উত্তরের খোঁজ
উত্তরের খোঁজ


-গুড মর্নিং ম্যাডাম.....
নতুন ক্লাস টিচার রচয়িতা দেবী ক্লাসে ঢুকতেই ক্লাসের সমস্ত ছাত্রীরা একসাথে বলে উঠলো।
-গুড মর্নিং, প্লিজ সিট ডাউন..
মৃদু হেসে রচয়িতা দেবী বলেন।
সবাই বসে পড়ে।
-শোন মেয়েরা, আজ আমি তোমাদের ইতিহাসের মোগল সাম্রাজ্য পড়াবো।
সকলে বই সামনে রেখে পড়ায় মন দাও।
কেউ যদি অন্যমনস্ক হয়েছো তাকে কিন্তু ক্লাস থেকে বের করে দেবো।
সকলে বইয়ে মনোনিবেশ করে।
রচয়িতা দেবী পড়াতে শুরু করেন।
বাবরের সম্পর্কে আলোচনা করেন, হুমায়ূন এর সম্পর্কে বলেন, আকবর নিয়ে আলোচনা করতে করতেই হঠাৎ তিনি খেয়াল করেন ক্লাসের একজন ছাত্রী জানালা ঘেষে বসে একমনে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।
-কি ব্যপার কি জানালার দিকে তাকিয়ে আছো কেনো?
সেই ছাত্রীর কোনরূপ পরিবর্তন হয় না।
-এই মেয়ে আমি তোমাকে বলছি। কি হোল শুনতে পাচ্ছো না। রচয়িতা দেবী রাগান্বিত হয়ে বলেন।
কিন্তু সেই মেয়ের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
ক্লাসের সকলেই সেই মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে,
এবারে রচয়িতা দেবী রেগে গিয়ে সেই মেয়েটির সামনে ব্রেঞ্চে জোড়ে ডাস্টার দিয়ে আঘাত করে।
মেয়েটি চমকে ওঠে আর সম্বিত ফিরে পায়।
-কি ব্যপার কি তোমার? ক্লাসে মন নেই কেনো? কি দেখছিলে তখন থেকে জানালা দিয়ে?
মেয়েটি মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে ।
-কি হোল কি কিছু জিজ্ঞেস করছি তো নাকি।
তখন থেকে আমি ডেকেই যাচ্ছি। তবুও তোমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
-আই অ্যাম সরি, ম্যাম।
-হোয়াট সরি!কি নাম তোমার?
- আমার নাম সুহাসি, মনমরা হয়ে উত্তর দেয়
-আর পদবী টা কে বলবে? সুহাসি.. কি
- সুহাসি চৌধুরী,
না না সুহাসি ভট্টাচার্য, না না সুহাসি সরকার,
মেয়েটির সব গুলিয়ে যায়, কি বলবে ভেবে পায়না।
ক্লাসের সকলে হো হো করে হেসে ওঠে।
-একটা থাপ্পড় মারবো অসভ্য মেয়ে, নিজের পদবী বলতে পারছো না? বাবার নাম কি?
রাগান্বিত হয়ে উচ্চস্বরে বলে ওঠেন রচয়িতা দেবী।
-বাবার নাম, রজতাভ, না না সুর্নিমল, না না স্মরজিৎ
আবারো সকলে সুহাসির দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
-অসভ্য মেয়ে, ইয়ার্কি মারার জায়গা পাওনা।
বাবার নাম বলতে পারছো না।
নিজের নাম বাবার নাম ঠিক করে বলতে পারছো না, ছিঃ ছিঃ ছিঃ এ কেমন ধরণের মেয়ে স্কুলে পড়ছে।
সুহাসি মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ অনর্গল অশ্রুধারা বেয়ে পরে।
-যাও বেড়িয়ে যাও ক্লাস থেকে। এমন জঘন্য মেয়েদের আমি পড়াইনা।
সুহাসি তবুও এক চিলতে নড়ে না।
এবারে রচয়িতা দেবী আরো উচ্চস্বরে বলে ওঠেন,
-আই সেইড গেট আউট, বেড়িয়ে যাও, যে মেয়ের বাবার ঠিক নেই সে কি না এত্ত বড় একটা স্কুলে এসেছে।
সুহাসি এবারে মুখ তুলে সেই শিক্ষাদাত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে, আর নির্বাক ভাবে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যায়।
রচয়িতা দেবী পুনরায় ক্লাসে পড়ানো শুরু করেন।
সুহাসি ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে অনর্গল ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই চলেছে।
হঠাৎ স্কুলের অন্য একজন শিক্ষিকা সুহাসি কে কাঁদতে দেখে কাছে এলেন,
- কি হয়েছে সুহাসি? এভাবে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদছো কেনো?
