Sanghamitra Roychowdhury

Abstract Tragedy Classics

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Abstract Tragedy Classics

আকাঙ্খা

আকাঙ্খা

4 mins
368



ডাক্তারবাবু রুটিন চেকআপে এলেই অনিরুদ্ধ রোজ প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, "ডাক্তারবাবু, বলতে পারেন ঠিক আর কদ্দিন বাঁচবো? আপনিই বলুনতো একে কি বেঁচে থাকা বলে ডাক্তারবাবু? আমি এইভাবে আর বেঁচে থাকতে চাইনা ডাক্তারবাবু! কই কিছু বলছেন না যে ডাক্তারবাবু?" প্রতিবারই উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে ডাক্তারবাবু বলেন, "আজ কেমন আছেন বলুনতো দেখি আগে? দেখি, হাতটা দেখি!"


পঁয়ত্রিশ বছরের সুস্থ সবল স্থিতধী প্রতিশ্রুতিমান সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অনিরুদ্ধ বসু গত তিন বছর আগে হঠাৎ অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়িতেই ঢলে পড়েছিলো। চলন্ত গাড়িতেই শরীরটা এলিয়ে পড়েছিল সিটের উপর। ড্রাইভার সামনের লুকিং গ্লাসে খেয়াল করেছিলো। ওই তদারকি করে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে ফোনে ফোনে খবর দেয়।‌ সব করেছিলো একান্ত আপনজনের মতো। তিনমাস হাসপাতালে রইলো অনিরুদ্ধ অসার অবশ দেহটা নিয়ে। খুব বড়োরকমের সেরিব্রাল অ্যাটাক। তিনমাস পরে বাড়িতে ফিরে এলো অনিরুদ্ধর জড়ভরত হয়ে যাওয়া অশক্ত শরীরটা বোঝাস্বরূপ... ছিয়াত্তর বছরের বাবা, সত্তর বছরের মা আর মাত্র আড়াই বছরের পুরোনো বৌ দামিনীর কাঁধের ওপরে। বিছানা আর হুইলচেয়ার। হুইলচেয়ার আর বিছানা। অনিরুদ্ধর জীবনের চাকাটা আছে, কিন্তু ঘোরা বন্ধ করেছে। সেই স্ট্রোকের পর থেকেই চলচ্ছক্তিহীন অনিরুদ্ধর ঠিকানা বারো বাই পনেরো ঘরটার চার দেওয়ালের মধ্যেকার এই বিছানাটুকু আর ঐ জানালার পাশে রাখা হুইলচেয়ারটা। মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানটাই তার এখনকার একমাত্র সচল বন্ধু। সর্বক্ষণের সঙ্গী। হুইলচেয়ারে বসাটাও তো কারুর সাহায্য নিয়ে। জানলা দিয়ে দৃশ্যমান একফালি আকাশটুকুও আর দেখতে ইচ্ছে করে না অনিরুদ্ধর। রাগ হয়, খুব রাগ হয় অনিরুদ্ধর। অনিরুদ্ধ জীবনের ওপরে তীব্র বীতশ্রদ্ধ। আশাহত... নিরাশ একজন মানুষ এখন ও। প্রতিভাবান সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের আঙুলগুলো কি আর কখনো ওর কম্পিউটার কীবোর্ডের ওপরে খেলে বেড়াবে? জানে না অনিরুদ্ধ। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস... গোটা তিনটে বছর বিছানায় শুয়ে থাকতে অনিরুদ্ধর উপলব্ধি... জীবনে সবই কেবল মায়ায় জড়ানো, সবই আসলে ফাঁকি। একমাত্র সত্য মৃত্যু। এখন মরণকেই বড্ডো বেশি করে ভালোবেসে ফেলেছে অনিরুদ্ধ। একলা ঘরে বসে শুধু মৃত্যুর পরোয়ানা পাবার অপেক্ষা করে। মৃত্যুকে কামনা করে সর্বান্তঃকরণে। মৃত্যুকে ডাকে সবসময়। অথচ জীবনেরও তো একটা নির্দিষ্ট রীতিনীতি আছে, নিয়ম-কানুন আছে। মৃত্যুকে চাইলেই তো আর মৃত্যু কারুর জীবনে অনধিকার প্রবেশ করতে পারে না! তাই অনিরুদ্ধর এইযে এতো অদ্ভুত কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু... সেও আর কিছুতেই আসে না অনিরুদ্ধকে নিজের দেশে নিয়ে যাবার ‍‍জন্য। আর অনিরুদ্ধ আছে ওর চড়ার দিকে ব্লাডপ্রেশার আর ব্লাডসুগার, দুর্বল হার্ট, কমজোরী ফুসফুস, অবসন্ন কিডনি নিয়ে... বাদ নেই কিছুই আক্রান্ত হতে। হাত পা চলে না। সব কিছুতেই পরমুখাপেক্ষী। অবসাদগ্রস্ত। কিন্তু, তবুও বেঁচে আছে অনিরুদ্ধ।


"দামিনী, তুমিই বলো, আমার বেঁচে থাকার কী মানে? কোনো মানে আছে কি এই বোঝার মতো জীবনটাকে টেনে নিয়ে চলার? বলো তো দেখি? বলো না!" স্ত্রীকে আকুল গলায় অস্পষ্ট জড়ানো উচ্চারণে জিজ্ঞেস করে অনিরুদ্ধ। বাবা মা'তো শুধু এই প্রশ্নটাকেই প্রাণপণে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অনিরুদ্ধর ঘরে খুব কমই আসেন আজকাল। প্রথম প্রথম বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা আসতো। গল্প হতো। তারপর দিন যত গড়িয়েছে ধীরে ধীরে সে সবই কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের ঘরে। সারাদিন একলা অনিরুদ্ধ আর মাথার ওপর ঘুরন্ত এক ফ্যান। ঘরঘর ঘরঘর করে অনিরুদ্ধর একাকীত্ব দূর করার নিষ্ফলা প্রচেষ্টায়।


এইরকম জীবন তো কখনও চায়নি অনিরুদ্ধ। এর চেয়ে মৃত্যু বরং ভালো। মৃত্যুকে তাই আর ভয় পায় না অনিরুদ্ধ এখন। জীবনটা অনিরুদ্ধকে তিক্ততার স্বাদ দিয়েছে। আস্ত একটা ধোঁকার চলচ্চিত্র কাহিনী যেন। অনিরুদ্ধ ভাবে চিরশান্তি বলে যদি কিছু থাকে তবে তা আছে কেবলমাত্র মৃত্যুতেই। অনিরুদ্ধ শুধু নির্ভীক এক অপেক্ষায় আছে... কবে সেই অমোঘ দিনটি আসবে, কবে কখন মৃত্যুদূত এসে হাত ধরে নিয়ে যাবে অনিরুদ্ধকে। মুক্তি দেবে অনিরুদ্ধকে। চিরমুক্তি। সারাদিন এইসবই ভাবে আর এই কথাগুলোই সবাইকে নানানভাবে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলতে থাকে অনিরুদ্ধ।


স্ত্রী দামিনী সন্ধ্যের সামান্য আগেই অফিস থেকে ফেরে। অনেক ধরাকরা করে অনিরুদ্ধর অফিসেই সামান্য একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে দামিনী। আর কীইবা করতো? এই হতশ্রী বসতবাড়িটা ছাড়া বাকি আর সবইতো গেছে অনিরুদ্ধর এই গত তিন বছর ধরে চলতে থাকা দীর্ঘ চিকিৎসার পেছনে। বাড়ীতে ফিরেই আগে স্নান করে রোজ। তারপর রান্নাঘরে ঢোকে। যথারীতি আজও স্নান সেরে রান্নাঘরে ঢুকেছে। রান্নাঘর থেকেই শুনতে পেলো চিৎকার... অনিরুদ্ধর গোঙানি মেশানো ভয়ার্ত চিৎকার। কী বীভৎস চিৎকার! চিৎকার না বলে আর্তনাদ বললেই ঠিকঠাক বলা হবে।


অনিরুদ্ধর চিৎকার শুনে এক ছুটে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে অনিরুদ্ধর ঘরে গেলো দামিনী। ভয়ে চোখমুখ ফ্যাকাশে, বালিশের ওপর থেকে একদিকে হেলে পড়েছে অনিরুদ্ধ। গলার শিরা ফুলে উঠেছে, সরে যেতে চাইছে অনিরুদ্ধ আপ্রাণ, কিন্তু অপারগ। কী করুণ দৃশ্য! চূড়ান্ত অসহায়ত্বের শিকার। খাটের পায়ের দিকের মশারি খাটানোর স্ট্যাণ্ডে জড়িয়ে এক সাপ। নিরীহ... নির্বিষ। তবুও সেদিকে তাকিয়েই অনিরুদ্ধ ভয়ে রক্তশূন্য... ফ্যাকাশে। পরম যত্নে দামিনী অনিরুদ্ধকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হুইলচেয়ারে বসিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে চললো। অনিরুদ্ধর ঘাড়টা সোজা করে দিতে দিতে দামিনী ভাবে, "হায়রে কী অদৃষ্ট! যে মানুষটা, সারাদিন ধরে শুধু মরতেই চায়, সেই মানুষটাই ঘরের ভেতর খাটের ওপরে একটা সাপ দেখে এখন মরার ভয়ে কাঁদছে? আহা, বাঁচার কী তীব্র অদম্য আকাঙ্ক্ষা! এমাসের মাইনেটা পেয়ে একটা ভালো মিউজিক সিস্টেম কিনে আনবো, সারাদিন তো শুধু গানই শোনার ক্ষমতাটুকুই অবশিষ্ট আছে। আর ফিজিওথেরাপিস্টকেও দু'বেলাই আসতে বলবো এমাস থেকেই..."! হুইলচেয়ারটা বসার ঘরের টিভির মুখোমুখি বসিয়ে দিলো। টিভিতে একটা গানের অনুষ্ঠান চলছে... "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে..." হুইলচেয়ারের হাতলে ডানহাতের দুটি আঙুল দিয়ে একটু তাল দিলো না অনিরুদ্ধ?




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract