আমি তুই আর একলা চাঁদ
আমি তুই আর একলা চাঁদ
অবশেষে অনেকদিনের প্রতীক্ষার পর মনের অভিলাষা পূর্ণ হতে চলেছে শুভাশিসের।তার প্রথম ও শেষ প্রেম প্রিয়াঙ্কার সাথে দেখা করার জন্য ছুটতে হচ্ছে সুদূর মধ্যপ্রদেশের দেওয়াসে।প্রিয়াঙ্কা তার অন্তরের আকুতি, তার বুকের প্রতিটি হৃদস্পন্দন, তার মনের এক একটি না বলা কথা, তার লেখা প্রত্যেক টি কবিতা।তার মনের সমস্ত আবেগ অনুভূতি শেয়ার করার একমাত্র পার্টনার।
আজ মনে পড়ে যাচ্ছে শুভাশিসের, প্রিয়াঙ্কার সাথে তার প্রথম পরিচয় সল্টলেক এন আই আই টি (NIIT)তে পড়ার সময়।বারাসত গর্ভনমেন্ট কলেজে ম্যাথ অনার্স নিয়ে পড়ার সময় থেকেই শুভাশিসের লক্ষ্য নামী দামী আই টি প্রফেশনাল হবার। না, নিজের লক্ষ্য মিস করতে চায় নি শুভাশিস। তাই তো ফাইনাল ইয়ারে পরীক্ষা দেবার পর NITATতে দারুণ রেজাল্ট করার সুবাদে স্কলারশিপ নিয়ে সল্টলেক NIITতে ভর্তি হয়েছিল শুভাশিস। সেখানে এক বছরের কোর্স আর তারপর ছয় মাসের ইন্টার্নশিপ।আর এই এন আই আই টি তে প্রথম দিনই ওর মন কেড়ে নিয়েছিল প্রিয়াঙ্কা।আজও সেই মুহূর্তের কথা ভাবলে শিহরণ জাগে শুভাশিসের সারা শরীরে আর মনে যখন প্রথমবারের জন্য দুজনের চারচক্ষু একত্রিত হচ্ছিল এই কোলকাতারই বুকে।
শুভাশিস আচার্য্য আর প্রিয়াঙ্কা পাণিগ্রাহী।এক বাঙালী যুবক আর এক ওড়িয়া যুবতীর প্রেমগাথা।ভিন্ রাজ্যের ছেলেমেয়ে হলেও একে অপরের প্রেমে পড়তে অসুবিধা হয় নি তাদের।প্রিয়াঙ্কা ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরাজী সাহিত্যের ছাত্রী।প্রিয়াঙ্কার কাছ থেকে শুভাশিস জেনেছিল যে, ওর বাবা ড.বেণুধর পাণিগ্রাহী ভুবনেশ্বরের বিখ্যাত বক্সী জগবন্ধু কলেজ , যা সংক্ষেপে BJBকলেজ নামেই বিখ্যাত,সেখানকার ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান। যথেষ্ট ধার্মিক,সংস্কৃতিবান এবং রাশভারী লোক।তার পড়ার ঘরটিকে ছোটখাটো লাইব্রেরী বললেও কম হবে।
শনিবারের বারবেলা।হাওড়া স্টেশনে বসে অপেক্ষা করছে শুভাশিস শিপ্রা এক্সপ্রেস ধরার জন্য।এই ট্রেন তাকে তার প্রিয় শহর উজ্জয়িনীর ওপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে দেওয়াসে তার প্রেমাস্পদার কাছে পৌঁছে দেবে।আসলে বলতে গেলে প্রিয়াঙ্কা এখন দেওয়াসের কলেজের ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপিকা। নিজের বাবার মতোই সে অধ্যাপনাকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে।এছাড়া সাহিত্যের জগতেও নাম করেছে। পিছিয়ে নেই শুভাশিসও।সেও অন্তেপ্রেনার হিসাবে নাম করেছে।
গ্রাজুয়েশনের পরেই বাবা বিক্রম আচার্য্যকে হারাতে হয়েছিল, কিন্তু তাতেও সে ভেঙে পড়ে নি। নিজের উপার্জনে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্সে এম . এস. সি কমপ্লিট করেছে।প্রথমে উইপ্রোতে চাকরি পেয়েছিল, সেটা ছেড়ে দিয়ে এখন টি সি এস এ অধিক মাইনের একটা চাকরি পেয়েছে।সে এখন সুপ্রতিষ্ঠিত এবং স্বপ্রতিষ্ঠিত।এম এস সি'তে দারুণ রেজাল্ট করার সুবাদে মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ করার অফার লেটার পেয়েছে।দশ-বারোদিন পরে ওখানে যাবার কথা রয়েছে।
ট্রেনের এসি টু টায়ারে নিজের আসন গ্রহণ করে মাথা থেকে সকল দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলল শুভাশিস।তার মন আর মনন জুড়ে এখন শুধুই প্রিয়াঙ্কা। শুভাশিসের মনে পড়ে গেল, কিভাবে প্রিয়াঙ্কা তার মন আর মনন ছেয়ে গেছিল।কি'ভাবে তার প্রিয়াঙ্কার প্রতি ভালোলাগা ও তা থেকে ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। প্রথম দিন বর্ষারাতে সে প্রিয়াঙ্কার সাথে বৃষ্টিতে ভিজেছিল,গাঢ় আলিঙ্গনে অনুভব করেছিল প্রেমিকার সিক্ত শরীরের উষ্ণ স্পর্শ,যা তার শরীর মনকে রোমাঞ্চিত করেছিল। তার পর রাতে প্রিয়াঙ্কার সাথে ফেসবুকে দীর্ঘ চ্যাট,দুপুরবেলা ক্লাস শেষ হয়ে যাবার পর মাঝে মাঝে সিটি সেন্টার আর নিউটাউনের ইকো পার্কে ঘুরতে যাওয়া। মনে পড়ে যাচ্ছে, কোনো এক শরতের শীতল সকালে প্রিয়াঙ্কাকে প্রপোজ করেছিল শুভাশিস। আধো আধো লাজুক স্বরে জানিয়েছিল মনের মধ্যে সঞ্চিত গভীর গোপন অনুভূতির কথা। প্রিয়াঙ্কার মনেও হয়তো পূর্বরাগ সঞ্চিত হয়েছিল আগে থেকেই। সেদিন কিছু বলে নি প্রিয়াঙ্কা, শুধু মাথা নিচু করে চুপ করে ছিল। হয়তো নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।পরের দিন সুশোভনস্যারের ক্লাস শেষ হবার পরে শুভাশিসের হাতে দিয়ে গেল ছোট্ট একটি চিরকুট।তাতে লেখা ছিল," শুভ,আমি শুধু তোকেই ভালোবাসি। তোকে ছাড়া আমি আর কাউকেই চাই না। তোকে পেতে চাই, হয়তো তোকে বেশি সময় দিতে পারি না।কিন্তু,আমি তোরই,আমি শুধুই তোর।তুই যদি শ্যাম হোস, তবে আমি রাই। তুই যদি রোমিও হোস,তাহলে আমি তোর জুলিয়েট।" সেদিন রাতে আর ঘুমই হয় নি শুভাশিসের,সারাক্ষণ ধরে ভেবে গেল প্রিয়াঙ্কার কথা,প্রিয়াঙ্কা তার হৃদয় হরণকারিণী,তার চিত্তবিনোদিনী।
পরেরদিনই যখন সে দেখেছিল প্রিয়াঙ্কাকে,তখন উভয়ের চোখ দিয়েই প্রেম উপচে পড়ছে। সেদিন ক্লাস শেষ হবার পর বাস ধরে ইকো পার্কে গিয়ে একান্ত আপন কিছু মুহূর্ত কাটিয়েছিল দু'জন।পশ্চিম দিগন্তকে রক্তিম করে অস্তাচলে যাচ্ছিল সূর্য,বইছিল শরীর আর মনকে তাজা করে দেওয়া বিকেলের ফুরফুরে হাওয়া,আকাশের কোণায় উঠেছিল একফালি চাঁদ, শুভাশিস প্রিয়াঙ্কার কোমল হাত ধরে বলেছিল ,"প্রিয়া, হয়তো কোনো এক সময়ে আমরা দূরে,বহু দূরে থাকব।কিন্তু,আমরা যেন একে অপরকে ভুলে না যাই।আমরা যদি এই জীবনে একে অপরকে
নাও পাই,,তাহলেও একজন আরেকজনের মনের মধ্যে যেন বেঁচে থাকি।" প্রিয়াঙ্কা তার অপ্সরানিন্দিত কন্ঠস্বরে বলল-"শোন্ শুভ,তোকে যদি না পাই এই জীবনে,তাহলে আমি আর বিয়েই করব না। কুমারীই থেকে যাব সারা জীবন। আমাদের প্রেমের সাক্ষী এই শরতের ফুরফুরে হাওয়া আর আকাশের কোণায় থাকা ঐ একলা চাঁদ।" তারপর কিছুক্ষণ থেমে বলেছিল,"আর তুই তো জানিস , আমি যা বলি তাই করি।তুই দেখে নিস আমি কি'ভাবে কথা রাখি।" এই কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল শুভাশিস।বলল-"বাপ রে,এতো বড়ো ডিসিশন,সত্যি তুইও পারিস।"তারপর আলতো করে প্রিয়াঙ্কার হাতে চুমু খেয়ে বলেছিল,"আমি জানি তুই পারবি। কথা দিয়ে কথা রাখিস তুই। কিন্তু,আমার খুব ভয় করে, কোনোদিন বদলে যাস না কিন্তু। ছেড়ে চলে যাস না আমাকে।" প্রিয়াঙ্কা হেসে বলেছিল-"কোনোদিন ভুলব না তোকে। চিরদিন তোর হয়েই তো থাকব।"
ট্রেন থামল আসানসোলে। আইফোনটা বেজে উঠতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল শুভাশিসের।ফোন করেছে পাড়াতো দাদা গৌরাঙ্গ দে, যে 'গোরাদা' নামেই সুপরিচিত। শুভাশিস বিরক্ত হল, আশ্চর্য মানুষ এই গোরাদা। কিছু মানুষ থাকে না,যাদের কাজই হল তেলা মাথায় তেল মাখানো,তো এই গোরাদা তাদেরই মধ্যে একজন।গোরাদার পাড়ায় প্রভাব যথেষ্ট আছে। কিন্তু,শুভাশিসের বাবা যখন লাংস্ ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন,শুভাশিসের গোটা পরিবার যখন অথৈ জলে পড়েছিল,তখন শুভাশিস প্রথমে এই গৌরাঙ্গ দের কাছেই সাহায্য চেয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়,গোরাদা তখন তাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা,বরং রাস্তার খেঁদি কুকুরের মতোই তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল।কিন্তু,এই শুভাশিসই যখন বি এস সিতে
ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল,তারপরে সমাজের বুকে সুপ্রতিষ্ঠিত হল,তখন গোরাদার মুখেই শুভাশিসের
প্রশংসা আর ধরে না।শুভাশিসের মতো আর ছেলেই হয় না গোরাদার মতে।আর শুধু গোরাদা কেন, পাড়ার সব লোকই তখন তো শুভাশিসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যাই হোক,এখনো শুভাশিসের মনে গোরাদার প্রতি চাপা রাগ যথেষ্ট আছে।তাই,এইসময় গোরাদার ফোন আসায় বিরক্ত হল শুভাশিস।ফোন ধরতেই ওপার থেকে উচ্ছ্বসিত গোরাদার চিৎকার ,"ভাই, কেমন আছিস! তোর মার কাছে শুনলাম তুই নাকি আমেরিকা যাচ্ছিস।বাহ্,দারুণ খবর।তো আমাদেরকে খাওয়াবি কবে?" না, আর ভণ্ডামি সহ্য হল না শুভাশিসের। এতদিন গোরাদাকে সে অনেক সহ্য করেছে। কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা থাকে। তৎক্ষণাৎ কলটা কেটে দিয়ে TrueCaller থেকে ব্লক করে দিল গোরাদাকে। এই কাজটা তার অনেক আগেই করা উচিত ছিল। রাতের আঁধারকে ছিন্ন করে দুরন্ত গতিতে ছুটছে শিপ্রা এক্সপ্রেস। সিটে হেলান দিয়ে সে ডুবে গেল প্রিয়াঙ্কার চিন্তায়।
তার মনে পড়ে গেল প্রিন্সেপঘাটে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় বসন্তের এক সোনালী বিকেলে তার প্রিয়তমাকে নিয়ে কাটানো কিছু ঘনিষ্ট অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে পূর্ণসলিলা ভাগীরথী-হুগলী নদী, এক পূর্ণযৌবনা তরুণীর ন্যায়। বিদ্যাসাগর সেতুর আড়াল থেকে সূর্যদেব অন্তিম বিদায় জানাচ্ছেন। প্রিয়াঙ্কার রক্তিম অধর শুভাশিসের সিগারেট খাওয়া ঠোঁটকে স্পর্শ করেছে। শ্যামবর্ণা সুস্তনী উদ্ভিন্নযৌবনা প্রিয়াঙ্কাকে আজ নীল শাড়িতে কতোই না সুন্দর মনে হচ্ছে! অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা লেখে প্রিয়াঙ্কা। একটা কথা রয়েছে,"Poets are the leaders of lovers." তো সেদিন তার হাত ধরে প্রিয়াঙ্কা বলে উঠেছিল,
"O my love, I'll be your daydream,
I'll wear your favourite things,
I'll take you to the paradise,
Say you'll never let me go!!"
উত্তরে শুভাশিসও বলে উঠেছিল,
"Like a tornado or a whirlwind,
Oft
en you come in my mind,
With the glimpses of angelic beauty and passion,
You never let me look behind!!"
ভাবনায় আবার ছেদ পড়ল শুভাশিসের। মধ্যরাত। দেহরি-অন-শোন পার করে ট্রেন ছুটছে শোন নদীর ওপর তৈরি ব্রিজ দিয়ে। এটা কোনো নদীর ওপর তৈরি ভারতের দীর্ঘতম রেলওয়ে ব্রিজ।ঝমঝম ঝমঝম শব্দ হচ্ছে। নীচে বালুর চড়া। সামনেই পূর্ণিমা । আকাশে প্রায় গোল পূর্ণচন্দ্র। বিশ্বচরাচর রূপোলী জ্যোৎস্নায় ভাসছে। চাঁদের আলোয় নদীর জল ঝিকিমিকি করছে। আপশোস হল শুভাশিসের মনে। সুন্দর ফুরফুরে হাওয়াটা মিস করল। কেন যে সে স্লিপার ক্লাসে চাপল না! শুভাশিস বুঝতে পারল বড়লোক হবার বিড়ম্বনা। কিন্তু তাতেও এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে কোনো বাধা নেই। ঝমঝম করে তুরীয় গতিতে ছুটছে শিপ্রা এক্সপ্রেস। চাঁদের রূপোলী আলোয় মনে হচ্ছে নদীর জলের ওপর কেউ একজন রূপোলী চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। সারা বিশ্বচরাচরকে অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে। শুভাশিস মনে মনে উচ্চারণ করল" By silver reeds in a silver stream." পেরিয়ে গেল শোননদী। না, আজ রাতে ট্রেনের মধ্যে হয়তো ঘুম আর আসবে না। শুভাশিস ফের ডুবে গেল প্রিয়াঙ্কার চিন্তায়।
প্রথমবার Wiproতে চাকরি পেয়েই প্রিয়াঙ্কার শহর ভুবনেশ্বরে বেড়াতে গিয়েছিল শুভাশিস। তখন প্রিয়াঙ্কা ভুবনেশ্বরেই ছিল ।দীপাবলীর সময়। হাওড়া থেকে ভোরের ধৌলী এক্সপ্রেস ধরেছিল শুভাশিস। খড়্গপুর পার হতেই বদলে গিয়েছিল
চার পাশের প্রকৃতি। দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিল ভুবনেশ্বর। প্রিয়াঙ্কা স্টেশনেই অপেক্ষা করছিল। সেখান থেকে বাসে করে প্রিয়াঙ্কাদের বাড়ি গিয়েছিল শুভাশিস।
প্রিয়াঙ্কাদের বাড়িটা স্টেশন থেকে বেশ দূর। লিঙ্গেশ্বর মন্দিরের কাছে। ভুবনেশ্বরকে বলা হয় মন্দিরের শহর। সারা শহর জুড়ে ছড়ানো রয়েছে সুদৃশ্য মন্দির। ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির,লিঙ্গরাজ মন্দির তো আছেই , শহর থেকে কিছুটা দূরেই উদয়গিরি, খণ্ডগিরি। সারা শহরে বিরাজ করছে এক স্নিগ্ধতার ছোঁয়া।
প্রিয়াঙ্কার বাবা ড.বেণুধর পাণিগ্রাহীর সাথে আলাপ করেছিল শুভাশিস। রাসভারী লোক হলে কি হবে সত্যিই ভালো মানসিকতাসম্পন্ন লোক। দেশপ্রেমী,দেশভক্ত। স্টাডিরুমে অনেক দেশভক্তির বইও রয়েছে। শুভাশিস ওনার সাথে কথা বলে জানল যে, উনি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' বইটি পড়েছেন এবং সেটা ওনার প্রিয় গ্রন্থাদির মধ্যেই পড়ে। শুভাশিসকে উনি 'কথাপুয়া'
বইটি উপহার দিলেন এবং বললেন," জান ,এই বইটা আগের বছর সরলা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এই বইটা তোমাকে আমার তরফ থেকে উপহার। জেনি(প্রিয়াঙ্কার ডাকনাম) র কাছে শুনেছি যে, তুমি একজন সাহিত্যপ্রেমী। এই বইটি ওড়িয়া সাহিত্য সম্পর্কে তোমায় জানতে, বুঝতে ও শিখতে সাহায্য করবে। " বেণুবাবুর আরেকটা কথা যেটা শুভাশিসের মন ছুঁয়ে গেছিল সেটা হল,"দেখ জেনিকে একটা কথা আমি প্রায়ই বলি,আর তোমাকেও আজ সেই কথা বলছি। আমি চাই তোমরা অনেক বড়ো হও।মানুষের মতো মানুষ হও। কিন্তু, তোমরা যেখানেই থাক না কেন, আমাদের এই 'সারে জঁহা সে অচ্ছা' হিন্দুস্থানকে ভুলে যেও না।এই দেশ এখন বড়ো দুঃখী, চারিদিকে শুধু জাতি-ধর্ম-ভাষার নামে রক্তপাত।এছাড়া আছে জঙ্গিবাদ আর উগ্র হিন্দুত্ববাদ।গোটা দেশ এখন কাঁদছে। আর ভারতমাতার চোখের এই জল মোছাতে এখন আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। দরকার আমাদের শক্তি,শিক্ষা,সাহস আর সম্পদকে এই মহান উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা।" আরও একটা কথা বললেন বেণুবাবু," স্বর্গের নিজস্ব সঙ্গীত নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু, সেটা মানুষ কিভাবে শুনবে তা ঠিক করে দেবার অধিকার ধর্মপ্রচারকের নেই।ঈশ্বর কখনো বলেন নি অপর ধর্ম, অপর জাতের মানুষদের ঘৃণা করতে।"
শুভাশিসের মনে হল এই দেশটাকে ভ্রষ্টাচার থেকে মুক্ত করার জন্য বেণুবাবুর মতো নির্ভীক , দৃঢ়চেত্তা ও চিন্তনশীল মানুষদের প্রয়োজন, যারা নির্ভীক কন্ঠে দেশপ্রেম তথা বিশ্বপ্রেমের কথা প্রচার করবে। বেণুবাবুর মানবতাবাদ দেশ-কাল-ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়,বরং তা সমুদ্রের মতো ছড়িয়ে পড়বে একদিন এই পৃথিবীর বুকে।
ভুবনেশ্বরে শুভাশিস পাঁচদিন কাটিয়েছিল। তারপর মনে আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল, বাঙালীদের প্রিয় তীর্থস্থান পুরীকে দর্শন করার। স্কুলে পড়ার সময় ক্লাস নাইনে শতদলস্যার পড়িয়েছিলেন,"দুরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী/তমালতালীবন রাজিনীলা/আভাতিবেলা লবণাম্বুরাশে/ধারার্নিবদ্ধেব কলঙ্করেখা।"সেই থেকে শুভর মনে অভিলাশা সমুদ্রকে দর্শন করার।কিন্তু, কোনোদিন তা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। যখন শুনেছিল তার প্রিয়া ওড়িশার মেয়ে , তখনই মনে তীব্র বাসনা জেগেছিল সাগর দর্শনের। যাই হোক, অবশেষে প্রিয়াঙ্কার সাথে পুরী বেড়াতে গিয়ে পূর্ণ হয়েছিল তার মনের অভিলাষা।
একদিনের কথা মনে পড়ে গেল শুভাশিসের। তখন
ভোররাত্রি। সাগরের বেলাভূমিতে সে আর তার প্রিয়া। দূরে সারি সারি জেলেদের মাছ ধরার ডিঙি। সামনে দিগন্তবিস্তৃত সাগর। বেলাভূমে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। একটু পরেই পুবাকাশকে লাল রঙে রাঙিয়ে উঠবেন দিবাকর। বইছে হেমন্তের শেষ রাতের মন মাতাল করা হাওয়া। প্রিয়া পরে ছিল নীল রঙের কুর্তি আর জিন্স।শুভর মুখে প্রেমের কবিতা, প্রিয়ার ঠোঁটে ভালোবাসার কলি। তাদের প্রেমের সাক্ষী শুধু ফুরফুরে হাওয়া আর আকাশের একলা চাঁদ আর সাগরের উর্মিমালা।এসব আজ থেকে চার বছর আগের কথা।
উজ্জয়িনী আসতেই চমক ভাঙে শুভাশিসের। এইতো সেই প্রেমের শহর, ইতিহাসের পাতায় পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এর নাম। এখানে বসেই তো মহাকবি কালিদাস রচনা করেছেন তার কালজয়ী রোম্যান্টিক সাহিত্য 'মেঘদূতম্','অভিজ্ঞান শকুন্তলম', 'কুমারসম্ভবম' প্রভৃতি। এই উজ্জয়িনীর রাজপ্রাসাদ আলো করেই ছিলেন প্রবল পরাক্রমী দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত 'বিক্রমাদিত্য' এবং তার নবরত্ন -আর্যভট্ট,বরাহমিহির প্রমুখ।এই উজ্জয়িনীর সিংহাসনে বসে রাজত্ব করতেন প্রবল পরাক্রমী দিগ্বিজয়ী রাজা ভোজ। ভারতমাতা সত্যিই রত্নগর্ভা!
উজ্জয়িনীর মেয়েরাও ছিল অপূর্ব সুন্দরী, মোহময়ী, পুরুষের মনোহরণকারিণী। নৃত্যগীতে পারদর্শিনী, চারুকলায় সুদক্ষ আর সাহিত্যসংস্কৃতির অনুরাগিণী। উজ্জয়িনী আসতেই নিজেকে 'মেঘদূতম'-এর বিরহসন্তপ্ত যক্ষের সাথে তুলনা করল শুভাশিস। সেও তো তার প্রেয়সীর থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে টানা দুই বছর।
অবশেষে এসে গেল মধ্যপ্রদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পশহর দেওয়াস। ট্রেন যখন দেওয়াস পৌঁছাল তখন প্রায় মাঝরাত। এখান থেকে ট্রেন যাবে ইন্দোর। প্রিয়াঙ্কা স্টেশনেই অপেক্ষা করছিল। স্টেশন থেকে প্রিয়াঙ্কার ফ্ল্যাট বেশ কিছুটা দূরে। শহরের বাইরের দিকে।
গোটা দেওয়াস নগরী নিঝুম। প্রিয়াঙ্কার ফ্ল্যাটে এসে
পৌঁছাল শুভাশিস। কতদিন পরে দেখা তার প্রিয়ার সাথে। কিছুটা মুটিয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখনো তাকে অপরূপা তন্বী মনে হচ্ছে। মাথার ওপর ফোঁটা ফোঁটা ঘামের বিন্দু মুক্তোর মতো লাগছে।
প্রিয়াঙ্কার ফ্ল্যাট থেকে বিন্ধ্য পর্বতমালাও খুব দূরে নয়। ছাদে উঠলে দূর দিগন্তে দেখা যায় অভ্রভেদী নগকে। ফ্ল্যাটটাকে দারুণ সাজিয়েছে প্রিয়া। কিন্তু ফ্ল্যাটে ঢুকেই একটা জিনিস দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল শুভাশিস।
কারণ,তার সামনেই এখন দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে ড.বেণুধর পাণিগ্রাহীর ফটো। আর সেখানে ঝুলছে রজনীগন্ধার মালা।
প্রিয়াঙ্কার কাছে জানতে পারল, ইদানীং ব্লগে ভীষণ সক্রিয় ছিলেন বেণুবাবু। RSS এর উগ্র হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেছিলেন।আগের মাসে সকালে মর্নিং ওয়াকে বেরোবার পর পার্কে পাওয়া গিয়েছিল তার প্রাণহীন নিথর দেহ। না, তেমন পদক্ষেপ নেয়নি ওড়িশার প্রশাসন, ফলে আর দুষ্কৃতীরাও ধরা পড়ে নি।
ক্রোধে শরীর কম্পিত হতে লাগল শুভাশিসের। সত্যিই ভালো লোক ছিলেন তার শ্বশুরমশাই। শুভাশিসকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন। দু'বছর আগে ঠিক এই দিনই যখন ভুবনেশ্বরে সে প্রিয়াঙ্কার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল, তখন শ্বশুরমশাই নবদম্পতিকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করেছিলেন। আর যখন আজ সে তার সেকেণ্ড ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি সেলিব্রেট করতে এত দূরে বউয়ের কাছে এসেছে, তখনই এই অকস্মাৎ দুঃসংবাদ! চোখ দিয়ে দরদর করে জলের ধারা বইতে লাগল শুভাশিসের।
না,এর একটা প্রতিবাদ সে করবেই করবে। ঠিক করেছিল সে মিশিগানেই সেটল করবে। কিন্তু,এখন তো ফিরে আসতেই হবে তাকে এই সুজলা সুফলা ভারতভূমে। গোটা দেশ এখন কাঁদছে। মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে কেরিয়ার বানিয়ে সে তার যৎসামান্য শক্তি-সম্পদ-সামর্থ্যকে উৎসর্গ করবে এই দেশকে সত্যিকারের পুণ্যভূমিতে পরিণত করার কাজে। আজ হয়তো ড.বেণুধর পাণিগ্রাহী নেই, কিন্তু রয়েছেন বেণুবাবুর মতো নির্ভীক দৃঢ়চিত্ত লোকেরা। আজও বেঁচে রয়েছে ভালোবাসা, রয়ে গেছে ফুরফুরে হাওয়া আর একলা চাঁদ আর সোনালী ভারতবর্ষ গড়ে তোলার স্বপ্ন।