Debdutta Banerjee

Thriller

2.4  

Debdutta Banerjee

Thriller

উত্তর আজো পাই নি

উত্তর আজো পাই নি

10 mins
10K


এভাবে হোটেল বুক না করে হুট করে চলে আসাটা যে বোকামি হয়েছে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। জুন মাসে পাহাড়ে পর্যটকের ভিড়, সব জায়গা গিজগিজ করছে। ঠিক এ সময়ে এভাবে হোটেল পাওয়া খুব সমস্যা বুঝতে পারছিলাম। 

আসলে বিয়ের জন্য ঋষভ মাত্র এক সপ্তাহ ছুটি পেয়েছিল। তারপর সব গুছিয়ে আমাদের চলে আসতে হল ওর কাজের জায়গা ওদলাবাড়িতে। চারদিকে সবুজ নীল পাহাড় আর পাহাড়ি নদীর ধারে ভারি সুন্দর জায়গা, তরাইয়ের শুরু এখান থেকে। সবাই শুনে বলেছিল ওটাই না হয় হানিমুন প্লেস হবে, আলাদা করে আবার হানিমুনের কি দরকার। টোনাটুনির সংসারে আর কেউ নেই। 

ঋষভের বাবা পাহাড়ে একটা হাইড্রেল প্রোজেক্টে কাজ করত, ওখানে অসুবিধা বলে ও পিসির কাছে মানুষ। ঋষভ আর আমি সেই ছোট্ট বেলার বন্ধু। নার্সারি থেকে একসাথে।ওর মা-বাবা ছুটিতে আসত কলকাতা।সেই ছোটবেলায় ওর মা আমায় ভীষণ ভালবাসতো ।ঋষভের মা-বাবা ও যখন দশ বছর তখন মারা গেছিল একটা দুর্ঘটনায়। 

ঋষভ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখানে চাকরী পেয়ে চলে এসেছিল গতবছর। আর এক বছরের মাথায় পিসি আমাদের চার হাত এক করে দিল।

এখানে আসার দু মাসের মাথায় ঋষভ হঠাৎ সোমবার এই ছুটিটা পেয়ে গেছিল। এক সাথে শনি, রবি নিয়ে তিনদিনের ছুটি। নতুন কেনা আই টুয়েন্টির গায়ে হাত বুলিয়ে ও বলেছিল,-" ব্যাগ গুছিয়ে নে। যে দিকে চোখ যায় চলে যাবো। নতুন গাড়ি সাথে নতুন বৌ, ফাটাফাটি একটা হলিডে।"

আমিও নেচে উঠেছিলাম, কারণ কাজের চাপে ঋষভ সময় খুব কম দিতে পারত। একা একা প্রকৃতি দেখেই আমার দিন কাটতো। শনি রবিবার টুকটাক ঘোরার ফাঁকেও ওকে ল্যাপটপ খুলে বসতে হতো। তেমন কারো সাথে আমাদের পরিচয় ছিল না যে ছুটির দিন গিয়ে একটু আড্ডা মারবো। যে বাড়িটায় আমরা ভাড়া থাকতাম তার মালিকও বুড়ো দাদু। দিদিমার সাথে গল্প করে সুখ পেতাম না,কারণ কানে শোনেন না। ওনাদের পুত্র পরিবার নিয়ে থাকে নাসিকে। কাজের মেয়ে কাঞ্চি নেপালি হলেও বাংলা ভালোই বলে। তবে কতক্ষণ আর ওর গল্প শোনা যায়। ফেসবুক আর হোয়াটস আপ ভরসা। তার মধ্যে এমন প্রস্তাবে আমিও নেচে উঠেছিলাম। শনিবার সকালে বেরিয়ে পড়লাম দুজন।

লাভা ছাড়িয়ে যখন গাড়ি আরো ওপরে উঠে যাচ্ছে আমি বললাম, -"কোথায় থাকবি কিছু ভেবেছিস ?"

-"কেন? আমার তো গাইতে ইচ্ছা করছে -এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?"

-" ওরে, এটা চারচাকা, ....."

