মাধব দারোগা আর সুরঙ্গনা
মাধব দারোগা আর সুরঙ্গনা
শ্রাবণ মাসের আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি কিছুটা থেমেছে কিন্তু আবহাওয়ায় একটা গুমোট মেঘলা ভাব। যেন নুতন করে আবার বানভাসির প্রস্তুতি। স্নান, প্রাতরাশ সেরে থানায় এসে বসতে না বসতেই ওয়্যারলেসের মেসেজটা পেলো মাধব দারোগা। ডিএসপি সাহেবের তলব। উনার অফিসে দুটোর সময় দেখা করতে হবে। মাধব নিশ্চিত উনি ছুটি নিয়ে ঝামেলা করবেন। টেলিগ্রাম এসেছে বউ সুরঙ্গনার খুব অসুখ, কঠিন অসুখ। দেরী করে নি মাধব, সাথে সাথেই ছুটির দরখাস্ত করে দিয়েছে। আগেও যখনই ছুটির দরখাস্ত করেছে মাধব, তখনই এই ডিএসপি সাহেব হয় ছুটি ছাড়তে চান নি, নাহলে ছুটির দিন কমিয়ে দিয়েছেন। আসলে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের ছেড়ে যাওয়া ছেঁড়া জুতায় এই ডিএসপির মতো কিছু লোক পা গলিয়ে বসে আছেন।একজন ভারতীয় পুলিশ অফিসারের তার নিম্নপদস্থ অফিসারদের সাথে এমন বিমাতৃ সুলভ আচরণের পেছনে কোন যুক্তি খুঁজে পায় না মাধব। ইংরেজরা পুলিশ রুলবুকে ডিসিপ্লিনের কথা বলেছে কিন্তু কোথাও অমানবিক হবার কথা বলেছে? তাছাড়া স্বাধীন ভারতবর্ষে দরকার হলে সেই রেগুলেশন পালটাতে হবে সব দি উনার সেই এক কথা, “পরিবারকে এখানে নিয়ে আসুন, একসাথে রাখুন”। বদলীর দরখাস্ত করেছে মাধব, সেটাও বড় সাহেব মানে এস. পি সাহেবের টেবিলে পৌঁছয় নি, ডিএসপি সাহেব সুপারিশ করেন নি। ভাবনাটা মাথায় আসতেই মাধবের মেজাজটা আরও বিগড়ে গেলো। এমনিতেই সুরঙ্গনার অসুখের খবরটা পেয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। ঘুসঘুসে জ্বর কমছে না কিছুতেই। সেই সাথে একটা ব্লিডিং। তাছাড়া একাকীত্বর যন সামরিক, আধা সামরিক দপ্তরের মতই পুলিশের দপ্তরেও টপকে কোন কিছু করা যায় না। এস পি সাহেব যথেষ্ট স্নেহ করেন মাধবকে, তবুও মাধব কোন দিন নিজের ব্যাক্তিগত সমস্যার কথা উনাকে বলেনি। ছুটি ছাটা, বদলী এইসব নিয়ে বললেই উনি সহানুভূতির সাথে মাধবের সব ইচ্ছে পূরণ করবেন, সেই আস্থা মাধবের আছে। চাকুরীটাই করে মাধব মন দিয়ে, তার পাশাপাশি ব্যাক্তিগত সুযোগ সুবিধার কথা কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারেনি কোনদিনই সুরঙ্গনাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার কথা এক আধবার মাধব যে ভাবেনি তা নয় কিন্তু কলকাতার পৈত্রিক বাড়ীতে বৃদ্ধা মা আর অবিবাহিতা বোন রয়েছে, তাছাড়া থানার চাকুরীতে রাত বিরেতে রেইড করতে যাওয়া, চোর ডাকাত খুনির পিছনে ধাওয়া করা-এইসব থেকে নরম মনের সুরঙ্গনাকে দূরে রাখতেই চেয়েছে মাধব। অফিসারদের সরকারী আবাসগুলো থানা প্রাঙ্গণেই। তাই ঘটনার আঁচ খুব ভাল করেই পরিবারের উপরে পড়ে। বার দুয়েক নিয়ে এসেছিল এখানে, দিন কয়েক থেকে আবার ফিরে গেছে। যাবার সময় সুরঙ্গনার ওই নদীর মতো দুচোখে বানভাসির লক্ষণ দেখে ডাকসাইটে মাধবের বুকের মধ্যেও একটা কিছু টনটন করে উঠত। সুরঙ্গনা ফিরে