সুহাসি কোন উত্তর করে না, শুধু মুখ ঢেকে কেঁদেই চলেছে।
- কি হয়েছে সুহাসি বলো।
শিক্ষিকার এই বার বার জিজ্ঞাসা দেখে রচয়িতা দেবী ক্লাস থেকে বেড়িয়ে আসেন,
-এই একটা ইডিয়েট মেয়ের সাথে কথা বলে কেনো সময় নষ্ট করছেন, বিরক্তির সুরে রচয়িতা দেবী বলেন।
- কি বলছেন আপনি? আপনি নতুন তাই জানেন না সুহাসি যথেষ্ট মেধাবী ছাত্রী। এমনকি ও ক্লাসে প্রতিবার ফার্স্ট হয়। অবাক হয়ে সেই শিক্ষিকা বলেন।
-ওহ তাই নাকি, তো যে মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে সেই মেয়ে সামান্য নিজের নাম, বাবার নাম ঠিক করে বলতে পারে না, ক্লাসে অমনোযোগী থাকে কি করে? অদ্ভুত তো। ব্যঙ্গ করে রচয়িতা দেবী বলেন।
-না না আপনি ভুল করছেন।
সুহাসি কি হয়েছে বলো আমায়। বাবার নাম বলোনি কেনো? বলো।
ইতিমধ্যে স্কুলের অন্যান্য শিক্ষিকারাও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন।
- কি হোলো সুহাসি উত্তর দাও
এবারে সুহাসি কান্না থামিয়ে কান্না জড়ানো গলায় বলে ওঠে,
-কি বলবো? কি বলবো আমি ম্যাডাম।
আমার নাম?
আমার নাম সুহাসি
কিন্তু পদবী......?
চৌধুরী.....? ভট্টাচার্য.....? নাকি সরকার....?
আর বাবার নাম...?
কাকে আমার বাবা বলবো বলুন তো?.
উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে সুহাসি।
আবার বলতে শুরু করে,
আমি যখন খুব ছোট তখন থেকেই আমাদের বাড়িতে রজতাভ সেন আসতেন। আমি আঙ্কেল বলেই ডাকতাম। মায়ের কাছে বাবার কথা জানতে চাইলে মা কোন উত্তর দিতেন না কোন না কোন বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যেতেন।
আমার মায়ের নাম শিবানী চৌধুরী, তাই আমার পদবীও ছিলো সুহাসি চৌধুরী।
পরে একটু বড় হয়ে জানতে পারি রজতাভ আঙ্কেলই আসলে আমার জন্মদাতা, কিন্তু তিনি তো আমার বাবা নন। মা আর তিনি লিভ ইন রিলেশনশিপে ছিলেন তিন বছর, আর তারই ফল আমি। মায়ের সাথে তার বিয়ে হয়নি, আর মাও কখনো তার পরিচয়টা আমাকে দেননি।
কয়েক মাস পর থেকে আর রজতাভ আঙ্কেলকে দেখিনি,
আরো একটু বড় হলাম, শুনলাম মা বিয়ে করছে, আমার এ বিষয়ে কোন মতামতের কারো প্রয়োজন ছিলো না।
মা বিয়ে করলেন সুনির্মল ভট্টাচার্য কে, আর মায়ের পদবী হোলো ভট্টাচার্য আর তার সাথে আমারো। আমি সুনির্মল ভট্টাচার্য কেই বাবা ভাবতে বসেছিলাম তিনি আমায় ভালোও বাসতেন, কয়েক বছর যেতে না যেতেই শুনলাম, মায়ের ডিভোর্স হচ্ছে। এতেও আমার কোন মতামত কেউ নেয় নি। হয়ে গেলো ডিভোর্স। পদবী ফিরে এলো আবাত চৌধুরী তে। সুনির্মল ভট্টাচার্য অন্যত্র বিয়ে করেন। দু বছর পর আবার শুনলাম মা বিয়ে করছে, আর সত্যি সত্যি করেই ফেললো, স্মরজিৎ সরকার কে।
তাকে নিজের বাবা বলে মানতে অসুবিধে হচ্ছিলো আবার তারও বোধ হয় একই সমস্যা হচ্ছিলো। পদবী পরিবর্তন হোলো আবার সরকার।
নাম -সুহাসি সরকার
বাবার নাম - স্মরজিৎ সরকার।
বেশ চললো দু বছর। সব ঠিকঠাক চলছিলো কিন্তু হঠাৎ আমাকে নিয়ে আবার দুজনের সমস্যা সৃষ্টি হোলো, নতুন মানুষ টি আমায় মেনে নিতে পারছিলো না।
শেষ মেশ মায়ের কাছে আমার চেয়ে নতুন মানুষটিই প্রাণপ্রিয় হয়ে উঠলো।
আমাকে দেওয়া হোলো নির্বাসন। পাঠিয়ে দেওয়া হোলো বোর্ডিং স্কুল। আর আজ মামার কাছে ফোনে শুনতে পেলাম মা আবার ডিভোর্স দিচ্ছে।
আচ্ছা এবার আপনারাই বলুন, আমার কোনটা পদবী বলা উচিত আর কেই বা আমার বাবা।
ডুকরে কেঁদে ওঠে সুহাসি। আচ্ছা তারা তো, নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে সবসময় ভাবছে, আমাকে নিয়ে তো কেউ ভাবে না, ভাবেনা এতটুকু আমি কি চাই, আমি কিসে খুশি থাকবো। তারা ডিভোর্স দিচ্ছে আদতে কি তাদের ডিভোর্স হচ্ছে? নাকি ডিভোর্স হচ্ছি আমি বা আমার মতো সন্তানরা। তারা তাদের শখ আহ্লাদ সবটাই মিটি থেকে অত্যাচারিত হয়ে চলেছি,এর থেকে তো বোধ হয় শারিরীক নির্যাতন সহ্য করা যায়। দিনের পর দিন এইসব জঘন্য জিনিস আমি সহ্য করতে পারছি না। ম্যাম ঠিকই বলেছেন আমি সত্যিই জঘন্য,অসভ্য কারণ ভদ্র মানসিকতার লোকেদের যে আমার পছন্দ নয়।
এসব ভাবলে যে আমার পড়ায় মন বসে না ম্যাডাম, গান গাইতে মন চায় না।
সুহাসি কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ে।
এই রকম অত্যাচারিত জীবন যে আমার সত্যিই ভালো লাগে না বিশ্বাস করুন।
কিছুক্ষণের জন্য ঘরে এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করে।
এবারে রচয়িতা দেবী এগিয়ে গিয়ে সুহাসি কে জড়িয়ে ধরেন, তিনিও কান্না জড়ানো গলায় বলে ওঠেন,
-আরে পাগলি মেয়ে, কি মিষ্টি নাম তোমার সুহাসি।
আর সুহাসির মুখে কান্না বড্ড বেমানান যে,
রচয়িতা সুহাসির চোখের জল মুছিয়ে দেয়।
-এবার আপনিই বলুন, আমি নিজের পদবী আর পিতৃপরিচয়টা কি দেবো?
রচয়িতা দেবী কোন উত্তর দিতে পারেন না, আর উপস্থিত কেউই এর কোন উত্তর করেন না.....
কারণ শিক্ষিকা হলেও যে সব প্রশ্নের উত্তর শিক্ষিকার কাছে থাকে না।।