STORYMIRROR

SUMITA CHOUDHURY

Classics Inspirational Others

3  

SUMITA CHOUDHURY

Classics Inspirational Others

সু-মিত

সু-মিত

3 mins
157


 খবরের পাতায় আজ জ্বলজ্বল করছে সুমিতের নাম। সত্যিই সে সু-মিত হয়ে, একটা গোটা বস্তিকে বাঁচিয়েছে লেলিহান আগুনের গ্রাস থেকে।


 খবরটা বারবার পড়েও আশ মিটছে না মিতালির। যেন নিজের চোখকে সে বিশ্বাসই করতে পারছে না, গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে। অথচ এই সেদিনও সবার মুখে মুখে ফিরেছে, সুমিতের প্রতি আঁটা "ভীতু" তকমাটা।


  হ্যাঁ, ভীতুই তো। সুমন ঐভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে চলে যাওয়ার পর থেকে, ছেলেটা সত্যিই ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল। ভয়ে ভয়ে বাঁচতো প্রতিটা ক্ষণ যেন। আজও মনে পড়ে সেই দীপাবলির রাতের কথা। বাজি জ্বালাচ্ছিল সুমিত আর তার বন্ধুরা মিলে। প্রদীপ গুলো জ্বলছিল সার সার। হঠাৎই একটা উড়ন্ত হাউই এসে পড়ল সুমিতের ঠিক পাশে রাখা বাজিগুলোর মধ্যে। নিমেষে ধরে গেল আগুন দাউদাউ করে। সুমিতকে বাঁচাতে সুমন দিল ঝাঁপ। আর তার হাত পা লেগে পাশাপাশি কয়েকটা প্রদীপ গেল উল্টে। আর সেই প্রদীপের তেলে, বাজির বারুদে আগুন নিল তার সর্বগ্রাসী রূপ। সুমিত আর বাকি কচিকাঁচাদের সুমন সরাতে পারলেও, নিজে বন্দী হয়ে গেল আগুনের ঘেরাটোপে। যতোক্ষণে বস্তির সবাই জল- টল দিয়ে তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হলো, ততোক্ষণে সে অর্ধমৃত। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সে চলে গেল চিরদিনের মতো, এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। সেই থেকে বাজি, আগুন, পুজো, চিৎকার- চেঁচামেচি, হই- হট্টগোল সব কিছুকেই সুমিতের খুব ভয়। একটা সামান্য দেশলাইও তাকে দিয়ে জ্বালানো যায়নি কখনো। এই নিয়ে, প্রথম প্রথম উদ্বেগ, ভয়, ভাবনা থেকে রোজকার জীবনযুদ্ধে মিতালির কাছে সেটাই পরিণত হচ্ছিল ক্রমে রাগ, ক্ষোভ, বিতৃষ্ণার অধ্যায়ে। সেই সুমিতই কিনা, গতকাল যখন পাশের বাড়ির মাধুরীদের সিলিণ্ডারটা ব্লাস্ট করে, তখন মাধুরীর বাচ্চা মেয়েটার তারস্বরে কান্নার আওয়াজে, রান্নাঘরের মধ্যে আগুনের শিখায় বন্দী তার মা-বাবাকে দেখে, হঠাৎই ঝাঁপ দেয় তাদের বাঁচাতে। প্রথমে মেয়েটাকে ঘর থেকে বের করে, ঘরের মধ্যে পড়ে থাকা বিছানার চাদর জড়িয়ে রান্নাঘরে ঢুকে উদ্ধার করে মাধুরী আর তার স্বামীকে। বস্তিতে তখন পরপর লাগোয়া ঘরে আগুন ছড়াচ্ছে। সে উদ্ভ্রান্তের মতো উদ্ধার করতে থাকে একে একে সকলকে। বাকি ছেলে ছোকরারাও তার দেখাদেখি উদ্ধার কাজে নামে। কেউ জল দিয়ে, কেউ তার সাথে ধরাধরি করে লোকজনকে বের করে আনায়। ততোক্ষণে কেউ বুদ্ধি করে দমকলে খবর দিয়েছিল। কাছেই দমকলের অফিস থেকে উদ্ধারকারী দল এসে পোঁছায় মিনিট দশেকের মধ্যেই। যদিও ততোক্ষণে উদ্ধার কাজ প্রায় শেষ। দমকলের তিনটে ইঞ্জিন আধঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিভিয়ে ফেলে। ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যই হয়েছে বস্তির প্রায় সব বাড়িরই। কিন্তু সামান্য আহত হওয়া ছাড়া গুরুতর অগ্নিদগ্ধ কেউ হয়নি। তার মধ্যে যতোটুকু বেশী যা পুড়েছে তা সুমিতেরই। কারণ, চাদর জড়িয়ে জড়িয়ে সেই সব ঘর থেকে সবাইকে উদ্ধার করেছে যে, সবার আগে। যদিও প্রাথমিক চিকিৎসাতেই সেই জ্বালা পোড়ার উপসম হয়েছে তারও। যখন হঠাৎই একটি সংবাদপত্রের লোকেরা এসে হাজির হয় দমকলের কাজ চলার সময় এবং দমকলকর্মীদের সাথে সমানতালে সুমিতকেও উদ্ধার কাজ করতে দেখে এবং সর্বোপরি সবার মুখে সবটা শোনে, তখন শেষমেশ উদ্ধারকাজ মেটার পর তারা সুমিতকে প্রশ্ন করে, "সে চিরাচরিত ভীতু হয়েও এ কাজ কি করে করল?" সুমিত যেন ঘোরের মধ্যে থেকেই উত্তর দেয়, "মিলি যখন কাঁদছিল ভয়ে, তখন যেন আমি আমার বাবাকেই ফের আগুনের মাঝে আটকা পড়ে যেতে দেখলাম। বাবা খুব করে বাঁচতে চাইছিল। আমাদের কাছে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু পারছিল না। মাধুরীমাসিদের "বাঁচাও বাঁচাও" চিৎকারে আমি বাবার গলাই শুনছিলাম। বাবা যেন প্রাণপণে আমায় বলছিল,"সুমিত বাঁচা আমায়।" আর কিছু মনে নেই, শুধু মনে আছে, প্রতিঘর থেকে আমি আমার বাবাকেই বারবার বাঁচাচ্ছিলাম।" 


 সুমিতের বলা কথাগুলো কাগজের পাতায় পড়তে পড়তে মিতালির চোখের জল বাঁধ মানলো না। কানে বাজতে লাগল সুমনের সবসময় বলা কথাগুলো। "আমরা যেখানে থাকি, সেখানকার সবাইকে নিয়েই তো আমাদের পরিবার। সেই বড়ো পরিবারের মধ্যেই তুমি, আমি আর সুমিত একটা অংশ। সুখে-দুখে, হাসি-কান্নায় সবাই সবাইকে জড়িয়েই বাঁচি আমরা আর বাঁচবো আজীবন। এই বড়ো পরিবারের মধ্যেই আমাদের সবার অস্তিত্ব। পরিবারহীন আমাদের কোনো অস্তিত্বই নেই জেনো। সুমিতকেও এটাই বুঝতে হবে, শিখতে হবে, ছোট থেকেই। ওর নামের অর্থ ওকেই পালন করতে হবে সবসময়। সবার সু-মিত, প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠতে হবে ওকে, আপদে-বিপদে, সুখে-দুখে।" মিতালি ভাবে, তাই বুঝি সুমন ওভাবে নিজের ছায়া দেখিয়ে সব ভয় ভেঙে সাহসী করে তুলল তার ছেলেকে এক রাতেই, সেই দুর্যোগের শিক্ষায় শিক্ষিত করে, বড়ো পরিবারের সু-মিত করে তুলল তাকে প্রকৃতই আজ।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics