Dola Bhattacharyya

Tragedy Inspirational

3  

Dola Bhattacharyya

Tragedy Inspirational

আলোয় এসো ফিরে

আলোয় এসো ফিরে

9 mins
173



কলেজ থেকে বেরোতে আজ একটু দেরিই হয়েছে স্মৃতির। তারপর আজ আবার কোচিং সেন্টারে ক্লাস ছিল। প্রায় দশটা নাগাদ পাড়ার মোড়ে অটো থেকে নামল ও। এবার খানিকটা রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। সুনসান গলিপথ। এই মুহুর্তে রাস্তায় কেউ নেই। মাথাটা নিচু করে হাঁটছিল স্মৃতি। ওটাই ওর অভ্যাস। 

"কেমন আছো?"- আচমকা এক পুরুষালী কন্ঠস্বরে চমকে উঠল স্মৃতি।

"কে!"

"কেমন আছো স্মৃতি? চমকে উঠলে? চিনতেই পারছো না আমায়!" 

চমকে তো উঠতেই হবে, কারণ একমূহুর্ত আগেও কেউ ছিল না আশেপাশে। 

নিজের মনের ভাব বুঝতে না দিয়ে স্মৃতি বলে, "নাঃ। ও কিছু নয়। আসলে হঠাৎ করে ডাকলে তো, তাই। কবে এলে রঞ্জন? ভালো আছো তো?" 

"ওই চলে যাচ্ছে। কয়লাখনির অন্ধকারে দিব্যি কেটে যাচ্ছে সময়। দিন রাতের প্রভেদ বুঝি না। অভ্যেস হয়ে গেছে এখন এসব। এখন দিনের আলো আর সহ্য হয় না জানো।" 

"এ আবার কি অদ্ভুত কথা রঞ্জন! কি সব হেঁয়ালী করছো বলো তো!" 

" না না। হেঁয়ালী কেন হবে! "

মৃদু স্বরে স্মৃতি বলে, "পথ ছাড়ো এবার। রাত হয়েছে অনেক। মা চিন্তা করবে। আমি না হয় কাল তোমার সঙ্গে দেখা করবো।" 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রঞ্জন বলে, "কি জানি, কাল যদি আর দেখা না হয়। আচ্ছা, আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পেরেছো তো স্মৃতি?" 

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে স্মৃতি অন্ধকারে প্রায় মিশে থাকা মূর্তিটার দিকে। করুণ কান্নার মতো একটা আকুতি ঝরে পড়ছে যেন ওর দুটি চোখ দিয়ে। 

আবার বলে রঞ্জন, "তোমার ক্ষমা পাবার আশায় কত দূর থেকে কত কষ্ট করে ছুটে এসেছি আমি। যদি পারো ক্ষমা করে দিও। তুমি ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।" কথাগুলো বলে ওর পাশ কাটিয়ে চলে যায় রঞ্জন। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্মৃতি। 


রাতে শুয়ে পড়ার পরও মনে পড়ছিল রঞ্জনের কথা। একদিন যাকে ছেড়ে আসতে একবারের বেশি দু'বার ভাবেনি, আজ তারই জন্য মনটা উতলা হয়ে উঠেছে স্মৃতির। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দিন গুলোর কথা। ছেলেবেলার ধুলোখেলার দিনগুলো। পাশাপাশি দুটো বাড়ির দুই ছেলেমেয়ে, স্মৃতি আর রঞ্জন। সমবয়সী। একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে ওরা। স্মৃতি ব্রিলিয়ান্ট। রঞ্জন ছিল ভীষণ দুরন্ত, পড়াশোনায় অমনোযোগী।


ছেলেবেলার ভালোলাগা কখন যেন ভালবাসায় পরিণত হয়েছে, টের পায়নি কেউই। বি এস সি পাস করে স্মৃতি ভর্তি হলো কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এস সি পড়তে। অতি সাধারণভাবে বি এস সি পাস করে পড়া বন্ধ করে দিল রঞ্জন। তিন চার বছর কেটে যাওয়ার পরেও একটা চাকরি জোটাতে পারল না রঞ্জন। এদিকে স্মৃতি তখন একটা কলেজে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। একদিন নিজের বাবা ও দাদাদের কাছে চরম অপমানিত হয়ে ঘর ছাড়ল রঞ্জন। স্মৃতি তখন পাগলের মতো খুঁজেছিল ওকে। রঞ্জনের বাড়িতে কেউই ওর জন্য তেমন চিন্তিত ছিল না। শুধু ওর মা'টা কেঁদে কেঁদে বেড়াতো।


    দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেল। রঞ্জনের মা তখন ছোট ছেলের শোকে একেবারে শয্যাশায়ী। এইসময়ে হঠাৎ করে ফিরে এল রঞ্জন। তখন আর সে বেকার নয়। কয়লাখনিতে চাকরি পেয়েছে সে। তারপর কিভাবে যে কি হয়ে গেল, আজও ভাবলে অবাক লাগে। দু বাড়ির কেউই রাজি ছিলেন না। তবু হয়েই গেল বিয়েটা। তারপর নতুন জীবন।

  পাহাড়, জঙ্গল ঘেরা ছবির মতো সুন্দর শহর কোডারমা। প্রথমদিন এখানে পা রেখে মুগ্ধ হয়েছিল স্মৃতি। স্বপ্নের মতো কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। কয়লাখনিতে কাজ করে রঞ্জন। কিছুদিনের মধ্যেই স্মৃতিরও একটা কাজ জুটে গেল। এখানে একটা স্কুল আছে, খনি শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য। অবৈতনিক স্কুল। এখানেই কাজ পেয়ে গেল স্মৃতি। স্মৃতি কে নিয়ে চারজন মাত্র টিচার। হেডমিসট্রেস মঙ্গলা মাহাতো একটু বয়স্ক মানুষ। রাশভারিও। আর আছে মৌলি আর সিদ্ধার্থ, স্মৃতিরই সমবয়সী। ওদের সাথে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল স্মৃতির।

  সহজ স্বচ্ছন্দ গতিতে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল বেশ। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতির পরিবর্তন মুগ্ধতার আবেশ রেখে যাচ্ছিল জীবনে। তারই সঙ্গে পরিবর্তন এসেছিল রঞ্জনের মনে। প্রথমে পাত্তা দিতে চায়নি স্মৃতি। ব্যাপারটা জটিল দিকে মোড় নিচ্ছে দেখে, বোঝাতে চেষ্টা করেছিল রঞ্জন কে। ''সিদ্ধার্থ আমার সহকর্মী, আমার ভাইয়ের মতো।" নাঃ। রঞ্জন তো বোঝার চেষ্টাই করে না। ওর দাবি, ''হয় তুমি চাকরী ছেড়ে দাও, না হলে সিদ্ধার্থর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করো।" কোনোটাই করেনি স্মৃতি। রঞ্জনের এই মিথ্যা সন্দেহ কে প্রশ্রয় দিতে চায়নি ও। তাই সিদ্ধার্থর জন্য মরণের ফাঁদ পেতেছিল রঞ্জন। 

সিদ্ধার্থ আর মৌলি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছিল তখন। সেদিন স্কুল ছুটির পর ওরা তিনজনে বরাকরের ধারে বেড়াতে যাবে ঠিক করে। বিশ্বাস করে রঞ্জন কে বলেছিল স্মৃতি ওদের প্ল্যানের কথা। মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল রঞ্জন। নদীর ধারে সূর্যাস্ত দেখে সেদিন মন ভরে গিয়েছিল ওদের। সিদ্ধার্থ আর মৌলি হাতে হাত রেখে চুপ করে বসেছিল দুজনে। ওদের থেকে একটু দূরত্ব রেখে বসেছিল স্মৃতি। মনে মনে ভাবছিল, দুটি কে মানিয়েছে কিন্তু বেশ। 

   এ জায়গাটায় একটু তাড়াতাড়িই সন্ধ্যা নেমে আসে। মৌলিকে ওর কোয়ার্টারে পৌঁছে দেয় ওরা। এরপর স্মৃতি কে ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে সিদ্ধার্থ ফিরে যায়। 

নিশ্চিন্তে ঘরে এসে বসে স্মৃতি। খবরটা আসে রঞ্জনের কাছ থেকেই। সেদিন মদে চুর হয়ে ঘরে ফিরেছিল রঞ্জন। হাসতে হাসতে বলেছিল, ''তোমার নাগর কে দেখলাম। রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অন্যের মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি করবে। দিয়েছে কেউ শালাকে ঠুসে।'' চোখ বুজে খুশিতে গান ধরেছিল সেদিন, ''ডাগর চোখে নাগর আমায় পাগল করেছে।" সে যাত্রায় মৌলির ভালবাসার জোরে বেঁচে ফিরেছিল সিদ্ধার্থ।


   সেদিন সকালটা অন্যরকম ভাবে শুরু হয়েছিল। স্মৃতি ভেবেছিল, এ তো আনন্দের একটা খবর, রঞ্জন হয়তো খুশিতে পাগল হয়ে যাবে। রঞ্জনের গলা জড়িয়ে কানে কানে বলেছিল খুশির খবর টা, ''আমি মা হতে চলেছি রঞ্জন।"

শীতল স্বরে রঞ্জন বলেছিল, ''এতে এত খুশি হবার কি আছে! ও বাচ্চা তো আমার নয়। তোমার পাপ আমি বহন করবো কেন! যাও। খালাস করিয়ে এসো।" স্তব্ধ হয়ে বসেছিল স্মৃতি। তারপর কঠিন স্বরে বলেছিল, "এই বাচ্চার জন্ম তো আমি দেবোই। আর তুমিও একদিন ঠিক বুঝতে পারবে, এই সন্তান কার। আর তখন দেখো, আজকের দিনের কথাগুলো মনে পড়লে তোমার নিজেরই লজ্জা করবে।"


    দিনের পরে দিন কেটে যায়। ভ্রুণের মধ্যে ধীরে ধীরে সঞ্চার ঘটে প্রাণের। তার স্পন্দন টের পায় স্মৃতি নিজের শরীরে। এই ক্ষুদ্র প্রাণের অস্তিত্বটিকে সমূলে বিনাশ করতে চেয়েছিল রঞ্জন। এখনও তার চেষ্টার ত্রুটি নেই। শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারল রঞ্জন। একদিন ওদের কথা কাটাকাটি যখন চরমে উঠেছে, তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্মৃতি কে সজোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। সব শেষ। মরতে মরতেও বেঁচে ফিরে এল স্মৃতি।

সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আর একটা দিনও এখানে থাকেনি স্মৃতি। কোলকাতায় ফিরে ডিভোর্স এর চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিল। 

      

      আজ অনেক দিন পর এই নাম্বারটায় কল করল স্মৃতি। নাঃ। নট রিচেবল বলছে। সকালে উঠেই আজ মনে হলো রঞ্জন কে একটা ফোন করা যাক, কিন্তু বারবার করেও পাওয়া যাচ্ছে না ওকে। বাধ্য হয়ে বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করে স্মৃতি। ফোনটা ধরেছে রঞ্জনের বৌদি।

"হ্যালো। কে।''

''আমি স্মৃতি বলছি।'' 

''ও। তুমি। কি মনে করে?'' 

''রঞ্জন উঠেছে?'' 

