আহাম্মকের কাণ্ড!
আহাম্মকের কাণ্ড!
শনিবার ভর দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরে, আবার ভালো করে পুকুরে চান করে আসলো তাপস। ভাত খাবার পর মাটির দেড়তলার ওপরের ঘরে শুয়ে পড়তে বসলো। একমাস পরই শুরু পরীক্ষা।
কিন্তু এই দুপুরবেলা, স্নানের পর ভরপেট ভাত খেয়ে জানালার পাশে শুলে, আর তার ওপর যদি পুকুরের দিক থেকে এমন হিল হিল করে ঠাণ্ডা হাওয়া দেয়, কার না ঘুম আসবে? পড়তে পড়তে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিলো বারবার। দু'দু'বার তো মাথাও ঠুকে গেলো!
অগত্যা, ঘুম কাটানোর জন্য ঠিক করলো একটু অন্যপথ নেওয়া যাক। বাড়িতেও কেউ নেই। মা গেছে পুকুর ঘাটে বাসন মাজতে। দাদাও খামারবাড়িতে গোয়ালঘরের ছাউনি ঠিক করাচ্ছে। বাবা তো তার শৈশবেই গত হয়েছেন। তো নিশ্চিন্তেই, বেশ আরাম করে...
এমন সময় মায়ের গলা - তাপস...
- উম্মম্
- বিড়ি খাচ্ছিস?
- হুম্মম্ (কোন রকমে ধোঁয়াটা গিলতে গিলতে উত্তর দিলো সে।)
- বেশি বিড়ি খাস না বাবা। দাদার মত অত বিড়ি খাস না। শরীর খারাপ হবে। চারিদিকে কত রোগ বালাই হচ্ছে...
তাপস আর চাপ নিতে পারলো না, আগলহীন জানালার ফোকর গলে পিছন দিয়ে নেমে গেল সে বাইরে। পুকুর পাড়ের পরই শুরু চাষের জমি। তার কিছুটা পর আসে বো'য়ের ধার - গ্রামের কোন এক ধনী গৃহবধূ(বৌ)-র আদেশে, গ্রামের উত্তর প্রান্ত (ধার) জুড়ে খনন করা হয়েছিল এই বিশাল দীঘি, তাই এমন নাম।
সেই দীঘির চওড়া দু'পাড় জুড়ে বড় বড় সব গাছ - বেল, নিম, তেঁতুল, শিরীষ, তাল, বাবলা ইত্যাদি। আর আছে আগাছার জঙ্গল। জলধারণ ক্ষমতা বিচার করলে, গোটা গ্রামের সারা বছরের জলের চাহিদা পূরণ করতে পারে সে একাই। তবুও সেই দীঘি গ্রামের লোকের জন্য গর্বের নয় বরং ভয়ের কারণ।
যে গৃহবধূর কারণে এই দীঘি খনন করা হয়েছিল, তাঁকেই একদিন সেখানে বেলগাছের ডালে গলায় ফাঁস বেঁধে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায় লোকজন! তারপর আর এক চাষী, হাল দিয়ে ফিরছিল মাঠ থেকে, ওখানেই একইভাবে তাকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
তারপর কত মানুষের অপমৃত্যু হয়েছে সেখানে তার ইয়ত্তা নেই। ধীরে ধীরে দীঘির পাড়টা হয়ে উঠেছিল যেন গ্রামের স্যুইসাইড পয়েন্ট। গ্রামের মানুষও তাই এড়িয়ে যাওয়া শুরু করে দীঘিটাকে। আজও গ্রামের কোন সুস্থ মানুষ একলা সেখানে যাবার সাহস করে না।
কেবল খরার চাষের সময় পূর্বদিকের এক কোণ দিয়ে, যেদিকে জঙ্গলটা একটু কম আর জল নির্গমনের জন্য একটা নালা কাটা আছে, সেদিক থেকে দল বেঁধে লোকজন ঢুকে জলের ধারার পথটুকু, মানে নালাটা সাফ করে দিয়ে যায়। আর চাষের পর নালার মুখও বাইরে থেকেই বন্ধ করে দেয় মাটি চাপা দিয়ে!
খুব প্রয়োজন ছাড়া, কোন অবস্থাতেই কেউ দল বেঁধেও যায় না যে দীঘির পাড়ে, তাপস কিনা বিড়ি ফুঁকবে বলে সেখানেই গিয়ে ঢুকলো! তাড়া খুলে একটা বিড়ি বের করে বেশ করে রগরে নিয়ে, দেশলাই জ্বেলে ধরায় সে ওটাকে। মনের সুখে বিড়িতে সবে দু'টো টান দিয়েছে কি দেয়নি, পিঠে একটা খোঁচা খেল সে!
ঘুরে দেখে তার দাদা! কি রে, এখানে এসে বিড়ি ফুঁকছিস একা একা? তাপসের তো ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল। দাদা যা রাগী, এবার না মেরে তার পিঠের চামড়াই ছাড়িয়ে নেয়! কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে দাদা বললো - দে, দেখি আমাকে একটা। ভাত খাওয়ার পর আমারও আজ বিড়ি খাওয়া হয়নি।
তাপস হতভম্ভ হয়ে বিড়ির তাড়াটা বাড়িয়ে দেয় দাদার দিকে! ঠিক এমন সময় একটা জোড়ালো আওয়াজ আসে তার কানে - তা-প-স! দাদার গলা! পাশ ফিরে দেখে কেউ নেই সেখানে - শুধু বিড়ির তাড়াটা মাটিতে পড়ে!
মায়ের কাছে শুনে তাপসকে খুঁজতে সেখানে এসেছিল দাদা। তাপস বিড়ি দেশলাই সব ফেলে, ভয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসে জঙ্গল থেকে দাদার দিকে। হঠাৎ কোন লতা অথবা মাটির ওপর বের হয়ে থাকা গাছের শিকড়ে পা জড়িয়ে গিয়ে সে আছড়ে পড়ে মাটিতে।
জমির আল থেকে তার পানে দাদা দৌড়ে আসে , কিন্তু তার আগেই, পায়ে জড়ানো লতার দড়ি ধরে যেন তাপসকে টেনে নেয় কেউ জঙ্গলের ভিতর দিকে! দাদা সেখানে এসে পৌঁছানোর আগেই, বিলকুল অদৃশ্য হয়ে যায় তাপস।
আজ ছোট ভাইয়ের ছবিতে শ্রাদ্ধের ফুল রাখতে রাখতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো তাপসের দাদা! সব দেখেও নির্বাক, যেন পাথরের প্রতিমা হয়ে গেছে তার মা!