বিবর্ণ শরত
বিবর্ণ শরত
দেখতে দেখতে আর একটা শরত এসে গেলো, পুজো আসছে। যদিও বর্ষা যাই যাই করেও রয়ে গেছে আবহাওয়াতে, ঈশানীর মনেও। গত লক্ষ্মী পুজার পর পরই লোকটা যেন বেমালুম উধাও হয়ে গেলো। বছর ঘুরতে যায়। ফেসবুকে, হোয়াট্স অ্যাপে খুব কম আসে এখন ঈশানী। ভালো লাগে না, আরণ্যক ছাড়া খাঁ খাঁ করে । ওর আইডি টা ফাঁকা। আশায় আশায় প্রতিদিনই ইনবক্সে উঁকি মারে, যদি মেসেজ আসে। মাঝে মাঝে নিজেও গুড মর্নিং, গুড ইভিনিং, গুড নাইট মেসেজ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখে-যদি সাড়া পাওয়া যায়। নাহ! এক অসহনীয় নিস্তব্ধতা। অপেক্ষা, অপেক্ষা আর অপেক্ষার প্রহর গোনা। প্রথম দিকে অস্থির হয়ে ভয়ে ভয়ে বার কয়েক ফোন করেছিল ওর নাম্বারে। প্রতিবারই মহিলা কণ্ঠের হ্যালো শুনে শঙ্কিত হয়ে ফোন নামিয়ে রেখেছে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নানা রকম খারাপ চিন্তা মাথায় আসে, বড় কোন অসুখ বিসুখ হোল, না কোন দুর্ঘটনা হোল? খবরের কাগজ, টি ভি চ্যানেল খুললেই তো পথ দুর্ঘটনার খবর।
কত চোখের জল ফেলেছে ঈশানী, নিঝুম রাত আর খাঁ খাঁ করা দুপুর গুলো তার সাক্ষী। আরণ্যকের এই আচরণে প্রথম দিকে অভিমান, রাগ সব মিশে একটা অনুভূতি ছিল। সন্দেহের কালো মেঘও যে মনের আকাশে উঁকি মারেনি, তাও নয়। পুরুষ মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব।হয়তো অন্য কোন আইডি দিয়ে অন্য কারুর সাথে- এই ভাবনাটা যখনই মাথায় এসেছে, তখন কষ্ট আরও বেড়েছে। কারণ উদ্বেগের সাথে অসহ্য একটা দমবন্ধ করা রাগ জোটবদ্ধ হয়ে মাথার মধ্যে দপদপানি আরও কয়েক গুন বাড়িয়ে দিয়েছে।
সময়ের শক্তি বিশাল, অসীমে বিস্তৃত তার ক্ষমতা। কথায় আছে যে সময় সন্তান শোকও ভুলিয়ে দেয়। অনেক নির্ঘুম রাত, বন্দী দুপুর খরচ করে ঈশানী কিছুটা নিজেকে সামলেছে,উঠে দাঁড়িয়েছে যদিও নিজের সংসারের কাজে ঈশানী কোন দিন কোথাও কোন ফাঁক রাখে নি। সময়ের পলি পড়তে পড়তে এখন শুধু রয়ে গেছে এক হাহাকার আর কিছুটা আক্ষেপ।এখন মনে হয় ফেসবুকে আরণ্যকের সাথে এই ভালবাসার সম্পর্কে জড়ানো ঠিক হয় নি, তাহলে এই শাস্তি পেতে হতো না। দুজনের কেউই বিবাহিত জীবনে সেই অর্থে অসুখী ছিল না। নিজ নিজ সংসারে সুখী দুটো মন কিভাবে যে এক আত্মিক বন্ধন আর নির্ভরতায় জড়িয়ে গেছিল, তার ব্যাখ্যা বা কোন উত্তর দুজনের কেউই খুঁজে পায় নি। হয়তো আপাত সুখের আড়ালে কোন অজানা অপূর্ণতা রয়ে গেছিল। নিরিবিলি দুপুরের অবসরে অনেকদিন ঈশানী ভেবেছে- মানবিক সম্পর্ক গুলো ভীষণ অদ্ভুত। সঠিক উত্তর খুঁজে না পাওয়া জটিল অঙ্কের মতো। দুটো মানুষ গায়ের সাথে দিনের পর দিন থাকলেও, অনেক কিছুই তাদের মধ্যে অজানা থাকে- জানার ইচ্ছে বা তাগিদটাও