আমার প্রথম প্রেমের গল্প
আমার প্রথম প্রেমের গল্প
আসাম থেকে সদ্য স্কুলের গণ্ডী পেড়িয়ে বাবা মা ভাইদের ছেড়ে কোলকাতার কলেজে পড়তে এলো এক তরুণ। টেন প্লাস টু এডুকেশন সিস্টেমের প্রথম ব্যাচের তরুণটিকে অংকের প্রাইভেট টিউশনে যেতে হত আর এক সহপাঠীর বাড়িতে। একদিনের কথা। সেদিন স্যার আসেননি, ওই ছেলেটি গ্রুপের অন্য বন্ধুদের সাথে ওই বাড়ির ছাদের রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে গল্পরত। হঠাৎ, হ্যাঁ বড়ই আচমকা, সেই ছেলের মুখের রা বন্ধ, চোখ সম্মোহিত। তার দৃষ্টির ওয়েভ লেংথের পরিধিতে এক ফর্সা মিষ্টি মুখের স্কারট ব্লাউজ পরিহিতা কিশোরী অবয়ব। মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে। বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হাফ সেঞ্চুরি পার করে আসা সেদিনের তরুণ আজ বুঝতে পারে, সেদিন মাথা নিচু করে হেঁটে গেলেও, ওই কিশোরী ছাদের রেলিঙে দাঁড়ানো ছেলেগুলির উপস্থিতির ব্যাপারে পুরো মাত্রায় সচেতন ছিল। এই বিশেষ ক্ষমতা ও দৃষ্টি মেয়েদের জন্মগত প্রাপ্তি। যাই হোক, আবার ফিরে যাওয়া যাক পুরনো দিনের গল্পে। তরুণটির কথা থামিয়ে এবং হা করে তাকিয়ে থাকান বাড়িওয়ালা বন্ধুটির নজর এড়ায় নি। সে বলল, “কি রে, তুই যে বাক্যিহারা হয়ে গেলি, ও আমাদের ঠিক পাশের একতলার বাড়িটাতে থাকে, ওর দাদা আমার বন্ধু। তুই চাইলে দাদা, বোন দুজনের সাথেই আলাপ করিয়ে দিতে পারি”। তরুণটি কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। আসলে তার তখন কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না। তার হৃদয়ের সকল তন্ত্রীতে তখন এক অননুভূত ভাল লাগা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। বন্ধুর প্রস্তাব শুনে বুকের মধ্যে দ্রিমি দ্রিমি মাদল বেজে উঠল। সে সময় মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের যুগ ছিল না। তখন প্রেমিকার বন্ধু বা প্রেমিকের বন্ধু মিডিয়াম হত প্রেমের। ডাইরেক্ট “আমি তোমাকে ভালবাসি”, বা “ আমার তোমাকে ভাল লাগে, দেখা করতে চাই” মেসেজ পাঠানোর প্রথা প্রচলিত ছিলনা। কিছুদিন পর সেই বন্ধু কাঁচুমাচু মুখ করে এসে বলল, “বলেছিলাম তোর কথা, তোকেই সরাসরি কথা বলতে বলেছে”। শুনেই সেই তরুণের আত্মারাম খাঁচাছাড়া অবস্থা। ঘুম নিদ্রা গেল, কি ভাবে শুরু করবে, কি কথা বলবে, মেয়েটাই বা কি উত্তর দেবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। তখন আর একবন্ধু পরামর্শ দিল প্রেম পত্র দেবার। আর এক অধ্যায় শুরু হল। সম্বোধন থেকে মাঝের টেক্সট হয়ে এন্ড পর্যন্ত কি লেখা যায়। বহু কাগজ কালির শ্রাদ্ধ শান্তি
শেষে এবং অনেক গবেষণার পর প্রথম চিঠি পৌঁছে গেল স্বস্থানে। এভাবেই শুরু হল চিঠি চালাচালি। প্রেম দানা বাঁধল। স্কুল ইউনিফর্ম পরা অবস্থাতেও রেস্তোরাঁতে, লেকের বেঞ্চে বসার মত সাহস অবশ্য দেখিয়েছিল সেই মেয়ে। সময়ের চাকা গড়িয়ে যায়। ইতিমধ্যে সেই তরুন গ্র্যাজুয়েট হল, চাকুরি খোঁজা শুরু করল। কিশোরী ঢুকল কলেজে। এলাকাতে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। ছায়াছবিতে যেমন হয়, প্রেমের আকাশে ভিলেইনের অনুপ্রবেশ ঘটল। না, না অন্য কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। মেয়ের দাদা, ঠাকুরমা প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়াল। গোঁড়া ব্রাহ্মন পরিবারের মেয়ের বেকার কায়স্থ ছেলের সাথে প্রেম? কভি নেহি। ইয়ে নেহি হো সেকতা। শুধু টিউশন করা সেই তরুনের পক্ষেও ওই ঝড় সামাল দেওয়া সম্ভব হলনা। তাছাড়া ইতিমধ্যে তার নিজের পরিবারেও নানা সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছে। বাবা রিটায়ার করে এখানে চলে এলো। দুই ভাই পড়ছে। মেয়েটির ওপর নজরদারি বেড়ে গেল। দাদা অথবা মেয়েটির বাবা নিষ্ঠা ভরে প্রহরীর দায়িত্ব গ্রহণ করল। এই ধরনের প্রহরীর সাথে আর যাই হোক ঢিসুম ঢিসুম হয় না। মেয়েটির দাদার সাথে তরুণটির বন্ধুর এই ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া হয়ে যাওয়াতে সে আর চিঠি পৌঁছে দেবার গুরুভার দায়িত্ব অথবা দেখা করার কথাটুকুও জানাতে অক্ষম হল। গ্রাজুয়েশনের বছর তিনেক পরে, ভাল কোম্পানিতে চাকুরী পাবার পরে সেই তরুন একটা মরীয়া চেষ্টা করেছিল কিন্তু তখন দ্য গেম ওয়াজ ওভার। ইট ওয়াজ টু লেট। সময়ের কারুকার্যে দুজন দুপথে এগিয়ে গেল। এক ব্রাহ্মণ তনয়ের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেল। এখন দুজনেই বিবাহিত, ঘোর সংসারী। অনেক বছরের অদেখা, কথা না বলার ফলে “হাই”, “হ্যালো”টুকুও অবশিষ্ট রইল না। কখনো, ক্বচিৎ কদাচিত দুজন মুখোমুখি হলেও সেদিনের তরুণ তার সুখের মেদ জমে পৃথুলা হয়ে যাওয়া প্রাক্তন প্রেমিকার মধ্যে সেই প্রথম দেখা কিশোরীকে খুজে পায় না। পাবে কি করে? তার মনের ক্যামেরার সাদা কালো রিলে মুখ নিচু করে হেঁটে যাওয়া সেই স্কারট–ব্লাউজ পরা কিশোরীর অবয়ব গাঁথা। তার প্রথম প্রেম। আজ পরিণত বয়েসে এসে সেদিনের সেই তরুণের মনে হয় ভাগ্যিস প্রথম প্রেম বিবাহিত জীবনের জাতাকলে বাঁধা পড়ে নি, তাই তো মনের মুকুরে আজও সেই প্রেমের বয়েস বাড়ে নি। চির বসন্তের পলাশ শিমুলের মতো কাব্যিক সুষমায় অমলিন, সুন্দর ও পবিত্র।