Partha Roy

Inspirational

3  

Partha Roy

Inspirational

যে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই

যে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই

7 mins
965


দুপুরে ঘুমনোর অভ্যাস নেই রুমঝুমের। ওর ধারণা দুপুরে ঘুমলে শরীরে পুট অন করে। জিমে না গেলেও নিয়মিত যোগ ব্যায়াম আর হালকা আসন করে শরীরকে বিশেষ করে তলপেট নির্মেদ রেখেছে। ছোট্ট বেলা কিন্ডার গার্টেন স্কুলে বছর দুই তিনেক বাদ দিলে তারপরে একে একে ডে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার ফলে দুপুরে ঘুমনোর অভ্যাস গড়ে ওঠে নি। ছোট বড় ছুটির দিনগুলোতে কোন না কোন ভাবে নিজেকে এনগেজ রেখে সচেতন ভাবে এড়িয়ে গেছে। টিভিটা অন করেছিল। নিউজ চ্যানেলে তিন বছরের শিশু কন্যাকে ধর্ষণ করে খুন করার খবরে শিউরে উঠেছে। ও ভেবে পায় না একটা শিশুকে কি করে ধর্ষণ করা যায়? ফুলের থেকেও সুন্দর শিশুকে হত্যা করা যায়? যারা এমন করে তারা কি মানুষ? ওর ভেতরে মন খারাপি আর ক্রোধ একসাথে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ভাল আগে না তবুও চারপাশের খবর রাখার জন্য দিনে একবার হলেও নিউজ চ্যানেল খোলে। টিভি খুললেই তো সেই একঘেয়ে সিরিয়াল তা নাহলে এমন ধারার সব বীভৎস খবর- ছাত্ররা অধ্যাপককে মাটিতে ফেলে মারছে, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, খুন খারাপি, ধর্ষণ, কলেজে ছাত্র সংঘর্ষ। সময় পেলে টিভিতে অথবা সেলফোনের ইউ টিউবে ভাল সিনেমা দেখে। বই পড়ার নেশা ছিল কিন্তু ইদানিং ওর ভাল লাগে না। সোফায় বসে গুড্ডু ড্রইং খাতায় হিজিবিজি এঁকে চলেছে। এটা ওর একটা প্রিয় খেলা। ওর কল্পনাকে নানা রঙের পেন্সিলের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলে, তারপরে হাতের কাছে যাকে পাবে তাকে ডেকে দেখাবে এটা বাচ্চা পাখী খেলছে, বাবা পাখী আর মা পাখী গাছে বসে দেখছে, এটা তিন্নিদিদিদের খোঁড়া কুকুরটা, এটা ওর টেডি রাইম পড়ছে। এমন আরও কতো শিশুসুলভ উচ্ছাস। খুশিতে ডগমগ আরণ্যক বলত, “তোমার ছেলে একদিন মকবুল ফিদা হুসেন হবে”। তোমার ছেলে! হাহ! সত্যিই গুড্ডু এখন শুধু ওর ছেলে। একরাশ মন খারাপি আর এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে ব্যাল্কনিতে এসে বসল রুমঝুম। ডিসেম্বর মাস পড়ে গেছে। বেলা ছোট হয়ে গেছে অথচ শরীরে শীতের কামড় কোথায়? চারদিকে একটা ধূসর ভাব। আসলে শীত ওর মনের ঘরে ছেয়ে আছে।

দেখতে দেখতে আরণ্যক ছাড়া সাতটা মাস কেটে গেল। অবশ্য সেটা একসাথে সহাবস্থান ও শারীরিক সংযোগের ক্ষেত্রে। কিন্তু মনের অন্দরমহলে? সেখানে প্রতি নিয়ত আরণ্যকের অশরীরী উপস্থিতি। কাছেই একটা মন্টেসারি স্কুলে শিক্ষিকার কাজ পেয়ে যাওয়াতে রুমঝুমের কিছুটা সময় কাটে। মর্নিং স্কুলটা ক্লাস ফোর পর্যন্ত। চার প্লাসের গুড্ডুকে চোখের সামনে রাখার ভাবনা থেকে আপাতত নিজের স্কুলেই ভর্তি করিয়েছে। বাবার চাপে দুম করে ডিভোর্সের নোটিশটা সই করে দিল। আরণ্যকই বা নোটিশটা পেয়ে সই করল কেন? ও তো রিফিউজ করতে পারত। যদিও নিজের কাছে এই যুক্তি বড় ঠুনকো মনে হল। কারণ নোটিশ পেয়ে আরণ্যক ফোন করেছিল, রুমঝুম ধরে নি। কোথাও ভুল হল না তো? ওর কিছু ভাল লাগছে না। শেষ চুমুক দিয়ে কফির কাপটা পাশে নামিয়ে রেখে আনমনা হয়ে গেল। 