বোধ হয় থাকে না, থাকলেও- হয়তোবা একসাথে থাকার একঘেয়েমি সেই ইচ্ছেটাকে মেরে ফেলে। আবার দুটো মানুষ কোন দিন দেখা সাক্ষাৎ হোল না, শুধু মাত্র সোশ্যাল সাইটের মাধ্যমে পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতায় একে অন্যের সব কিছু জেনে ফেলে। নিঃসঙ্কোচে, পরম নির্ভরতায় ঈশানী অকপটে নিজের মাসিক জনিত শরীর খারাপের কথা আরণ্যককে বলে দিত। আরণ্যক জেনে গেছিল, সব মাসে না হলেও কিছু কিছু সময় মাসিকের আগে পরে ঈশানীর কোমর থেকে পায়ের গোছে প্রবল ব্যাথা হয়। কখনও ফোনে, কখনও ইন বক্সে আদর করে পরম মমতায় আরণ্যক ওর কোমর, পা টিপে দেওয়ার কথা বলত। লাজে রাঙ্গা হয়ে অপ্রস্তুত ঈশানী বলত, “আহ! ছাড়ো। কি হচ্ছে কি? লাগবে না, অতো অস্থির হয়ও না তো। মেয়েদের অমন হয়”। মুখে বলত বটে, কিন্তু ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা ঈশানীর শরীর মন জুড়ে ভাল লাগার এক তিরতিরে সুখ সম্প্রসারিত হত। কি অদ্ভুত! ব্যাথাটাও যেন প্রশমিত হয়ে যেতো। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে আরণ্যক তারিখ খেয়াল রাখতে পারত না কিন্তু গলার স্বর শুনেই নির্ভুল ভাবে বুঝে ফেলত ঈশানীর পিরিয়ড হয়েছে এবং এবার সেটা যন্ত্রণাদায়ক।
ঝগড়াও যে হতো না তা নয় কিন্তু ভালবাসার টানে খুব সহজে মিটেও যেতো। কার কি পছন্দ, কি অপছন্দ সব জানা ছিল একে অন্যের। ঈশানী জেনে গেছিল, পুজো বা কোন অনুষ্ঠানে শাড়ি পড়ে, দুই ভ্রূর মাঝখানে বড় টিপ লাগিয়ে, কানে ঝুমকো পড়ে আলতো ঘোমটা দেওয়া ছবি ইনবক্সে না দিলে অথবা দুই একদিন দেরী হলেই বাবুর গোঁসা হয়ে যাবে। আরণ্যকের এই ইচ্ছের মেসেজ যেন মুখস্থ ঈশানীর। অন্যদিকে ঈশানীরও আবদার ছিল আরণ্যকের পাঞ্জাবী, পায়জামা পড়া ছবির।
আরণ্যকের সিগারেট খাওয়া ওর স্ত্রী, ছেলে পছন্দ করত না কিন্তু ঈশানীর ভাল লাগতো। রাতের দিকে বা ছুটির দিনে নিরিবিলি দুপুরে ইনবক্সে আরণ্যকের উদ্দাম আদরে ভিজে যেতে যেতে ঈশানী কিশোরী হয়ে বলত, “উমমম, তোমার মুখ আর বুক থেকে সিগারেটের পুরুষালী গন্ধ আসছে। আমায় আরও চুমু খাও, খেতেই থাকো- দম বন্ধ হয়ে গেলেও ছেড়ো না”।
তবে বিরহের শূন্যতা ভরা হাহাকার দুজনের অভিজ্ঞতাতেই ছিল। যেমন প্রায় চার বছরের ঘনিষ্ঠতায় আরণ্যকরা দু সপ্তাহের জন্য হরিদ্বার, কেদার-বদ্রি গিয়েছিল আর ঈশানীরা দিন দশেকের জন্য কন্যাকুমারী, তিরুপতি। পারস্পরিক বেড়াতে যাবার সেই সময় গুলোতে ওরা যখন টাওয়ার পেয়েছে, সংক্ষিপ্ত মেসেজ চালাচালি করে কুশল বিনিময় করেছে। তাছাড়া সেই সব অনুপস্থিতি গুলোর আগাম খবর দেওয়া ছিল উভয় তরফে। তাই একে অন্যকে মিস করলেও একটা সান্ত্বনা ছিল।
কিন্তু এমন তো কোন দিন হয় নি। বিনা নোটিশে বেমালুম এতো দিন গায়েব। ফেসবুকে দুজনের বেশ কিছ ঘনিষ্ঠ মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে। তাদের দুই তিনজনের কাছে ঈশানী কায়দা করে আরণ্যকের খোঁজ জানতে চেয়েছে। তারাও কোন সদুত্তর দিতে পারে নি। যদিও কেউই ওদের এই ভার্চুয়াল সম্পর্কের কথা জানত না কারণ ওরা দুজনেই এই ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিল।
##
মেয়েটা আজ হস্টেলে ফিরে গেলো।সামনে সেমিস্টারের পরীক্ষা। ঈশানী চেয়েছিল, আরও কটা দিন থাকুক। ও থাকলে মনের ভার ভার ভাবটা অনেক কমে যায়। একটা উচ্ছল পাহাড়ি ঝর্না যেন। পুজোর আগে আবার আসবে। ও চলে গেলে বিষাদ যেন আরও বিশাল আকারে গ্রাস করে। কাজ খুঁজে বেড়ায় ঈশানী।
স্বামী অফিসে। স্নান সেরে, ঠাকুরকে জল বাতাসা দিয়ে আলসে ভাবে ঈশানী বিছানায় এসে বসল। এই বিশ্রাম, এই অবসরটা আর আনন্দ দেয় না ঈশানীকে। অথচ আগে ওর মধ্যে এই অবসরটা বের করার একটা তাড়না থাকতো। আরণ্যক যে অপেক্ষা করে থাকত। শুধু তাই নয়, একটু দেরি হলে, অস্থির হয়ে যেতো।অভ্যাসবশত একবার দ্রুত হাতে ফেসবুক, মেসেঞ্জার ঘুরে এলো। নাহ! কিছু নেই। একগাদা মেসেজ জমে আছে বিভিন্ন বন্ধু, বন্ধুর বন্ধু, অবন্ধু দের। বেশীর ভাগই বিভিন্ন বয়েসের পুরুষ।অবাক লাগে, কিছু আবার ষাটোর্ধ বয়েসের।তাদের ছুঁকছুঁকানি আরও বেশী। কি যে ভাবে এরা মেয়েদের? সহজলভ্যা? ঘুরে ফিরে সবারই একই কথা।“তুমি খুব সুন্দর”, “তোমার বন্ধুত্ব চাই”, “তোমার হাসিটাই তো একটা কবিতা”, “আমি বোধ হয় তোমার প্রেমে পড়েছি” ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিছু মেসেজ আবার আরও সাংঘাতিক। ফোন নাম্বার দিয়ে কথা বলার জন্য ঝুলোঝুলি, দেখা করার আবদার। “সোনা”, “ডার্লিং”, “সুইট হার্ট”, “মিষ্টি” আরও কতো সম্বোধন। প্রথম দিকে বেশ মজা পেত, একা একা একচোট হাসত। ঈশানী আরণ্যককে তাতানোর জন্য ইচ্ছে করে এসব জানিয়ে দিত, কখনো আবার মেসেজ গুলো ফরোয়ার্ড করে দিত ওর ইন বক্সে।বাবুর হিংসা হতো, যতো রেগে যেতো ততো ঈশানী মজা পেত।শেষে অনেক চুমু ঘুষ দিয়ে বাবুর রাগ ভাঙ্গাতে হতো।পরের দিকে আরণ্যক খুব সিরিয়াসলি রেগে যেতো বলে, সেসব মেসেজ আর ফরোয়ার্ড করত না।তাছাড়া ঈশানীও ভাবল, বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে ওর মনে। কারণ ওদের তো দেখা সাক্ষাৎ হয় না।যে কোন ভালবাসার সম্পর্কে বিশ্বাস আর আস্থা সবচেয়ে বড় জিনিষ অথচ কি ভীষণ পলকা!আর এই ধরনের ভার্চুয়াল সম্পর্ক সেটা আরও বেশী করে দাবী করে।এখন আরণ্যক ছাড়া, সেসব মেসেজ পড়া তো দুরের কথা, দেখতেই ইচ্ছে করে না। কিছুই ভালো লাগে না।
হাতে কোন কাজ নেই। বিছানায় ক্লান্ত শরীর ছেড়ে দিল। একটু তন্দ্রা মতো লেগে এসেছিল, একটা শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসল। ও কি ভুল শুনল? সেলফোনটাতে সেই পরিচিত শব্দ নিয়ে একটা মেসেজ ঢুকল? বুকটা ধক করে উঠল। মনের ভুলই হবে। অবচেতন মনে সব সময় আরণ্যকের মেসেজের অপেক্ষা করে বলেই হয়তো এমন হয়েছে।নাহ দেখবে না। ভুলই শুনেছে। তবুও ভেতরের ঈশানীটা লালায়িত করছে।মনে মনে ঠাকুরকে ডাকল। হে ভগবান! যেন সত্যি হয়, হতাশ কোর না। আবার সেই শব্দ। তার মানে আর একটা মেসেজ, হোয়াট্স অ্যাপে। কাঁপা কাঁপা হাতে হোয়াট্স অ্যাপে গেল ঈশানী। ভুল দেখছে? না! ভুল না।
“ তোমাকে একবার দেখতে চাই, সোনা। খুব ইচ্ছে করছে, তোমাকে সেই সাজে দেখতে। ভুলে যাও নি তো আমাকে? প্লীজ, প্লীজ রাগ কোর না, সোনা আমার”।
“ সময় বড় কম আমার। আমার আবদার রাখবে না?”
রাগ হচ্ছে, ঈশানীর ভীষণ রাগ হচ্ছে। অসভ্য একটা লোক! ছাই ভালবাসে, এতো দিন পরে উদয় হয়েই যাই যাই ভাব। এ কেমন আবদার? কেমন আছে ঈশানী, একবার জানতেও চাইল না। সব পুরুষ মানুষই এক, স্বার্থপর।সময় কম না ছাই। একগাদা প্রশ্নের মেসেজ ছুঁড়ে দিল ঈশানী।
“আহ! এতো প্রশ্ন কোর না, প্লীজ। বলছি না আমার সময় খুউব কম। একটু সুযোগ পেয়েছি। এখুনি একবার সেই সাজে এসো’।
অভিমানে ঈশানীর গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আছে।একবার ভাবল ফোন করে। কিন্তু সাত পাঁচ ভেবে নিজেকে সংযত করল। কে জানে কি অবস্থায় আছে, কোথায় আছে, কে ধরবে ফোন। অভিমানের মেঘ গুলো গলে গিয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিয়ে গেল ঈশানীকে। মেসেজ গুলো সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ফাঁকা ঘরে নিরিবিলি দুপুরে ঈশানী উঠে দাঁড়াল ভালবাসার দাবী পূরণ করতে।
##
সেই শেষবারের মতো ঈশানী আরণ্যকের ইচ্ছে পূরণ করেছিল। তারপরে আর কোন দিন আরণ্যকের মেসেজ আসেনি, ঈশানীও আর কানে ঝুমকো পড়েনি, মাথায় ঘোমটা দেয় নি, দুই ভ্রূর মাঝে টিপ পড়েনি। নুতন শাড়ি পড়তে হয়, তাই পড়ে। ফুসফুসের ক্যান্সারের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত আরণ্যক একদিন চির অসীমে মিলিয়ে গিয়েছিল। ঈশানী জানতেও পারেনি কারণ আরণ্যক যে কিছুই বলে যায় নি। ওর থমকে থাকা আইডিটাতে আগে আগে যেতো ঈশানী, এখন আর যায় না- জানে শূন্য হৃদয়ে ফিরে আসতে হবে। বড় বুকে বাজে। কেমন যেন ছ্যাঁত করে ওঠে বুকের ভেতরটা। নিরালা দুপুর গুলোতে ঈশানীর কান, মন প্রাণ অপেক্ষায় থাকে সেই বিশেষ আওয়াজ শোনার জন্য। কখনও এক শূন্যতা গ্রাস করে, হাহাকার করে ওঠে বুকের ভেতরটা, কখনও ভীষণ কান্না পায়।
শরত এসেছে, মা দুর্গাও আসবেন, চলেও যাবেন। প্রাকৃতিক, জাগতিক সব কিছু একই ভাবে নিয়ম মেনে চক্রাকারে আসবে, চলেও যাবে আবার আসার জন্য। শুধু আরন্যকের জন্য ঈশানীর প্রহর গোনার শেষ হবে না।