আলো
আলো
আমি রিক্তা। নামের সঙ্গে আমার জীবনের ভীষন মিল। জন্মের পর থেকেই জীবন যা নিয়ে জন্মেছিলাম তার থেকে কিছু কিছু করে নিতে নিতে ধীরে ধীরে রিক্তই করে তুলেছে। জন্মের পর পর মা মারা গেল অপুষ্টিতে। নাকি মেয়ে জন্ম দেবার অপরাধে অবহেলা, হতচ্ছেদ্দা তাকে ঠেলে দিয়েছিল জীবনের কিনারে! প্রথমে অবশ্য এত কিছু বুঝতাম না, কিন্তু যত বড় হলাম তত বুঝলাম এ বাড়িতে মেয়ে হয়ে জন্মানো অপরাধ। আর মেয়ে জন্ম দেওয়া ততোধিক অপরাধ! তাই মায়ের মৃত্যু কতটা প্রাকৃতিক আর কতটা ইচ্ছাকৃত তাতে একটা সন্দেহ দানা বাঁধে।
যত বড় হচ্ছি তত লাথি, ঝাঁটা, দুচ্ছাই, মুখ ঝামটা সব গা সওয়া হয়ে গেল। বুঝে গেলাম যার মা নেই তার কিছু থাকে না, থাকতে নেই! তাদের খিদে পেতে নেই, শীত লাগলে সোয়েটার চাইতে নেই, মন খারাপ করলে কাঁদতে নেই। মজার কথা হলো এতোগুলো না এর মধ্যে আমি পড়াশোনায় ভীষন রকম একটা হ্যাঁ হয়ে গেলাম। গতে বাঁধা নিয়মরক্ষার জন্য বাড়ির আর সব ভাই বোনের সঙ্গে আমিও স্কুল যেতাম। প্রাথমিক স্কুলে সব সময় প্রথম , তাই স্কুলের দিদিমণিদের উৎসাহেই আমার হাইস্কুল। আর সেখানেও প্রথম। তাই একান্ত ঢেঁকি গেলার মত করে হাইস্কুল পাশ। তার পরে , বাড়ির সবার বেঁচে যাওয়া খাবার ,আর বেঢপ ঝড়তি পড়তি জামা কাপড় পরেই কলেজ। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে চলে গেলাম এস.এস.সি ফর্ম ফিলাপ করতে। ভাবিনি এরকম কিছু ঘটতে পারে। তবে চাকরিটা যখন পেয়েই গেলাম এবং পেলাম বাড়ির থেকে বেশ দূরে তখন কিন্তু খারাপ লাগার বদলে আমার না জানি কেন খুব ভালো লাগছিল! বাড়ির এর মুখ বেঁকানো, ওর মুখ গোমড়া করা, বাবার গররাজি ভাব, জ্যেঠিমা কাকিমার আমার চরিত্র খারাপ হবার প্রবল সম্ভাবনার ভুত দেখা সত্ত্বেও বাবা রাজী হলো। আসলে হয়তো ঘাড় থেকে নামলে বাঁচে। তাছাড়া এতগুলো টাকা ছাড়তে কেই বা চায়?
চলে গেলাম মসলন্দপুর জামুর দহ উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার দিদিমণি হয়ে। প্রথম দিন হলেও সঙ্গে কেউ নেই। আসলে যার মা নেই, তার জীবনের আলোটা সেই মুহূর্তেই নিভে যায়। তারপর তার যাওয়াটা একটা অন্ধকার টানেলের মধ্যে দিয়ে। ভাবতাম, মা না জানি কি ভালো, কি এক স্বর্গীয় সুখের নাম! বিছানায় শুয়ে শুয়ে একা একা কতবার মা, মা বলে ডেকেছি। কেউ সাড়া দেয়নি। কিন্তু আমার মা ডাকতে পেরে মনে হত এক বরফ গলতো প্রতিবার।
একেবারে গ্ৰামের স্কুল। মেঠো পথ, পুজোর আগে আগে জয়েনিং। গ্ৰামের রাস্তার দুপাশে বাঁশের থেকে ঝুলছে পাট, একটা অদ্ভুত গেছো গন্ধ, জায়গায় জায়গায় ফাঁকা, সামান্য জলে ভরা নয়ানজুলি, তারই ধার ঘেষে দুয়েকটা কাশফুল, কেমন মোটা কাঠবেড়ালির লেজের মতন। সারাজীবন উত্তর কলকাতার ইট, কাঠ, পাথরে বড় হয়েছি, সেভাবে গ্ৰাম কখনো দেখিনি, এমনকি বেড়াতেও যাইনি কখনো। টিভির পর্দাতেই আমার গ্ৰাম দেখা। তাই বেশ একটা ভালো লাগা। আসলে মাটির থেকে উঠে আসা সোঁদা গন্ধটা বড্ড আপন করা মনে হলো।
দোতলা স্কুল, বেশি বড় নয়। ছাত্রী সংখ্যাও খুব বেশি নয়। আমি শহরে বড় হয়েও যখন সামান্য পড়াশোনার জন্য আমার লড়াইটা এত প্রবল ছিল তখন না জানি এদের লড়াইটা কতখানি! অফিস রুমে বসে এসব হাবিজাবি ভাবছি। তখনো হেডমিসট্রেস এসে পৌঁছাননি। হঠাৎই যেন ঘরের মধ্যেটা একরাশ আলোয় ভরে উঠলো। এক বছর চল্লিশের মহিলা, অত্যন্ত সুন্দরী, কিন্তু তাতে শুধু রূপ নয় আছে আভিজাত্য এবং আরো না জানি কি? আমি চিরকাল নিজেকে গুটিয়েই রেখেছি, সবাই আমাকে শুধু ভয় পেতেই শিখিয়েছে। আমাকে দাঁড়াতে দেখে উনি ঢুকেই বললেন,
-আরে, বসো বসো।
দেখি আমার সামনের ছোট টুলটাতেই এসে বসলেন।
-কাগজপত্র সব এনেছো? সঙ্গে কে এসেছেন?
কেউ আসেনি শুনে উনি একটু অবাক হলেন কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। বুঝলাম উনি প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্মান করেন। আমি তো চিরকাল সবাইকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাকে আহত করতেই দেখেছি। তারপর যখন ওনার সঙ্গে ওনার ঘরে যেতে বললেন, বুঝলাম উনিই হেডমিসট্রেস! অফিসে গিয়ে যাবতীয় কাগজপত্রের কাজ শেষ হলে উনি নিজেই জিজ্ঞাসা করলেন,
-এখানে কোথায় থাকবে? এতদূর থেকে তো যাতায়াত করতে পারবে না।
আমি মাথা নাড়তেই, উনি আবার প্রশ্ন করেন,
-ঘরটর কিছু দেখেছো?
ওনার কথায় কি যেন ছিল! অথবা হয়তো কখনো কাউকে আমার জন্য চিন্তা করতে দেখিনি এই প্রথম দেখলাম, তাই কিনা না জানি না, হঠাৎই আমার চোখ জলে ভরে উঠলো! আমার জন্মদাতা পিতা, আমার বাড়ির আর সবাই যাদের এই চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের ভেবেছি, যাদের সঙ্গে জড়িয়ে গড়িয়ে কেটেছে এতগুলো বছর তারা কেউ ভাবলো না, অথচ উনি একজন অপরিচিতা হয়েও আমার জন্য ভাবছেন! সেই মুহূর্তেই যেন আমি ওনার প্রতি এক অদ্ভুত সম্মান, শ্রদ্ধা অনুভব করলাম। শেষে ফোনে কথা বলে উনি সব ঠিকঠাক করে, স্কুলের দারোয়ানের সঙ্গে আমাকে নতুন বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন,
-আজ তো প্রথম দিন, সইটা সেরে বাড়ি যাও। মোটামুটি গোছগাছ সেরে নাও। কাল থেকে তো রোজই স্কুল । আর হ্যাঁ শোনো, আজ আর রান্নাবান্না কোরো না, আমি ফোন করে বাড়ি থেকে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আমার চোখ জলে ভরে এলো, মনে হলো এই অপিরিচিতার পায়ে একবার মাথাটা ছোঁয়াই, অন্তত একবার দুহাত দিয়ে পা দুটো ছুঁই। আমি আমার সঙ্গে হওয়া কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারিনি, শুধু কারো পা কখনো ছুঁইনি কখনো, ওটাই ছিল আমার নীরব প্রতিবাদ। কিন্তু আজ মনে হলো ওনার পা দুটো একবার ছুঁই!
--আপনাকে একটা প্রণাম করবো?
উনি অবাক চোখে তাকলেন , তারপর হেসে বললেন,
-যাও যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। এখন খুব ক্ষান্ত। ওসব পরে হবে।
আমি আমার নতুন ঠিকানার দিকে যেতে যেতে একবার পেছন ফিরলাম, দেখলাম পেছনে একজন মানুষ নন, শুধু এক আলো, উজ্জ্বল , সাদা আলো, যা সব অন্ধকারকে মুছে দিতে পারে এক নিমেষেই।
©®