***

রামধনু রঙা সেসব দিন। ও তখন স্বপ্ন দেখা উচ্ছল তরঙ্গ। শান্ত দীঘির চোখ আর মাথায় এলোমেলো অরণ্য চুলের আরণ্যকের প্রেমে দিশেহারা। বিভিন্ন সময়ে ছোট ছোট ঘটনায় রুমঝুম দেখেছে পরের উপকার করার জন্য যেন মুখিয়ে থাকে ওই ছেলে। আজ রক্তদান শিবির তো কাল কোন সহপাঠীর অসুস্থ বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটছে নতুবা বন্যাত্রাণে কোন এনজিওর সাথে দিন কয়েকের জন্য উধাও। এত কিছুর পরেও রেজাল্ট ভীষণ ভাল। ওর কথায় “দিনে কয় ঘণ্টা পড়ছ বড় কথা নয়, কতটা মনোযোগ দিয়ে পড়ছ সেটা হল আসল”। এমনও হয়েছে যে ও তিন চারদিনের জন্য বাইরে গেছে, রুমঝুম জানতে পারেনি। ফিরে এলে একরাশ অভিমান নিয়ে যখন রুমঝুম ওর ওপর আছড়ে পড়েছে, বিব্রত আরণ্যক পড়া না পারা ছাত্রর মত করুণ, অপরাধী মুখে তাকিয়ে থেকেছে।

শেষমেশ হাত খরচের টাকা থেকে এক জন্মদিনের উপহার হিসেবে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিল। তখন অ্যানড্রয়েড ফোন সবে বাজারে এসেছে। ফোনটা হাতে পেয়ে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারপরে নির্ভেজাল শিশুর খুশি নিয়ে কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে ফোনটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে রুমঝুমকে হতচকিত করে কাছে টেনে নিয়ে এক আনাড়ি কিন্তু প্রলম্বিত চুমুতে ভালবাসার জানান দিয়েছে। লজ্জা আর আনন্দ মাখামাখি হয়ে রুমঝুমের ফর্সা গালে তখন লাল আবিরের রঙ।

“জানো রুম, এই প্রথম আমি কাউকে চুমু খেলাম। এই প্রথম কেউ আমাকে ভালবেসে এত সুন্দর উপহার দিল। তুমি কি রাগ করলে?”। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রুমঝুম ওর ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, “চুপ! আমাকে কিছু সময় ভাল লাগায় ডুবে থাকতে দাও। আমারও এটা প্রথম অভিজ্ঞতা, প্রথম অপার্থিব আজন্ম ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বড়লোকের আদুরী মেয়ে শহুরে কৃত্রিমতা বিবর্জিত জিলা স্কুলের সেরা ছাত্রের এইসব গুণাবলী দেখেই মুগ্ধ হয়েছিল। এমএ পাশ করে আরণ্যক ব্যাঙ্কের চাকুরীটা পেতে বাবার জোরাল আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ে।

বিয়ের বছর দেড়েকের মাথায় গুড্ডু আসার পরে সুখের সাগরে জোয়ার এল। মাঝে মাঝে অফিসের পরে এনজিওর কাজ সেরে রাত করে ফিরত। বাইরেও যেত অন্য কোন জেলায়। রুমঝুম মেনে নিয়েছিল। কারণ তখন ও অনেক বেশি দায়িত্বশীল। বাইরে গেলে বলে যেত। অফিস থেকে ফিরতে দেরী হলে ফোন করে জানিয়ে দিত। বেশ কাটছিল দিনগুলো। তারপরে? কমার্শিয়াল ফিল্মের কাহিনীর মতো এক সুনামি ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড। কি ধরণের সেবা মূলক কাজ, কি তার পরিসর তখন সুখসাগরে ভাসা রুমঝুমের এত বৃতান্ত জানার দায় বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না। এক দুপুরে স্কুলের বন্ধু দীপশিখার ফোন। অনেক ভূমিকা, ভনিতার পরে জানাল ওর বর নাকি আরণ্যককে চেতলা ব্রিজের কাছে এক পতিতালয় থেকে বের হতে দেখেছে।

কেউ যেন আচমকা পেছন থেকে মাথায় আঘাত করল। কিছু সময় ওর মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে থাকল। ওপ্রান্ত থেকে দীপশিখা অধৈর্য হয়ে ক্রমাগত হ্যালো, হ্যালো করে যাচ্ছে। ধাতস্থ হয়ে বলল, “ও একটা এনজিওর সাথে যুক্ত।“

"দ্যাখ তুই আমার অনেকদিনের বন্ধু। বিশ্বাস ভাল, চোখ থাকতে অন্ধ হওয়া কি ঠিক? একটু চোখ কান খোলা রাখিস”

“আহ! তুই অকারণে অনেক ভাবছিস। অরুকে আমি চিনি”

“সে ঠিক আছে। বাট মনে রাখিস স্ত্রী হিসাবে তোর জিজ্ঞাসা করার অধিকার আছে। পুরুষ মানুষ...”।

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল দীপশিখা রুমঝুমের বিরক্ত লাগছিল, বাধা দিয়ে বলল, “হ্যা, আমি জেনে নেব। কথা বলব ওর সাথে। এখন রাখছি। গুড্ডুর হোমটাস্ক করাতে হবে রে”।

বন্ধুকে বলল বটে কিন্তু নিঃশব্দে মনের ঘরে কি সন্দেহের কেউটে সাপ ঢুকে পড়ল? প্রশ্নবাণে জর্জরিত আহত, অপমানিত আরণ্যক বলেছিল, “অকারণে সন্দেহ করে নিজেকে ছোট কোর না রুম। এতো অল্পে অবিশ্বাস ঠিক নয়। আমি কোন অন্যায় করছি না। ওদের ছেলে মেয়েদের জন্য একটা স্কুল করা যায় কিনা সেসব ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা চলছে। সেই ব্যাপারেই গিয়েছিলাম”। ক্রমশ অবিশ্বাসের চোরাবালিতে ডুবতে থাকা রুমঝুমের কাছে এই উত্তর বড় ঠুনকো মনে হল। মুখ ভার করে বলল, “তোমাকেই যেতে হবে ওসব জায়গায়? বিয়ের আগে যা করেছ। দয়া করে এবার একটু আমাদের কথা ভাব। লজ্জায় মাথা কাটা যায় আমার”। আরণ্যকের ফিরতে রাত হলে অশান্তি, কথা বন্ধ। আরণ্যক কাছে টানতে উদ্যোগী হয়ে বরফ শীতল অবহেলায় প্রত্যাখাত হয়েছে। আসলে ততদিনে সন্দেহের চারাগাছটা ডালপালা মেলে শেকড় প্রথিত করে ফেলেছে। সেই গাছ সম্পর্কের ভিতকে ফাটিয়ে দিল যখন ওর মা ফোনে ধরা গলায় জানাল রুমঝুমের বাবার এক কর্মচারী ওকে বউবাজারের কাছে এক পতিতালয়ে দেখেছে। মালিককে দেখাবে বলে সে তার সেলফোনে ছবিও তুলে এনেছে। বাবা সব দেখে, শুনে আগুন হয়ে আছে। অজান্তেই হয়ত ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে ছিল, মায়ের কথাগুলো অণুঘটকের কাজ করল। আরণ্যক তখন অফিসে, গুড্ডুকে নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি। আরণ্যক এসেছিল বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যেতে। অনড় থেকেছে রুমঝুম।

আরণ্যককে অপমান করে পুরনো ঝাল মিটিয়েছেন রুমঝুমের বাবা। ওঁর মাথায় অন্য চিন্তা কাজ করছে। ডিভোর্সটা পেয়ে গেলেই এবার নিজের পছন্দ করা পাত্রের সাথে মেয়ের আবার বিয়ে দেবেন। তলেতলে সেই প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। এত কিছুর পরেও আরণ্যক বার কয়েক এসেছিল। ছেলের সাথে গল্প করে, অনেক আদর করে ফিরে গেছে। রুমঝুম সামনে যায় নি। কাজের লোককে দিয়ে চা জলখাবার পাঠিয়েছিল। যে আরণ্যক চাখোর, সে খাবার তো দুরের কথা কোনদিন এক কাপ চাও ছুঁয়েও দেখেনি। আসলে অনুনয় বিনয় করে প্রত্যাখাত হবার পরে ওর মধ্যে অভিমান আর ক্রোধ জমতে জমতে এক ধরণের আহত বিতৃষ্ণা জমাট বেঁধেছে। ছেলের টানে বেশ কিছুদিন অপমান সহ্য করেও আসত। তারপর আসা কমে যেতে যেতে এখন বন্ধ হয়ে গেছে। শ্বশুরমশাইয়ের থেকেও নিজের স্ত্রীর আচরণ ওকে অনেক বেশি পীড়া দিয়েছে। ছোট্ট গুড্ডুর বাবার জন্য মন কেমন করে। সারাদিন এক রকম, রাত্রে বিছানায় শুয়ে ওর মাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। “বাবাই কোথায় গেছে?”, “বাবাই কেন আসছে না?”, “আমার আঁকাগুলো দেখাতে পারছি না”, “হলিডে তে ক্রিকেট খেলবে বলে গেল, আসছে না কেন?”, এমন আরও হাজার রকম প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয় রুমঝুম। সত্যি মিথ্যে মিলিয়ে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কোন রকমে ঘুম পাড়ায় ছোট্ট শিশুটাকে।

***

উত্তেজিত গুড্ডুর উল্লসিত চিৎকারে অতীতের রোমন্থন করা রুমঝুমের সম্বিৎ ফিরল। “মাম মাম, মাম মাম। বাবাই টিভিতে, দ্যাখো। আমার বাবাই”। ছুটে ঘরে গেল রুমঝুম। এক পতিতালয়ের সামনে সাংবাদিক বলে চলেছে, “এনজিও ‘ভালবাসা’র উদ্যোগে দেহোপজীবিনীদের সন্তানদের জন্য স্কুল এবং হোস্টেল স্থাপিত হতে চলেছে। সরকার জমি, অর্থ দিয়ে এই আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করবে। অর্থ দপ্তর থেকে টাকা স্যাংশন হয়েছে। এনজিওর কর্ণধার আরণ্যক সান্যালের নিরলস চেষ্টায় ওদের বহুদিনের স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে। এখানে আজ তাই উৎসবের আনন্দ”।

রুমঝুমের বুকের ভেতরে একটা ঢেউ সবেগে মাথা তুলছে। আরণ্যককে ঘিরে দাঁড়িয়ে কিছু মহিলা সমস্বরে বলে চলেছে, “এই দাদাভাই আমাদের ভগবান। আমাদের অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আমরা চাই আমাদের এই নরকের জীবন থেকে আমাদের ছেলে মেয়েরা মুক্তি পাক। ওরা সুস্থ জীবন যাপন করুক”। আর একজন স্বেচ্ছায় সঞ্চালকের মাউথ পিসের সামনে এসে বলল, “ভগবান আছে কি নেই জানি না। এই দাদা হল আমাদের ভগবান। কত সম্মান করে আমাদের সাথে কথা বলেন। এই দাদার দেখা না পেলে কোনদিন জানতে পারতাম না যে আমরাও মানুষ”। মাথা উঁচু করে নিষ্পাপ অথচ ভাবলেশহীন মুখে আরণ্যক দাঁড়িয়ে। গুড্ডু মায়ের হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে আর বলছে, “মাম মাম বাবাইর কাছে কবে যাব? বাবাই কবে আসবে? বল না। কিছু বলছ না কেন?”। সব কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। অনেক ভাবনা একসাথে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তারই মধ্যে বিদ্যুৎ তরঙ্গের ঝলকানির মত একটা প্রশ্ন ওর মস্তিষ্কের অনু পরমাণুতে আঘাত করল। ওরই করা ডিভোর্সের মামলা কি ও তুলে নিতে পারে না? ভুল সংশোধন করার এক প্রবল তাগিদে উন্মাদিনীর মতো সেলফোন তুলে ওদের অ্যাডভোকেট আঙ্কলের নাম্বার ডায়াল করতে লাগল রুমঝুম।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational