৯৯ নট(?) আউট
৯৯ নট(?) আউট
ফোনটা হঠাৎ করে বেজে ওঠাতে বেশ বিরক্তই হলেন আশিস বাবু।
কাজের মধ্যে !! উফফফ। পারা যায় না।
-হ্যালো
-নমস্কার দাদা, আমি সুব্রত বলছি এ.বি পাবলিশার্স থেকে। বলছিলাম যে..
-না দুঃখিত, হাতে প্রচুর কাজ।বইমেলার আগে আর কাজ নিতে পারব না।
ফোন কেটে লিখতে বসলেন আশিস বাবু। লিখতে দিলে তো!! আবার ফোন!
- জয়া পাবলিশার্স তো! আপনাকে তো গত মাসে বললাম জানুয়ারি থার্ড উইকের মধ্যে আপনাকে ঠিক গল্প পৌঁছে দেব। এত ফোন করেন কেন!
এভাবে লেখায় মন বসে নাকি!! ধুর!!
আবার ক্রিং ক্রিং!!
-হ্যালো, আশিস অধিকারী বলছি।
-নমস্কার দাদা। রঞ্জিত বলছিলাম। আজকের মধ্যে লেখাটা পাঠাবেন বলেছিলেন। একটু..
-কটা বাজে?
-ইয়ে মনে ৭টা ২০।
-৭ টা ২২। রাত ১১টা ৫৯এর মধ্যে ঠিক পেয়ে যাবেন।
-হ্যাঁ, সরি দাদা। আমরা জানি আপনি কতটা রেস্পন্সিবিলিটি, ডিটারমিনেশন, অনেস্টি সহকারে লেখা লেখেন। ওপর থেকে চাপ আসায় একটু ফোন করতে হল। সরি দাদা।
ফোন টা কেটে এবার সুইচ অফ করে দিলেন আশিস বাবু।
পাবলিশার্সদের থেকে এরকম চাপ আসা অবশ্য আশিস বাবুর কাছে নতুন কিছু নয়। যার কলমের জাদুতে পাঠকরা মুগ্ধতার সাগরে ডুব দেয়, তার সেই জাদুদণ্ডের ছোঁয়া পাওয়ার জন্য পাবলিশার্সদের ভিড় তো জমবেই।
গল্পটা শেষের দিকে, সময়ও অবশ্য বেশি নেই হাতে। লিখতে শুরু করলেন আশিস বাবু।
“শুভর ব্যক্তিগত রান তখন ৯৯। টেস্ট ক্রিকেটের শুভ্রতার মাঝে হঠাৎ ই নীল আকাশে কালো মেঘের ভ্রুকুটি। সূর্যাস্তের লালচে আভা কখন যে সেই কালো মেঘের কোলে মুখ লুকিয়েছে তা খেয়াল করেনি শুভ। এরকম হবে জানলে হয়তো আর একটু আক্রমণাত্মক খেলে দলের জয়ের জন্য অবশিষ্ট ৯ টা রান আর ব্যক্তিগত সেঞ্চুরির জন্য অবশিষ্ট ১ টা রান আজ ই করে ফেলত শুভ। বৃষ্টি নামবে কি নামবে না! একটা ছয় মারার চেষ্টা করবে শুভ! এই সংকোচের মধ্যে আশঙ্কাই সত্যি হল। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল আর সাথে সাথে চতুর্থ দিনের খেলায় দাড়ি।“
-এই দাদা! ওষুধ দিবি না! সাড়ে সাতটা বাজে তো!
পাশের ঘর থেকে ভাই চেঁচিয়ে ডাকলো আশিস বাবুকে।
-আসছি দাঁড়া। একটু দাঁড়া।
-আয় না তাড়াতাড়ি, আজ পেপার পড়েছিস! তোকে নিয়ে কি দারুণ একটা লেখা ছেপেছে রে।
-আর পেপার! এত লেখার চাপ দিচ্ছে পাবলিশার্সগুলো যে কি বলবো! দাঁড়া পাঁচ মিনিট । আসছি।
বইয়ের তলা থেকে হলদেটে একটা খুব পুরোনো দিনের খবরের কাগজের টুকরো বের করলেন আশিসবাবু। চোখ টা নিমেষে ছলছলিয়ে উঠলো আশিসবাবুর। হঠাৎ ই বা হাতের আলগা বাঁধনে সেই খবরের কাগজ টা রেখে ডান হাতে শক্ত দৃঢ় মুঠোয় কলম ধরলেন উনি। চোখে মুখে এক দৃঢ়তার ছাপ। লিখতে শুরু করলেন আবার।
“মেঘের ভ্রূকুটি চতুর্থ দিনের শেষ বেলার খেলা ভেস্তে দিলেও পঞ্চম দিনে সে সবের বালাই নেই আর।“
পঞ্চম দিন! দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আশিস বাবু। কলম টা আরো দৃঢ় করে লিখতে শুরু করলেন।
“অবশ্য আগের দিন রাত টা খুব চিন্তায় কেটেছে শুভর। আগামীকাল হাওয়ায় বল খুব সুইং করবে, ইস, একটু মেরে খেললে হত। এইসব ভাবতে ভাবতে দুশ্চিন্তার করাল গ্রাসে নিজেকে যে কিভাবে নিমজ্জিত করে ফেলেছিল শুভ তা কেবল ও-ই জানে।“
দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাসের শব্দে হুইলচেয়ারের চাকার আওয়াজ ও কানে পৌঁছায় নি আশিস বাবুর। কলমের আঁচড়ে আবার ও লেখা শুরু করলেন উনি।
“খেলাতে অবশ্য তার কোনো প্রভাব পড়েনি শুভর। দুর্ধর্ষ কয়েকটা চোখ জুড়ানো শট! আর তারপর সেঞ্চুরি, ম্যাচ জেতানো ইনিংস। সমর্থকদের কাঁধে চেপে যখন মাঠ ছাড়ল শুভ, রাজ্যের রঞ্জি দলে প্রথম এগারোয় তার নামের অন্তর্ভুক্তি তখন ই সমাপ্ত। জাতীয় দলের দরজার সামনে..”
-এই দাদা!!
হকচকিয়ে উঠলেন আশিসবাবু। গল্পের খাতাটা মুহূর্তে বন্ধ করে বাম হাতের খবরের কাগজের টুকরোটা খাতার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলেন উনি।
-তুই আসতে গেলি কেন আবার!
-বাব্বা! এমন চমকে উঠলি!! যেন মনে হল এই বুড়ো বয়সে প্রেমের চিঠি লিখছিস কাউকে। আমি আসতে সব লুকিয়ে ফেললি!
- হা! হা! না রে। আরে যাচ্ছিলাম তো। আবার কষ্ট করে আসতে গেলি কেন!
- না এলে কি আর জানতে পারতাম আমার দাদাটা বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়েছে। যাকগে! এই পেপার টা দেখে আর তোর কাছে আসার লোভ সামলাতে পারলাম না।
-কিসের রে!
-এই দ্যাখ লিখেছে এখানে। হাজার লেখকের ভিড়ে আলাদা ভাবে যিনি বাঁচতে শিখেছেন, তিনি আর কেউ নন। তিনি আমাদের অত্যন্ত প্রিয় আশিস অধিকারী। হাজার লেখকের ভিড়ে না মিশে আমাদের নয়নের মণি হয়ে রয়েছেন এই আশিস বাবু। না, তার লেখা কল্পনার জগতে কখনো চাঁদের বাড়ি খুঁজতে যায় না। বরং বাস্তবের রুক্ষ্ম মাটিতেই তার লেখনীর সার্থকতা। প্রিয় মিথ্যা নয়, বরং অপ্রিয় সত্যিকেই তিনি তার লেখনীর মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলে দর্শক মননে জায়গা করে নিয়েছেন বারংবার। পড় দাদা পড়। এই যে। আমার তো গর্বে বুক টা ফুলে উঠছিল। বিশ্বাস কর। তুই বারবার সবাইকে শিখিয়েছিস মিথ্যের আশ্রয় নিবি না, আর আজ! তোর সেই কথার ইয়ে, মানে বল না!! প্রতিধ্বনি!! ,হুমম, তোর কথার প্রতিধ্বনি তোর গল্প উপন্যাসগুলোর মাঝে এমন ভাবে ফুটেছে যে .. উফফফ। কি সুন্দর লিখেছে পেপার টায়। শোন! পড়ে নে। আমায় পরে দিয়ে দিবি। আমি পেপারটা কেটে রেখে দেব।
-আচ্ছা বাপু আচ্ছা। দাঁড়া, ওষুধটা তোর।
-তুই এত মন দিয়ে লিখছিস দেখে আমি নিজেই নিয়ে খেয়ে নিয়েছি। এই শোন! আমি চললাম এখন। তুই লেখ।
-পৌঁছে দিয়ে আসি?
-ধুর পাগল! চলে যাবো। আরে টিভি দেখব একটু। পরে ডাকবো তোকে দরকার হলে।
- ও! এখন আবার কি দেখবি!
-উফফ। তুইও না। টি টোয়েন্টি রে বাপু, ম্যাচ আছে না! এলাম, কটা উইকেট পড়ল কে জানে!
নিজেই হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে টিভির ঘরে চলে গেল ভাই শুভাশিস, শুভাশিস অধিকারী। গল্পের খাতার মধ্যে থেকে পুরোনো হলুদ পেপার কাটিং টা বের করলেন আশিস বাবু।
দুমড়ানো মোচড়ানো সেই হলদেটে পাতা থেকে এখনো জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠছে হেডলাইন। “ মারাত্মক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত আগামী দিনের ক্রিকেট প্রতিভা শুভাশিস অধিকারী।“
চোখের জল বাঁধ মানলো না আশিস বাবুর। না, পঞ্চম দিন আর খেলতে যেতে পারেনি শুভ, জাতীয় দল কেন! রঞ্জি দলেও কোনোদিন ও খেলতে পারেনি শুভ। চতুর্থ দিনের খেলা শেষে অন্যমনস্কতার জন্য একটা মারাত্মক দুর্ঘটনায় প্রাণটুকু বাঁচলেও আর খেলার মাঠে ফেরা হয়নি শুভর।
সত্যের চাদর ছিন্ন করে শুভর পরাজয় ,আজ জয়ের মুখোশ পরে গল্পের খাতায় হাজির হয়েছে বটে, কিন্তু আশিসবাবুর মনে দোটানার সুনামি আছড়ে পরছে বারংবার। শেষ পরিচ্ছেদটুকু স্ট্রাইক থ্রু করলেন আশিস বাবু।