লক্ষ্যপূরণের পথে
লক্ষ্যপূরণের পথে
গাড়িটা রাতের প্রায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটছে। কোলকাতার সারসার আলো ঝলমলে দোকান - মল সরে সরে যাচ্ছে। সেইদিকে আনমনে তাকিয়ে মৌসুমির মনেও পরপর দৃশ্যপট যেন সরে সরে যাচ্ছে। কৈশোরের শেষ লগ্নে করণ ও সুমির(করণের দেওয়া নাম) একে অপরকে দেওয়া অঙ্গীকার, "বিয়ে হবে না আমাদের কখনো, কারণ সেটা কেউ মেনে নেবে না। কিন্তু আমরা আজীবন একে অপরের হয়ে থাকবো। কেউ অন্যকাউকে বিয়ে করবো না কোনোদিন। তুমিও চাকরি করবে, আমিও।" কিন্তু বছর না ঘুরতেই ধস্। মৌয়ের( মৌসুমির ডাক নাম) মাষ্টারমশাইয়ের অবাধ যাতায়াতে বিশ্বাস হারিয়ে করণের বিপথে হারিয়ে যাওয়া ও সেমতো অবস্থাতেই হঠাৎ মাত্র ৬ মাসের মাথায় শুধুমাত্র মৌকে তার কথার খেলাপের শাস্তিস্বরূপ, করণের বিয়ে। তার পরিণতিতে মৌয়ের নিজের অসুস্থতার সাথে যুঝতে থাকা শরীর মনের জোর সবটুকু হারিয়ে প্রায় পঙ্গুত্বের দিকে চলে যাওয়া ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়া। ডাক্তার, ওষুধ, বাড়ি আর হাসপাতালের দৌরাত্ম্যের মাঝেই সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মিতার জীবনে ঝড়ের গতিতে মাষ্টারমশাইয়ের স্থান থেকে প্রেমিকের স্থানে উঠে আসা সুবীর। হাজার বাধা, বিয়ে না করার জেদ, একা থাকার প্রতিজ্ঞা, সর্বোপরি নিজের ও করণের সম্পর্কের সবটা বলা সত্বেও আটকানো যায়নি সুবীরের ভালোবাসার দুর্বার গতি। সর্বতোভাবে দুর্বল মৌ আরো দুর্বল হয়েছিল, নিজের বাবার একাকীত্বের অসহায়তায়।
সব বাধা অতিক্রম করে সুবীর বিয়ে করলো মৌকে, মৌয়ের মাত্র ১৮ বছর বয়স হতে না হতেই। কারণ একটাই, মৌয়ের বাঁচার কোনো স্থিরতা নেই , সব ডাক্তারের একই মত। মৌয়ের বাবা সুবীরের জেদের কাছে হার মেনেছিলেন, হয়তো মনের কোণের এইটুকু আশাতেই যে, যেটুকু জীবনই বাঁচুক, ততোটুকুতেই নারীজীবনের পূর্ণতা নিয়ে বাঁচুক তাহলে। আর সুবীরের হয়তো মনে হয়েছিল জীবনের বেশ কিছুবছর, বেশ কিছুধাপ পেরিয়ে সে তার অগোছালো, উছৃঙ্খল জীবনে সত্যি ভালোবাসার স্বাদ, সর্বোপরি সততার স্বাদ হারাতে কিছুতেই রাজী নয়। এতোদিনের মিথ্যে ভালোবাসার খেলায় এই প্রথম সে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে কাউকে, তাই তার সেই ভালোবাসার জোরেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাবে সে। তার ভালোবাসার জোরেই মৌকে জীবন ফিরিয়ে দেবে। একথা অবশ্য সে শুধু ভাবেইনি, এ কথা স্পষ্টত বলেই, সবাইকে তার কথার দ্বারা প্রভাবিতও করেছিল, তার বন্ধুবান্ধব, বাড়ির লোক ও সর্বোপরি নিজের মা ও মৌয়ের বাবাকে। ততোদিনে কিছুটা পারিবারিক আত্মীয়তার পরিপ্রক্ষিতে মৌকে ও তার বাড়িকে চিনে জেনে ও নিজের ছেলের অগোছালো জীবন সাজানোর আশায় সুবীরের মা শুধু নিজেই রাজী হননি, মৌয়ের বাবাকেও রাজী করিয়েই ছেড়ে ছিলেন।
বিয়ে কি, দাম্পত্যজীবন কি, ঘুণাক্ষরে না জেনেই বিয়ে হয়ে গেল মৌয়ের। বন্ধুরা বা দিদি- বোনেরা যখনই মেয়েলি আলোচনায় মৌকে টানতে চেয়েছে, মৌ হাত ছাড়িয়ে পালিয়েছে। কারণ তার মনের অঙ্গীকারে, তার এসব জানার প্রয়োজনীয়তাই ছিল না। সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, সে বিয়ে করবে না। খুব ভালো করে পড়াশুনা শেষ করে মাষ্টারি করবে আর বাবাকে দেওয়া ঐটুকু বয়সের কথা মতো আজীবন নিজের মা,বাবা,বোনকে দেখবে অভিভাবক হয়ে। তাই ফুলশয্যার রাতে প্রথম চরম অভিজ্ঞতায় বুঝতে শিখলো বিয়ে কি, দাম্পত্য কি। তারপর থেকে পদে পদে হোঁচট খেতে খেতে হাজার মানানো ও মেনে নেওয়াকে সম্বল করে একটু একটু করে সংসার তথা দাম্পত্যজীবনের পথ চলা। কোথাও সবার চোখের দৃষ্টিতে করুণা, দয়া ও জোর করে মেনে নেওয়াকে দেখে, মনে মনে জেদ চেপে যাওয়া, যা হয় হোক, নিজের জীবনের বিনিময়েও একটা সুস্থ -স্বাভাবিক সাধারণ মেয়ে যে দাম্পত্য সুখ দিতে পারে নিজের স্বামীকে, সেই সুখ তাকেও দিতেই হবে। যার ফলে ডাক্তারের ভয়, নিজের বাবা মায়ের নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করে, নিজের জীবনের বাজী রেখে গর্ভধারণ। মনে মনে নিজেই নিজেকে আশা জাগানো আর কেউ না হোক নিজের সন্তান একদিন বুঝবে তাকে, সেই মৌয়ের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠবে একদিন। মনের মাঝে জমানো হাজার ব্যাথার পাহাড় প্রমাণ যন্ত্রণাগুলোকে সে তার কোমল আঙুলে ছুঁয়ে দেবে, ব্যাথা গলে পড়বে অশ্রু হয়ে , যা আজ হিমশীতল বরফ হয়ে জমে আছে মনের হাজার ক্ষতর মাঝে।
কন্যাসন্তান ভূমিষ্ট হওয়ায় আবারও হাজার লাঞ্ছনা, গঞ্জনার অপমান দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে এবার আর নিজের জন্য নয়, সন্তানের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া।তাকে সঠিক শিক্ষা ও মননশীলতার পাঠ পড়াতে গিয়েও নিরন্তর লড়াই আধুনিকতা ও বাহুল্যের প্রাচুর্যের সাথে। তবু হার না মানা জেদ ঘরে, বাইরে সর্বত্র। যার ফলস্বরূপ কখনো ঐটুকু মেয়ের কান্না, কষ্ট, অসহায়তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় কখনো কখনো কঠোর মায়ের রূপ নেওয়া। আবার সেই মৌ ই যখন যখন তার মেয়ে প্রিয়ার দিকে অগণিত প্রশ্ন ও আঙ্গুল উঠেছে, তখন তখন বারংবার মায়ের ভরসা যুগিয়ে বলেছে, " তুই পারবি, তোকে পারতেই হবে। মুখে নয়, কাজে করে দেখাবি। তোর সামনে ওরাই মাথা নত করতে বাধ্য হবে। ওদের হারাবি তুই। ওরা যতোদূর যায়নি, তুই সেই দূর অবধি যাবি।"
হ্যাঁ, এই অদম্য জেদ ঢুকিয়ে দিয়েছিল মৌ প্রিয়ার মনে। তাই প্রিয়াও হাজার ঝড়ঝাপ্টা সামলাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। আজ সে মৌয়ের মতোই দৃঢ়চেতা, কিন্তু মনের দিক থেকে মায়ের মতোই সহজ, সরল, কোমল ও সৎ। তাদের অদম্য জেদ ও কাঠিন্যে ভরা পথের ফসল প্রিয়া আজ নিউট্রিশিয়ানিষ্ট।
হ্যাঁ, মৌ পেরেছে, পেরেছে প্রিয়াও। আর এই দীর্ঘপথে অনেক অসম লড়াই লড়েও মৌকে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। তার শরীর বারবার ভেঙ্গে পড়েছে, অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনও হয়েছে, কিন্তু মৌ লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পিছু হটেনি। আরো দৃঢ়চেতা হয়ে ফিরে এসেছে লড়াইয়ের আসরে। নিজের মেয়ের ভার বহন ও তার সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য নিজের কাঁধকেই বেশী নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত মনে হয়েছে তার পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার চাপে। তার জেদ চেপে গিয়েছিল, এবার তাকে নিজের পায়েই দাঁড়াতে হবে। কোনো কিছুই সম্বল ছিল না, না অর্থ, না মেধার মানপত্র। শুধু মনের জোর আর অসম সাহসকে সম্বল করে সুবীরের কাছে বারংবার হার না মানা জেদে দরবার করে, সামান্য পুঁজি নিয়ে একসাথে ৩টে ব্যবসায় পথে নামা সেই প্রথম, সমস্ত কুণ্ঠা ও জড়তাকে সরিয়ে রেখে। কারণ ততোদিনে সে বুঝেছিল, সুবীরের দায়িত্ব ও তার নিজস্ব জীবনযাপন, তার সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে না কোনোদিন। কারণ ততোদিনে মৌ আর সুবীরের সম্পর্ক হাজার প্রতিশ্রুতির বন্যা ও ভালোবাসার কথার ভিড়ের থেকে সরে এসে বাস্তবের মাটিতে পা রেখেছে। যার একদিকে দুজনের অসম বয়স, মানসিকতা, শিক্ষা, রুচিহোধ, সংস্কৃতির তফাৎ ও অন্যদিকে অহংকার, আমিত্ববোধ, মহান হওয়ার অভিলাষে, সম্পর্কে মুহুর্মুহু ফাটল ধরাচ্ছিল। যার ফলস্বরূপ মৌয়ের একলা লড়াইয়ের পথ আরো কঠিন হয়ে গিয়েছিল। অসুস্থ শরীরে ঘরের কাজ সামলে, মেয়ের দায়িত্ব সামলে, বাইরে শাড়ি, জামা, কসমেটিক্স, হাউসহোল্ড প্রডাক্টের ব্যবসা সামলাতে, বাইরে নিত্য যাতায়াত। হাজার কথার ঝাঁঝ, অপমান উপেক্ষা করেও সবটা চালিয়ে যাওয়া ও তিলে তিলে নিজের মেয়ের ভবিষ্যত গড়া। এরই মাঝে নিজের অভিভাবকহীন পরিবারেরও অভিভাবকের দায়িত্ব পালন। বোনের বিয়ে, হাজার ঝড় ঝাপ্টার জেরে নিজের বাবার চরম অসুস্থতা, মায়ের অসহায়তা, একাকীত্ব ও অসুস্থতায় সর্বক্ষণের সঙ্গী হওয়া, পাশে থাকা, সাধ্যমতো সহয়তার চেষ্টা করা। যদিও সেই চেষ্টায় হামেশাই সুবীরকে পাশে লেগেছে। কারণ, তার ক্ষুদ্র আয়ে, বড়বড় ঝড় সামলানো সম্ভব হয়নি।
কিন্তু এতোকিছুর ভার বইতে বইতে তার অসুস্থ শরীর এবার তার সঙ্গ ছাড়ল। চারিদিকের পরিস্থিতি যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে, ঠিক তখনই তার নিজের জীবনে নেমে এলো বিপর্যয় প্রায় পঙ্গুত্বের রূপ নিয়ে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে, ৪টে জটিল অস্ত্রোপচারে দেহ মন শ্রান্ত, অবসন্ন। একাকীত্বে, মানসিক অবসাদ জাঁকিয়ে বসেছে। এবার সে ফের এই অসম যুদ্ধে লড়তে, ছোটোবেলার বাবার দেখে মনের খুশীতে ধরা কলমকেই হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিল।যদিও নিরন্তর জীবনযুদ্ধে লড়তে যখনই সে ভেঙ্গে পড়েছে তখনই মনের আগুন নেভাতে, জ্বালা মেটাতে, সবার অলক্ষ্যে সে কলমকেই হাতিয়ার করে কাগজেই সব উগড়েছে বারবার। আজ ফের সেই কাগজ কলমকেই জীবনের বাকী লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিল সে। এবার আর সুবীরের পুঁজি চাই না তার। তার কাগজ কলমই এখন তার পুঁজি। হ্যাঁ, এবারও সে পেরেছে কিছু সহৃদয় লোকের সংস্পর্শে এসে, মেয়ের অবদানে আধুনিক যুগের মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে, নিজের লড়াই লড়তে। জীবনের এই অতি অসম যুদ্ধে প্রথম কদম রাখতে। তাই আজ যখন তার প্রথম একক বই প্রকাশের মঞ্চে উদ্যোক্তারা মাইকে সদর্পে বলছিলেন, "হাজার প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে অদম্য জেদে, একক প্রচেষ্টায় উঠে এসেছেন লেখিকা মৌসুমী দেবী। আমরা তাঁর এই হার না মানা লড়াই, মনের জোর, ইচ্ছশক্তিকে কুর্ণিশ জানাই। ", আর সারা অডিটোরিয়াম হাততালির শব্দে গর্জে উঠছিল, তখনও মৌ তারইমধ্যে নিজের মেয়ের উজ্জ্বল মুখ, হাততালির শব্দ ও মোবাইল ক্যামেরার মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশই যেন বারংবার দেখছিল ও তার মনে তা আলাদা সুরের মূর্ছনায় ধরা পড়ছিল বাদবাকী ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি ও করতালির কনসার্টের মাঝে।
এইসব দৃশ্যপট ও কথার তরঙ্গই ধারাবাহিক ভাবে সরে সরে যাচ্ছিল মৌয়ের মনের ক্যামেরায় ও ধ্বনিযন্ত্রে। ঠিক তখনই প্রিয়ার কথায় সেই ঘোরের জাল ছিঁড়ে বাস্তব মাটিতে ফিরে এলো মৌ। প্রিয়া বলছিল, " বাবা ফোন করে বলল, এখুনি সব ছবি বাবাকে পাঠাতে, বাবা ফেসবুকে দেবে। আর আমি তোমার এই মেডেল আর স্মারকটা আমার কাছে রেখে দেবো আজীবন যত্ন করে। মৌয়ের কিছুটা চোখের জল বহুদিন বাদে গড়িয়ে পড়ল প্রিয়ার কথায় আনন্দাশ্রুরূপে আর কিছু হয়তো গভীর বেদনারূপে সুবীরের কথা শুনে। মনও কোথাও কি তাকে আজ কুর্ণিশ জানালো, লক্ষ্যে পৌঁছোনোর তাগিদে!!