-"আরে তাই তো চিন্তা নেই। কোনো থাকার জায়গা না পেলে এই জঙ্গলে গাড়িতেই রাত কাটাবো। তবু ঐ ভিড় জায়গায় থাকবো না, বুঝলি।"

বেশ কিছুটা গাড়ি চালিয়ে ও একটা কফি-শপে দাঁড়িয়ে ছিল। সামনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা তুষার-মুকুট পরে হাসছে। নাম না জানা ফুলের মেলা। পাশে একটা ছোট্ট পাহাড়ি ঝরনা। কফি খেতে খেতে পাশের ঝাউ বনে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল। ঐ কফি-শপের মালিকের থেকে বেশ কয়েকটা নতুন জায়গার নাম জানা গেলো। কয়েক প্লেট 'মোমো' খেয়ে আবার ড্রাইভিং শুরু করলো ঋষভ। পাহাড়ে ও বেশ ভালোই গাড়ি চালায় । দুপুরের পর থেকেই পশ্চিম দিকের আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছিল। পেডং এ ও হোটেল পেলাম না আমরা। সব ফুল। তবে ঋষিও এগিয়েই যাবে ঠিক করেছে। 

-"এখানে পাহাড়ের বাঁকে আজকাল কয়েকটা রিসর্ট হয়েছে। কিছু না পেলে আরিতার বা রামধুরা চলে যাবো বুঝলি।" ও গাড়ি চালাতে চালাতেই বলল। 

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘের দল আমাদের ঘিরে ফেলল। এক হাত দূরের কিছুই আর দেখা যায় না। এপথে এভাবে গাড়ি চালানো বেশ বিপদের কাজ। একে সরু প্যাঁচালো রাস্তা, অন‍্যদিকে খাদ। কুড়ির উপর স্পিড তোলাই যাচ্ছে না। হঠাৎ মুষল ধারে বৃষ্টি নামলো। সাথে ঠাণ্ডা হাওয়া। গাড়ির কাচ তুলে দিয়ে ব্যাগ থেকে চাদর, জ্যাকেট সব বের করলাম। প্রায় এক ঘণ্টা বৃষ্টির পর একটু পরিষ্কার হতেই আবার এগিয়ে চললাম। ফগ্ লাইট জ্বেলে ঋষভ গাড়ি চালাচ্ছে। তেমন কোনো লোকালয় চোখে পড়ছে না। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে গেল। জোনাকির মত দূরের পাহাড়ে কিছু আলোর মালা ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় এলাম , কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না। নেট, গুগল সব দেহ রেখেছে। ঋষভ কিন্তু বেশ পেশেন্স নিয়ে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে গাড়ি চালাচ্ছে। হঠাৎ খুব জোরে ব্রেক কষলো ও। গাড়ির আলোয় দেখলাম আমরা কোনো প্রাইভেট রোডে ভুল করে ঢুকে পড়েছি, সামনে একটা সুন্দর কাঠের দোতলা বাংলো। 

আমার মনে হল এই বাংলোর ছবি আগেও দেখেছি। গাড়ি ঘোরাতে হলে ঐ বাংলোর গেটের ভেতর ঢুকে সামনের গাড়ি বারান্দা দিয়ে ঘুরিয়ে আনতে হবে। কুয়াশায় ঢাকা বাংলোর কাচের জানালা দিয়ে হাল্কা আলোর আভাস বলছে এখানে লোক আছে। দুজনে দুজনের দিকে তাকালাম। ঋষভ মিচকি মিচকি হাসছে। ''এখানে আমাদের রাতটা থাকতে দিলে মন্দ হয় না, কি বল?"

-" তুই ঐ স্বপ্নই দেখ।"

ও বেশ জোরে দু'বার হর্ন দিয়ে নেমে গেটের কাছে গেল।আমিও নেমে এলাম, বলা ভালো কে যেন টেনে নামাল। বহু কালের পুরানো জং ধরা লোহার গেটে একটা মরচে পড়া চেন ঝোলানো। ঋষভ ওটা খুলে একাই গেটটা খুলে ফেলল। একটা পাখি বিকট শব্দে ডেকে উড়ে গেলো। আমি শক্ত করে ঋষভের হাতটা ধরতেই ও বলল -" এতেই ভয় পেয়ে গেলি?"

