STORYMIRROR

SUMITA CHOUDHURY

Inspirational Children

3  

SUMITA CHOUDHURY

Inspirational Children

মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা

মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা

6 mins
199


পর্ব-১


  কদিন ধরে রঞ্জার একটুও ফুরসৎ নেই। সারাদিনই প্রায় সুইটিকে পড়িয়ে চলেছে। ক্লাস ফোরের সুইটি, স্টুডেন্ট হিসেবে যদিও বেশ ভালো। তবু, এ শেখানো- পড়ানোতে তো কোনো ফাঁক রাখলে চলবে না। সুইটি অবশ্য ইংলিশ মিডিয়ামেই পড়ে। কিন্তু বাড়িতে তো সবার সাথে বাংলাতেই কথা বলে। রঞ্জা কতোবার বলেছে সন্দীপকে, সুইটির সাথে বাড়িতেও ইংলিশেই কথা বলতে, তাহলে সুইটির ইংলিশটা আরো বেটার হবে। বিশেষ করে উচ্চারণগুলো। সুইটির ইংলিশ উচ্চারণে এখনও বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে, ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টের সাথে। সেটা শোধরাতেই হবে এই কদিনে। দিদি(বড়ো জা), দাদাভাই(ভাসুর), অ্যাশ আসছে বলে কথা। ওরা কি ভাববে, রঞ্জা সুইটিকে গেঁয়ো ভূত করেই মানুষ করেছে। না, না, এমন বেইজ্জত হতে পারবে না সে কিছুতেই। তাছাড়া অ্যাশও প্রায় সুইটিরই বয়সী, একটু সামান্য বড়ো। সে তো লণ্ডনে থেকে ইংলিশে একদম চোস্ত। সে এমন ভেতো বাঙালির মতো, ইংলিশ বলা সুইটিকে পাত্তা দেবে নাকি। মেয়েটা তখন সবার সামনে ছোট হয়ে যাবে না। এসব কিছুই সন্দীপের মাথায় ঢোকে না। আর শ্বশুড়মশাইয়ের কথা তো ছেড়েই দাও, তিনি তো আবার সবসময়ই বাংলা নিয়ে গর্ব করেই হেদিয়ে মরেন। তাই রঞ্জাকে একাই সবটুকু পরিশ্রম করে সুইটিকে গড়েপিটে নিতে হচ্ছে। 


 এদিকে সুইটির হয়েছে মহা জ্বালা। এই উইন্টার ভেকেশনের ছুটিটাও মায়ের জ্বালায় ভালো করে এনজয় করা হচ্ছে না। ক্রিসমাসে সান্টা হিসেবে দাদুন তাকে একটা সুন্দর বই গিফ্ট করেছে। কিন্তু সেটা বাংলা বলে, মা সেটা এখন কিছুতেই পড়তে দিচ্ছে না। সারাদিন কিছু না কিছু শিখিয়েই চলেছে। সে তো ইংলিশ ভালোই বলে, স্কুলের ম্যামরাও ভেরী গুড বলেন সবসময় তাকে, তবু মা সমানে বলছে, এটা এরকম নয়, ওটা ওভাবে বলতে হবে। তার একদম বিরক্ত লাগছে। সারাদিনে একটু খেলার সময়, দাদুর কাছে গল্প শোনার সময়টুকু পর্যন্ত নেই, তার এখন। মাঝে মাঝে ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদলে চলবে না, সে তো এখন বড়ো হয়েছে। বাচ্চাদের মতো কাঁদলে সবাই হাসবে যে, বড়ো বলে মানবেই না আর। 


পর্ব- ২


 ঐশ্বর্য ভীষণ এক্সাইটেড। কতো গল্প শুনেছে এতোদিন সে নিজেদের দেশ ভারত সম্পর্কে মা- বাবার কাছে। এই প্রথম সে সচক্ষে দেখবে সেই দেশকে, সেই মাটিতে পা রাখবে প্রথম। সে ঠিকই করে নিয়েছে, ওখানে গিয়ে আর একদম ইংলিশে কথা বলবে না। শুধু প্রাণভরে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলবে সবার সাথে। এখানে তো বাড়িতে যতোটুকু সময় মা- বাবার সাথে থাকে, ঐটুকু সময়েই শুধু বাংলা বলে। আর তো বাকী সবসময় তাকে ইংলিশেই কথা বলতে হয়। বাংলা তো কেউ বোঝেই না। সে ইতিমধ্যে দাদুনের সাথে ফোনালাপে আবদার জানিয়ে রেখেছে, তাকে ভারতের ইতিহাস সংক্ষেপে জানানোর,স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, এসব সম্বন্ধে তাকে বলার জন্য। মা- বাবার থেকে সে জেনেছে, নিজেদের মাতৃভাষার অধিকার পেতে কতো রক্তক্ষয়ী লড়াই করতে হয়েছে শত সহস্র বাঙালিকে। তারপর সেই ভাষা আন্দোলন স্বার্থক হয় আর আজ সেই ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের দিনকে তো সারা পৃথিবী জুড়ে ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই বাংলা ভাষাই, জন্মসূত্রে তার মাতৃভাষা। তাই এই ভাষাকে নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই। সে আবদার করে মা বাবাকে রাজি করিয়ে নিয়েছে, ২১শে ফেব্রুয়ারির পরেই এদেশে ফেরার। সে দেখতে চায় সচক্ষে বাঙালিদের ভাষা দিবস উৎযাপন।


  ঐশ্বর্যর আবেগ, উৎসাহ দেখে ঐশি আর ত্রিদিব ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে, এবারের ভারতে তথা নিজেদের বাড়িতে যাওয়া নিয়ে। ওরা একসময় কলেজে কতো ডিবেট করেছে ভাষা আন্দোলন নিয়ে, কতো না অনুষ্ঠান করেছে ভাষা দিবসে। এখন ঐশ্বর্যর আবদারের দৌলতেই না হয় আরেকবার সামিল হবে সেই ভাষা দিবস উৎযাপনে। যদিও বাংলাদেশই এর জনক। তবু পশ্চিমবঙ্গও তো বৃহত্তর বাঙলারই অংশ। তাই সেখানে আপন মাতৃভাষার গরবে গর্বিত হওয়ার মানুষের অভাব কই। সেই আবেগে, সেই জোয়ারে, সামিল হবে এতো বছর পরে তারাও, আরো একবার। ভেবেই যেন আনন্দে, গর্বে বুকটা ভরে উঠছে। আর তার সাথে সর্বোপরি নিজের দেশের টান, আপন মাতৃভূমির টান তো আছেই।


পর্ব- ৩


  বাড়িতে আসা ইস্তক, সুইটি তাকে সেই লণ্ডনের সবার মতো "অ্যাশ" বলে ডাকছে দেখে, ভীষণ মনখারাপ লাগছে ঐশ্বর্যর। তার এতো সুন্দর নামটাকে ওরা নয় অজান্তেই "ছাই" বানিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তা বলে সুইটিও! এমনকি কাম্মাও তাকে "অ্যাশ" বলছে। কাম্মা তো নিশ্চয়ই জানে তার নামের মানে। তবু এরকমটা কেনো করছে ওরা? আর সারাদিন ইংলিশেই বা কথা বলছে কেন তার সাথে! সে যতো বাংলা বলে, তবুও কাম্মা আর সুইটি ইংলিশ বলা ছাড়েই না! দূর, সেই লণ্ডনের মতোই লাগছে তার, বিরক্তিকর। একমাত্র দাদুন, ঠাম্মা আর কাকুমণির সাথে কথা বলে শান্তি পাওয়া যাচ্ছে। তবে দাদুন তার মধ্যে দি বেস্ট। দাদুন কিন্তু তার সব আবদার রেখেছে। তাকে রোজ গল্পের মতো করে ভারতের কতো কথা বলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা, শহীদদের কথা, এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারীর কথাও বলেছে। দাদুনদের পাড়ার ক্লাবে নাকি একুশে ফেব্রুয়ারী পালন হবে। সে দাদুনের সাথে যাবে কাল সকালে তাই পাড়ার ক্লাবে, জানতে, কি কি হবে ঐদিন। এই নিয়ে ভীষণ উৎসাহ তার। সে সুইটিকেও বলেছে তাদের সাথে যেতে। সে ভেবেছিল সুইটির থেকেও সে অনেক কিছু জানতে পারবে, শিখতে পারবে, কিন্তু সুইটি বলে কিনা, সে এইসব সম্বন্ধে কিছু জানেই না! অবাক কাণ্ড! সুইটি এখানেও ইংলিশ মিডিয়ামেই পড়ে, বাংলা মিডিয়ামে পড়ে না! ইস্, সে যদি এখানে থাকতো, তবে বাংলা মিডিয়ামেই পড়তো, ইংলিশ মিডিয়ামে কিছুতেই নয়। যদিও সুইটিদের স্কুলের একটা সাবজেক্ট হিসেবে বাংলাও আছে। কিন্তু সুইটি বাংলাতে একেবারেই সড়গড় নয়! ইদানিং তো সে আবার ওদেশের মতো করে ইংলিশ বলাও রপ্ত করে নিয়েছে। ধূর, কি কর্কশ, সারাদিন ঐ শুনে শুনে কান পচে গেছে। বাংলা কতো মিষ্টি ভাষা। কতো সহজেই আপন করে নেওয়া যায় তাকে। দাদুন এবার সান্টা সেজে সুইটিকে কি সুন্দর একটা কবিতার বই উপহার দিয়েছে, তার জন্যও পাঠিয়েছিল অবশ্য সান্টার উপহার, প্রতিবারের মতোই, এরকমই খুব সুন্দর একটা বই। সে তো কবেই সেই বইটা পড়ে ফেলেছে। কিন্তু সুইটি এতোদিনের উইন্টার ভেকেশনের মধ্যেও বইটা পড়ার সময়ই পায়নি! তাকে নাকি রোজ কাম্মা সারাক্ষণ ইংলিশ শিখিয়েছে, তাই। নাঃ, সুইটিকে সেই নয় শিখিয়ে দিয়ে যাবে, যা সে জানে, যা সে শিখেছে এতোদিনে মা, বাবা, দাদুনের কাছ থেকে। নাহলে তো সুইটিকে লোকে অশিক্ষিত বলবে, ভারতে থেকেও, বাঙালি হয়েও বাংলা সম্বন্ধে কিছু না জানার জন্য। সে তো এটা হতে দিতে পারে না। একবছরের বড়ো হলেও, দিদি হিসেবে তো তার একটা দায়িত্ব আছে, সেটা তাকে পালন করতেই হবে।



পর্ব- ৪


  ঐশ্বর্যর খুব মজা, দাদুনদের পাড়ার ক্লাবে একুশে ফেব্রুয়ারীর অনুষ্ঠানে সে সবেতেই নাম দিয়েছে। সুইটি খুব কাঁদছিল। ও রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রনৃত্য আর বাংলা কবিতা, আবৃত্তি জানে না বলে। শেষপর্যন্ত ঐশিই সব সমস্যার সমাধান করে দিল। এই এক সপ্তাহ ধরে ঐশ্বর্য আর সুইটিকে গান, নাচ, আবৃত্তির তালিম দেওয়ার মাঝেই, সে হারিয়ে গিয়েছিল তার স্কুল কলেজের সোনা ঝরা দিনগুলোয়।



পর্ব- ৫


 ঐশ্বর্য আর সুইটিকে নিয়ে আজ সেনবাড়ির সবার গর্বের শেষ নেই। পাড়ার সবাই বলেছে এতো সুন্দর একুশে ফেব্রুয়ারী পালন বহুবছর বাদে আবার হলো। অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব তাঁরা ছেড়ে দিয়েছিলেন এবারের অতিথি হিসেবে ঐশিদের। আর পাড়ার ক্লাবের সভাপতি সুশোভন সেনবাবুর দুই বৌমা হতবাক করে দিয়েছে সবাইকে, অনুষ্ঠান সুচারুরূপে পরিচালনা করে এবং এই অল্প সময়ে পাড়ার কচি- কাঁচাদের অনুষ্ঠানের জন্য তৈরী করে। এতোবছর ধরে তাঁরা সুশোভন বাবুর বড় বৌমাকে না দেখলেও, ছোট বৌমাকে দেখেছেন, কিন্তু কোনোদিন এভাবে কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখেননি। এমনকি, ছোট্ট সুইটিকেও নয়। এবারে তাঁরা সত্যিই হতবাক হয়ে গেছেন। সুশোভন বাবুরও এই প্রথম তাঁর বৌমাদের নিয়েও গর্বে বুক ভরে গেছে। আর বহু বহুদিন পর ঐশি আর রঞ্জা যেন তাদের সেই অনাবিল আনন্দমুখর ছাত্রীজীবনের সোনালী দিনগুলো ফিরে পেয়েছিল।



পর্ব- ৬


  ঐশি রঞ্জার কাছে আবদারে একটা জিনিসই চেয়ে নিয়েছে। সুইটিকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর পাশাপাশি, সে যেন তাকে বাংলা সম্বন্ধে সবকিছু জানতে, শিখতে অনুপ্রেরণা দেয়, উৎসাহিত করে। আর ক্রিসমাস নিউ ইয়ারের মতোই, বাংলা সব অনুষ্ঠানেও যেন সুইটিকে নিজে হাতে গড়েপিটে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ায়। আপন মাতৃভাষা নিয়ে গর্বে বাঁচতে শেখায়, হীনমন্যতায় ভুগতে কখনোই নয়। রঞ্জাও কথা দিয়েছে, ঐশির সব কথা সে রাখবে। আসলে এই প্রথম বোধহয় রঞ্জা মন থেকে বুঝল, আধুনিক শিক্ষার নামে পরাধীনতাকেই আঁকড়ে বেঁচেছে সে এতোদিন। আর আজ প্রাণখুলে তার মাতৃভাষাকে নিয়ে, গর্বে বাঁচতে পারছে। আর মাতৃভাষাকে আপন করার সাথে সাথেই, তার হৃত সম্মানও ফিরে এসেছে পূর্ণরূপে। আসলে মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার গরবের মাঝেই যে, সে জাতির অস্তিত্ব নির্ভরশীল। এতোদিন মেকি আধুনিকতায় অন্ধ হয়ে, সে এই সহজ সত্যকে অস্বীকার করে এসেছিল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational