আবাহন
আবাহন


১
ঝিলমিল সমুদ্রপাড় বরাবর ছোট্ট পায়ে এগিয়ে চলেছে। অস্তগামী সূর্যের লাল আলোর আভরণে, রুক্ষ এলো চুলে, হাতে একগুচ্ছ মুক্তর মালা আর চোখে অনাবিল সরলতা নিয়ে ঝিলমিল এগিয়ে চলেছে নিজের রুজিরুটির সন্ধানে। আট বছরের মেয়েটার কোনোদিন হয়তো ভালো বিক্রি হয়, কোনোদিন মন্দা যায়।
'ও দিদিভাই, মালা কিনবে, মুক্তর মালা?' মস্ত ক্যামেরা গলায় ঝোলানো, বড়ো ব্যাগ পিঠে একজন ত্রিশোর্ধ্ব মহিলার সামনে এসে অনুরোধ রাখলো ঝিলমিল।
কেউ কেউ শখে কেনে, কেউ সহানুভূতিতে, বিরল কেউ হয়তো ওকে স্নেহ করে। এই দিদি কি কিনবে ওর সামগ্রী?
নিয়ন্তা মেয়েটার সাথে আলাপ জমালো। বেশ মিশুকে মিষ্টি মেয়েটা। কত ব্যবধান ওদের দুজনের তথাকথিত সামাজিক স্তরে, তবু মেয়েটিও ওর মতনই তো বেরিয়েছে নিজের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রামে। ও নিজেও তো এসেছে নিজের চিত্রশিল্প সত্তাকে জাগ্রত করতে, সব্বার থেকে আলাদা কিছু করে কোনো চমৎকার ঘটাতে, সাড়া ফেলে দিতে মানুষের মনে। ভিন্ন ভাবে হলেও, ওদের সংগ্রাম কোথাও যেন এক - উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতন বেঁচে থাকার।
কি মনে করে নিয়ন্তা বলল,
'ছবি তুলবি? আমি তোর ছবি তুলে ফটোগ্রাফি কনটেস্টে দেব। কত মানুষ দেখতে পাবে তোর মুখ'
ঝিলমিল অত বোঝে না, অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করার বুদ্ধি ওকে এখনো ঈশ্বর দেয়নি। জলের ওপর হঠাৎ এসে পড়া সূর্যকিরণ যেমন ক্ষুদ্র তরঙ্গকে ঝিলিমিলিয়ে তোলে, তেমনই ছবি তোলার নামে ওর ছোট্ট মনটা শিহরিত হয়ে উঠলো। লাজুক হেসে সম্মতি জানালো তক্ষনই।
২
আজ নিয়ন্তার তোলা ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বছরের সেরা চিত্রশিল্পকারের খ্যাতি এখন ওর মুকুটে স্বমহিমায় জাজ্বল্যমান। ছবিটার শিরোনাম 'আবাহন'। দিগন্তে সূর্যোদয়ের বর্নবলয়ে, দারিদ্র্য ছেড়ে উঠে আসছে একটা বাচ্চা মেয়ে সমুদ্রমন্থন সেরে। গলায় তার শোভিত মুক্তমালা, কপালে লিপ্ত সিঁদুর। চিত্রচরিত্রে ঝিলমিল।
ছবিটা এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যে পুজো মণ্ডপের সজ্জায় এবছর স্থান পেয়েছে বহুজায়গায়। বড়ো বড়ো পুজোয় ঝিলমিলের মুখের আদলে তৈরি হয়েছে দেবীপ্রতিমায়ের আরাধ্য মুখশ্রী।
নিয়ন্তা ভোলে নি। প্রতিশ্রুতিমত, ছুটে গিয়ে ঝিলমিলকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে, নিজের রোশনাইয়ের ভাগ দিতে। কিন্তু আজব আদব-কায়দা মানুষের। ঝিলমিলকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল যারা, তারাই কেন যে আজ চূড়ান্ত অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখছে ওকে? প্রয়োজন ফুরিয়েছে ওর, বুঝেছিল সেইটুকু। তবুও একটা খচখচানি কিছুতেই যাচ্ছিল না মন থেকে...
দশমীর সন্ধিক্ষণে, দেবীকে বিদায়লগ্নের মুহূর্তে পায়ে পায়ে গঙ্গার ধারে এসে নিয়ন্তার হাতটা ধরলো ঝিলমিল।
নিজের মুখবয়বের প্রতিফলনে গড়া দেবী তখন ভাসানের জলে। বিস্ফারিত চোখে ওর অবোধ জিজ্ঞাস্য
'যেই মা'কে আবাহন করে পুজো করো, তাকে কেন বিসর্জন দাও তোমরা?'
সমাপ্ত।।