যে অঙ্ক মেলেনি
যে অঙ্ক মেলেনি
প্রতিবছরই নববর্ষ আসে সময়ের নিয়মে, তবে আমাদের ছোটবেলার নববর্ষের দিনের সাথে বর্তমান নববর্ষ উদযাপনের অনেকটাই তফাৎ আছে। তখনকার নববর্ষ উদযাপন এত বিলাসবহুল ভাবে উদযাপিত হত না। এটা ভালো না মন্দ এই বিচারে আমি যেতে চাইছি না। তবে আমার ব্যক্তিগত মতে তখনকার দিনগুলো এত প্রাচুর্য বা বিলাসিতা না থাকলেও মানুষের সাথে মানুষের আত্মিক যোগাযোগ অনেক বেশী ছিল। আজ আমরা যতই দাবী করিনা কেন যে গোটা পৃথিবীটা একটা গ্লোবাল ভিলেজ আর আমরা সেই গ্লোবাল ভিলেজের সদস্য, অথচ আমরা আমাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে বাক্যালাপ থাকে না, সেখানে সদস্য হওয়া অনেক দূরের কথা। যাইহোক,
আমাদের ছোটবেলায় নববর্ষের দিনে
বাবা বাজার থেকে আধা কেজি খাসির মাংস আনতেন, সেদিন আমাদের ঘরে একটা বড় উৎসবের আমেজ চলে আসত। তখন এটা শুধু আমাদের বাড়ি বলে নয়, পাড়ার সব বাড়িতেই এই চল ছিল। গোটা পাড়াটা
মাংসের গন্ধে ভরে থাকত। এছাড়া নববর্ষের দিন বড়দের প্রণাম করে তাঁদের আশীর্বাদের সাথে উপরি পাওনা ছিল নববর্ষের মিষ্টি। এছাড়া সন্ধ্যে বেলা, বাবার সাথে বাবার হাত ধরে হালখাতার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া।
আবার ফিরে আসি মাংসের কথায় - মা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে মসলা বাটতে বসে যেতেন। আমি কাঁচা মাংসগুলোকে নেড়ে চেড়ে দেখতাম,মুখের কাছে নিয়ে গেলেই মা দিত বকুনি ।বলত "কাঁচা গিলে খাসনে,পেটে ছাগল হবে"।
আমি চোখ ড্যাব ড্যাব করে মা কে বলতাম "ছাগল হলে বেশ হবে মা, রোজ ই তো তাহলে মাংস খেতে পারব চিবিয়ে চিবিয়ে"।
মা আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে হাসি মুখ করে বলত "আমার পাগল ছানা একটা"।
খানিকটা দূরে বসে মা ছেলের খুনসুটি দেখে বাবা ঠোঁটের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসতেন।
একসময় মশলা মিশিয়ে মা ঝোলসুদ্ধ মাংস উনুন থেকে নামাতেন। আমি দৌড়ে গিয়ে হামলে পড়তাম।একটা চামচে এক টুকরো আমায় বাড়িয়ে দিয়ে মা বলতেন -"ধর খোকা, নুন হয়েছে কিনা দেখ তো "। আমি প্রথম টুকরো খেয়ে দুষ্টুমি করে বলতাম -"এক টুকরোয় কি বোঝা যায়? আরেক টুকরো দাও না মা, খেয়ে ঝটপট বলে দিই। মা আরেক টুকরো দিত। আমিও খেতাম। স্বাদ করে খেতাম। আর মায়ের শাড়ীর আঁচলে আয়েশ করে মুখ মুছতাম।
সেদিন বাবা বাজার থেকে আড়াইশো মাংস এনেছিল। এত কম এনেছে কেন জানতে চাইলে বাবা মুখ মলিন করে বলেছিল "আজকের ছাগলটা তোর মত বাচ্চা, তাই মাংস কম দিয়েছে"।
সবে এক দুই গুণতে শিখেছি। মা যখন মশলা বাটায় ব্যস্ত তখন মাংস গুলো ধরতে ধরতে আনমনে গুণে দেখলাম সব মিলিয়ে মোট পনের টুকরো মাংস আছে।
একসময় মা আলু মাখিয়ে ঝোল করে মাংস রাধে। তিন টুকরো আমায় দেয় নুন ঝাল পরখ করার জন্যে। আমি খেতে খেতে হিসেব রাখি আর বারো টুকরো আছে।
রাতে মা প্লেটে করে আরো পাঁচ টুকরো ভাত মাখিয়ে দলা করে আমায় খাওয়ায়। আমি খেতে খেতে হিসেব রাখি আর সাত টুকরো আছে।
এরপরের দিন সকালেও আমার প্লেটে মাংস আসে।দুপুরেও মাংস আসে। খেতে খেতে হঠাৎ হিসেবে গন্ডগোল বেঁধে যায়। হিসেব করে দেখলাম বারো টুকরো মাংসই আমার পেটে।
বাবা খায়নি, মা ও খায়নি।
অনেক বছর পর আমি যখন অংক করতে শিখলাম। হঠাৎ অংক করতে করতে একদিন একটা অংক মিলালাম-
আড়াইশো গ্রাম মাংস যদি পনের টুকরো হয়। তবে আধা কেজি মাংস তিরিশ টুকরো। যদি পাঁচ টুকরো করে ভাগ করা হয় তবে তিনজনে দুই বেলা খেতে পারবে। কিন্তু যেবার বাবা আধা কেজি মাংস আনতেন প্রত্যেক বারই আমার ভাগে পাঁচ টুকরো করে মোট ছয় বেলা মাংস জুটত।
পাঁচ টুকরো করে ছয় বেলা।
অংকটার উত্তর:-
"বাবা-মা কোনদিনই মাংস খাননি"।
আর অংকটার মন্তব্য:-
অথচ বাবা-মায়ের দুইজনেরই খাসির মাংস ভীষণ প্রিয় ছিল।
এরপর বহুদিন কেটে গেছে, আমি এখন আর সেই ছোট বাচ্চাটি নেই। লেখাপড়া শেষ করেছি - ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়ে একটি বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি করি। মাইনেকড়িও ভালোই পাই। এখন আর আমরা আর আগে যেখানে থাকতাম, সেখানে থাকিনা। এখন আমরা দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত আবাসনে থাকি।আজ আমার ১১ তলার ফ্ল্যাটে থাকি তিনজন। আমি, আমার স্ত্রী ও ছেলে। হ্যাঁ, আমার মা - বাবা আমাদের সাথে এখন আর থাকেন না, আমার জীবনে প্রতিষ্ঠা - স্বচ্ছলতা আসার শুরুর মুখেই আমাদের ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেছেন। অবশ্য এটা নিয়ে আমার জীবনের প্রতি একটা তীব্র অভিমান রয়েছে, যেটা আমার একটা একান্ত ব্যক্তিগত দুঃখ । আজকাল প্রতিদিনই প্রায় খাসির মাংস কেনা হয়। আগের মত আধা কেজি না। ২ কেজি, ৩ কেজি। কিন্তু আগের মত সেই উচ্ছ্বাস আর নেই, নেই মায়ের হাতের রান্নার সেই স্বাদ, নেই বাবার মুচকি হাসির মাঝে অফুরন্ত ভালবাসা।
মা বাবা দুজনেই আজ অনেক দূর থেকে আমার না মেলা অঙ্কের হাসিতে হেসে যাচ্ছেন ......।