উত্তর না দিয়ে দুজনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম গাড়ি বারান্দার দিকে। পায়ের নিচে শুকনো পাতা আর পাথরকুচির মচমচ আওয়াজ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক মিলেমিশে এক অন্যরকম শব্দ, মাঝে মাঝে কনকনে হাওয়ার ঝাপটা, কুয়াশার চাদরে মোড়া বাংলো থেকে ক্ষীণ আলোর রেখা সব মিলিয়ে এক আধা ভৌতিক পরিবেশ। মেইন গেটের গায়ে একটা ঘণ্টা, সেটাই বাজালাম আমি। বেশ কিছুক্ষণ পর ইংরাজীতে প্রশ্ন ভেসে এলো।

ঋষভ উত্তর দিতেই দরজা খুলে দিলেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। একটু হলেও ব্রিটিশ রক্ত ওনার গায়ে আছে দেখলেই বোঝা যায়। আমি অবাক হয়েছিলাম কারণ এদিকে কোনো ব্রিটিশ বা এ্যাংলো পরিবার আছে জানতাম না। অবশ্য কতটুকুই বা আমি জানি। চা ব‍্যবসায় জড়িত অনেক ব্রিটিশ এদিকে বাড়ি বানিয়েছিল। দু'একজন এখনো রয়ে গেছেন জানি। শিলিগুড়ি, দার্জিলিং এ কয়েকটা এমন পরিবার আছে শুনেছিলাম। হয়তো তাদের কারো সম্পত্তি এটা। ওনারাও হয়তো ছুটি কাটাতে এসেছেন। 

আমাদের অবাক করে উনি আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। ঋষভ ভদ্রতা করে বলল, আমরা রাস্তা ভুলে এসে পড়েছি। গাড়িটা ঘুরিয়ে নিতে চাই ওনাদের এখানে। তাতে ভদ্রলোক জানালেন গাড়ি ঘুরিয়ে এতো অন্ধকারে আমরা কোথায় যাবো!আশেপাশে লোকালয় নেই। চাইলে রাতটুকু ওনাদের আতিথেয়তা গ্ৰহন করতে পারি। তাতে ওনাদের অসুবিধা হবে না।

আমায় কিছু বলতে না দিয়েই ঋষভ রাজি হয়ে গেলো। ঘরে ঢুকেই ওনার স্ত্রীর সাথে আলাপ করালেন। মোমের আলোয় ড্রইংরুমটায় এক মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একটা বড় পিয়ানোর পাশে বসে সুর তুলছিলেন ওনার স্ত্রী এমিলি গোমস। উনি নিজের পরিচয় দিলেন পিটার গোমস। ওনারা কোনো কনভেন্টে পড়াতেন। এখন আর্লি অবসর নিয়ে পাহাড়ের কোলে দিন কাটাচ্ছেন। 

আমাদের জন্য কফি আর কুকিস নিয়ে এলেন মিসেস গোমস। আমাদের পরিচয় আর ঘুরতে আসার গল্প শুনে ওনারা দারুণ খুশি। ওনারাও নাকি এখনো এভাবেই ঘুরতে বেরিয়ে যান। ওনাদের গেস্ট রুমটা আমাদের দেখিয়ে দিলেন। কাঠের দোতলায় বেশ সুন্দর সাজানো ঘর। আমার মনে কিন্তু একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। ওনাদের সামনে ঋষভকে বলতে পারছিলামনা কিছুই। গাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে এসে দুজনেই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। মিসেস গোমসের হাতে ভেজ স‍্যুপ আর চিজ স‍্যান্ডুইচ আর চিকেন স্টিকস দিয়ে ডিনার সেরে আবার গল্পের আসর বসলো। আমাদের মাত্র দু'মাস বিয়ে হয়েছে শুনে দু জনেই অবাক। আর এটা আমাদের হানিমুন ট্রিপ শুনে দুজনেই খুব খুশি। আমাদের দেখে নাকি ওনাদের মনেই হয়নি আমাদের সদ্য বিয়ে হয়েছে। 

হঠাৎ আমার চোখ দেওয়ালের একটা ছবিতে আটকে গেল। একটা ছোট্ট চার্চ পাহাড়ের মাথায়। কুয়াশা ঘেরা পাইন গাছের ফাঁকে কয়েকটা রডোডেনড্রন উঁকি দিচ্ছে। ছবিটার মধ্যে কি যেন ছিল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। ছবিটা কোথায় যেন দেখেছি মনে করতে পারলাম না। ভীষণ, ভীষণ জীবন্ত ছবি। ক্যামেরায় নয় , তেল রঙে আঁকা। যেন আমি নিজের চোখে দেখছি ঐ চার্চ।

-"সেন্ট মেরিস ব‍্যসলিকা। " মিসেস গোমস বললেন। আরো বললেন, এই পিছনের পাহাড়ের ঝরনাটার পাশের পায়ে হাটা রাস্তা ধরে কালিম্পং এর দিকে এক মাইল গেলেই নাকি এই সুন্দর চার্চটা। পায়ে হেঁটে এক ঘন্টার রাস্তা। 

ওনারা নাকি প্রতি রবিবার ওখানে যান। আমারও ভীষণ যেতে ইচ্ছা করছিল। পরদিন রবিবার, সবাই মিলেই যাবো স্থির হল।

রাতে মেঘ কেটে জ্যোৎস্না দেখা দিল। কাচের জানালা দিয়ে পরিষ্কার পাহাড় দেখা যাচ্ছে। বাগানে কত রকমের ফুল। এক মায়াবী আলোয় চরাচর ধুয়ে যাচ্ছে। গল্প হচ্ছিল এ দু'মাসে আমরা ঝগড়া করেছি কিনা তাই নিয়ে। ঋষবভ সোফায় বসে আমার হাতটা ধরে বলেছিল, -"ঝগড়ার সময় পাই নি এতোটাই ব্যস্ত।"মিঃ গোমস হেসে বলেছিলেন, এ সময় আমাদের একসাথে থাকার সময়। দুজনকে চেনার জানার সময়। ভবিষ্যতে কি লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। তাই আনন্দটুকু পুরোটা উপভোগ করতে। কি এক বিষাদ ছিল যেন ওনার গলায়। সবাই চুপ করে গেছিলাম। কিছুক্ষণ পর মিঃ গোমস ভায়োলিন নিয়ে বসলেন। এক মনকেমন করা সুর। কি যেন হারিয়ে গেছে। কিন্তু উঠতেও পারছিলাম না ওখান থেকে। 

অবশেষে ওনাদের গুডনাইট জানিয়ে আমাদের ঘরে এলাম। বড় বড় কাচের জানালা চুঁইয়ে ঘরে খেলে বেড়াচ্ছে জ্যোৎস্না। একটা ফুলদানীতে হাসনুহানা মন মাতাল করা গন্ধ ছড়াচ্ছে। ছোট্ট কাঁচে ঘেরা বারান্দায় বসে আরো কিছুক্ষণ এই প্রকৃতি কে উপভোগ করলাম আমরা। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলাম , কখন শুতে গেলাম কিছুই মনে নেই। পরদিন মিষ্টি রোদের স্পর্শে ঘুম ভাঙ্গল। বেশ বেলা হয়ে গেছে। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখি টেবিলে জলখাবার আর কফির সাথে ছোট একটা নোট, আজ রবিবার , আমাদের দেরি দেখে ওনারা চার্চে চলে গেছেন। প্রেয়ার শেষে ওনারা কোনো বন্ধুর বাড়ি যাবেন। ফিরতে বিকেল হবে। আমাদের অনুরোধ করেছেন আজকের দিনটাও থেকে যেতে। 

কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ঋষভ খুব খুশি, ওর নাকি দারুণ লাগছে এখানে। এই ফাঁকা বাংলোয় ও আর একটা রাত কাটাতে চায়। আমি ওকে বোঝাতে অপারগ, আমার অস্বস্তি। অবশ্য দিনের আলোয় ভালোই লাগছিল এখানে। বাইরের লনে ছোট্ট গলফ কোর্স, একটা দোলনা। একধারে ফুল বাগান। পিছনে টেনিস কোর্ট। আমরাও চার্চে যাবো ভেবে পিছনে ঝরনার পাশের পাহাড়ি পথে এগিয়ে গেলাম। এই পথের কথাই কাল বলেছিলেন ওনারা। প্রায় এক দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর দূর থেকে চার্চটা দেখতে পেলাম। একটা হালকা কুয়াশা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে মনে হল। ভালো লাগছিল বেশ। ছোট্ট চার্চ, ধূপের গন্ধ আর মোমের আলোয় এক আলোআঁধারি ভেতরটা। কিন্তু কোনো লোকজন চোখে পড়লো না। ফাদার বা কর্মচারী কেউ কি নেই!!