যাবার সময় বড্ড ফাঁকা ফাঁক সেবার যেমন সোর্স মারফৎ খবর এলো কুখ্যাত খুনে ডাকাত আবদুল তার দলবল নিয়ে ডাকাতি করবে বলে জড়ো হয়েছে পুরনো কেল্লার দিকে একটা পরিত্যক্ত কারখানায়। মাধব বরাবরই অকুতোভয়। দেরি না করে হানা দিয়েছিল। আবদুলকে ধরতে যেতেই, ক্ষিপ্র নেকড়ের মতো ছুরীটা চালিয়েছিল মাধবের বুক লক্ষ্য করে। সতর্ক ছিল মাধব, সরে গিয়ে হাত দিয়ে আটকে দিল ঠিকই কিন্তু সেই হাতটা ছুরিকাঘাতে জখম হল। রিভলবার বের করতে পারত শক্তিশালী মাধব, করল না। নিজের ক্ষতের আঘাত ভুলে গিয়ে জাপটে ধরল আবদুলকে, এক লাথি মেরে ছিটকে ফেলে দিল আবদুলের ছুরি, তারপরে ঘাড়ের কাছে এক জোরালো রদ্দা মেরে গলা চেপে ধরল নিজের বগলের নীচে। হিঁচড়ে টানতে টানতে দুই মাইল হাঁটিয়ে নিয়ে এসে থানার লকআপে পুরে দিয়েছিল। সবাইকে ধরতে না পারলেও, দলের বড় অংশটাই ধরা পড়েছিল। হাত দিয়ে তখন গলগল করে রক্ত ঝরছে। সুরঙ্গনা যদি সেই সময় থাকত, হয়তো অসুস্থ হয়ে যেত এইসব দেখে। জেলায় পুলিশ মহলে যেমন মাধবের সুনাম, অপরাধী মহলও তেমনি মাধব দারোগার নামে কাঁপে। সুনাম হবে নাই বা কেন, মাধব যে বড্ড মন দিয়ে, ভালবেসে পুলিশের চাকুরীটা করে। ভালবাসে প সন্তান নেই তাদের। দুবার গর্ভবতী হয়েছিল সুরঙ্গনা কিন্তু প্রতিবারই বাচ্চা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নরম তরম বউকে বড্ড ভালবাসে মাধব দারোগা। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে স্বামীর বুকের মধ্যে আরও সেঁধিয়ে এসে সুরঙ্গনা বলেছিল, “আমি তো তোমাকে একটা সন্তান দিতে পারি নি। তারপরে কালো, অতো লেখাপড়াও শিখি নি। আমাকে বিয়ে করলে যে বড়ো? এই কুচ্ছিত মেয়ের কি গতি হবে ভেবে মায়া হয়েছ নিজের শরীরের মধ্যে জাপটে ধরে বউ এর নরম রাঙ্গা ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটের মধ্যে নিয়ে এক প্রস্থ আদরের পরে চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “কি করব? এই ঢলঢলে ভরা নদীর মতো চোখ দুটো দেখে ভেসে গিয়েছিলাম যে। তারপর এই পান পাতার মতো মিষ্টি মুখটা দেখে দারোগা বাবু নিজেই আসামী হয়ে গ্রেফতার হয়ে গেছিল”। অনেকবারই শুনেছে মাধবের মুখে এই কথাগুলো কিন্তু যতবারই শোনে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে যায়, বুকের মধ্যে আরও আদুরী হয়ে ওঠে। ভাল লাগে সুরঙ্গনার, তাই বারে বারে উস্কে দিয়ে শুন সুরঙ্গনাও তার পতি দেবতাটিকে হাতের তালুর মতো চিনেছে, তাই ভালোওবাসে খুব।পরিবার ছাড়া থাকতে থাকতে পুলিশের অনেক দারোগারই বাঁধা মেয়েমানুষ আছে, কিন্তু মাধব দারোগার নামে এই অভিযোগ তার চরম শত্তুরও দিতে পারবে না। মাধব দারোগার একটাই দুর্বলতা- তার চাকুরী আর পুলিশের ইউনিফর্ম। আঘাত লাগা হাতের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের দাগের উপরে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সুরঙ্গনা স্বামীর বুকের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে অনুযোগ করেছিল, “যা আছে কষ্টে সৃষ্টে চলে যাবে আমাদের। তানাহলে তোমার তো অনেক পাশ দেওয়া আছে, একটা ইস্কুলে মাস্টারের চাকুরী ঠিক যোগাড় হয়ে যাবে। আমার এই সতীন কে কি ছাড়া যপ্রথমে বুঝতে পারেনি মাধব। হকচকিয়ে গেছিল। “সতীন? সে আবার কে?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেছিল সন্দিগ্ধ মাধব।
“কে আবার? তোমার চাকুরী। আগে জানলে কি সতীনসহ এই বাজে লোকটাকে বিয়ে করতাম? সারাক্ষণ আমি চিন্তায় থাকি” হা হা করে প্রবল অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল মাধব, বউকে আরও জাপটে ধরে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে আদরে আশ্লেষে ভাসিয়ে দিয়েছ সকাল থেকে তিলে তিলে জমা করা বজ্র নির্ঘোষে প্রকৃতির যেন এক খুনি রূপ এখন, রুদ্রমূর্তি ধারন করেছে বললেও কম বলা হয়। যেমন ঝড়, তেমনি মুষলধারে বৃষ্টি, সাথে কড়াত কড়াত করে বাজ পড়ার আওয়াজ। স্বাভাবিক ভাবেই রাস্তা ঘাট জনমানবশুন্য। ফাঁকা ষ্টীমার ঘাটের ছাউনিতে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে ছটফট করছিল মাধব। কোন নৌকা নেই, মাঝিরা কে কোথায় পালিয়েছে-ভগবান জানে। যে দাপুটে লোকটার বাজখাই ধমকে অনেক ঘাঘু অপরাধীরও বুক কেঁপে ওঠে, যে লোকটা খালি হাতে ধারালো ছুরীর আঘাত খেয়েও ডাকাতকে বগলের নীচে চেপে দু মাইল হাঁটিয়ে থানায় নিয়ে আসে, সেই পরাক্রমি লোকটাই আজ প্রকৃতির কাছে কি অসহায়। প্রিয়তমা স্ত্রী সুরঙ্গনার জন্য মনটা আজ বড় উচাটন মাধব দারোগার। ছুটি মঞ্জুর না করার কারণে সাহেবের সাথে ঝগড়া করে দারোগার ইউনিফর্ম জমা দিয়ে চলে এসেছে কিন্তু এই উপরওয়ালার কি মহিমা আজ। কখন যে খেয়া পারাবার চালু হবে ঈশ্বরই একমাত্র জানেন। এই উচাটন মনোভাবের মধ্যেই ডিএসপি সাহেবের ঝুলে পড়া মুখটার কথা ভেবে মাধবের মুখে এক চিলতে আত্মতৃপ্তির সাহেবের ঘরে ঢুকে প্রথামাফিক স্যালুট করে দাঁড়াতেই, একটু রুক্ষ ভাবেই বললেন, “ দশ দিনের ছুটি চেয়েছেন, একসাথে এতো দিন ছুটি ছাড়া যাযনিজেকে সংযত রাখল মাধব। পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতায় শিখেছে সময়ে সময়ে প্রতিকূল পরিস্থিতে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয- স্যার, গত দুই মাস হল আমি বাড়ী যাইনি, বেতন দিয়ে আসতে পারিনি। তাছাড়া স্ত্রীর খুব অসুখ- ওরকম সবাই বলে, স্ত্রীর অসুখ, বাপের অসুখ। মরা মাকে বাঁচিয়ে বলে, মায়ের অসুখ। ওসব আমার জানা আছে।চোয়াল শক্ত হোল মাধবের। ধীর কণ্ঠে বলল, “স্যার, কে কি বলে আমি জানি না, আমি বলি না”।- রাখুন ওইসব কথা। ৫ দিনের বেশী ছুটি ছাড়া যাবে না।
- আমার যেতে আসতেই দুই দিন চলে যাবে, বাকী তিনদিনে আমার হবে না স্যার।
- না হলে কিছু করার নেই।
ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গল মাধবের। কোনদিন যা করে নি, আজ তাই করল। ডিএসপির চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ইন দ্যাট কেস আমি চাকুরীটা ছেড়েই দিলাম, ধরে নিন এবং এর জন্যে আপনিই দায়ী থাকবেন। আমার বদলীর দরখাস্তটাও আপনি ফরোয়ার্ড করেন নি। যদি আমার স্ত্রীর কিছু হয়, আমি কিন্তু আপনাকে ছাড়ব না। আপনার মতো অফিস ঘরে বসে পুলিশের চাকুরী আমি করিন অধস্থন অফিসারের এহেন আচরণে অনভ্যস্ত ডিএসপি চিৎকার করে উঠলেন।
- হোয়াট! হাউ ডেয়ার ইউ! ইউ আর থ্রেটেনিং মি। আমি তোমার এগেন্সেটে রিপোর্ট করব, সুপিরিয়র অফিসারের সাথে ইনডিসিপ্লিন্ড আচরণ করার জন্য- রিপোর্ট তো আমিও করব আপনার বিরুদ্ধে এস পি সাহেবের কাছে। আমরা প্রাণ হাতে নিয়ে ডিউটি করব, আর আপনার মতো কিছু তাঁবেদার ব্রিটিশদের মতো আচরণ করবেন- সেটাও তো স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। ব্রিটিশরা চলে গেছে , ওদের মত আচরণ করলে চলবে না। ইউনিফর্ম জমা দিয়ে যাব। যা খুশী করতে পারেন আপনি। চললআবার প্রথামাফিক স্যালুট করে গটগট করে বের হয়ে গেছিল মাধব। এস পি সাহেবের নাম শোনা মাত্র ডিএসপির মুখ ঝুলে গেলো, উনি খুব ভাল করে জানেন এস পি সাহেব, অ্যাডিশনাল এস পি সাহেব থেকে শুরু করে সদর পুলিশ লাইন্সের সব র্যাঙ্কের পুলিশ কর্মচারী এক ডাকে মাধবকে চেনে। সম্ভ্রমও করে এই সৎ, দক্ষ এবং কর্মঠ পুলিশ অফিসারটিকে। তাছাড়া মাধবের মুখ দিয়ে আজ যে কথাগুলো বের হোল, সেটা পুলিশের সব নিচুতলার কর্মচারীদের মুখের, মনের কথা।
কাছেই একটা বিরাট বাজ পড়ার শব্দে চটকা ভাঙ্গল মাধবের। মা কালীকে স্মরণ করল। - “মা, এই যাত্রায় আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবার ব্যাবস্থা করে দে, সুস্থ করে দে তোর মেয়েকে।কালীঘাটে গিয়ে পাঁঠা বলি দেব। মা, রে তোর মেয়ের ইচ্ছেই পূর্ণ করব, এই চাকুরী আর করব না, ফিরেও যাব না আর। শুধু সুরোকে সুস্থ করে দে”।
কোন কিছুই এই পৃথিবীতে স্থায়ী নয়। ঝড়ের তাণ্ডবও থামল, বৃষ্টিও সেই তেজ হারিয়েছে। ঝিরঝির করে পড়ছে। পরের দিন ভোরের আলো ফুটতেই বেশী পয়সা দিয়ে নৌকা নিয়ে পাগলের মতো ছুটেছিল মাধব কিন্তু ভাগ্য দেবতা যে কি লিখে রাখে কার কপালে, কেউ জানে না। বড় দেরী হয়ে গেছিল পৌঁছুতে। আদরের স্ত্রীর নিশ্চল দেহের পাশে একটা ভেঙ্গে পড়া বট গাছের মতো বসে পড়ল ডাকসাইটে মাধব দারোগা। যেন ঘুমিয়ে আছে ঢলঢলে মুখটা নিয়ে। যেন এক্ষুনি মাধবের আসার খবর পেয়ে লাফ মেরে উঠে ব্যাস্ত হয়ে পড়বে সরবতের গ্লাস আর গামছা এগিয়ে দেবার জন্য, তারপরে লজ্জাবনত খুশি খুশি মুখে অপেক্ষা করবে একান্ - “একটু তর সইল না, সুরো। আমি যে তোমার সতীনকে ছেড়ে চলে এসেছি তোমার কাছে, এতো তাড়া ছি আমাকে ছেড়ে যাবার?” দুর্যোগ থেমে প্রকৃতির এখন শান্ত সমাহিত রূপ, শুধু মাধব দারোগার বুকের ভেতরে কূল ভাঙ্গা জলোচ্ছ্বাস। হাউ হাউ করে কাঁদতে চাইছে অন্তর কিন্তু ডাকসাইটে দারোগা মাধব মিত্তিরের চোখের জল কি সবাইকে দেখানো যায়? ওটা তার একান্ত নিজস্ব। ওই চোখের জলেও যে তার আদরের সুরোর নাম লেখা আছে।