''রঞ্জন! তাকে কোথায় পেলে! সে তো তোমার জন্যই আজ দীর্ঘদিন বাড়িছাড়া।"

স্তম্ভিত হয়ে গেল স্মৃতি। ''রঞ্জন কাল বাড়ি ফেরেনি?'' 

'' না। কোন মুখে ফিরবে শুনি!"


ফোনটা কেটে দিয়ে সোফায় এসে বসল স্মৃতি। রঞ্জন ফেরেনি! তাহলে কাল কাকে দেখল! কার সাথে কথা বলল ও! মনের অস্বস্তি কাটাতে খবরের কাগজ টা খুলে বসল। ফার্স্ট পেজেই খবরটা ছিল। কোডারমায় কয়লাখনির মধ্যে জল ঢুকে বহু মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা। খবরটা পড়ে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে স্মৃতি। কি করবে বুঝতে পারে না। এই খনিতেই তো কাজ করে রঞ্জন। 

অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় স্মৃতি। যেতে হবে। যেভাবেই হোক যেতে হবে ওখানে। স্মৃতির ফোন পেয়ে ছুটে আসে ওর রিপোর্টার বন্ধু রুবি চ্যাটার্জি আর সায়ন ভার্মা। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় আরও একজন, বন্ধু সুগত রায়। স্মৃতির সহকর্মী, নৃতত্ত্বের অধ্যাপক। 

   চারজনের দলটা সন্ধ্যা নাগাদ কোডারমা পৌঁছলো। রঞ্জনের বাংলোতেই ওরা এসে উঠলো। রঞ্জন না থাকলেও মাংরা ছিল বাংলোতে। এতোদিন পরে স্মৃতিকে দেখেও চিনতে পারল মাংরা। "এ দিদিমনি। এতদিন বাদে ফিরলি তুই। বাবু টো কুথাকে গেল বল তো"- অঝোরে কাঁদতে থাকে মাংরা। ওর কাছেই সব জানতে পারে ওরা। এই সময়ে ড্যামগুলো থেকে জল ছাড়া হয়। আশেপাশের নদীগুলো অতিরিক্ত জলের উচ্ছ্বাসে ফুলে ফেঁপে ওঠে। বরাকরের জল বিপদসীমা ছাড়িয়ে বইছিল। এই সময়ে এরকম বিপদ ঘটতেই পারে। কিন্তু মালিক পক্ষ এ ব্যাপারে একদম উদাসীন। আজ তিনদিন হয়ে গেল, কাউকে উদ্ধার করা যায়নি। 

   পরদিন সকালে ওরা যখন স্পটে পৌঁছলো, তখন সেখানে অনেক লোকের ভিড়। প্রিয় মানুষগুলো যদি ফিরে আসে আজ, ব্যর্থ প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে পরিবারের মানুষগুলো। দূরে একটা পুলিশের জীপ দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে সেদিকেই এগোলো ওরা। একজন পুলিশ অফিসারের সাথে আরও দুজন দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। "এক্সকিউজ মী"- রুবির কন্ঠস্বরে চমকে ফিরে তাকালেন তিনজনেই। 

"আমরা কোলকাতা থেকে আসছি।" 

"বলুন, কি করতে পারি আপনাদের জন্য।"

সরাসরি প্রশ্ন করে রুবি, ''খনিতে জল ঢুকে কতগুলো মানুষ আটকে পড়েছে মাটির নিচে, আজ চারদিন হয়ে গেল। তাদের উদ্ধার করা যায়নি এখনো। আপনারা কি ভাবছেন এ বিষয়ে। আর কত দেরি হবে তাদের উদ্ধার করতে?'' 

কাটাকাটা স্বরে অফিসার বলেন, "আপনারা বাইরের লোক এ বিষয়ে মাথা ঘামাবেন না। আমরা কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।" 

এবার স্মৃতি বলে,''উত্তর দিতে তো আপনারা বাধ্য। রঞ্জন মিত্র কোলকাতার ছেলে। আমরা রঞ্জনের বন্ধু। খবর পেয়ে ছুটে এসেছি। খালি হাতে তো ফিরবো না। রঞ্জনের সাথে যারা যারা নিখোঁজ হয়েছে, তাদের সবার খোঁজ চাই। না হলে আপনারা এখানে যা দেখেননি কোনোদিন, তাই দেখবেন।'' 

অফিসারের সঙ্গে ছিলেন খনির ম্যানেজার চন্দন রাউত আর ইঞ্জিনিয়ার ঋষভ সায়গল। চন্দন বাবু বলেন, "থ্রেট দিচ্ছেন নাকি, আ্যঁ! কি ভেবেছেন! ভয় পেয়ে যাব আমরা! দেখুন। পরিস্থিতি এখন ভীষণ খারাপ। এভাবে গলাবাজি করে কিছুই হবে না।''

'' না না। ব্যাপারটা এভাবে দেখছেন কেন? আমরা কেউ থ্রেট দিচ্ছি না। শুধু যেটা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তরটা তো দিন।" অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার ছেলে সায়ন। খুব ভদ্র ভাবেই কথাগুলো বলে। কোনও সুরাহা হলো না। মালিক পক্ষের কারো সাথে দেখা করতে চায় ওরা। সেটাও ওদের করতে দেওয়া হয় না। আবার বাংলোয় ফিরে আসে ওরা। কিছুই হলো না। আরও একটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। মানুষগুলো অন্ধকার খনিগর্ভের মধ্যে কিভাবে আছে, আদৌ বেঁচে আছে কিনা কে জানে! চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে স্মৃতি। সায়ন আর রুবি একটার পর একটা ফোন করেই যাচ্ছে। সুগতও ফোনে ব্যস্ত। স্মৃতি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। এদিকে খবর পেয়ে রঞ্জনের দাদা সুবীরও চলে এসেছেন। খবরটা স্মৃতিই দিয়েছিল। 

রঞ্জনের বাংলোয় স্মৃতিদের দেখে যথেষ্ট বিরক্ত তিনি। বলেই বসলেন, 'তুমি এখানে কি করছো? এটা তো তোমার জায়গা নয়। আর কবেই তো তোমাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে।' 

স্মৃতি কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওকে থামিয়ে দেয় রুবি। বলে, ''দাদা, রঞ্জন ওদের ডিভোর্সের পেপারে সাইন করেনি আজ পর্যন্ত। সেই অর্থে স্মৃতি কিন্তু এখনও ওর স্ত্রী। আর এই বাংলো কিন্তু খনি কর্তৃপক্ষের। সেখানে আপনারও অধিকার খাটে না। '' 

স্মৃতি বলে, "খবরটা তো আমিই দিলাম। কাগজে দেখেও আপনারা কিছুই বুঝতে পারেননি। নিজের ভাই কোথায় চাকরি করে, সেই খবরটা পর্যন্ত রাখেন না আপনি। কি করে বলেন এসব কথা!'' 

   বিকেলে সিদ্ধার্থ আর মৌলি এসেছিল স্মৃতির সাথে দেখা করতে। ও কোলকাতায় ফিরে যাবার পর রঞ্জন আর সিদ্ধার্থ'র মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্মৃতি জানতো না। জানতে দেয়নি রঞ্জন। নিদারুণ অভিমান পুষে রেখেছিল বুকের মধ্যে। গলার কাছটা কেমন ব্যথা করে উঠছে। বুকের মধ্যে উথলে উঠছে কান্না। তবু নিজেকে সংযত করে বসে রইলো স্মৃতি। 

ওদের কাছ থেকে জানা গেল, সেদিন কিছু শ্রমিক নিয়ে খনির অন্দরে প্রবেশ করে রঞ্জন। ওই দলটার সুপারভাইজার ছিল ও। কিছু পরেই হুড়হুড় করে জল ঢুকতে শুরু করে খনিগর্ভে। কেউই ওরা বেরোতে পারেনি। সকলেই আশায় ছিল, খনি কর্তৃপক্ষ খুব তাড়াতাড়ি শুরু করবে উদ্ধারের কাজ। কিন্তু কাজ শুরু হয়নি। মৌলি আর সিদ্ধার্থ কিছু লোকজন নিয়ে ঘেরাও করেছিল খনির অফিস। কোনো লাভ হয়নি। আসলে উদ্ধার কার্যে নামার মতো লোকই নেই এদের এই মুহুর্তে । তাই এরা টালবাহানা করে যাচ্ছে।


   পরদিন সকালে দেখা গেল চিত্র টা বদলে গেছে। খনিগর্ভে আটকে পড়া মানুষগুলোকে উদ্ধার করার তোড়জোড় চলছে। আগের রাতেই অফিসে একটার পর একটা ফোন আসতে শুরু করে। নড়েচড়ে বসে খনি কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন মিডিয়া মারফৎ খবর টা ছড়িয়ে গিয়েছে চারিদিকে। খবর পৌঁছেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরে। আগামী কাল রিপোর্টারদের একটা বড় দল চলে আসছে এখানে। সেই সঙ্গে আসছে উদ্ধারকারী দল। ঝাড়খণ্ড পুলিশ এবং খনি কর্তৃপক্ষের ওপর কড়া নির্দেশ জারি হয়েছে, উদ্ধার কার্যে সহায়তা করার জন্য। 

   একটু বেলার দিকে দেখা যায়, শক্তিশালী পাম্পের সাহায্যে জল বার করার চেষ্টা চলছে। চারিদিক লোকে লোকারণ্য। সকলেই বুঝতে পারে, ওই কোলকাতার ছেলেমেয়েগুলোর জন্যেই এটা সম্ভব হয়েছে। 

  সারাদিন ধরে জল বের করার পর সন্ধ্যা নাগাদ মানুষ গুলোর হদিস পাওয়া গেল। কেউই আর বেঁচে নেই। উঠে আসছে একটার পর একটা মৃতদেহ। পরিজনেরা সকলেই ভেঙে পড়ছে কান্নায়। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল স্মৃতি। 

    পরপর কুড়ি টা দেহ শোয়ানো রয়েছে। কিন্তু রঞ্জন কোথায় গেল। উদ্ধারকারী দল জানালো আর কেউ নেই। না না। এ হতে পারে না। ও নিশ্চয়ই আছে কোথাও। আমি যাবো ভেতরে। আমি ঠিক খুঁজে নিয়ে আসব ওকে। বন্ডে সই করে এবার স্মৃতিও নামলো উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে। অনেক চেষ্টার পর অন্ধকুপের মধ্যে থেকে উদ্ধার করা হল রঞ্জন'কে। জলের তোড়ে ধ্বস নেমেছিল খনিগর্ভে। ধ্বসের তলায় চাপা পড়েছিল দেহটা। এতক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়ল স্মৃতি।


     দাহকার্য শেষ। রঞ্জনের শেষ চিহ্ন'টুকু মাটির সরায় নিয়ে বরাকরের জলে নামল স্মৃতি। চোখের জলে জোয়ার এসেছে ওর। সেই জল নদীর জলে মিশে গিয়ে নদীতে তুলেছে ঢেউ। সরাটাকে ভাসিয়ে দিয়ে এবার দু'হাত দিয়ে ঠেলে দিল স্রোতের অভিমুখে। অস্ফুটে বলে উঠলো, "আর অন্ধকারে থাকতে হবে না। মুক্তি দিলাম তোমায়। পারলে নতুন হয়ে ফিরে এসো এই আলোর জগতে।"


পুবের আকাশ তখন রঙিন হয়ে উঠেছে আর একটা নতুন দিনের অপেক্ষায়। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy