিয়েছে আমি হেলায়, কতো দামী সময় চলে গেছে আমার হাত গলে। তাই তাদের খুঁজে পাওয়া আমার জীবনের এখন একমাত্র লক্ষ্য। তুমি একটু সাহায্য করতে পারো? তোমার বাবার বন্ধুদের হয়তো অনেককেই তুমি চেনো, নামে, বা চাক্ষুষ পরিচয়ে। আর সেই তারাপদ, এঁরা কোথায় বলতে পারো আমায়? নিখিল, অজিত, সমীর, ধ্রুবজ্যোতি, প্রাণেশ, তপন, নামগুলো চেনা লাগছে কি?" অরূপ কিছুটা বিরক্তি নিয়েই আবার একবার বসতে বাধ্য হয়ে বলল, "আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন সময়ের হিসেবটা। আপনার অর্থপ্রাচুর্যে এবং শরীর সচেতনতায় আপনি এখনো সুস্থ- সবল আছেন ঠিকই। কিন্তু বয়সটা অস্বীকার করতে পারবেন না। আর যাঁদের কথা বলছেন, তাঁরা কেউ কেউ হয়তো একটু স্বচ্ছল ছিল, ব্যস ঐ পর্যন্তই। তাই সমীরকাকু, তপনকাকু আর অজিতকাকু বাবার একটু আগে পরেই চলে গেছেন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে। আর প্রাণেশকাকুর খবর বাবাও জানতেন না শেষের দিকে। ধ্রুবকাকু অবশ্য দিল্লিতে ওনার মেয়ের বাড়ি থাকেন, কাকীমা মারা যাওয়ার পর থেকে। আর নিখিলকাকু আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন, ওনার ছেলের সাথে, তবে রোগশয্যায় পঙ্গু, এমনকি কাউকে চিনতেও পারেন না। তবু আপনি যদি চান, দেখে আসতে পারেন সচক্ষে। তবে যিনি নিজের স্ত্রীকে, ছেলেকেই চিনতে পারেন না, তিনি কি আর আপনাকে এতোযুগ পর দেখে, চিনতে পারবেন? আর ঐ চায়ের দোকানের তারাপদ বহু আগেই তার দোকানের পাট চুকিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেছে। তার দেশ কোথায় এটা অবশ্য বলতে পারবো না, বাবার মুখেই শোনা কথা বললাম আপনাকে। আসি। আমার আবার অফিস আছে, এমনিতেই আজ অনেক দেরী হয়ে গেল। ও হ্যাঁ, নিখিলকাকুদের ফ্ল্যাট নাম্বার 29B, যদি যান, দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দেবে। আসছি।" নমস্কারের ভঙ্গিমায় হাতজোড় করে বলল, "ভালো থাকবেন, সাবধানে ফিরবেন।"
চোখটা ভীষণ জ্বালা করছে রমেনবাবুর। যেন কোনো বিষাক্ত ধোঁয়া গেছে তার চোখে। শুধু কি চোখে? নাঃ, ঐ বিষাক্ত ধোঁয়া প্রবেশ করেছে তার শ্বাসযন্ত্রেও, নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাঁর। গলার কাছটা কেউ যেন সজোরে চেপে ধরেছে, কণ্ঠরোধ হয়ে গেছে, হাজার চেষ্টাতেও স্বর বেরোচ্ছে না, তা থেকে। অথচ চিৎকার করতে চাইছেন তিনি প্রাণপণে, সর্বশক্তি দিয়ে। বলতে চাইছেন,"এ কোন অহঙ্কারের বিষে আমার জীবনটা ধ্বংস হলো নিঃশেষে! এ কোন ভয়ঙ্কর শাস্তি দিল সময় আমাকে? তাকে উপেক্ষা করার অপরাধে, সে কী ভীষণভাবে উপেক্ষা করে, একাকী ফেলে রেখে চলে গেল আমায়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে মনের সবটুকু জমা ব্যথা উজাড় করে, প্রচলিত প্রথার তোয়াক্কা না করে, নিজের মিথ্যে পরিচয়ের গণ্ডি ভেঙে। কিন্তু এই পুতুল সমাজ, এই অলীক পরিচয়ের আমিত্ববোধ, আজও নাগপাশে জড়িয়ে তাকে রিক্ত হতেও দিচ্ছে না মনের বোঝা থেকে। ইতিমধ্যে চাঁদিফাটা রোদও উঠেছে, বোধহয় তার মরুসম জীবনকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে, হয়তো বা উপহাসে বিঁধতে। ধোঁয়াশা চোখে উঠে দাঁড়ালেন কোনোক্রমে। হ্যাঁ, তাঁর চলার পথটাও যে আজ ধোঁয়াশাবৃতই, নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই আর।