ঋষভ গলা ফাটিয়ে ডাকল। ওর ডাক পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো। কটা পাখি উড়ে গেল। কে যেন আমার কানে কানে বলল ফিরে যেতে। অনেক করে ঋষভকে বুঝিয়ে ফিরে চললাম। ওর আর আমার মোবাইলে ছবিটুকু থেকে গেল স্মৃতি হিসাবে। দুপুরেই ফিরে যাবো ভেবেছিলাম কিন্তু আকাশ কালো করে বৃষ্টি এলো। গোমস দম্পতির দেখা নেই এদিকে। বুঝলাম বৃষ্টিতে আটকে গেছে কোথাও। দুপুরে যখন শেষ আমি রান্নাঘরে খুঁজে চালে ডালে খিচুড়ি করলাম। সন্ধ্যার মুখে বৃষ্টি কমলো। ওনারাও ফিরে এলেন। খুব লজ্জিত আমাদের এভাবে একা রেখে যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যায় কফি কাপ আর কেক, কুকিজ নিয়ে সান্ধ্য আড্ডা বসল। আবার আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি এলো। 

মিসেস গোমস কিচেনে চলে গেলেন। মিঃ গোমস বসলেন ভায়োলিন নিয়ে। সুরের মূর্ছনায় আটকা পড়লাম আমরা। কিন্তু কি এক বিষাদ সিন্ধু বয়ে চলেছে। এ কেমন মন খারাপ করা সুর। সহ্য হচ্ছিল না আর। দুঃখ, কষ্ট যেন ঠেলে আসতে চাইছে। আমি সব শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে বলে উঠলাম, -"প্লিজ, স্টপ ইট, প্লিজ, প্লিজ"

আমার দু চোখে জলের ধারা। ঋষভ অবাক হয়ে আমায় দেখছে। আমি বললাম, -"ফিরে চল ঋষু, আমি ফিরতে চাই।"

মিঃ গোমস ইংরাজিতে বললেন,-" চাইলেই কি ফেরা যায়!! আমিও চেয়েছিলাম ফিরতে, পারি নি।"

ঋষভ উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু মিঃ গোমস বলে চলেছেন, -"সেই রাতেও বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি চেষ্টা করেও ফিরতে পারিনি। এমিলি একাই ছিল। মেঘ-ভাঙ্গা বৃষ্টিতে হরপা বানে আমাদের এই বাংলো ভেসে গেছিল, বড় বড় পাথর গড়িয়ে নেমেছিল। এমিলি ভেসে গেছিল একাই।..... তারপর থেকে একা থাকা আর এই ভায়োলিন....."

ঋষভ অবাক চোখে তাকিয়ে বলল-"কি বলছেন এসব...."

-"আমি বাড়িটা আর বানাই নি। ভাল লাগতো না আর। উপরে চার্চে থাকতে শুরু করেছিলাম। এমিলিকে খুঁজে বেড়াতাম চাঁদনি রাতে। একা ,বড্ড একা হয়ে গেছিলাম। ঠিক ছ'মাস পর আবার একদিন বৃষ্টির রাতে ঐ চার্চের উপর পাথর গড়িয়ে এলো। ধ্বস, সব শেষ। আমিও পাথরচাপা পড়েছিলাম। তবে একা থাকার কষ্টের হাত থেকে বেঁচেছিলাম। "

আমি কাঁপছি, ভয়ে নাকি অন্য কিছু জানি না। মোমবাতি গুলো কাঁপছিল। বাইরে গুড়গুড় আওয়াজ। যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়ছে। মিঃ গোমস কে কেমন অদ্ভুত লাগছে। বললেন ,-" তোমাদের মধ্যে কে আগে যাবে ?"

ঋষভ বলল, -"এমিলি ম‍্যাডাম তাহলে রান্না ঘরে কি করছেন ?" ও উঠে দাঁড়াতেই কে যেন আমায় ধাক্কা দিয়ে বাইরে যেতে বলল। আমার মনে হল কেউ পালাতে বলছে। বাইরে তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। কাঠের বাংলোটা পিচবোর্ডের মতো দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। একটা বড় জলরাশি নেমে আসছে ছোট বড় পাথর নিয়ে। রান্নাঘরের দিকটা চোখের সামনে ভেঙ্গে নিচের খাদে পড়ে গেল। কে যেন আমায় আবার বলল, -"পালা, ঋষভকে নিয়ে পালা, ওর হাত ছাড়িস না কখনো "

আমি ঋষভের হাত ধরে গাড়ির দিকে দৌড়লাম। পিছনে মিঃ গোমস বলছেন, -" এভাবে পালাতে পারবে না। তোমাদেরও একা থাকার কষ্ট বুঝতে হবে। অথবা একসাথেই যেতে হবে।"

গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিতেই পুরো পাহাড়টাই যেন হুড়মুড়িয়ে নেমে এলো। শেষ মুহূর্তে মনে হল কেউ যেন গাড়িটা ঠেলে রাস্তার দিকে ফেলে দিল। অতবড় গেটটা করকর শব্দে খুলে গেল। নাকি আমি অস্পষ্ট একটা লালপাড় শাড়ি পরিহিতা মাঝবয়সী মহিলার অবয়ব দেখলাম, যায় কপালে বড় একটা সিঁদুরের টিপ। গাড়িটা ঐ অভিশপ্ত বাড়ির বাইরের রাস্তায় আসতেই আমি জ্ঞান হারালাম। 

একে একে সব মনে পড়ছিল। চোখ খুলে দেখি হাসপাতালে, পাশের বেডে ঋষভ। কিছু মিলিটারি আর লোকাল লোক আমাদের নিয়ে এসেছিল এখানে। গাড়িটা একটা খাদের কিনারে বড় পাথরে ধাক্কা খেয়েছিল নাকি! তবে আমাদের তেমন কিছু হয় নি। একটু পরে দাদু,দিদিমা এসে আমাদের বাড়ি নিয়ে গেলো।

রাতে দাদুদের ঘরেই সেদিন খাবারের ব্যবস্থা। হঠাৎ খাওয়ার ঘরের দেওয়ালে একটা ছবি দেখে মাথাটা আবার ঘুরে গেল, সেই চার্চ, কুয়াশা ঘেরা পাইন বনের ফাঁকে.....

ওধারে আরেকটা ছবি, সেই অভিশপ্ত বাংলোর। হয়তো আগেও দেখেছি। থাকতে না পেরে দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম ছবির ব‍্যাপারে। উনি বললেন, - "কালিম্পং এর দিকে একটা পাহাড়ের মাথায় এই চার্চ ছিল, আর একটু নিচে এই বাংলো, এ্যাংলো দম্পতি থাকতেন।প্রায় চল্লিশ বছর আগে এক জল ঝড়ের রাতে বাংলোটা হরপা বানে ভেসে যায় , মহিলাও ভেসে যায়। আর ভদ্রলোক বাড়ি ছিলেন না বলে বেঁচে যায়। তবে একা থাকতে পারতেননা। বাড়িটাও আর বানায়নি। ঐ ওপরের চার্চে থাকতেন ফাদারের কাছে। ছ'মাস পরে একদিন বৃষ্টিতে ঐ চার্চে ধ্বস নামে। এ বার গোমস সাহেব ও চাপা পড়েন। এর পর অনেক কাপল ঐ অঞ্চলে দুর্ঘটনার কবলে পরেছে।কেউ বাঁচে নি।"

আমি ভাবছিলাম আমাদের কে বাঁচালো!! চব্বিশ ঘন্টার মতো ঐ বাড়িতে কাদের সাথে কাটালাম? শুনেছিলাম এমনি বৃষ্টির রাতে ঋষভের বাবা-মা ও পাহাড়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছিলেন। তবে কি ওনারাও!.....উনিই ......সেই মহিলা!

উত্তর আজো পাই নি।

#positiveindia


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller