অদৃশ্য ছোবল
অদৃশ্য ছোবল
সকালে কোয়াটারের সামনে দাড়াতেই কানুর আর বুঝতে বাকি রইলোনা ব্যালকনিতে মেলা জিনিসটা আসহলে কি। সেটি যে একটি ছোটো সাপের খোলস সেটা ঠিক, কিন্তু সাপের শরীর কি এত চওড়া হয় আর তার দুপাশ দিয়ে দুটো ও নীচ দিয়ে একজোড়া......। ভাবনা মাঝখানেই থেমে গেলো রেঞ্জার সাহেবের গলার আওয়াজে।
মাস তিনেক আগে বছর তেইশের ফরেস্ট রেঞ্জার, ইন্দ্রসিস চৌধুরী ঝলদায়ে বদলি হয়ে এসেছে। সাঁওতাল পরগনার এই জায়গাটা শোনাগরা বাঘমারী রোড। দিন চারেক পরের এক সকালে রাইফেলটা পরিষ্কার করতে-করতে নানারকম কথা শুনছিল কানুর। ইন্দ্র একটু ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির ছেলে বলে খুব বেশি কথা বলছিলো না। কিন্তু কানুর বলা কথাগুলো শুনতে তার খুব ভালো লাগছিলো। এখনকার চাষী, চাষবাস, ক্ষেত, জলকপাত আর সাপ। এই সাপের কথায় উঠতেই ইন্দ্র রাইফেলটা চেয়ারের পাশে হেলান দিয়ে রাখলো। তারপর আরো মনোযোগে শুনতে থাকলো কানুর কথা। কোন সাপে বিষ বেশি, কোনটা ছোটো সাপ, কোনটা আবার কালো সাপ, আবার কোনটা মোটা সাপ, ইত্যাদি বিষয়ে শুনতে-শুনতে বেশ আগ্রহী হয়ে পড়ে ইন্দ্র।
বিকেলের পড়ন্ত আলোয় চারিদিক কেমন তামাটে হয়ে উঠেছে। তারই মাঝে জিপে বসে মিস্মির অপেক্ষায় বারবার হাত ঘড়িটা দেখছে ইন্দ্র। স্টেশনে ঘোষণার পর্ব শেষ হলেই গাড়ি থেকে নেমে প্লাটফর্মে হাটা দিল। তারপর জনসাগরের ভির ঠেলে পুরুলিয়া জংশনের মধ্যবর্তী স্থানে দাড়াতেই এস নাইন বোগীর গেটে মিস্মিকে দেখলো। সেও তার দিকে তাকালো। চারটে দৃষ্টি এক হওয়ায় দুজোরা পায়ের গতি বাড়লো। তারপর বহুদিনের স্পর্শের অভাব ঘুচে যাওয়ার প্রথমভাগে এমন আলঙ্গনাবধ্য হলো যে তারা ভুলেই গেলো এটা একটা পাব্লিক প্লেস। তারপর কুলির টাকা মিটিয়ে যখন জিপে বসে তারা তখন মির্মির লেকে সূর্যমামা ডুবন্ত। পুরুলিয়ার এই সাওতাল পরগনা দিয়ে কালো ধোয়া উড়িয়ে জিপটা যাচ্ছে। লাল মাটির দেশে মিস্মি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলো। সিটের উপর উঠে দাড়িয়ে আড়াআড়ি মেলে ধরলো হাত দুটো। তারপর প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, "থ্যাক্স ইন্দ্র, থ্যাক্স ফর সাচ লাভলি ড্রাইভ"। ইন্দ্রসিশ মুচকি হেসে বললো, "তাহলে ফাইনালি তোমার লং ড্রাইভের ইচ্ছাটা পূরণ হলো"। মিস্মি চঞ্চল হয়ে বলে উঠলো, "ইয়েস ইন্দ্র, থ্যাক্ষ্ণ ইউ সো মাচ, আই লাভ ইউ ফর দ্যাট"। ইন্দ্রসিস মুখ বেকিয়ে বললো, "ও বুঝেছি, তার মানে লং ড্রাইভে না নিয়ে গেলে তুমি আর আমায় ভালোবাসতে না"। মিস্মি ডানদিকে চেপে, ইন্দ্রর গায়ে ঘেঁষে বসে বললো, "ভালো না বাসলে এখানে এলাম কেনো?" ইন্দ্রোর মুখে আবার হাসি ফুটলো। সে বললো, তোমায় এক জায়গায় নিয়ে যাবো, দেখবে একদম তোমার মনের মতো জায়গা। খুব ভালো লাগবে তোমার"। মিস্মি "আচ্ছা, কোথায়?" বলে জিজ্ঞেস করে কিন্তু ইন্দ্র কিছু বলেনা যাতে মিস্মি সাসপেন্সে থাকে।
জায়গাটা এতোই ভালো লেগেছে মিস্মির, যে সেখান থেকে যেতে তার মন সায় দিচ্ছিলো না। কিন্তু সময়ের অভাবে তাদের ফিরতেই হলো। ইন্দ্র হাই স্পীডে জিপ ছোটালেও ততক্ষনে ভালই রাত হয়েছে। খামার পেরোতেই ঘণ্টা খানেক লেগেছে। একসময় দুম করে গাড়িটা বেগরবাই শুরু করলো। মিস্মির তাকে, "কি হলো ইন্দ্র গাড়ি কি আর এগোবে না" বলতেই, ইন্দ্র তাকে সান্তনা দিয়ে বললো, "তেমন কিছুই হয়নি। ইঞ্জিনে সামান্য প্রবলেম" বলেই ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। মিস্মিও নেমে পড়লো। তারপর ইন্দ্রের পাশে দাড়িয়ে বললো, "ইঞ্জিনের সমস্যা সামান্য কীকরে হয় ইন্দ্র। ইটস আ মেজর প্রবলেম ডিয়ার"। ইন্দ্র তাকে আশ্বাস দিয়ে বললো, "গাড়ি এখনই ঠিক হয়ে যাবে শোনা। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ" বলেই সামনের বারেট খুলেছে, এমন সময় একটা কৃমির আকারের সাপ ইঞ্জিনে থেকে লাফিয়ে পড়ে ইন্দ্রসিশের আঙ্গুলে। সাথে-সাথে একটা কামড়ও বসিয়ে দিয়ে কোথায় পালিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ইন্দ্র 'আহ্' বলে চেচিয়ে ওঠে। মিস্মি একবার তার নাম উচ্চারণ করে, খপ করে আহত আঙুলটা ধরে নেয়। কিন্তু একি কাণ্ড, সাপের ছোবলের কোনো চিন্হমাত্র নেই সেখানে। মিস্মির দিশেহারা ভাব দেখে ইন্দ্র বলে, "ছারো আমার ব্যাথা করছে না"। মিস্মি অবাক হয়ে বলে, "কি বলছো তুমি। সাপে কেটেছে তোমায়। স্নেক বাইট ইন্দ্র, তোমাকে এক্ষুনি একটা ডক্টরের কাছে যেতে হবে। কিন্তু এখানে কাছাকাছি ডক্টর কোথায় পাবো?" ইন্দ্র বলে, "কোয়ার্টারের কাছেই একজন সদ্য পাশ করে ডাক্তারি করতে এসেছে। ও ছাড়া আরতো কোনো ডক্টর নেই মিস্মি"। মিস্মি বলে, "তাই চলো ইন্দ্র। কিন্তু দড়ি কোথায় পাবো?" ইন্দ্র অবাক হয়ে বললো, "গাড়ির ডিকিতেই তো রাখা আছে। কিন্তু দড়ি দিয়ে তুমি কি করবে?" মিস্মি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। ছুটে গেলো ডিকির দিকে। সেখান থেকে দড়িটা নিয়ে ইন্দ্রের কপজিতে জোরে বেঁধে দিলো। ইন্দ্রও বাঁধা দিলোনা। শিরায় রক্ত চলাচল কিছুক্ষনের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। বাকি পথ মিস্মিই ড্রাইভ করেছিল। ডাক্টার অবশ্য ইন্দ্রের আঙ্গুলে কোনো ক্ষত না দেখে ঠিক ওদের মতোই অবাক হয়েছিল। কারণ সর্পে দনশন করলে সেই স্থানটি ক্ষত হবেই। ইন্দ্র ডাক্তারের সামনেও বললো, যে তার কোনো রকম ব্যাথা হয়নি। সে দিব্যি আছে। ডাক্টার কি ওষুধ দেবে বুঝতেই পড়লো না। ইন্দ্রউ আর তার বিড়ম্বনা বাড়ালো না। মিস্মিকে নিয়ে কোয়ার্টারে ফিরে গেলো। হাত-মুখ ধুয়ে, ফ্রেশ হয়ে খাটে বসে মিস্মি বললো, "এতটা রিস্ক না নিলেই পারতে ইন্দ্র। কোনো একটা মেডিসিন, বা বিষ বের করার পদ্ধতি......"। ইন্দ্র বললো, "ডাক্টার নিজেই বিস্মিত হয়ে দাড়িয়েছিলো, সে আর কিই বা ওষুধ রেকমেন্ড করবে বলোতো"। "তাও" বলতেই মিস্মির মুখের উপর একটা আঙ্গুল রাখলো ইন্দ্র। রাতও অনেক হয়েছে, তাই শুয়ে পড়তে বললো। কিন্তু ইন্দ্র ঘুমিয়ে পড়লেও মিস্মি দুচোখের পাতা এক করতে পারছেনা, এপাশ-ওপাশ করেই চলেছে। একসময় সে উঠে বসল। ইন্দ্র আধো ঘুম জড়ানো গলায় বললো, "কি হলো তোমার, উঠে বসলে কেনো?" মিস্মি বললো, ঘুম আসছে না। কি আজব সাপটা। ছোবলে বিষ নেই, কামড়ানোর দাগ নেই। খুবই অদ্ভুত"। ইন্দ্র মিস্মিকে টেনে ধরলো নিজের বুকের ওপর। তারপর সযত্নে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। এবার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিল। মিস্মির স্নায়ু চঞ্চল হয়ে উঠলো। সেইগুলির সক্রিয়তা বেড়ে গেলো। মিস্মি ঘাড়ের কাছে অনুভূতি পেলো ইন্দ্রের উষ্ণ নিশ্বাসের। ওর শরীরের লোম গুলো খাড়া হয়ে গেলো এক ধাক্কায়। ইন্দ্র চুমু খেল মিস্মির ঘাড়ের কাছে। তারপর তার পোশাক নামিয়ে আবার চুমু খেল তার খোলা পিঠে। ওর শিরায়-শিরায় এক অজানা আবিশের ঝঙ্কার খেলে গেলো। ইন্দ্রের হাত দুটো চেপে ধরলো নিজের বুকের ওপরে। অন্ধ হয়ে গেলো উন্মাদনায়। বিয়ের উপহারের চাদরের উপর এই প্রথম ওদের শরীর দুটো একটু-একটু করে একে অপরের মধ্যে হারিয়ে যেতে লাগলো। একটা-একটা করে আবরণ হারাতে লাগলো মিস্মি আর ইন্দ্রের দেহ। অন্তর্বাসের শেষ টুকরোটুকুর সাথেই খোষে পড়লো মিস্মির কুমারিত্বের শেষ লজ্জার রেশটুকু। পশুর মতো ইন্দ্রের মাথাটাকে চেপে ধরলো নিজের বুকের মধ্যে। আর রাতের শেষ অন্ধকারটুকু তাদের নগ্নতার মধূর্যকে আড়াল করে রক্ষা করে গেলো তাদের সংযমের মর্যাদাটুকু।
মাস খানেক কাটতে না কাটতেই মিস্মির পেটে যন্ত্রণা শুরু হলো, সাথে বমিও। তার এমন অবস্থা মাঝে-মাঝেই হচ্ছে দেখে, ইন্দ্র তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। কিন্তু ডাক্টার যা বললো, তাতে দুজনেরই হুশ উড়ে গেলো। ডাক্টার জানালো, মিস্মি চার মাসের অন্তরসত্ত্যা। তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, কারণ তাদের বিয়েওতো চার মাস হয়নি। কোয়ার্টারে ফিরে ইন্দ্র বললো, "খুবই আজব বেপার, বিয়ের আগেতো এতটা ঘনিষ্ঠ হয়েছি বলে মনে পড়েনা আমার। তোমার কি মনে হয়, এতটা ইন্টিমেসি হয়েছিলাম আমরা বিয়ের আগে?" এই প্রশ্ন শুনে মিস্মির চিন্তা আরো বেড়ে গেলো। কারণ লিপ কিস ছাড়া সত্যিই তেমনভাবে তারা ঘনিষ্ঠ হয়নি বিয়ের আগে। যদিও ইন্দ্র তাকে বেশি চিন্তা করতে বারণ করলো। সে আরো বললো, "যে আসতে চলেছে সে আমাদেরই। সুতরাং এতো ভেবে লাব নেই"। কিন্তু তখনকার মত চিন্তা না করলেও, দ্বিতীয় মাসের শেষেই দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলো। কারণ মিস্মির শরীরটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যে সে প্রায় ছয় মাসের অন্তরসত্ত্যা। এমন বেপার দেখে ডাক্টার ট্রিটমেন্ট করবে কি, নিজেই কাপতে শুরু করেছে। ইন্দ্র অনেকবার কলকাতায় ট্রিটমেন্টের কথা বলেছে কিন্তু মিস্মির আর ঘর থেকে বেরোতে ইচ্ছা করেনা। ইন্দ্র তাকে সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করে, তাউ মেয়েটা মনেমনে গুমরে যাচ্ছে। এটাই কি কোনো আসুক না অন্য কিছু তাউ তারা বুঝতে পারছেনা আর বুঝতে চায়ও না মিস্মি।
এমন করে আর কটা দিন অতিবাহিত হলো। তৃতীয় মাসের শেষে একদিন মিস্মির তলপেটে মারাত্মক যন্ত্রণা শুরু হলো। ইন্দ্র পরিকিমরি করে ডাক্তারকে নিয়ে এলে, সে ডেলিভারি করে মিস্মির। সুন্দর, ফুটফুটে একটা মেয়ে হয় ওদের। কিন্তু ডাক্টার কোনো ফিস নেয়না, কারণ তিন মাসে মানুষের সন্তান জন্ম, ব্যাপারটাই তার কাছে আশ্চর্যের থেকেও বেশি কিছু।
কানুর ছেলের জর ছিল বলে সে দুদিন কাজে আসেনি। আজ সকালে কোয়াটারের সামনে দাড়াতেই তার আর বুঝতে বাকি রইলোনা ব্যালকনিতে মেলা জিনিসটা আসহলে কি। সেটি যে একটি ছোটো সাপের খোলস সেটা ঠিক, কিন্তু সাপের শরীর কি এত চওড়া হয় আর তার দুপাশ দিয়ে দুটো হাত ও নীচ দিয়ে একজোড়া পা হয় কি?


