আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
পঞ্চনবতিতম অধ্যায়
বড়দা হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নন। আবার কলিং বেল টিপলেন । একবার, দু'বার নয় - পরপর বেশ কয়েকবার। এবার সেই লোকটা দোতলার জানালায় এসে বলল - কি অসভ্য লোক আপনারা ! ভর দুপুরে গৃহস্থ বাড়ীতে এ কি জ্বালাতন শুরু করেছেন ? এবার কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই পুলিশ ডাকব ।
বড়দা ততোধিক উত্তেজিত হয়ে বললেন - পুলিশ ডাকলেও কিছু হবে না । এসেছি যখন প্রয়োজন হলে গুলি করে তালা ভেঙে ঢুকব । দেখি কে কি করতে পারে ?
লোকটা এবার গালাগালি দিয়ে উঠল ।
- বাঁদর কোথাকার ! তোরাই আমার বাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করেছিস । এখন এসেছিস আমাদের মারতে - সে কি বুঝি না ?
আমি বড়দাকে সরিয়ে দিয়ে বললাম - আপনি উত্তেজিত হবেন না বড়দা । আমি দেখছি কি করা যায় !
দোতলায় দাঁড়ানো লোকটা নিশ্চয় বুঝতে পারছি সত্যচরণের ছেলে । বললাম - আপনি তো নিত্যশরণ ঘোষাল ?
লোকটা এবার অবাক হল । তার নাম জেনে এসেছি ভেবে বলল - পুলিশ আসছে । এলে তবে গেট খোলা হবে ।
আমি বললাম - বেশ তবে তাই হোক ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গড়িয়া থানা থেকে একটি পুলিশের গাড়ি এসে আমাদের গাড়ির পিছনে থামল । নেমে এলেন একজন এস আই পদমর্য্যাদার অফিসার । আমাকে দেখেই বললেন - হ্যাণ্ডস আপ ।
আমি দু'হাত উপরে তুলে রয়েছি । বড়দা এসে ওঁকে বললেন - আপনি কে ?
- আমি এস আই সৌম্যদেব রায় । আপনি কে ?
- আমি ? এই নিন আমার পরিচয়পত্র ।
বড়দার পরিচয় পেয়ে একটা লম্বা স্যালুট ঠুকে বললেন - স্যার, একটা খবর দেবেন তো ! আমরাই ব্যবস্থা করে দিতাম। সত্যচরণের ছেলে উপর থেকে দেখল । দৌড়ে নেমে এসে গেট খুলে বারবার ক্ষমা চাইতে লাগল ।
বড়দা বললেন - ইটস ওকে । এবার আমাকে আমাদের কাজ করতে দিন।
আমরা সবাই মিলে প্রবেশ করলাম ঘরে । বেশ ছিমছাম করে সাজানো বাড়ী । মার্বেল পাথর যেন এইমাত্র বসানো হয়েছে । যেমন সুন্দর রঙ তেমনই চকচকে । গেটে ঢুকেই ডানদিকে উপরে ওঠার সিঁড়ি । বাঁ দিকে একফালি বাগান। সেখানে নানা রকমের ফুলের গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। তবে সবই টবে লাগানো ।
বড়দা কোন ভনিতা না করে সোজাসুজি বললেন - আমরা এসেছি লেট মিঃ ঘোষালের হেফাজতে ত্রিলোকেশ্বরের দেওয়া ২৬/২ সূর্য্যসেন স্ট্যীটের দলিল এবং নকশা নিতে ।
ছেলেটি প্রথমে আপত্তি করছিল ।
- না তো ! ও সব কাগজপত্র বাবা রাখেননি , আর ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিতই বা ওগুলো ওঁকে দেবেন কেন ?
বড়দা বললেন - হয় সম্পত্তি ওনার নামে ট্রানস্ফার করে দিতে নতুবা জাল দলিল তৈয়ারী করে দিতে । আর দ্বিতীয়টা যদি সত্যি হয়; তবে সপরিবারে হাজতবাস সুনিশ্চিত ।
ছেলেটা ভয় পেয়ে গেল । কিন্তু ওজর আপত্তি বহাল রাখল । বড়দা বললেন - আপনার বাড়ী সার্চ করব ।
ছেলেটা বলল - ওয়ারেন্ট ? সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছেন?
বড়দা বললেন - একজন গোয়েন্দার ওয়ারেন্ট দেখাতে হয় না । চলুন ওনার চেম্বারটা দেখিয়ে দেবেন।
এস আই সৌম্যদেব রায় ছেলেটিকে ডেকে বড়দা সম্পর্কিত তথ্য দিলেন এবং তাঁর যে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সখ্যতা আছে, বেশী আপত্তি করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলে বোঝাতে লাগলেন।
তখন জনৈকা বিধবা ভদ্রমহিলা বড়দার সামনে এসে বললেন - আসুন । আমি নিয়ে যাচ্ছি ।
বড়দা বললেন - আপনি ?
- আমি স্বর্গত ঘোষাল সাহেবের বিধবা । আমার স্বামী বীরেশ্বর রক্ষিতের ব্যক্তিগত আইনি উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বুঝতে পারেননি ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিতের ষড়যন্ত্র । দলিল দস্তাবেজ যদি নিয়েও থাকেন তবে ত্রিলোকেশ্বরের ভয়ে হয়তো নিয়ে থাকবেন । আপনারা আসুন , দেখে নিন ওগুলো আছে কি ন
া ।
আমি বললাম - সময় তো অনেক পেয়েছেন - অন্যত্র সরিয়ে দেননি তো ?
- কোথায় আর রাখব স্যার ? প্রথমত তিনি আমাদের কোন কথা বলতেন না । কি করছেন, কোথায় যাচ্ছেন কিছু বলতেন না । কারণ অর্থের প্রতি তাঁর একটা বড় রকমের দুর্বলতা ছিল ।
বড়দা বললেন - দ্বিতীয়ত ?
- দ্বিতীয়ত তিনি যেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ; ত্রিলোকেশ্বরের হাতে, সেদিনই দুপুর বেলায় তিনি আধ ঘন্টার নোটিশ দিয়ে আমাদের তমলুকে মানে আমার বাপের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন । আমরা আজ সকালেই এখানে এসেছি । অতএব দলিল সরিয়ে দেবার যে কথা উঠছে তা' ঠিক নয় ।
বড়দা বললেন - তাহলে চলুন দেখি ।
বড়দা, আমি এবং সৌম্য রায় তিনজন ওঁদের সঙ্গে ঘোষাল উকিলের চেম্বারে এসে ঢুকলাম । বেশ কয়েকটা কাঠের আলমারিতে থরে থরে ফাইল সাজানো । প্রতিটি ফাইলে নাম, কেস নং, এবং টেলিফোন নং লেখা আছে । টেবিলের ড্রয়ারেও বেশ কিছু নতুন ফাইল রাখা আছে ।
আমি এবং সৌম্য রায় আলমারিতে রাখা ফাইলের নাম পড়তে পড়তে যাচ্ছি আর বড়দা ড্রয়ারের ফাইল বের করে করে স্তুপ করে দিচ্ছেন । হঠাৎ তাঁর নজর পড়ল টেবিলের নীচে ফেলে দেওয়া কিছু কাগজের উপর ।
একটা একটা করে কাগজ পড়ে টেবিলে তুলে দিতে থাকলেন । তারপর ঘোষালের ব্যাখের খোঁজ নিলেন ।
ভদ্রমহিলা বললেন - ব্যাগটা তো সবসময় তাঁর হাতেই থাকত । জানি না মারা যাবার সময়ও ছিল কি না ।
সৌম্য রায় বললেন - এ ভাবে হবে না স্যার । আলমারি থেকে ফাইলগুলো নামাতে হবে ।
বড়দা বললেন - কোন দরকার নেই । নীচেই কোথাও নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন । ত্রিলোকেশ্বরকে মারার প্ল্যান ছিল তাঁর । সেজন্যই বিবাদী বাগে সুপারি কিলারের সাথে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলেন । সময় পাননি আলমারিতে মত্ন করে রাখার । আপনারা নীচেই কোথাও খুঁজে দেখুন ।
বড়দার নির্দেশে আমিও খুঁজে যাচ্ছি । হঠাৎ আমার মনে হল ধনীর ঘরের দলিল নিশ্চয় কোন নামীদামী ফাইলে বন্দী থাকবে নতুবা শুধু দলিলগুলো উলঙ্গ অবস্থায় ঘোষালকে দিয়ে থাকতে পারেন ।
খুঁজছি, নিজের ভাবনা অনুসারে । চেম্বারে এঁরা খুঁজছেন খুঁজুন । আমার মনে হল তাঁর বেডরুমটা একবার দেখলে হত । নিত্যশরণকে বলায় সে আমাকে ঘোষালের বেডরুমে নিয়ে গেল । বিছানা পত্তর উল্টেপাল্টে দেখতেই এক বাণ্ডিল কাগজের তোড়া ঝুপ করে মাটিতে মানে মেঝেতে পড়ল ।
আমি দলিলের নাম পড়ে এক ছুটে বড়দার হাতে গিয়ে জমা দিলাম । দলিল পেয়ে বড়দা ভীষণ খুশী। বললেন - তোর হবে । তুই পারবি আমার পাট বজায় রাখতে।
আমরা উক্ত দলিল এবং আনুষঙ্গিক কাগজপত্র নিয়ে নিলাম ।
বড়দা বললেন - আপনাদের সেফটির জন্য এগুলোর রিসিপ্ট এবং একনলেজমেন্ট দিয়ে যাচ্ছি ।
একটা কাগজে বিবরণ লিখে আমাকে বললেন - তিন কপি জেরক্স করে নিয়ে আয় ।
তারপর তিনটে কপিতে উভয়পক্ষের সাইন এবং সৌম্য রায়ের উইটনেস নিয়ে অরিজিনাল কপিটা ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে বললেন - নিজের কাস্টডিতে সেফসাইডে রাখবেন কিন্তু ।
সৌম্য রায়কে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা চিনার পার্কের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম ।
তখন বিকেল সাড়ে তিনটেয়। ক্ষিধেয় পেট চুঁই চুঁই করছে ।
বড়দা বললেন - এখন এই অবেলায় চা জলখাবার খেয়ে কাটিয়ে দেব ।
গোপা রূপা সুনেত্রা বুকুন শিউলি জিজ্ঞাসু নেত্রে আমাদের দিকে এমন ভাবে চেয়ে রয়েছে যে আমার মনে হল কি বড় অপকর্ম সেরে ঢুকেছি !
বড়দা বললেন - একটা বড় কাজ সেরে এলাম বউমা।
কেউ কোন প্রশ্ন করল না । বড়দাও আর কিছু বললেন না ।
আমি বললাম - কিছু তো বলুন!
বড়দা বললেন - না জিজ্ঞেস করা পর্য্যন্ত কিছু বলবি না ।
( চলবে )