অচল পয়সা
অচল পয়সা
বেশ নাম ডাক ছিলো তরনী খুঁড়োর একটা সময়। বছর চারেক পাঁচেক আগে থেকে ওর গান আর ও অচল হয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগে পালা গান গেয়ে শেষ যে নামবলিটা উপহার পেয়েছিলো ও। সেই ছেঁড়া নামবলিটাই জরিয়েই তরনী খুঁড়ো মারা গেলো। শত ছিদ্র নামবলি দেখিয়ে গত হাটে ভিক্ষা করেছিলো তরনী খুঁড়ো দেখেছিলাম। ওর চোখে দেখেছিলাম জলে ভরা, আর বলছিলো " আমার মতো এই নামবলিটাও অচল হয়ে গেছে। শীত আসছে একটা চাদর কিনে দেন না আমায় , কেউ বাবারা।"
দুই দিন আগেই মারা গেছেন, বোধহয় তরনী খুঁড়ো। আগে ওর মোটামুটি রোজগার পাতি ভালোই ছিলো। ভালো বাউল গান গাইতো যে ওরা। ওরা বলতে ও ট্রেনে ভিক্ষা করতো ওর মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটা হরি নামও ভালো গাইতো। কিন্তু অতি লোভে তাঁতী নষ্ট। সূর্যপুরের ইটখোলায় বিহার থেকে কাজ করতে আসা রফিকুল সাথে ওর প্রেম হলো কিভাবে কে জানে? ওর নাকি মুম্বাইয়ে ফ্লিম পাড়ায় চেনা জানা আছে ।এমনটাই বলেছিলো রফিকুল । তারনী খুঁড়োর মেয়ে শ্যামা ওর সাথে স্বপ্ন দেখলো বড়ো গায়িকা হবার, সাথে গান গেয়ে, অনেক বড়ো লোক হবার। রফিকুল সাথে পালালো মুম্বাইএ । শ্যামল সেদিন বলছিল যে শ্যামা গায়িকা হতে পারি নি। নাম তো দূরে থাক বদনাম করছে গায়ের নাম । ওকে এখন পাওয়া যাবে সেন্ট্রাল মুম্বাই এর কাছে ঐ বদনাম গলি পথে।
লাশ পচা গন্ধ ছড়িয়েছে দেখেই, তরনী খুঁড়ো ঘরে এসে হাজির হয় সবাই । গ্রামের মানুষ জন আবিষ্কার করলো তরনী খুঁড়ো মারা গেছেন বোধহয় দুই তিন দিন আগেই মারা গেছে। লোকজন এর দোষ কি ?এদিকে টায় তো কেউ আসে না । অচল তরনী খুঁড়ো খোঁজ খবর রাখার প্রয়োজনতো কখনো পরে না গ্রামবাসিদের। কিন্তু তরনী খুঁড়ো লাশটা অদ্ভুত ভাবে জরিয়ে আছে একটা মাটির লক্ষীরভাড়কে ।
পাড়া ছেলে পুলেরা বললো ওটা ভেঙে যা টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে তরনী খুঁড়ো সৎকারটা হয়ে যাবে এটাই ভালো। ভারটা ভাঙা হলো। একটা পাঁচশ টাকার নোট বেড়ালো , আর অনেক খুচরা পয়সা। বেশির ভাগটাই অচল। তবে আমি পেলাম একটা চিঠি। তরনী খুঁড়োকে শ্যামা লিখেছে।
" বাবা ক্ষমা করো আমায়। চুরি করলাম তোমার সারাজীবনের সঞ্চয়টাকে । শত বিপদেও ভাড়টা তুমি ভাঙ্গতে দাওনি। তুমি বলতে আমার বিয়ে সময় ভাঙ্গবে ভাড়টা। নোট বন্দীর সময় লক্ষ্মী ভাড়টা যখন ভাঙতে চেয়েছিলাম তুমি বলেছিলে। আমরা গরীব মানুষ, ওতে মাত্র একটাই পাঁচশ টাকা আছে। তুমি বলেছিলে চব্বিশটা একশত টাকা, পাঞ্ছান্নটা পঞ্চাশ টাকা, চল্লিশটা কুড়ি টাকা, আশিটা দশটাকা , আর বিরানব্বই টা পাঁচ টাকার নোট আছে। মুম্বাই যাবার জন্য আমি ভাড়া টাকে ভেঙে টাকা গুলো বেড় করে আবার জূড়ে রেখে দিয়েছি। সত্যি হুবাহুব হিসেবে মিলে গেলো তোমার সাথে । কষ্ট হয়েছে ভেবে হয়তো এই একটা একটা নোট জমানোর পিছনে ছোট ছোট অনেক ইচ্ছা না পুরনের গল্প লুকিয়ে আছে। তবে অচল টাকা পয়সা গুলো রেখে গেলাম। বড়ো গায়িকা হয়ে তোমাকে সব টাকা পয়সা ফিরত দিয়ে দেবো। আমাকে ক্ষমা করো। রফিকুল আমায় বিয়ে করবে বলছে বিনা টাকা পয়সায় , তবে টাকা লাগবেই মুম্বাই যেতে।"
চিঠিটা আমার কাছে খুব দামী। মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনের দলিল ওটা। বাকি সব কিছুই ওর অচল।দুঃখ হলো তরনী খুঁড়ো অচল পয়সা গুলো আগলে আগলে মারা গেলো। যদিও আজ অচল হলেও তরনী খুঁড়ো আর অচল পয়সা গুলোর কিন্তু একদিন বাজারে মূল্য ছিলো।
