গোধূলির রঙ ফিকে হয় না
গোধূলির রঙ ফিকে হয় না
অন্য দিনের মতো আজও সূর্যটা বিদায় নেবার আগে রোজকার অভ্যেসে সুজাতার ৮ ফিট বাই ৬ ফিটের ব্যাল্কনিতে উঁকি দিল। সুজাতা যখন ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য স্বামী অনিন্দ্যর সাথে মুম্বাইতে ছিল, তখন প্রতিদিন গোধূলির সূর্যটা তার কর্তব্য করে গেছে আর হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। বিচ্ছেদের কষ্ট কি সুজাতাও পায় নি?একমাত্র মেয়ে রুমঝুমকে ছেড়ে এর আগে একরাত্রিও কি কোন দিন থেকেছে?
আহ!অবশেষে নিজের বাড়ী। তার মিষ্টি বাড়ী। তার সংসার। সুজাতা শ্বাস টানল স্বস্তিতে। আজই ফিরল ওরা। জোর করে হাবি অনিন্দ্যকে পাঠিয়েছে দমদমে বাপের বাড়ী থেকে মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য। সুজাতাকে একা ছেড়ে যেতে চাইছিল না অনিন্দ্য।
পায়ে পায়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল সুজাতা। মাথায় সেই একঢাল চুল আর নেই। কেমোথেরাপির ফল। নাইটির হুক খুলতেই মুখে আষাঢ় নেমে এল। বাঁদিকের সেই সুডৌল স্তন অদৃশ্য। কি বিসদৃশ! তাড়াতাড়ি ক্ষিপ্র হাতে হুক আটকে নিল।
“উমমমম, কোনটা আগে করি? চুলের নদীতে অবগাহন করব নাকি এই সুডৌল ধবলে ডুব দেব”- আদর করতে করতে অনিন্দ্য বলত। আবেশে লাল হয়ে যেতে যেতে সুজাতা বলত, “তোমার যা ইচ্ছে, সবই তো তোমার”।
কেন রুমঝুম? ক্লাস থ্রি তে পড়া মেয়ের মায়ের মিম মিম না ধরলে ঘুমই আসবে না। মায়ের দুধকে ও মিম মিম বলে।
চোখ ফেটে জল আসছে। নাহ!আজ কান্না নয়। আজ শুধু আনন্দ। অনেক কষ্টে চোখের জল আটকাল সুজাতা।
ডুবুডুবু সূর্যটা ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছে, তার শিফট ডিউটি যে শেষ হতে যায়।
হঠাৎ সুজাতার চমক ভাঙ্গল। আরে ওর “বাচ্চা”দের কী খবর? ওর শখের ফুল গুলো, ওর আদরের ‘বাচ্চারা’। আহারে!জল না পেয়ে বোধহয় মরেই গেছে সব। ত্র্যস্ত পায়ে দরজা খুলে ব্যাল্কনিতে আসতে সুজাতার মুখ খুশীতে ভরে ওঠে। সবাই আছে। ইস! কী চেহারা হয়েছে সব কটার। বেটা ছেলেরা অনেক দিন দাঁড়ি না কামালে যেমন হয়, ঠিক তেমনি। পরম মায়ায় হাত বুলিয়ে একের পর এক টবে রাখা ফুলের গাছগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। বলতে চাইল, “আমি এসে গেছি রে। আর তোদের কষ্ট হবেনা”। ওদেরও যেন আজ খুশীর বাঁধ ভেঙ্গেছে।
সুজাতা খেয়াল করল না, পশ্চিম আকাশে গোধূলির সূর্যটা ডুবে যাবার আগে শেষবারের মতো একরাশ খুশীর লালিমা ছড়িয়ে দিয়ে গেল। আসলে রাত আসে দিনের আলো আসার বার্তা নিয়ে। সুখের মতো দুঃখও অস্থায়ী। চক্রাকারে আবর্তিত হয় দিন রাতের মতো। দরকার জীবনী শক্তি, মনের জোর আর ভালবাসার মানুষদের সমর্থন। কলিং বেলের আওয়াজ হল যেন। হ্যা, আবার। কেউ অস্থির হাতে বাজাচ্ছে। নিশ্চয় রুমঝুম, তার ছোট্ট সোনা! তার প্রাণ ভোমরা।
নিশ্চয় রুমঝুম, তার ছোট্ট সোনা! তার প্রাণ ভোমরা! দ্রুত পায়ে দরজার দিকে যেতে যেতে সুজাতা চেঁচিয়ে বলে, “আসছিইইই। খুলছি সোনা মা”।